সৎকাজে আদেশ এবং অসৎকার্জে নিষেধের ফজীলত

সৎকাজে আদেশ এবং অসৎকার্জে নিষেধের ফজীলত 


        আয়াতে কুরআনী, সুন্নতে নবুবী, এজমায়ে উম্মাত, বিজ্ঞ বুযর্গদের বালী এবং ঙ্গন বিবেকের দ্বারা সৎকাজে উপদেশ দান করা কাজটি ওয়াজিব অর্থাৎ বাধ্যতামূলকরণে সাব্যস্ত হয়েছে।

         আয়াতে কুরআনীঃ আল্লাহতায়ালা কুরআনে পাকে এরশাদ করেছেনঃ "আলতাকুম মিনকুম,  উম্মাতুই ইয়াদউনা। ইলাল খাইরি অ ইয়া' মুরনা বিল মারফি অ ইয়ানহাওনা আনিল মুনকারি অ উলায়িকা হুমুল মুফলিহুন"। অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে একটি দল থাকা চাই, যারা কলানের দিকে আহবান করবে, তারা সৎকাজ করতে আদেশ করবে এবং অসৎ কাজ করতে নিশেধ করবে এবং তারাই সফলকাম হবে। এ আয়াতে প্রথম বিষয় হল, এতে আদেশসূচক শব্দ ব্যবহার করায় বুঝা যাচ্ছে যে, এ কাজটি ওয়াজিব অর্থাৎ অবশ্য কর্তব্য। আয়াতের দ্বিতীয়ফ বিষয় হল, সাফল্যকে এর সাথে বিশেষভাবে যুক্ত করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, তারাই সফলকাম হবে। তারপর তৃতীয় বিষয় হল, সৎকাজে আদেশ এবং অসৎ কাজে নিশেধ একটি ফরজে কিফায়া কাজ। এটা ফরজে আইন নয়। যদি মুসলমানদের কিছু লোকও এ কাজটি পালন করে, তবে বাকী মুসলমানগণ এই ফরজের যিম্মামুক্ত হয়ে যাবে। কেননা আয়াতে এরপ বলা হয় নি যে, তোমরা সবাই একাজ কর; বরং বলা হয়েছে "একটি দলের এ কাজটি সম্পাদন কর। চাই"। এ কারণেই মুসলমানদের মধ্যে একজন বা একাধিকজন একাজ করলে অন্যান্যগণ দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে। তবে বিশেষ সফলতা তাদেরই, যারা একাজটি করবে। পক্ষান্তরে মুসলিম জাতির প্রত্যেকেই যদি একাজ থেকে বিরত থাকে, তবে তাদের প্রত্যেকেরই শাস্তি ভোগ করতে হবে। বিশেষতঃ যাদের এ কাজের সঙ্গতি এবং ক্ষমতা আছে, আল্লাহতায়ালা বলেছেনঃ লাইসু সাওয়ায়াম মিন আহলিল কিতাবি উন্মাতুন কায়িমাতুন। ইয়াতলুন। আয়াতিল্লাহি আনায়াল্লাইলি অহুম ইয়াসজুদুনা অইয় 'মিনূনা বিল্লাহি অল ইয়াওমিল আখিরি অ ইয়া মুরুন্য বিল মা'রুফি অ ইয়ানহাওনা অনিল মুনকারি অ ইয়ুসারিউনা ফিল খাইরাতি অ.উলায়িকা মিনাছছালিহীন। অর্থাৎ আহলে কিতাবের সবাই-ই সমান নয়। তাদের একদল সরল পথে রয়েছে, তারা রাতের বেলায় আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠ করে, সিজদাহ করে, আল্লাহ এবং শেষ দিবসে বিশ্বাস করে, সৎকাজে আদেশ করে অসৎকাজে নিষেধ করে এবং পুণ্যকাজে প্রতিযোগিতার সাথে ধাবিত হয়, তারাই সৎকর্মশীল।

