উল্লেখ্য যে, আদেশ-নিষেধ সম্পর্কিত ব্যাপারটি চার ভাগে বিভক্ত। অথবা বলা যায় যে, এর মধ্যে মোট চারটি বিষয় রয়েছে। যেমন (১) আদেশ ও নিষেধকারী। (২) যাকে আদেশ ও নিষেধ করা হয়। (৩) যে বিষয়-ব্যাপারে আদেশ ও নিষেধ করা হয়। (৪) খোদ আদেশ ও নিশেধ।
প্রথম শর্তঃ আদেশ ও নিষেধকারী হবার জন্য প্রথম শর্ত হল মুকাল্লাফ অর্থাৎ শরীয়তের বিধি- বিধান পালনে যোগ্য হওয়া। যেমন বুদ্ধিমান ও প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া। কেননা যে ব্যক্তি মুকাল্লাফ নয় তার জন্য কোন বিধান পালন করা বাধ্যতামূলক নয়। আমি এখানে যেসব শর্ত উল্লেখ করব সেগুলো ওয়াজিব হবার শর্ত, জায়েয হবার নয়। কাজেই যে বালক হিতাহিত সম্পর্কে জ্ঞান রাখে এবং প্রাপ্তবয়স্ক না হলেও তার নিকটবর্তী, সে মুকাল্লাফ না হলেও সৎকাজে আদেশ এবং অসৎকাজে নিষেধ করা তার জন্য জায়েয। যেমন সে যদি মদ মাটিতে ঢেলে দেয় এবং খেলা-ধূলার সামগ্রী ভেঙ্গে ফেলে তবে সে একাজের ছওয়াব পাবে এবং তাকে বাধা দেয়ার অধিকার কারও নেই।
দ্বিতীয় শর্তঃ নবীন মুসলমান হওয়া। ধর্মকে সমুন্নত রাখার অপর নাম হচ্ছে সৎকাজে আদেশ এবং অসৎকাজে নিষেধ। অতএব যে দ্বীনকে অস্বীকার করে এবং দ্বীনের শত্রু সে এর যোগ্য হতে পারে না।
তৃতীয় শর্তঃ আদিল অর্থাৎ কবীরাহ গুনাহ থেকে মুক্ত হওয়া। এটাকে কিছু লোকে শর্ত মনে করেন। তারা বলেন, যে ব্যক্তি ফাসেক অর্থাৎ পাপাচারী তার জন্য সৎকাজে আদেশ এবং অসৎকাজে নিষেধ করা জায়েয নয়। এ ব্যাপারে তাদের প্রথম দলীল হল এই যে, পবিত্র কুরআনে সেই লোকদের প্রতি শাস্তি দানের কথা বলা হয়েছে, "যারা যা বলে তদনুযায়ী নিজের কাজ করে না। কুরআনে পাকে আরও এরশাদ হয়েছে, "আতা মুরূনান নাসা বিল বিররি ওয়া তানসাওনা আনফুসাহম।" অর্থাৎ তোমরা কি লোকদেরকে সৎকাজে আদেশ কর এবং নিজেদেরকে ভুলে যাও! আরও এরশাদ হয়েছে "কাবুরা আকতান ইন্দাল্লাহি মান তাকুল্ মা লা তাফআলুন।” অর্থাৎ তোমরা যা করবে না তা' বলবে এটা আল্লাহর কাছে খুবই অপছন্দনীয়। এদের দ্বিতীয় দলীল হল, হুযুরে পাক (দঃ) এর হাদীস। তিনি এরশাদ করেছেন, আমি মিরাজের রাত্রে এমন লোকদের নিকটও গমন করেছি যাদের ঠোঁট কাঁচির দ্বারা কর্তন করা হচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমরা কারা? তারা বলেছিল, আমরা অন্যকে সৎকাজে আদেশ করতাম কিন্তু নিজেরা তা' পালন করতাম না এবং অন্যকে অন্য কাজ থেকে বারণ করতাম কিন্তু নিজেরা সে কাজ করতাম। তৃতীয় দলীল এই যে, আল্লাহতায়ালা হযরত ঈসা (আঃ)এর প্রতি অহী পাঠালেন, "তুমি প্রথম নিজেকে উপদেশ দাও। যখন সে তা' মেনে নেয় তখন অপরকে উপদেশ দাও নতুবা আমার নিকট লজ্জিত থাক।" এদের চতুর্থ দলীল এই সে, জলাকে পথ প্রদর্শন করা নিজে পথে থাকারই প্রমাণ। এমনিভাবে জবাবে সোজা করা দিকে বোজা ব্যভারই প্রমাণ। সুতরাং যে ব্যক্তি নিজে পথপ্রাপ্ত নয় সে জলবনে কি করে পথ দেখায়।
এদের উল্লিখিত দলীলগুলো একান্তই কল্পনাপ্রসূত ছাড়া অন্যকিছু নয়। শত্য এই যে, ফাসেক ব্যক্তির জন্য সৎকাজে আদেশ করা এবং অসৎকাজে নিষেধ করা সিদ্ধ। তার প্রমাণ এই যে. আমাদের দেখতে হবে আদেশ ও নিষেধকারীও জন্য সব গুনাহ থেকে পবিত্র হওয়া শর্ত কিনা। যদি বলা হয় শর্ত, তবে তা এজমায়ে উন্মতের খেলাফ। তাছাড়া এর অর্থ দাঁড়াবে আদেশ ও নিষেধের দ্বার সম্পূর্ণরূপে রুদ্ধ করে দেয়া। কেননা সব গুনাহ থেকে পবিত্র হুযুরে পাক (দঃ)-এর স্বাহাবীগণও ছিলেন যা। অন্য লোকদের ত কোন কথাই উঠে না। এজন্যই সাঈদ ইবনে জোবায়ের (রহঃ) বলেছেন, যদি আদেশ ও নিষেধ শুধু সে ব্যক্তিই করে যে সম্পূর্ণ বেগুনাহ। তবে এ কর্তব্য পালনে কেউই সক্ষম হবে না। তার এ উক্তি ইমাম মালেক (রহঃ) পছন্দ করেছেন। যদি বলা হয় ছগীরাহ গুনাহ থেকে পবিত্র হওয়া শর্ত নয়। কাজেই রেশমী বস্তু পরিহিত ব্যক্তি ব্যভিচার ও মদ্যপান থেকে নিষেধ করলে তা' জায়েয হবে। তাহলে আমরা প্রশ্ন করব যে, মদ্যপায়ী বাক্তির জন্য কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা জায়েয হবে কিনা? যদি বলা হয়, জায়েয নয় তবে তা' এজমায়ে উম্মতের খেলাফ। কেন না মুসলমানদের সৈন্যবাহিনীতে সর্বদাই সৎ বীর আবার মদ্যপায়ী, ইয়াতিমদের প্রতি অন্যায় ব্যবহারকারী সর্বশ্রেণীর লোকই থাকত। তাদেরকে জিহাদ করতে রাসুলুল্লাহ (দঃ) এর যমানায়ও নিষেধ করা হয় নি এবং পরবর্তী যুগেও নিষেধ করা হয় নি। আর যদি বলা হয়, শরাবখোরের জন্য জিহাদ করা জায়েয, তবে আমরা জিজ্ঞেস করব, তার জন্য হত্যা করতে নিষেধ করাও জায়েয হবে কিনা? যদি জায়েষ না হয় তবে আমরা বলব যে, মদ্যপায়ী ও রেশমী বস্ত্র পরিধানকারীর মধ্যে পার্থক্য হওয়া উচিত। এভাবে যে, রেশমী বস্ত্র পরিধানকারীর জন্য মদ্যপানে নিষেধ করা জায়েয অথচ হত্যা, মদ্যপান এবং রেশমী বস্তু পরিধান মন্দ কাজের দিক দিয়ে একই পর্যায়ভুক্ত। এগুলোর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। যদি বলা হয়, মদ্যপায়ীর জন্য হত্যা করতে বারণ করা জায়েয এবং তার কারণ হল, যে ব্যক্তি একটি গুনাহ করে তারজন্য এরই অনুরূপ এবং এর চেয়ে নিম্নস্তরের গুনাহ থেকে নিষেধ করা জায়েয বরং সে এর চেয়ে উঁচুস্তরের গুনাহ থেকে নিষেধ করতে পারে। তবে এ দাবী নিছক জবরদস্তি এবং বেদলীল। কেননা এটা অসম্ভব নয় যে, মদ্যপায়ী ব্যভিচার এবং হত্যা থেকে নিষেধ করবে এবং ব্যভিচারী মদ্যপান থেকে নিষেধ করবে; বরং এটাও অসম্ভব নয় যে, একব্যক্তি নিজে মদ্যপান করবে এবং তার দাস-দাসীদেরকে ঐ কাজ থেকে নিষেধ করবে। সে বলবে, নিষেধ মান্য করা এবং অন্যকে নিষেধ করা এদুটো বিষয়ই আমার উপর ওয়াজিব। তারপর একটি বিষয়ে যদি আমি গুনাহ করি তবে অপরটিতেও আল্লাহর নাফরমান হওয়া আমার জন্য কিরূপে অপরিহার্য হবে? এক্ষেত্রে যদি কেউ এরূপ বলে যে, এরূপ বক্তব্য দৃষ্টে কেউ বলতে পারে যে, আমার উপর অজু ও নামায দুটো বিষয়ই ওয়াজিব। কিন্তু আমি অজু করব নামায পড়ব না, সেহরী খাব কিন্তু রোযা রাখব না। এ উক্তির জবাব এই যে, এদুটো বস্তুর মধ্যে অজু ওয়াজিব, নামাযের জন্য পৃথকভাবে ওয়াজিব নয়। একই ভাবে সেহরী খাওয়া হয় রোযার জন্য, রোযা না হলে সেহরী খাওয়া মুস্তাহাব নয়। কিন্তু আলোচ্য বিষয়টি তদ্রূপ নয়। এখানে অন্যের সংশোধন নিজের সংশোধনের জন্য উদ্দেশ্য নয় এবং নিজের সংশোধন অন্যের সংশোধনের জন্য উদ্দেশ্য নয়। তবে অজু ও নামাযের ক্ষেত্রে এতটুকু বিষয়ই জরুরী হয় যে, যে ব্যক্তি অজু করে কিন্তু নামায পড়ে না'তার শাস্তি সেই ব্যক্তির তুলনায় কম হবে যে অজু ও নামায দুটোই বর্জন করে। এমনিভাবে যে ব্যক্তি অন্যকে নিষেধ করা এবং নিজে বিরত থাকা দুটোই বর্জন করবে তার শাস্তি ঐ ব্যক্তির তুলনায় অধিক হবে যে ব্যক্তি অন্যকে নিষেধ করে কিন্তু নিজে বিরত থাকে না বা নিষেধ মানে না।
