কুরবানী শব্দের ব্যাখ্যা

 কুরবানী শব্দের ব্যাখ্যা

    কুরবানী শব্দটি আরাবী কুরবান শব্দ থেকে গঠিত। আর কুরবান শব্দটি কুরবাতুন শব্দ থেকে উৎপন্ন। আরাবী কুরবাতুন এবং কুরবান উভয় শব্দের শাব্দিক অর্থ নিকটবর্তী হওয়া, কারো নৈকট্যলাভ করা প্রভৃতি। ইসলামী পরিভাষায় কুরবান ঐ বস্তুর নাম যদ্বারা আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভ করা যায়। (মুফরাদা-তে ইমাম রাগিব ৩য় খণ্ড ২৮৭ পৃষ্ঠা, তফসীরে কাশশাফ ১ম খণ্ড ৩৩৩ পৃষ্ঠা, বায়যাডী ১ম খণ্ড ২২২ পৃষ্ঠা)

বর্তমানে আমাদের নিকটে কুরবানীর জানোয়ারকেই বিশেষভাবে কুরবান বলা হয়। (তফসীরে আলমানার ৬ষ্ঠ খণ্ড ৩৪২ পৃষ্ঠা) পরিশেষে ঐ যবহকৃত জন্তুকেই কুরবান বলা হয় যা লোকেরা আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য পেশ করতে থাকে। (তফসীরে মাযহারী ২য় খণ্ড ১৮৮ পৃষ্ঠা)

 ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ উপমহাদেশে কুরবানী বলতে বোঝায় যুলহিজ্জাহ মাসের ১০ম থেকে ১২ই বা ১৩ই তারীখ আসর পর্যন্ত আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে উট, গরু, বকরী, ও ভেড়া প্রভৃতির মধ্য হতে কোন এক জন্তুকে নহর বা যবহ করা।

আমার জ্ঞান মতে আরাবীতে কুরবানী শব্দটি ব্যবহৃত হয়না। তাই কুরআনে কুরবানীর বদলে 'কুরবান' শব্দটি মোট তিন জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন ১. সূরা আলে ইমরানের ১৮৩ নং আয়াতে। حتى يا تينا بقريان ২. সূরা মায়েদার ২৭ নং আয়াতে از تر با قربانا এবং ৩. সূরা আহকা-ফের ২৮ নং আয়াতে

فلولا نصرهم الذين من دون الله قربانا الهة :

-হাদীসেও কুরবানী শব্দটি ব্যবহৃত না হয়ে তার পরিবর্তে উযহিয়্যাহ এবং যাহিয়্যাহ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এই জন্য কুরবানীর ঈদকে ঈদুল আযহা বলা হয়। ফারসী, হিন্দী ও উর্দুতে আরবী কুরবান শব্দটি কুরবানী অর্থে ব্যবহৃত হয়। বাংলার মুসলমানগণও কুরবানী শব্দটির সাথে খুবই পরিচিত। তাই আমি এই বইয়ে কুরবানী শব্দটি ব্যবহার করেছি যাতে জনগণ সহজেই বুঝতে পারে।

পৃথিবীর প্রত্যেক জাতির জন্য কুরবানীর বিধান

    পৃথিবীর ইতিহাসে কুরবানী কবে থেকে চালু হয়েছে জানতে গেলে কুরআন বলে- وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا

لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ অর্থাৎ আল্লাহ বলেন, আমি প্রত্যেক জাতির জন্য কুরবানীর বিধান দিয়েছি যাতে তারা পালিত চতুষ্পদ জন্তুর উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে যা তিনি তাদেরকে খোরাকী স্বরূপ দান করেছেন (সূরা, হজ্জ ৩৪ আয়াত)

উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা নাসাফী ও যামাখশারী বলেন, (হযরত আদম (আ:) থেকে হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সঃ) পর্যন্ত) প্রত্যেক জাতিকে আল্লাহ তাআলা তাঁর নৈকট্য লাভের জন্য কুরবানীর বিধান দিয়েছেন। (তফসীরে নাসাফী ৩য় খণ্ড ৭৯ পৃষ্ঠা ও কাশশাফ ২য় খণ্ড ৩৩ পৃষ্ঠা)