        এ আয়াতে কেবল আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসে বিশ্বাস করাকেই সৎকর্মপরায়ণতা আখ্যার আখ্যায়িত করা হয় নি বরং সৎকাজে আদেশ এবং অসৎকাজে নিষেধকেও এর সাথে যুক্ত করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেছেনঃ "অলমু'মিনূনা অলমু'মিনাতু বা'বুহুম, আউলিয়ায়ু ব্যাধিন ইয়ামুরুনা বিল মা'রূফি অ ইয়ানহাওনা আ'নিল মুনকারি অ ইয়ত্বীস্নাস্বালাতা।” অর্থাৎ মু'মিন পুরুষ ও মুমিন। স্ত্রীলোকগণ পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। তারা পরস্পর পরস্পরকে সৎকার্যে আদেশ দেয় এবং অসৎকার্যে নিষেধ করে এবং নামায কায়েম করে। আল্লাহতায়ালা। মু'মিনদেরকে এজন্য প্রশংসা করেছেন যে, তারা পরস্পরকে সৎকাজে আদেশ দেয় এবং মন্দকাজে নিষেধ করে এবং নামায আদায় করে। যারা এ কাজ দুটো বর্জন করে, তারা মুমিনদের দল বহির্ভুত 

        আল্লাহতায়ালা বলেন, "লুয়িনাল্লাযীন। কাফার মিম বানী ইস্রায়ীলা আলা লিসানি দাউদা অ ঈসা বনি মারইয়াম। যালিকা বিমা আ'ছাও অ কানু ইয়া'তাদূনা কান্ লা ইয়াতানাহাওনা আম মুনকারিন ফাআল্‌হু লাবি'সা মা কানু ইয়াফআ'লুন"। অর্থাৎ আল্লাহতায়ালা বলেন, বনী ইস্রাইল কওমের মধ্যে যারা কাফির তারা হযরত দাউদ (আঃ) এবং বিবি মরিয়ম তনয় হযরত ঈসা (আঃ) এর রসনায় অভিশপ্ত। এর কারণ হল, তারা ছিল পাপীষ্ট, সীমালঙ্ঘনকারী এবং তারা পরস্পর পরস্পরকে অসৎকাজ করতে নিষেধ করত না, যে মন্দকাজে তারা অভ্যস্থ ছিল। এ আয়াতে আল্লাহতায়ালা কঠোর ভাষায় তাদের সম্পর্কে এই উক্তি করছেন যে, তারা অসৎকার্যে নিষেধ করাকে বর্জন করে খুবই অন্যায় করেছিল।

        আল্লাহতায়ালা বলেছেনঃ কুনতুম খাইরা উম্মাতিন উখরিজাত লিল্লাযী তা'মুরুনা বিল মা'রূফি অ তানহাওনা আ'নিল মুনকারি"। অর্থাৎ তোমরা সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি, যাদেরকে মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজে নিষেধ করবে। এ আয়াত দ্বারা এ কাজ দুটোর শ্রেষ্ঠত্ব অনুভব করা যায়। কেননা এ আয়াতে এই শ্রেণীর লোককে সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত নামে অভিহিত করা হয়েছে।

        আল্লাহতায়ালা বলেছেনঃ ফালাম্মা নাস্ মা যুককির বিহী আনজাইনাল্লাযীন। ইয়ানহাওনা আনিস সূয়ি অ আখাযনাল্লাযীন। জালাম্ বিযাবিম বায়ীসিম বিমা কানু ইয়াফসুকুন"। অর্থাৎ অতঃপর যখন তারা উপদেশ ভুলে গেল, আমি তাদেরকে রক্ষা করলাম। যারা অসৎকাজ করতে নিষেধ করত এবং জালিমদেরকে শোচনীয় শাস্তি দ্বারা পাকড়াও করলাম, কারণ তারা অসদাচারে লিপ্ত ছিল। এ আয়াতে অসৎকাজে নিষেধকারীদের রক্ষা পাবার কথা বলা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেছেনঃ "আল্লাযীনা ইমমাক্কান্না হুম ফিল আরদ্বি আকামুছ ছালাতা অ আতুয যাকাতা' অ আমার বিল মা'রূফি অনাহাও আনিল মুনকারি"। অর্থাৎ যাদেরকে আমি ক্ষমতা দিলে তারা নামায আদায় করে, যাকাত দান করে, সৎকাজে আদেশ দেয় এবং অসৎকাজে নিষেধ করে। অত্র আয়াতে আদেশ ও নিষেধ করাকে নামায আদায় এবং যাকাত দানের সাথে উল্লেখ করবার কারণে বুঝা যাচ্ছে যে, এ কাজ দুটোও ওয়াজিব বা অবশ্য কর্তব্য।