যারা কুরআনের আয়াত দ্বারা দলীল পেশ করেন তাদের দলীলের জবাব এই যে, উল্লিখিত আয়াতে উত্তম কাজ বর্জন করবার নিন্দা করা হয়েছে। আদেশ করবার নিন্দা করা হয় নি। কিন্তু তাদের আদেশ দ্বারা তাদের ইলমের জোর পরিলক্ষিত হয়। আর যে আলিম, সে সৎ কাজ বর্জন করলে শাস্তি বেশী হয়। কারণ ইলমের শক্তি থাকলে তার কোন ওজর থাকার কথা নয়। তাছাড়া "লিমা তাকুলুনা মা লা তাফআলুন" এ আয়াতে মিথ্যা ওয়াদা বুঝানো হয়েছে। প্রথম নিজেকে উপদেশ দাও। হযরত ঈসা (আঃ) এর প্রতি আল্লাহতায়ালার এই উক্তির মধ্যে মৌখিক আদেশ ও নিষেধ করবার অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। এটা আমরাও স্বীকার করি যে, ফাসেক ব্যক্তির মৌখিক উপদেশ উপকারী নয়, তাদের জন্য, যারা তার পাপাচার সম্বন্ধে ওয়াফিহাল আছে। এ উক্তির শেষে বলা হয়েছে যে, আমাকে লজ্জা কর। এ উক্তি দ্বারাও অন্যকে উপদেশ দেয়ার নিষেধাজ্ঞা বুঝা যায় না; বরং এর তাৎপর্য এই যে, বিশেষ জরুরী বিষয়কে পরিত্যাগ করে কম জরুরী বিষয়ে লিপ্ত হয়ো না। যেমন প্রবাদ রয়েছে, প্রথম পিতার সম্মান কর, তারপর অন্য লোকের। চতুর্থ শর্ত কারও কারও মতে এই যে, আদেশ ও নিষেধের কাজটি করার জন্য ইমাম অর্থাৎ শাসনকর্তার তরফ থেকে অনুমতি দরকার। তারা সাধারণ লোকদের মধ্য থেকে যে কোন ব্যক্তির আদেশ ও নিষেধের অধিকার স্বীকার করেন না। কিন্তু আমাদের মতে এ শর্তটি ঠিক নয় বরং অনিষ্টকর। কেন না আমরা যেসব আয়াত ও হাদীস উল্লেখ করেছি সেগুলো থেকে জানা যায়, যে ব্যক্তি কোন অসৎ কাজ হতে দেখে নীরব থাকবে সে গুনাহগার হবে। কেন না তা' যেখানেই দেখুক না কেন তা' থেকে নিষেধ করা তার প্রতি অবশ্য কর্তব্য। অধিক আশ্চর্যের বিষয় এই যে, রাফেজী সম্প্রদায় আরও বেশী বাড়াবাড়ি করে বলে যে, সৎকাজে আদেশ এবং অসৎকাজে নিষেধ জায়েযই হবে না যে পর্যন্ত না কোন নিষ্পাপ ইমাম বা শাসনকর্তা আত্মপ্রকাশ করেন। তারা বলে থাকে যে, নিষ্পাপ ইমাম আত্মগোপন করে আছেন। এদের এই ধরনের ধারণা ও মতবাদ সম্পর্কে আলোচনা না করাই শ্রেয়।
বর্ণিত আছে যে, একবার খলীফা মেহদী মক্কা মুআয্যমায় এসে বেশ কিছুদিন তথায় অবস্থান করলেন। তরপর তিনি যখন খানায় কা'বা তাওয়াফ করতে গেলেন, তখন তার চারদিক থেকে সব লোকদেরকে সরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। এতে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসরুক (রহঃ) লাফিয়ে উঠে তাকে একটা ঝাকানি দিয়ে বললেন, তোমাকে এ অধিকার কে দিয়েছে যে, তুমি দূর থেকে আগত লোকদেরকে কা'বার নিকট থেকে সরিয়ে দেবে? অথচ আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন, "সাওয়ায়ানিল আকিফু ফীহি অলবাদ"। অর্থাৎ এ গৃহে স্থানীয় ও বহিরাগত সবাই সমান। খলীফা তার এরূপ ব্যবহারে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি তাকে চিনতে পেরে বললেন, তুমি কি আবদুল্লাহ ইবনে মাসরুক (এ ব্যক্তি উক্ত খলীফারই অধীনস্থ এক কর্মচারী ছিলেন)। তিনি বললেন, হাঁ। খলীফা তাকে আটক করে বাগদাদে নিয়ে গেলেন। কিন্তু লোকাপবাদের ভয়ে নিজে তাঁর প্রতি কোন দন্ড বিধান না করে তাকে একটি অশ্বের আস্তাবলে বেঁধে রাখলেন, যাতে করে অশ্বখুরের আঘাতে তাঁর প্রাণ নিঃশেষ হয়। ঐ আস্তাবলে একটি পাগলা অশ্বও ঢুকিয়ে দেয়া হল। সে মানুষ কামড়াত। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় আস্তাবলের প্রত্যেকটি অশ্বই তাঁর বশীভূত হয়ে গেল। তার কোনরূপ অনিষ্ট হল না। অতঃপর তাঁকে একটি ক্ষুদ্র অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ করে সে প্রকোষ্ঠের চাবি খলীফা নিজের হাতে রেখে দিলেন। কিন্তু তিনদিন পর খলীফার লোকেরা তাঁকে একটি উদ্যানে তরকারী ভক্ষণরত অবস্থায় দেখতে পেয়ে বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল। তারা তাঁকে খলীফার কাছে ধরে নিয়ে গেল। খলীফা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, কে তোমাকে বদ্ধ প্রকোষ্ঠ থেকে মুক্ত করে দিল? তিনি বললেন, যে আমাকে আবদ্ধ করেছিল। খলীফা বললেন, কে তোমাকে আবদ্ধ করেছিল? তিনি বললেন, যে আমাকে মুক্ত করেছে, তার এই প্রকার জবাবে সে ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে বলল, আমি যে তোমাকে হত্যা করে ফেলতে পারি, তোমার মনে কি সে ভয়ও নেই? তিনি মৃদু হেসে বললেন, যদি আমার জীবন মরণে তোমার কোন দখল থাকত তাহলে অবশ্য আমি তোমাকে ভয় করতাম। কিন্তু তা' তো তোমার দখলে নেই। শেষ পর্যন্ত খলীফা তাঁকে কারাগারে বন্দী করে রাখলেন। খলীফার মৃত্যু পর্যন্ত তিনি কারাভ্যন্তরেই থাকলেন এবং খলীফার মৃত্যুর পর মুক্তিলাভ করে মক্কা শরীফ চলে এলেন। শুন্য যায়, তিনি এরূপ মানত করেছিলেন যে, যদি কারাগার থেকে কখনও বেরিয়ে আসতে পারেন, তবে একশ উষ্ট্র কুরবানী করবেন। কারামুক্ত হবার পর তিনি তাঁর সে মানত পূর্ণ করেছিলেন।