পৃথিবীর সর্বপ্রথম কুরবানী

    কুরআনের ৬ষ্ঠ পারায় সূরা মায়িদার ৮ম রুকুতে পৃথিবীর প্রথম মানুষ হযরত আদম (আঃ)-এর দুই পুত্র কাবীল ও হযরত হাবীলের কুরবানীর বর্ণনা আছে। পৃথিবীর ইতিহাসে ঐটাই প্রথম কুরবানী। তফসীরের বর্ণনায় তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই। মুফাসসিরে কুরআন হযরত ইবনে আব্বাস বলেন, হযরত হাওয়া আলায়হাস সালামের গর্ভে জোড়া জোড়া সন্তান পয়দা হোত। কেবল হযরত শীস (আঃ) ছাড়া। কারণ, তিনি একা ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। সেই সময় আদম (আঃ) একটি জোড়ার মেয়ের সাথে অন্য জোড়ার ছেলের বিয়ে দিতেন। কারণ, তখন যে-জোড়ার সাথে যে মেয়ে জন্মাত সেই জোড়ার ছেলের সাথে ঐ জোড়ার মেয়ের বিয়ে হালাল ছিলনা। অত:পর হাওয়া (আ:) কাবীলের সাথে একটি সুন্দরী মেয়েকে জন্ম দেন যার নাম ইকলীমা এবং হাবীলের সাথে এমন একটি মেয়ে জন্ম দেন যে ইকলীমার এত ছিলনা। ঐ মেয়েটির নাম লিযূয়া। অতঃপর আদম (আঃ) যখন ক্ত দুই জোড়ার বিয়ে দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন তখন কাবীল বলে, আমি আমার ভুড়ি বোনের হকদার বেশি। তথাপি আদম আঃ তাকে তাঁর নির্দেশ মানতে বললেন। কিন্তু সে মানলোনা। এবার তিনি তাকে বকাঝকা করলেন। তবুও সে ঐ বকাঝকায় কান দিলনা। অতঃপর তাঁরা সবাই কুরবানী দেবার ব্যাপারে একমত হলেন।

    তাঁদের কুরবানীর পদ্ধতি সম্পর্কে আল্লামা আবু আলী আলফারসী বলেন, কাবীল ছিলেন চাষী। তাই তিনি গমের শীষ থেকে ভাল ভাল মালগুলো বের কোরে নিয়ে বাজে মালগুলোর একটি আঁটি কুরবানীর জন্য পেশ করেন। আর হাবীল ছিলেন পশুপালনকারী। তাই তিনি তাঁর জন্তুর মধ্য থেকে সব চেয়ে সেরা একটি দুম্বা কুরবানীর জন্য পেশ করেন। অতঃপর হাবীলের জন্তুটি আসমানে তুলে নেওয়া হয়। যা সেখানে চরতে থাকে! পরিশেষে ঐ দুম্বাটি দিয়ে হযরত ইসমায়ীল যবীহ আলায়হিস সালামকে বাঁচিয়ে নেওয়া হয়। পূর্ববর্তী আলেমদের একটি দল একথা বলেন। কিন্তু কেউ কেউ বলেন, আসমান থেকে আগুন অবতীর্ণ হয় এবং 'হাবীলের কুরবানীটি জ্বালিয়ে দেয়। (তফসীর ইবনে কাসীর, দুররে মনসূর, ফতহুল বায়ান, ৩য় খণ্ড ৪৫ পৃষ্ঠা ও ফতহুল কাদীর ২য় খণ্ড ২৮ ও ২৯ পৃষ্ঠা)

     হযরত আদম আলায়হিস সালামের যুগে তাঁরই পুত্র কাবীল ও হাবীলের কুরবানীর পর থেকে হযরত ইবরাহীম আলায়হিস সালাম পর্যন্ত কুরবানী চলতে থাকে। সূরা হজ্জের ৩৪ নং আয়াতটি ওর প্রতি ইঙ্গিত করে। তবে ঐসব কুরবানীর কোন বর্ণনা কোন গ্রন্থে পাওয়া যায়না। তাই ঐসব কুরবানীর বিবরণ এখানে দেওয়া গেলনা। বর্তমানে আমাদের উম্মতে মুহাম্মাদীর মধ্যে যে কুরবানী চালু আছে তার সম্পর্ক হযরত ইবরাহীম আলায়হিস সালামের নিজপুত্র ইসমাইলকে কুরবানী করার সাথে সংশ্লিষ্ট। তাই তার বর্ণনা নিয়ে বিবৃত হল।

Post a Comment

0 Comments