        আল্লাহতায়ালা বলেছেনঃ তাআ'ওয়ান্ আলাল বিরবি অত্তাক্বিওয়া অ লাতাআ'ওয়ান্ আলাল ইছমি অলউদওয়ানি"। অর্থাৎ তোমরা সৎকাজে একে অপরের সাথে সহযোগিতা কর এবং পাপ ও সীমা লঙ্ঘনের কাজে সহযোগিতা করো না। সহযোগিতার অর্থ সৎকাজে একে অপরকে প্ররোচিত করবে, কল্যাণের পথ প্রদর্শন করবে এবং যথাসাধ্য অনিষ্ট ও সীমা লঙ্ঘনের পথ রুদ্ধ করবে।

        আল্লাহতায়ালা বলেছেনঃ লাও লা ইয়ানহা হুমুর রাব্বানিয্যূনা অল আহবারু আন কাওলিহিমিল ইছমা অ আকলিহিমিস্ সুহতা লা বি'সা মা কানু-ইয়াছনাউন"। অর্থাৎ পাদ্রী ও পুরোহিতগণ তাদেরকে পাপাচারের কথা বলতে এবং হারাম ভক্ষণ করতে নিষেধ করল না কেন? তাদের কার্যকলাপ খুবই খারাপ। আয়াতে উক্ত হয়েছে যে, অসৎকাজে নিষেধ করা বর্জন করবার কারণে তারা গুনায় লিপ্ত হয়েছে।

        আল্লাহতায়ালা বলেছেনঃ "ফালাও লা কানা মিনাল কুরুনি মিন এ্যাবলিকুম উলু বাক্তিয়্যাতিন্ ইয়ানহ।ওনা আ'নিল ফাসাদি ফিল আরদ্বি"। অর্থাৎ তোমাদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে এমন প্রভাবশালী লোক যদি না থাকত, যারা দুনিয়ায় অপকর্ম করতে নিষেধ করত। আয়াতে বলা হয়েছে, যারা অপকর্ম করতে নিষেধ করত, তাদেরকে ব্যতীত আমি সবাকে ধ্বংস করে দিয়েছি।

        আল্লাহতায়ালা বলেছেনঃ ইয়া আইয়্যুহাল্লাযীন্য আমান্ কুন্ কাওয়্যামীন। বিল কিসতি গুহাদায়। লিল্লাহি আলাও আলা আনফুসিকুম অল ওয়ালিদাইনি অল আরাবীনা। অর্থাৎ মুমিনগণ। তোমরা ন্যায়নিষ্ঠতার উপর প্রতিষ্ঠিত থাক, আল্লাহর জন্য সাক্ষী হও, যদি তা' তোমাদের নিজেদের, তোমাদের পিতামাতার এবং তোমাদের আত্মীয়-স্বজনদের স্বার্থের প্রতিকূলে যায়। অতএব পিতামাতা ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্য এটাই হচ্ছে সৎকার্যে আদেশ।

        আল্লাহতায়ালা বলেছেনঃ লা খাইরা ফী কাছীরিম মিন নাজওয়া হুম ইল্লা মান আমারা বি ছাদাক্বাতিন আও মা'রফিন আও ইছলাহিম বাইনান্নাসি অমাই ইয়াফআ'ল যালিকার তিগায়া মারদ্বাতিল্লাহি ফাসাওফা নু'তিহী আজরান আজীমা"। অর্থাৎ তাদের অধিকাংশ শলাপরামর্শে কল্যাণ নেই। কিন্তু যে দান খয়রাতের, সৎকাজের এবং মানুষের মধ্যে সন্ধিস্থাপনের আদেশ করে। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য যে এটা করে, তাকে আমি পুরস্কৃত করব।