হযরত হাক্কান বিন আবদুল্লাহ (রহঃ) বলেন, একবার খলীফা হারুনর রশীদ ভ্রমণে বের হলেন, বনু হাশিম বংশীয় সোলায়মান ইবনে আবু জাফরও তাঁর সঙ্গে ছিলেন। খলীফা তাঁকে বললেন, তোমার যে গায়িকা বাঁদীটি আছে, তাকে ডাক, সে আমাকে গান গেয়ে শুনাক। বাঁদীটি এসে খলীফার সামনে গান গাইতে শুরু করল। কিন্তু সেদিন তার গান খলীফার মনোপুতঃ হল না। খলীফা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আজ তোমার গান জমছে না কেন? বাঁদী বলল, আমার বাদ্যযন্ত্রটি না থাকায় গান জমছে না। সেটি অমুক স্থানে রয়েছে। তখন ফলীফা তার খাদেমকে সেখান থেকে বাদ্যযন্ত্রটি নিয়ে আসতে পাঠালেন। সে যথাস্থানে গিয়ে বাদ্যযন্ত্র নিয়ে রওয়ানা হল; কিন্তু সে পথ ভুলে গিয়েছিল। তখন সে এক বৃদ্ধকে দেখতে পেল, সে খেজুরের আঁটি কুড়াচ্ছিল। খাদেম বৃদ্ধকে বলল, তুমি আমাকে পথ দেখিয়ে দাও, বৃদ্ধ মস্তকোত্তোলন করে খাদেমের হাতে বাদ্যযন্ত্র দেখে হঠাৎ তার হাত থেকে তা' নিয়ে সজোরে মাটিতে আছাড় দিয়ে ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলল। খাদেম অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে পাকড়াও করে স্থানীয় কাজীর নিকট উপস্থিত করে বলল, একে হাজতে বন্দী করে রাখ। এ ভীষণ অপরাধ করেছে। আমি স্বয়ং খলীফার নির্দেশে তার জন্য বাদ্যযন্ত্র নিয়ে যাচ্ছিলাম। এ লোকটি তা' আছাড় দিয়ে ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলেছে। কাজী বলল, এ লোকটির চেয়ে ধর্মভীরু লোক দ্বিতীয় নেই। এর ব্যাপারে খলীফার তদন্ত করে দেখা দরকার। খাদেম তাকে ধমক দিয়ে বলল, তুমি আমার কথা মত কাজ কর। কাজী কোন উত্তর না করায় খাদেম খলীফার কাছে উপস্থিত হয়ে এ ঘটনা তাঁকে জানাল। খলীফা শুনে ক্রোধে জ্বলে উঠলেন। তাঁর চক্ষুদ্বয় রক্তবর্ণ হয়ে গেল। তা' দেখে তার সঙ্গী সোলায়মান ইবনে আবু জাফর বললেন, লোকটির প্রতি এত ক্রোধ হবার কি দরকার? বরং তথাকার কাজীকে নির্দেশ পাঠিয়ে দিন। সে বৃদ্ধকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে তার লাশ দজলায় নিক্ষেপ করুক। খলীফা বললেন, না তা' করবার দরকার নেই। আমি লোকটির সাথে আলাপ করে দেখি। অতঃপর লোক পাঠিয়ে বৃদ্ধকে তার দরবারে উপস্থিত করা হল, বৃদ্ধের আস্তিনের মধ্যে খেজুরের আঁটির একটি থলে রক্ষিত ছিল। সে খলীফার দরবারে এসে তাকে সালাম দিয়ে বসে পড়ল। খলীফা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ওগুলো দিয়ে কি হবে? সে বলল, এগুলো আমার রাত্রের খাদ্য। খলীফা বললেন, তোমার খাদ্যের ব্যবস্থা আমিই করব। ওগুলো ফেলে সাও। বৃদ্ধ বলল, তোমার খাদ্যে আমার প্রয়োজন নেই। খলীফা এ ব্যাপারে আর কথা না বাড়িয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, আস্থ্য বৃদ্ধ। তুমি ঐ কাজটি করলে কেন? বৃদ্ধ বলল, আমি কি কাজ করেছি। খলীফা লজ্জাবশতঃ কাজটির উল্লেখ না করে পুনরায় ঐভাবেই প্রশ্ন করলেন, বৃদ্ধও একইভাবে জওয়াব দিল, আমি কি করেছি? এভাবে খলীফা কয়েকবার প্রশ্ন করবার পর বৃদ্ধ বলল, দেখুন খলীফা, আমি আপনার পিতৃপুরুষদেরকে মিম্বরে দাঁড়িয়ে এ আয়াত পাঠ করতে শুনেছি, "ইন্নাল্লাহা ইয়া'মুরু বিল আদলি অল ইহসানি অ ইতায়ি যিলকুরবা অ ইয়ানহা আনিল ফাহশায়ি অল মুনকারি অল বায়ি" অর্থাৎ নিশ্চয় আল্লাহ আদেশ করেন ন্যায়বিচার করতে, অনুগ্রাহ প্রদর্শন করতে, আত্মীয় এগানাকে দান করতে এবং নিষেধ করেন অশ্লীল অপছন্দনীয় এবং বিদ্রোহমূলক কাজ করতে। আমি একটি অপছন্দনীয় বস্তু দেখেছি এবং তা' ভেঙ্গে ফেলেছি। খলীফা বললেন, ভেঙ্গে ফেলেছ, ভালই করেছ। এরপর বৃদ্ধ বাইরে চলে গেলে খলীফা তার খাদেমের হাতে একটি থলে দিয়ে বললেন, এর পিছনে পিছনে যাও। দেখ সে বাইরে গিয়ে আমাদের আলোচনার বিষয়টি কারও কাছে বলে কিনা। যদি বলে তবে এটি তাকে দিও না আর যদি কিছু না বলে তবে এটি তাকে দিয়ে দেবে।
খাদেম দেখল, সে কারও কাছে কিছু না বলে নীরবে চলে যাচ্ছে। তখন সে উক্ত থলেটি বৃদ্ধের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এটি খলীফা তোমাকে দিতে বলেছেন। নিয়ে যাও। থলেটিতে স্বর্ণমুদ্রা ভর্তি ছিল। বৃদ্ধ তা' গ্রহণ না করে বলল, ওগুলো আমাকে দিয়ে কি লাভ হবে? বরং যেখান থেকে ও যাদের থেকে ওগুলো আনা হয়েছে, সেখানে ও তাদেরকে ওগুলো খলীফাকে ফিরিয়ে দিতে বল।
হযরত সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেন, খলীফা মেহদী ১৬৬ হিজরী সনে হজ্জ্ব করেছিলেন। আমি তাকে জামরায় আকাবায় কংকর নিক্ষেপ করতে দেখলাম। তখন তার চারদিক থেকে লোকজনকে যষ্টীদ্বারা হটিয়ে দেয়া হচ্ছিল। আমি তথায় কতক্ষণ অপেক্ষা করে বললাম, হে সুদর্শন ব্যক্তি। কুদামা বিন আবদুল্লাহ কেলাবী থেকে আমার নিকট এ হাদীসটি এসেছে, তিনি বলেছেন যে, আমি হুযুরে পাক (দঃ)কে কুরবানীর দিন উটে আরোহণ করে কংকর মারতে দেখেছি, তাতে কেউ লোককে প্রহার করেনি বা কেউ কাউকে সরিয়েও দেয়নি। এ কথাও কেউ বলেনি যে, তোমরা এখান থেকে দূরে সরে যাও। খলীফা একটি লোকের নিকট জিজ্ঞেস করলেন, এ ব্যক্তি কে? সে বলল, সুফিয়ান ছাওরী। তখন খলীফা বললেন, হে সুফিয়ান! আমার স্থলে খলীফা মনজুর হলে নিশ্চয়ই তোমার এরূপ সাহস হত না। হযরত সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বললেন, খলীফা মনছুরের উপর যে বিপদ এসেছিল, তা' আপনি প্রত্যক্ষ করলে আপনি যে অবস্থায় আছেন তা' কিছুটা হ্রাস পেত। এসময় একব্যক্তি বলে উঠল, হে আমীরুল মুমিনীন। সুফিয়ান আপনাকে আমীরুল 'মুমিনীন' বলে সম্বোধন না করে সুদর্শন ব্যক্তি বলে সম্বোধন করেছে। একথা শুনে খলীফা বললেন, সুফিয়ানকে আমার সামনে নিয়ে এস। কিন্তু হযরত সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) খলীফাকে ঐ কথা বলে আর বৃথা কালক্ষেপ না করে ইতোপূর্বেই চলে গিয়েছিলেন।
খলীফা মামুন একবার শুনতে পেলেন যে একব্যক্তি মানুষের কাছে গিয়ে তাদেরকে সৎকাজে আদেশ দেয় এবং অসৎ কাজে নিষেধ করে। কিন্তু সে ব্যক্তি তার নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে নেয়নি। খলীফা সে লোকটিকে দরবারে ডাকালেন। সে হাজির হলে খলীফা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার নিকট খবর পৌঁছেছে, তুমি আমার নিকট থেকে অনুমতি গ্রহণ না করে মানুষকে আদেশ নিষেধ করছ। তোমাকে কে এ কাজে অনুমতি দান করল? এ সময় খলীফার হাতে একখানা কিতাব ছিল। তা' থেকে কয়েকটি পাতা ছুটে গিয়ে নীচে তার পায়ের উপর পড়ল। কিন্তু তিনি তা' টের পেলেন না। লোকটি তা' দেখে খলীফাকে বলল, আল্লাহর নাম আপনার পায়ের উপর থেকে তুলে ফেলুন। তারপর যা বলার বলুন। খলীফা মামুন তার কথার অর্থ বুঝতে পারলেন না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি বলতেছেন? লোকটি তার ঐ কথাই তিন বার বলল। কিন্তু খলীফা মামুন তাতেও ব্যাপারটি বুঝতে পারলেন না। তখন লোকটি আবার বলল, আপনি তুললেন না, আমাকে তুলবার আদেশ দিন। এবার খলীফা তার পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন, তার পদতলে কিতাবের কয়েকটি পৃষ্ঠা পড়ে আছে। তিনি তা' উঠিয়ে তাতে চুম্বন করতে লাগলেন। খলীফা অত্যন্ত লজ্জিত হলেন। কিন্তু আবার তিনি লোকটিকে সেই পূর্বের প্রশ্ন করলেন, তুমি কেন লোকদেরকে সৎকাজে আদেশ এবং অসৎকাজে নিষেধ কর? অথচ তুমি আমার থেকে একাজের অনুমতি গ্রহণ করনি। আমরা আহলে বাইত আমাদেরকে আল্লাহতায়ালা এ কাজের ভার দিয়েছেন এবং আামদের সম্পর্কেই আল্লাহ বলেছেন, যদি আমি তাদেরকে হুকুমত প্রদান করি তারা নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং সৎকাজে আদেশ করে ও অসৎকাজে নিষেধ করে। লোকটি বলল, হে আমীরুল মুমিনীন! আপনার বক্তব্য সত্যবটে। আমরা শুধু সে কার্যে আপনার সাহায্যকারী এবং আপনার বন্ধু এবং একথাও আল্লাহর কিতাবে ও হযরত রাসূলে করীম (দঃ) এর হাদীসে রয়েছে, তা' অস্বীকার করতে পারেন না। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। তারা সৎকাজে আদেশ দেয় ইত্যাদি। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, এক মুমিনের জন্য অন্য মুমিন একটি অট্টালিকা সদৃশ। এর এক অংশ অন্য অংশকে শক্তিশালী করে। আল্লাহতায়ালা দুনিয়ায় আপনাকে হুকুমত দিয়েছেন এটা আল্লাহর কিতাব এবং হুযুরে পাক (দঃ) এর সুন্নত। যদি এদুটো বিষয়ের আপনি অনুসরণ করেন, যে ব্যক্তি আপনাকে সে কার্যে সহায়তা করে তবে তজ্জন্য আপনার শোকর করা উচিত। আর যদি আপনি অহঙ্কারের বশে আপনি তা' প্রত্যাখ্যান করেন এবং সেই বিষয় দুটোকে মান্য না করেন তাহলে যার হাতে আপনার সম্মান তাঁর এই বাণী উল্লিখিত রয়েছে, যথাঃ "ইন্নাহু লাইযুদ্বীউ আজরা মান আহসানা আমালা"। অর্থাৎ যে ব্যক্তি সৎকাজ করে তার পুরস্কার আল্লাহ নষ্ট করেন না। এখন যা আপনার ইচ্ছা তাই করতে পারেন।
লোকটির কথা শুনে খলীফা অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন, তাকে অভিনন্দন জানালেন এবং বললেন, আপনার মত লোকের সৎকার্যে আদেশ দেয়াই উচিত। আপনি আপনার কাজে বহাল থাকুন। পাঠক-পাঠিকা। উল্লিখিত ঘটনাসমূহ দ্বারা পরিষ্কারভাবে বুঝা যাচ্ছে যে, সৎকাজে অদেশ এবং অসৎকাজে নিষেধের জন্য শাসনকর্তার অনুমতি গ্রহণের প্রয়োজন হয় না।
এখন যদি প্রশ্ন করা হয় যে, পিতার উপর সন্তানের, মনিবের উপর দাসের, স্বামীর উপর স্ত্রীর, শিক্ষকের উপর ছাত্রের এবং শাসনকর্তার উপর প্রজার আদেশ নিষেধ করবার ব্যাপারে ঐরূপ কর্তৃত্ব থাকবে, যেরূপ পিতার পুত্রের উপর, মনিবের দাসের উপর, স্বামীর স্ত্রীর উপর, শিক্ষকের ছাত্রের উপর এবং শাসনকর্তার প্রজার উপর কর্তৃত্ব থাকে? না এ-উভয়ের মধ্যে পার্থক্য থাকবে?
এ প্রশ্নের উত্তর এই যে, আদেশ-নিষেধের জন্য পাঁচটি ধাপ আছে। পিতার প্রতি পুত্রের উপদেশ ও নিষেধের প্রথম দুটি ধাপ আছে। পুত্র পিতার সাথে তিরস্কার, কর্কশ ব্যবহার এবং সতর্কবাণী ব্যবহার করবে না এবং তাকে প্রহারও করবে না। কেননা তাতে পিতা মনে দুঃখ ও ক্লেশ পেতে পারে। এদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার। পিতার গানের বাদ্য যন্ত্র ভেঙ্গে ফেলা, তার গৃহে যদি যেয়ে হারাম মাল পাওয়া যায়। যথা-অত্যাচারলব্ধ মাল বা চুরি-ডাকাতি দ্বারা অর্জিত মাল অথবা মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট কোন পুরস্কারের মাল পুত্র নিজের হাতে নিয়ে প্রকৃত মালিকের নিকট তা' ফিরিয়ে দেয়া, যদি মালিক নির্দিষ্ট থাকে। পিতার গৃহের দেয়ালে লটকানো প্রাণীর ছবি ফেলে দেয়া, তার গৃহের খাট পালং-এর নকশা মিটিয়ে দেয়া, তার স্বর্ণ ও রৌপ্যের পাত্র ভেঙ্গে ফেলা ইত্যাদি জায়েয হবে। এসব কার্য পিতাকে প্রহার বা তিরস্কার করবার বিপরীত হলেও এতেও পিতার মনঃকষ্ট হয় এবং এ ধরনের কাজেও কিছু কিছু মাল নষ্টও হয়, তবুও যেহেতু পুত্রের এসব কার্য ন্যায়সঙ্গত এবং পিতার অসন্তুষ্টি ও মনঃকষ্ট অসত্যভিত্তিক। তাই পুত্রের এসব কাজ করা অনুচিত নয় বরং করা কর্তব্য। অবশ্য এ ব্যাপারে পিতার অসন্তুষ্টি ও মনঃকষ্টের পরিমাণ এবং তার মন্দকার্যের গুরুত্বের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যদি পিতার মন্দকার্য মদ্যপানের ন্যায় অশ্লীল হয় এবং মদ ঢেলে দিলে পিতা অসন্তুষ্ট না হয় তা'হলে প্রকাশ্যে পুত্র এরূপ কার্য করতে পারে। যদি পিতার মন্দ কাজটি অধিক গর্হিত না হয় এবং পিতার অসন্তুষ্টির পরিমাণ অধিক হয় তবে সেক্ষেত্রে পিতার সন্তুষ্টির দিকে লক্ষ্য রেখে পুত্রের সে কাজ করতে হবে। যেমন নকশাকৃত বা প্রাণীর আকৃতিবিশিষ্ট কাঁচের জিনিস ভেঙ্গে ফেলা এবং এভাবে পিতার প্রভৃত আর্থিক ক্ষতি করে দেয়া এই গুনাহ মদ্যপান ইত্যাদি বিষয়ের ন্যায় তত গুরুতর নয়। মোটকথা, প্রত্যেকটি বিষয় বিশেষভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে যেটা ন্যায্য তাই করতে হবে।
যদি কেউ এরূপ প্রশ্ন করে যে, পুত্রের পিতার প্রতি কর্কশ ব্যবহার করা ও তাকে প্রহার করা জায়েয নয় একথা কি করে বলা হল? অথচ বাতিল কার্য ত্যাগ করতে সতর্ক করা এবং সৎকাজে আদেশ দেয়া কুরআন ও হাদীসে সবার জন্য এসেছে। কুরআনে পাকে পিতামাতার প্রতি 'উফ' বলা এবং তাদেরকে কষ্ট দেয়ার বিষয় যে, নিষেধ এসেছে তা' এমন বিষয় সম্বন্ধে যার নিন্দনীয় কাজ করবার সাথে সম্পর্ক নেই। এ প্রশ্নের উত্তর এই যে, পিতার হকের বেলায় তা' বিশেষ করে বলা হয়েছে এবং সর্বসাধারণের বেলায় তার বাতিক্রম করে বলা হয়েছে। কেননা এতে মতভেদ নেই যে, পুত্র হুকুমতের অধীনে জল্লাদের পদে নিযুক্ত থাকলে তার পিতাকে ব্যভিচারের শান্তির জন্য হত্যা করা জায়েয হবে না। তার উপর নির্দিষ্ট শান্তির সংবাদ দেয়াও তার পক্ষে অন্যায় হবে; বরং তার কাফির পিতার হত্যার সংবাদও সে দেবে না; বরং যদি পিতা পুত্রের হস্ত কর্তন করে ফেলে তবে সেক্ষেত্রে পিতার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না। এর বিনিময়ে পুত্রের সামনে পিতাকে কষ্ট দেয়া উচিত নয়। এ সম্বন্ধে হাদীস শরীফে উক্তি রয়েছে, কেউ কেউ ইজমা দ্বারা এটা প্রতিষ্ঠা করেছেন। যখন পূর্ব দোষের জন্য পিতাকে শাস্তির দ্বারা কষ্ট দেয়া জায়েয হয় না, তখন এমন শাস্তির দ্বারাও তাকে কষ্ট দেয়া জায়েয হবে না যা ভবিষ্যৎ গুনাহ করবার প্রতিষেধক: বরং এরূপ অবস্থায় কষ্ট না দেয়াই উত্তম।