        আল্লাহতায়ালা বলেছেনঃ "অ ইন ত্বায়িফাতানি মিনাল মু'মিনীনাক্বতাতাল্ ফা আছলিতু বাইনা হুমা। অর্থাৎ যদি দু'দল মু'মিন সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তবে তাদের মধ্যে আপোষ করে দাও। অবাধ্যতায় নিষেধ করা ও আনুগত্যের বাধ্য করাই হল আপোষ করে দেয়া। তারা এটা না মানলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার আদেশ দেয়া হয়েছে। যেমন এরশাদ হয়েছেঃ ফাকাতিলু প্রাতী তাবগী হাত্তা তাফিয়া ইলা আমরিল্লাহি"। অর্থাৎ যে দল অবাধ্যতা প্রকাশ করে, তোমরা সবাই মিলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, যে পর্যন্ত না তারা আল্লাহর আদেশের দিকে ফিরে আসে। আয়াতে একেই অসৎকাজে নিষেধ রূপে গণ্য করা হয়েছে।

        বুযর্গদের বাণীঃ হযরত আবু দারদা (রাঃ) বলেছেন, তোমরা সৎকাজে আদেশ কর এবং অসৎকাজ থেকে ফিরিয়ে রাখ। নতুবা আল্লাহতায়ালা তোমাদের প্রতি কোন অত্যাচারী শাসনকর্তা চাপিয়ে দেবেন। সে তোমাদের জ্যেষ্ঠ এবং সম্মানিত লোকদের সম্মান করবে না এবং ছোট ও দুর্বলদের প্রতি স্নেহ প্রদর্শন করবে না। তখন তোমাদের নেককার লোকগণ তাকে বদদোয়া করলে তা' কবুল হবে না। তোমরা আল্লাহর দরবারে সাহায্য চেয়ে কোন সাহায্য পাবে না। ক্ষমা প্রার্থনা করে ক্ষমালাভে সক্ষম হবে না। হযরত হোজায়ফা (রাঃ) কে কেউ জিজ্ঞেস করল, জীবিত লোকদের মধ্যে মৃত লোক কে? তিনি বললেন, যে কোন অসৎকাজ সংঘটিত হতে দেখে হাত দিয়ে তা' প্রতিরোধ করে না, মুখে বাধা দেয় না এবং তার প্রতি অন্তর দিয়ে ঘৃণা পোষণ করে না। হযরত বেলাল ইবনে সা'দ (রাঃ) বলেন, পাপাচার যখন গোপনে করা হয় তখন তা' কেবল যে পাপাচারী তারই ক্ষতি করে কিন্তু যদি প্রকাশ্যে করা হয় এবং কেউ তা' নিষেধ না করে তখন সে পাপাচার শুধু পাপাচারীর নয়; বরং সর্বসাধারণের ক্ষতি করে। ছহল ইবনে আবদুল্লাহ (রহঃ) বলেন, যে ব্যক্তি নিজেকে ছাড়া অন্যের উপর ক্ষমতা রাখে না, সে যদি নিজের বেলায় আদেশ ও নিষেধের কর্তব্য পালন করে এবং অন্য ব্যক্তিগণ অন্য কাজ করলে মনে-প্রাণে তাকে অপছন্দ করে তবে তার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। হযরত ফোজায়ল ইবনে ইয়াজ (রহঃ) কে কেউ জিজ্ঞেস করল, আপনি সৎকাজে আদেশ এবং অসৎকাজে নিষেধ করেন না কেন? তিনি বললেন, কোন কোন লোক আদেশ ও নিষেধ করে কাফির হয়ে গেছে। কেননা আদেশ ও নিষেধের প্রত্যুত্তরে তাদের উপর যে নির্যাতন করা হয়েছে তাতে তারা ধৈর্য্য রাখতে পারে নি।

Post a Comment

0 Comments