মনিবের সাথে দাসের এবং স্বামীর সাথে স্ত্রীর ব্যবহারও পূর্বের নিয়মের পর্যায়ভুক্ত। কেননা এরা উভয়ই এই কর্তব্যের বেলায় পুত্রের নিকটবর্তী। যদিও দক্ষিণ হস্তের অধিকার বিবাহের (অধিকার) থেকেও দৃঢ়। কিন্তু হাদীস শরীফে আছে, যদি মানুষকে সিজদাহ করা জায়েয হত তাহলে নিশ্চয়ই আমি স্বামীকে সিজদাহ দেয়ার জন্য স্ত্রীকে আদেশ দিতাম। স্বামী ও স্ত্রীর হক ও সম্পর্ক কত দৃঢ় তা' এ হাদীস দ্বারাই অনুমান করা যায়।
শাসনকর্তার সঙ্গে প্রজার সম্পর্কের বিধান পুত্রের বিধান থেকেও অধিক কঠোর। প্রজা সুলতানের প্রশংসা করবে, প্রজা গুণ গাইবে এবং তাকে উপদেশ দেবে। কিন্তু তাকে তিরস্কার ও তার সাথে কর্কশ ব্যবহার করা সম্পর্কে মতভেদ আছে। কেননা তার কোষাগার থেকে ধন গ্রহণ করবার জন্য হামলা করা এবং সে ধন প্রকৃত মালিককে ফিরিয়ে দেয়া, তার রেশমী বস্ত্র থেকে সূতা উঠিয়ে নেয়া, তার গৃহে মদের পাত্র ভেঙ্গে ফেলা ইত্যাদি কাজগুলো করলে শাসনর্কতার উপর থেকে ভয়ভীতি দূর হয়ে যাবে এবং শাসনকর্তার গৌরব বিনষ্ট হবে; এজন্য এটা নিষিদ্ধ। হাদীস শরীফেও তা' নিষিদ্ধ হয়েছে। যেরূপ মন্দ দোষ দেখলে, তাতে নীরব থাকা নিষিদ্ধ, তদসম্বন্ধে দুটো বিষয় পরস্পর বিরোধী হয়। উক্ত বিষয় দুটোর বিধান দেয়া ইজতেহাদের উপর নির্ভরশীল। তখন উক্ত মন্দ জিনিস কোন্ স্তরের মন্দ এবং শাসনকর্তার প্রতি ব্যবস্থা নিলে তার কি পরিমাণ সম্মান হ্রাস পাবে, তার প্রতি লক্ষ্য করা উচিত। এ ব্যাপারে সরাসরিভাবে কোন বিধান দেয়া সম্ভব নয়।
ছাত্র এবং শিক্ষকের মধ্যে বিধান তত কঠিন নয়। কেননা শিক্ষক সম্মানিত এবং তার নিকট থেকে দ্বীন সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জিত হয়। যে আলিম তার ইলম অনুসারে আমল করে না, তার কোন সম্মান নেই, ইলম অনুসারে তার আমল করা উচিত। বর্ণিত আছে যে, একদা হযরত হাসান বছরী (রহঃ) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সন্তান কিরূপে তার পিতাকে সৎকাজে উপদেশ দেবে এবং অসৎকাজে নিষেধ করবে? তিনি বললেন, এব্যাপারে পিতার অসন্তুষ্টি এবং ক্রোধান্বিত হবার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যদি পিতা অসন্তুষ্ট বা ক্রোধান্বিত হয়, তবে নীরব থাকবে।
পঞ্চম শর্তঃ আদেশ-নিষেধকারীর শক্তি ও সামর্থ থাকা। কেননা যে অক্ষম, যার শক্তি সামর্থ্য নেই তার পক্ষে আদেশ নিষেধ করা ওয়াজিব নয়। তবে যে আল্লাহকে ভালবাসে সে অন্যায় কার্যকে ঘৃণা করে এবং সম্ভব হলে তা' করতে নিষেধ করবে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেছেন, তোমরা তোমাদের হস্তদ্বারা কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর। যদি তা' না পার শুধু তাদের মুখের উপর নাক সিটকাতে পার, তবে তাই করবে। জেনে রাখবে, বাহ্যিক অক্ষমতার জন্য এতটুকু করাই তখন ওয়াজিব হয়ে যায়। অক্ষমতার অর্থ যাকে উপদেশ দেয়া যায় তার নিকট থেকে কোনরূপ ক্ষতি ও অনিষ্টের ভয় করা। কিন্তু যদি কোন অনিষ্ট ও ক্ষতির ভয় না থাকে এবং এই জ্ঞান থাকে যে তার অস্বীকারে কোন অপকার হবে না, তখন দুটো বিষয়ের দিকে লক্ষ্য করবে। প্রথমতঃ নিষেধ করায়ও কোন ফলোদয় না হওয়া এবং দ্বিতীয়তঃ কষ্ট পাবার ভয় হওয়া। এই দুটো বিষয়ের দিক থেকে চারটি অবস্থা সৃষ্টি হয়। যথাঃ
প্রথম অবস্থাঃ দুটো বিষয়ই একত্র হওয়া যেমন তোমার উপদেশে কোন ফলোদয় হবে না বলে জানা এবং প্রহারের ভয় করা। এ অবস্থায় তার প্রতি উপদেশ দান করা ওয়াজিব নয়; বরং তা' কোন কোনক্ষেত্রে হারাম হয়ে যায়। একথা সত্য যে, নিন্দনীয় স্থানে যাওয়া উচিত নয় এবং না দেখা পর্যন্ত নিজের গৃহেই থাকা উচিত। বিশেষ কার্য বা জরুরী প্রয়োজন ব্যতীত বাইরে না যাওয়াই উচিত। স্থানত্যাগ করে হিজরত করাও উচিত নয়। তবে যদি অশান্তি সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা থাকে অথবা শাসনকর্তার অত্যাচারের ভয় থাকে তাহলে দেশ ত্যাগ করবার মত অবস্থা হলে দেশত্যাগ করবে। কেননা যে ব্যক্তি অত্যাচার থেকে পালিয়ে যেতে পারে তার পক্ষে অত্যাচারের ওজর প্রকাশ করা উচিত হবে না।
দ্বিতীয় অবস্থাঃ এটা হল দুটো বিষয়ের কোন একটিই না থাকা। অর্থাৎ তার উপদেশ এবং কার্যদ্বারা মন্দকার্য দূর হয়ে যাবে এবং কেউ কোন অনিষ্ট করতে পারবে বলে অবগত না থাকা। এমতাবস্থায় অন্যায় কার্যক বারণ করা তার পক্ষে ওয়াজিব। এটাই মানুষের সাধারণ ক্ষমতা।
তৃতীয় অবস্থাঃ এটা হল নিষেধে কোন ফল হবে না অবগত থাকা এবং ক্ষতি বা অনিষ্টেরও কোন ভয় নেই তা' অবগত থাকা। এ অবস্থায় তার পক্ষে উপদেশ দেয়া ওয়াজিব নয়। কেননা তাতে কোন ফল হবে না। কিন্তু ইসলামের নিদর্শনসমূহ প্রকাশ করাকে এবং দ্বীনের কার্যসমূহ স্মরণ করিয়ে দেয়াকে তার জন্য ভালবাসা উচিত।
চতুর্থ অবস্থাঃ এ অবস্থাটি তৃতীয় অবস্থার বিপরীত। অর্থাৎ উপদেশ দাতা জানে যে, আদেশ- নিষেধ দ্বারা তার ক্ষতি এবং অনিষ্টের সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু সে চেষ্টার দ্বারা সৎকাজ প্রতিষ্ঠা এবং অসৎকাজ দূর করে দিতে পারবে। যেমন কোন বড় গুনাহগারের মূর্তি অংকিত কাঁচের জিনিস পাথর দ্বারা ভেঙ্গে দেয়া বা তার মদ ঢেলে ফেলে দেয়া বা যে যষ্টি দ্বারা সে অন্যায়ভাবে প্রহার করে তা' ভেঙ্গে ফেলা। অথবা এই প্রকার কার্য দ্বারা তার মন্দকাজগুলো দূর করে দেয়া। কিন্তু সে জানে যে, তার উপর এর প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে এবং তার মস্তকের উপর লাঠির আঘাত পড়তে পারে। এ অবস্থা হলে তার জন্য আদেশ ও নিষেধ করা ওয়াজিব নয়। আবার হারামও নয়; বরং তখন এটা মুস্তাহাব বা উত্তম হবে। এ সম্বন্ধে হাদীস শরীফে আছে, অত্যাচারী শাসনকর্তার সামনে সত্যকথা বলার ফজীলগত অধিক। কেননা এতে সন্দেহ নেই যে, উপদেশ সাধারণতঃ ভয়সস্কুল স্থানেই দান করা হয়ে থাকে। এর সমর্থনে হযরত আবু সোলায়মান দারানী (রহঃ) এর একটি বর্ণনা রয়েছে। তিনি বলেন, আমি কোন খলীফার নিকট থেকে শরীয়ত সম্পর্কিত একটা কথ্য শুনে মনে করলাম যে, তার প্রতিবাদ করব। কিন্তু জানতে পারলাম যে, তজ্জন্য আমার প্রাণদন্ড হতে পারে। তবে আমার প্রাণদন্ডের ভয় ছিল না কিন্তু ভয় হল যে, মানুষের মধ্যে আমাকে হত্যা করলে লোকগণ আমাকে সাধু এবং ধার্মিক লোক বলতে পারে। যার ফলে ইখলাছহীন কার্যের মধ্যে আমার প্রাণ বিয়োগ ঘটতে পারে।
যদি তুমি প্রশ্ন কর যে, তাহলে "ওয়ালা তুলকু বিআইদীকুম ইলাত্তাহলুকাহু" অর্থাৎ তোমরা তোমাদের ধ্বংসের দিকে হাত বাড়িও না। এ আয়াতের অর্থ কি হবে? এই প্রশ্নের উত্তরে আমি বলব, এতে কোন মতভেদ নেই যে, যদিও কোন মুসলমান অবগত থাকে যে, যদি সে একাকী কাফিরদেরকে আক্রমণ করে এবং তাদের সাথে যুদ্ধ করে তাতে সে নিহত হতে পারে তবুও তার সে কার্য জায়েয হবে। এ কথা বলা চলে না যে, তার কার্য উক্ত আয়াতের বিপরীত। প্রকৃতপক্ষে তা' সত্য নয়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, এই তাহলুকাহ বা আত্মধ্বংস আত্মহত্যাতুল্য নয়; বরং আল্লাহর দ্বীন রক্ষার্থে ঐ রূপ কাজ না করাই ধ্বংসকর। যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে ব্যয় করে না বা আল্লাহর জন্য আত্মোৎসর্গ করে না সে নিজেকেই ধ্বংস করে। হযরত বারা' বিন আজেব (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, কোন ব্যক্তি কোন গুনাহর কাজ করে তারপর যদি বলে, আমার তাওবাহ কবুল হবে না, তবে তার একথা আত্মধ্বংস বা তাহলুকাহ হবে। হযরত আবু ওবায়দা (রাঃ) বলেছেন, কোন গুনাহর কাজ করে ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত কোন নেককাজ না করবার নামই আত্মনিধন বা তাহলুকাহ।
যখন নিহত না হওয়া পর্যন্ত কাফিরদের সাথে যুদ্ধ করা জায়েয তখন সৎকাজে উপদেশ এবং অসৎকাজে নিষেধ করে কোন ক্ষতি বা অনিষ্টের সম্মুখীন হওয়াও জায়েয আছে। কিন্তু যদি সে জানে যে সে কোন অন্ধ বা অক্ষম লোকের ন্যায় কাফিরদের সারিতে নিজেকে, দাঁড় করালে কোন ফল হবে না, তাহলে তার সে কার্য হারাম হবে এবং তাতে সে উক্ত আয়াতের আত্মনিধনের ব্যাখ্যার অন্তর্ভুক্ত হবে। যদি সে জানে যে, যে পর্যন্ত সে নিহত না হবে সে পর্যন্ত যুদ্ধ করতে পারবে অথবা তার উপস্থিতিতে কাফিরদের হৃদয়ে এবং সাহস-শক্তি দমে যেতে পারে এবং অবশিষ্ট মুসলমানের দৃঢ় বিশ্বাস অনুসারে আল্লাহর পথে তাদের শাহাদাতের কামনা বৃদ্ধি পেতে পারে। তাহলে তার সে যুদ্ধে অগ্রসর হওয়া জায়েয হবে। এরূপ অবস্থা হলে আদেশ ও নিষেধ করা নাজায়েয হবে না। তখন নিজেকে প্রহার বা চরম শান্তির সামনে উপস্থিত করা মুস্তাহাব বা উত্তম। যদি তার উপদেশ কোন মন্দকার্যকে দূর করে দেয় অথবা কোন বড় গুনাহগারের খ্যাতি যশ নষ্ট করে দেয় অথবা ধার্মিকদের হৃদয়ে তা' দ্বারা দৃঢ় হয়। যদি সে কোন গুনাহগারকে বিক্রমশালী দেখতে পায় এবং তার এক হাতে যদি তরবারী ও অন্য হাতে মদের পাত্র থাকে আর যদি সে জানে যে, তাকে মদ্যপান করতে নিষেধ করলে তার গর্দান উড়িয়ে দেবে তখন তার পক্ষে সৎকাজে আদেশ এবং মন্দকাজে নিষেধ করা জায়েয নয়। এ প্রকার কার্যে আত্মবিনাস ব্যতীত আর কিছুই হয় না। অথচ উপদেশ দ্বারা ধর্মের মধ্যে উত্তম ফল সৃষ্টি করা এবং নিজের তাতে উপকার হওয়াই উদ্দেশ্য। কোন উপকার ব্যতীত নিজেকে ধ্বংসের কোলে তুলে দেয়ায় কোন লাভ নেই; বরং তা' হারাম বা নিষিদ্ধ।
যখন সে কোন অসৎকাজ দূরীভূত করতে সমর্থ হয় অথবা তার কার্যের মধ্যে কোন উপকার প্রকাশ পায়, তার জন্য তখন আদেশ-নিষেধ করা মুস্তাহাব বা উত্তম। তবে এটাও শর্তসাপেক্ষ। যদি উপদেশদাতা জানে যে, অন্যায়কারীর অন্যান্য সঙ্গী-সাথী, আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু- বান্ধবদের সাথে তার সংঘর্ষ বেঁধে যেতে পারে তখন তার মন্দ বারণ করা জায়েয নয়; বরং তা' হারাম হবে। কেননা সে তখন মন্দকাজ দূর করবার ব্যাপারে অসমর্থ এবং তাতে গুরুতর অশান্তি সৃষ্টির সম্ভাবনা। এ ব্যাপার তাঁর শক্তির বহির্ভূত; বরং সে-জানে যে, যদি এই অবস্থায় আদেশ দেয় বা নিষেধ করে সে আদেশ বা নিষেধ ব্যর্থ হবে। অথচ তা' অন্য এক অধিক মন্দকাজের কারণ হতে পারে। এমতাবস্থায় প্রকাশ্যভাবে মন্দ কাজ নিবারণ করা তার পক্ষে। জায়েয হবে না। কেননা মন্দকাজ প্রবল না হওয়া বা নতুন মন্দকাজ সৃষ্টি না হওয়াই সাধারণতঃ শরীয়তের লক্ষ্য। তার দৃষ্টান্ত এই, যেমন কোন ব্যক্তির নিকট হালাল পানি আছে কিন্তু তার মধ্যে নাপাকী পতিত হয়ে তা' অপবিত্র হয়ে গেছে। এমতক্ষেত্রে অন্যায় নিবারণকারী জানে যে, সেই অপবিত্র পানি ঢেলে ফেলে দিলে পানির মালিক তৃষ্ণা নিবারণের জন্য মদ্যপান করতে পারে বা তার পরিবারবর্গকে পান করাতে পারে। তখন তার পক্ষে ঐ পানি ঢেলে ফেলে দেবার কোন অর্থ হয় না। কেউ কেউ আবার বলে যে, ঐ অপবিত্র পানি ঢেলে ফেলে দেয়া উচিত। কেননা তদ্বারা মন্দকাজ প্রতিরোধ করা হয়। কিন্তু তখন শুধু মদপান বাকী থাকে যে তা' পান করণে তার উপরই তার দোষ বর্তাবে। পাপ নিবারণকারীর উপরে ঐ দোষ বর্তাবে না। তার দায়িত্ব শুধু মন্দকাজ বারণ করা। এটা করলেই তার পক্ষে যথেষ্ট হবে। অনেকে এ সমাধানকেও পছন্দ করেছেন। তবে মূলকথা হল, এই প্রশ্ন ফিকাহ সম্পর্কিত বলে কিয়াস ব্যতীত এর বিধান দেয়া যায় না। যেমন একব্যক্তি অন্যের রকরী ভক্ষণ করবার জন্য যবেহ করতে উদ্যত। পাপ নিবারণকারী জানে যে, যদি সে তাকে নিষেধ করে তাহলে সে মানুষ হত্যা করে ফেলবে। তখনু তাকে নিষেধ করবার কোন অর্থ হয় না।
এসকল সূক্ষ্ম মাসয়ালা ইজতেহাদ বা চিন্তাপ্রসূত আবিষ্কারের অন্তর্গত। উপদেশদাতা সমস্ত 'কাজেই ইজতেহাদের অনুসরণ করবে। এসকল সূক্ষ্ম মাসয়ালার জন্য আমরা বলি যে, পরিষ্কাররূপে জানার স্থান ব্যতীত সাধারণ লোকের সৎ কাজে আদেশ ও মন্দকাজের নিষেধ করা উচিত নয়। যেমন মদ্যপান, ব্যভিচার, নামায ত্যাগ ইত্যাদি। এসব কাজে উপদেশ দান সাধারণের জন্যও জায়েয। যেসব কার্য অন্যান্য কার্যের সংস্পর্শে এসে গুনাহর কার্যে পরিণত হয় এবং কোন কারণে ইজতেহাদের আবশ্যক হয়, সাধারণ লোকেরা যদি সে বিষয় নিয়ে আলোচনা করে তবে তার অনিষ্ট তার মঙ্গল থেকে অনেক বেশী। যে ব্যক্তি শাসনকর্তার অনুমতি ব্যতিরেকে আদেশ ও নিষেধের ভার গ্রহণ করে এবং তার পরিচিতিগত কোন ত্রুটির কারণে বা বিশ্বস্ততাজনিত ত্রুটির জন্য সে সেই কাজের অনুপযুক্ত হয় তাতে নানারূপ দোখ- ত্রুটি ঘটে থাকে। আমরা যথাস্থানে সে বিষয়ে আলোচনা করব।
যদি তুমি প্রশ্ন কর যে, উপদেশদাতার কোন বিপদ হওয়া বা তার উপকারে আসা বা না আসার বিষয় জানার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু জানার পরিবর্তে যদি সে সম্বন্ধে কেবল ধারণা হয় তাহলে তার বিধান কি হবে? এর উত্তর এই যে, ঐ সমস্ত বিষয়ে প্রবল ধারণাই জানার তুল্য। তবে জানা এবং ধারণা করা যখন পরস্পর বিরোধী হয় তখন তার পার্থক্য প্রকাশ পায় যখন সে নিশ্চিতরূপে জানে যে, তার উপদেশে কোন কাজ হবে না তখন তার ধারণা যাই থাকুক না কেন তার উপর থেকে তখন উপদেশ দেয়া ওয়াজিব হওয়া দূর হয়ে যায়।
যদি তার প্রবল ধারণা হয় যে, উপদেশে কোন উপকার হবে না কিন্তু সাথে সাথে এরূপ সন্দেহও হয় যে, হয়ত বা উপকার হতেও পারে এবং এজন্য কষ্টও পাওয়া যেতে পারে, এই অবস্থায় নিষেধ করা ওয়াজিব হওয়া সম্বন্ধে আলিমদের মধ্যে মতভেদ আছে। কিন্তু অধিকাংশ আলিমের মতে নিষেধ করা ওয়াজিব হয়। কেননা, তা' করলে কোন অনিষ্ট হবে না; বরং উপকারের আশা থাকে, সৎকাজে আদেশ এবং অসৎকাজে নিষেধ সর্বাবস্থায়ই ওয়াজিব। এটাই সাধারণ বিধান। তবে এর ব্যতিক্রম এই যে, যখন কেউ জানে যে, আদেশে ও নিষেধে কোন উপকার হবে না তখন তা' ওয়াজিব নয়। আমি এটা ইজমা বা প্রকাশ্য ফিকাহ থেকে বলছি। প্রকাশ্য ফিকাহর কারণ এই যে, শুধু আদেশের জন্যই আদেশ দেয়া হয় না; বরং যাকে আদেশ দেয়া হয় তাকে তদ্বম্বরা সংশোধন করবার উদ্দেশ্য থাকে। যদি তা' হতে নিরাশ হওয়া যায় তখন উপদেশে কোন উপকার হবে না। যদি নিরাশ না হওয়া যায় তখন উপদেশ দান করবার ওয়াজিবই থেকে যায়।
যদি তুমি প্রশ্ন কর, পাপী শাসনকর্তার বিপদাপদ ঘটবার যদি কোন নিশ্চিত জ্ঞান না থাকে বা প্রবল ধারণা দ্বারাও সে তা' জানতে না পারে অথচ তাতে সন্দেহ থাকে অথবা তার সাধারণ ধারণা হয় যে, তার উপর কোন বিপদাপদ পতিত হতে পারে এবং সেই বিপদাপদের সন্দেহ দূর হয় না। এর ফলে বা সাধারণ ধারণার ফলে কি ওয়াজিব থেকে মুক্তি পাওয়া যায়? বিপদাপদ না আসার নিশ্চিত বিশ্বাসের নিকট কি নিষেধ করা ওয়াজিব হয় বা তা' কি প্রত্যেক অবস্থায়ই ওয়াজিব হয়? আর বিপদাপদ আসবার ধারণা হলে তা কি ওয়াজিব হয় না? তার উত্তর এই যে, যদি প্রবল ধারণা হয় যে, বিপদ হবে, তখন আদেশ-নিষেধ ওয়াজিব হয় না। যদি প্রবল ধারণা হয় যে, তার এ কাজের ফলে কোন বিপদ হবে না, তখন আদেশ ও নিষেধ করা ওয়াজিব হয়। তবে শুধু কষ্ট পেতে পারে এরূপ সন্দেহ হলে তাতে আদেশ-নিষেধ করা ওয়াজিবই থেকে যাবে। কেননা যে কোন আদেশ-নিষেধের ক্ষেত্রেই ক্ষতি বা অনিষ্ট হবার এরূপ দুর্বল ধারণা থাকে। যদি প্রবল ধারণা না হয়; বরং তাতে এই সন্দেহ উপস্থিত হয় যে, বিপদ হতেও পারে অথবা না-ও হতে পারে। এমতক্ষেত্রে তর্কের ব্যাপার আছে। সাধারণ নিয়ম এই যে, বিপদ- আপদ পতিত না হবার ধারণা থাকলে আদেশ-নিষেধ করা ওয়াজিব হয়। কিন্তু তা' পতিত হবার ধারণা থাকলে ওয়াজিব হয় না। বিপদাপদের ধারণা দু'রকম আছে। একপ্রকার অনুমানজনিত। আর একপ্রকার অভিজ্ঞতাজনিত'। যখন সে জানে যে, উপদেশ দিলে ও নিষেধ করলে কোন অনিষ্ট হবে না বা যখন তার এরূপ ধারণা হয় যে, তাতে তার উপর কোন অনিষ্ট হবে না তখন আদেশ-নিষেধ করা ওয়াজিব হবে না।
যদি তুমি বল, সাহসী ও কাপুরুষের মধ্যে আশঙ্কার তারতম্য হয়। কেননা কাপুরুষের হৃদয় দুর্বল। সে দূরবর্তীকেও নিকটবর্তী দেখে। এমন কি সে সেই বিষয় যেন স্বচক্ষে দেখে এবং তাতে সে ভয় পায়। কিন্তু সাহসী ব্যক্তি বিপদকে দূরবর্তী দেখে এবং তা' বাস্তবে সংঘটিত না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বাস করে না। এমতাবস্থায় কার প্রতি বিশ্বাস করে বিধান দেয়া যায়? এর উত্তর এই যে, মধ্যম প্রকৃতি সূক্ষ্মবুদ্ধি এবং মধ্যম মেজাযের লোকের উপর বিশ্বাস করে বিধান দেব। কেননা কাপুরুষতা ব্যাধিসদৃশ। তা' হৃদয়কে দুর্বল করে এবং শক্তি ও সাহসকে হ্রাস করে। পক্ষান্তরে বাড়াবাড়ি বা হঠকারিতায় অতিরিক্ততার দোষ আছে। হ্রাস ও আধিক্য উভয়ই সীমার বাইরের বস্তু। এ দুটোই অনিষ্টকর বরং সমতা বা মধ্যবর্তী অবস্থাই পূর্ণতাপ্রাপ্ত এবং এই গুণটিকেই প্রয়োজনীয় সাহস বলা যায়। কাপুরুষতা ও হঠকারিতা দুটো দোষই অসম্পূর্ণ বুদ্ধি হতে জন্যে। কখনও কখনও তা' মেজাযের অতিরিক্ততার দোষ থেকে উদ্ভুত হয়। যার মেজাযে সাম্য ভাব অর্থাৎ মধ্যবর্তী অবস্থা থাকে অর্থাৎ কাপুরুষতা ও হঠকারিতা না থাকে তখন সে মন্দের মূল অনুসন্ধান না করলে তার সাহসের কারণ হয় অজ্ঞতা। যখন সেই মন্দের মূল দূর করবার পন্থা জানে না তখন তার কাপুরুষতার কারণ হয় তার অজ্ঞতা। কখনও কখনও পরীক্ষা ও অভিজ্ঞতার দ্বারা মন্দের উপস্থিতি ও দূরীকরণের বিষয় সে জানে বটে, কিন্তু তার হৃদয়ের দুর্বলতার কারণে সে অসৎকার্যকে দূরবর্তী দেখে। অথচ তা' সাম্য স্বভাব বিশিষ্ট সাহসী পুরুষের পক্ষে নিকটবর্তী অসৎকার্য।
কাপুরুষের কর্তব্য কাপুরুষতার কারণ দূর করে দিয়ে তাকে দূর করে দেয়া। কাপুরুষতার কারণ অজ্ঞতা বা দুর্বলতা। অজ্ঞতাকে অভিজ্ঞতা দ্বারা দূর করা যায়। আর দুর্বলতা দূর করা যায় অনিচ্ছা হলেও অনবরত ভয়-ভীতির কাজকর্ম করবার দ্বারা। যে পর্যন্ত তা' অভ্যাসে পরিণত না হয় সে পর্যন্ত এরূপ কাজ করতে হবে। যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম বক্তৃতা করবার জন্য লোকের সামনে দাঁড়ায়, দুর্বলতাজনিত কারণে তার মনে ভীরুতা আসে। কিন্তু যখন সে বার বার এরূপ করতে থাকে তখন তার দুর্বলতা চলে যায়। তবে হৃদয়ের দুর্বলতা প্রবল হবার কারণে তা' দূর করবার উপায় না পাওয়া গেলে এরূপ দুর্বল লোকের বিধান তার অবস্থানুসারে হয়ে থাকে। এজন্যই আমরা বলি যে, রুগ্ন ব্যক্তির উপর সমুদ্রযাত্রা ওয়াজিব হয় না। পক্ষান্তরে যার হৃদয় ভয়ে ভীত নয় সমুদ্রযাত্রায় তার কোন বিশেষ ক্ষতি হয় না। তদ্রূপভাবে আদেশ-নিষেধ করা অবস্থা বিশেষে ওয়াজিব হয় এবং ওয়াজিব হয় না। যদি তুমি বল, উল্লিখিত কারণে বিপদাপদের আশঙ্কার সীমা কি? এ বিষয়ে মানুষের অবস্থার তারতম্য হয়। কোন বাক্তি কারও উপদেশে কষ্ট অনুভব করে। আবার কারও প্রহারে কই অনুভব করে, উপদেশে নয়। গাকে উপদেশ দেয়া হয় তখনও তার কথা শুনলে ক্লেশ অনুযুত হয়। এমন কোন ব্যক্তি নেই যাকে সৎকাজে আদেশ দেয়া হলে তার নিকট থেকে কিছু না কিছু কষ্ট পাওয়া যায় না। হয়ত দে শাসনকর্তার নিকট নিয়ে অভিযোগ করে বা কোন মজলিসে গিয়ে তার নিন্দা করে এবং তার ফলে তার উপর বিপদ উপস্থিত হয়। সুতরাং প্রশ্ন আসে যে, এই কষ্ট ও বিপদের সীমা কি? এর উত্তরে আমি বলব যে, এর মধ্যেও বিশেষ সূদ্ধ আলোচনা রয়েছে। তবে তার বর্ণনা বহুবিস্তৃত এবং দীর্ঘ। আমরা তার বিভিন্ন অবস্থা তুলে ধরতে চেষ্টা করব।
দুনিয়ায় মানুষের বহু আশা-আকাঙক্ষার বিষয় আছে। তবে মোটামুটিভাবে সে বিষয়গুলোকে চার ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ (১) জ্ঞানার্জনের আকাঙ্খা। (২) শারীরিক স্বাস্থ্য এবং নিরাপদ নির্বিঘ্নতার আকাঙ্খা। (৩) ধন-সম্পদের আকাঙ্খা। (৪) যশঃ এবং খ্যাতির আকাংক্ষা। জ্ঞানার্জন, স্বাস্থ্যলাভ, ধনার্জন এবং যশঃ ও খ্যাতি এগুলো অন্বেষণের বিষয়বস্তু। যেমন অর্থ-সম্পদ ও স্বর্ণ-রৌপ্য মানুষ তার দখলে রাখতে চায়। তদ্রূপ যশঃ ও খ্যাতি মানুষ তার হৃদয়ের আয়ত্তে রাখতে চায়। ধন-সম্পদ ও স্বর্ণ-রৌপ্য আয়ত্তাধীন থাকলে মানুষের নানাবিধ পার্থিব উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়। তদ্রূপ যশঃ খ্যাতি ও সুনাম দ্বারা মানুষের হৃদয় যদি নিজের আয়ত্তে রাখা যায় তবে তার মাধ্যমেও নানাবিধ উদ্দেশ্য সাধন করা যায়। যশঃ খ্যাতির প্রকৃত অর্থ এবং তার প্রতি মানব স্বভাবের অনুরক্তি আমরা শীঘ্রই যথাস্থানে বর্ণনা করব। উপরোক্ত চারটি বিষয়ের প্রত্যেকটি বিষয় মানুষ নিজের জন্য, আত্মীয়-স্বজনের জন্য বা বিশেষ বন্ধু- বান্ধবের জন্য অন্বেষণ করে। এই চারটি বিষয়ের ব্যাপারে দুটো বিষয় মানুষ ভালবাসে না, তা' হল অর্জিত বিষয় হস্তচ্যুত হওয়া এবং আকাঙিক্ষত বিষয় অর্জিত না হওয়া। যা' অর্জন করা হয় বা দখলে থাকে তা' দখল থেকে চলে গেলে মানুষের মনঃকষ্ট হয় বা তাতে তার ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। কিন্তু যার আকাঙক্ষা করা হয় তা' হস্তগত হতে বিলম্ব হলে মানুষের প্রকৃতপক্ষে কোন অনিষ্ট হয় না। কোন বস্তু অর্জন করা সম্ভব হলেই তা' পাবার জন্য আশা পোষণ করা হয়। যা' অর্জন করা সম্ভব তা' প্রায় অর্জনেরই মত বলা চলে। কাজেই যে বস্তু অর্জন করা সম্ভব তা' চলে যাওয়াও অর্জিত জিনিসটি চলে যাওয়ার ন্যায় হয়।
দু'ভাবে এই কষ্ট উপস্থিত হয়। যেমন যাকে মন্দ কার্যের ব্যাপারে সতর্ক করা হয় তার ভয়। মূলতঃ সৎকার্যে আদেশ ত্যাগ করা এক্ষেত্রে অনুমতি দেয়া যায় না। এর দৃষ্টান্ত উল্লিখিত পার্থিব অনুসন্ধানের চারটি বিষয়ের মধ্যে উল্লেখ করব। প্রথমতঃ জ্ঞানার্জনের ভয়। তার দৃষ্টান্ত এইঃ তুমি যদি শিক্ষকের অন্যায়ের শাসন কর তাহলে সে তোমাকে শিক্ষা দান করবে না বলে তোমার ভয় হয়। দ্বিতীয়তঃ স্বাস্থ্যের ভয়। তা' এই যে, তুমি কোন চিকিৎসকের নিকট গিয়ে তাকে রেশমী বস্ত্র পরিধান করতে দেখে তাকে তা পরিধান করতে নিষেধ করতে ইচ্ছা কর। কিন্তু তোমার ভয় হয় যে, তাহলে সে তোমার চিকিৎসা করবে না। যার ফলে তোমার স্বাস্থ্য ও শরীর নষ্ট হতে পারে। তৃতীয়তঃ ধনের ভয়। যার দৃষ্টান্ত এই যে, তুমি শাসক, প্রশাসক এবং আমীর-উমারাকে উপদেশ দিতে এই ভয়ে বিরত থাক যে, তারা তোমার বৃত্তি, জায়গীর বা অন্য কোনরূপ আর্থিক সুবিধা-সুযোগ বন্ধ করে দেবে এবং তোমার লতি তাদের সাহায্য- সহানুভূতি বজায় থাকবে না। চতুর্থতঃ যশঃ বা খ্যাতির ভয়। তার দৃষ্টান্ত এই যে, যার। তোমার সুনাম-সুখ্যাতি করবে, যাদের মুখে তোমার যশঃ প্রচারিত হবে, তাদেরকে যদি তুমি মন্দ কাজ করতে নিষেধ কর তাতে তোমার এই ভয় হয় যে, তাদের মাধ্যমে তোমার ঐ স্বার্থ বিনষ্ট হয়ে যাবে।
উপরোক্ত কারণসমূহে তুমি অন্যায় শাসন বা পাপের বিরোধিতা না করলে ওয়াজিবের যিম্মা থেকে অব্যাহতি পাবে না। কেননা উল্লিখিত বিষয়গুলোর ব্যাপারে মানুষের মনে প্রকৃত ভয় হয় না। কেবলমাত্র ভবিষ্যতে স্বার্থ নষ্ট হতে পারে এই আশঙ্কাটুকু হয়। তবে যদি, তুমি সত্যিকার অনিষ্টের সম্মুখীন হও এবং তা' থেকে মুক্তি লাভের কোন উপায় না থাকে, তখন কোন অন্যায় হতে দেখে তোমার জন্য নীরব থাকা বৈধ হবে। যেমন যখন তুমি কোন কঠিন রোগে আক্রান্ত হও এবং তোমার চিকিৎসকের একান্ত আবশ্যক হয় আর তার চিকিৎসায় আরোগ্য লাভের দৃঢ় আশা থাকে এমতক্ষেত্রে সে যদি তোমার নিকট রেশমী বস্ত্র পরিধান করে আসে আর তুমি যদি তজ্জন্য তাকে তিরস্কার এবং ভর্ৎসনা কর তবে সে তোমর চিকিৎসায় হয়ত রাজী হবে না। তাতে তোমার অবস্থা সঙ্গীন হয়ে তুমি মৃত্যুর সম্মুখীন হতে পার। এ অবস্থায় তাকে তোমার উপদেশ না দেয়াই উত্তম। যদি তুমি ধর্মের অত্যাবশ্যকীয় বিষয়গুলো না জান এবং তা' শিক্ষা করবার জন্য একজন শিক্ষক মাত্র পাও এবং অন্য কোন শিক্ষকের নিকট যাবার মত তোমার সামর্থ্য না থাকে বা যার অন্যায় শাসন করতে চাও সে সেই শিক্ষকের একান্ত অনুগত ও বাধ্য এবং তার নিকট তোমার পৌঁছার পথ সে বন্ধ করে দিতে পারে। অথচ ধর্মের সে আবশ্যকীয় বিষয়গুল্যে তোমার জন্য জানা ফরজ। আবার মন্দ কাজ দেখে নীরব থাকাও নিষিদ্ধ। এমতাবস্থায় এই দুটো কর্তব্যের মধ্যে কোনটি অধিক জরুরী তা' দেখতে হবে এবং অধিক জরুরী বিষয়টি অবলম্বন করতে হবে। মন্দ বা নিন্দনীয় কাজের পরিমাণ এবং ধর্মীয় বিষয়ের গুরুত্ব দেখে আদেশ-নিষেধ করবার মধ্যে তারতম্য হয়। যদি কাজ অত্যন্ত অশ্লীল হয় তবে উপদেশ দিতে হবে। আর যদি ধর্মের প্রয়োজন অধিক না হয় তাহলে উপদেশ ত্যাগ করতে হবে।
0 Comments