জানোয়ারের গুণাবলী
কুরবানীর জানোয়ার সাধ্যমত মোটাতাজা, সাইজে বড়সড় ও নিখুঁত হওয়া চাই। হাফিয ইবনে আবী হাতেম বলেন, কুরআনের ১৭ পারার সুরা হজ্জের ৩২ নং আয়াত و من يعظم شعائر الله
(অমাঁই ইয়োআযযিম্ শাআ'-য়িরাল্লাহ) এর ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত আছে যে, "শাআ-য়ির” এর ভাবার্থ মোটাতাজা ও পছন্দনীয় জন্ত। (তফসীর ইবনে কাসীর, ৩য় খণ্ড, ২২০ পৃষ্ঠা)। ইমাম বুখারী 'আলবুদন' এর ব্যাখ্যার মুজাহিদ থেকে বর্ণনা কোরে বলেছেন যে, বুদন হল মোটাতাজা জানোয়ার। এর সমর্থনে আবুল আস্ম্মদ আনসারীর পিতা থেকে একটি মরুফু হাদীসে রসূলুল্লাহ (স:) বলেন, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে পছন্দনীয় কুরবানী সাইজে উঁচু ও মোটাসোটা জানোয়ার। (তালখীসুল হাবীর, ৩৮৫ পৃষ্ঠা)। সেই জন্য রসূলুল্লাহ (স:) যখন কুরবানী করতেন তখন দুটো মোটাতাজা বড়সড়, শিংওলা ছিটফুট দুম্বা কিনতেন। (ইবনে মাজা ২৩২ পৃষ্ঠা)। নবীজীর এই আদর্শকে সামনে রেখে সাহাবীরাও ঐরূপ করতেন। তাই আবু উমামাহ ইবনে সহল সাহাবী বলেন, আমরা মদীনাতে কুরবানীর পশুকে খাইয়ে মোটা করতাম এবং অন্যান্য মুসলমানরাও তাই করতো। (বুখারী ২য় খণ্ড, ৮৩৩ পৃষ্ঠা)।
এই প্রসঙ্গে একথাটা মনে রাখবেন যে, আমাদের দেশে রটে আছে- 'কুরবানীর জানোয়ার কিয়ামতের দিনে পুলসিরাতে সওয়ারীর কাজ দেবে'- কথাটা ঠিক নয়। কারণ, ঐ ব্যাপারে এই বর্ণনা-'তোমরা তোমাদের কুরবানীর জানোয়ারকে মোটাসোটা কর। কারণ, উহা পুলসিরাতে তোমাদের বাহন হবে' কথাটি নকল করার পর জাল হাদীসের নাড়ীবিদ হাফিয ইবনে হাজার আস্কালানী বলেন, আমি হাদীসটি কোথাও দেখিনি। আর এক মুহাদ্দিস কুল শিরোমনি হাফিয ইবনুস সলা-হ্ বলেন, হাদীসটি অপরিচিত এবং আমার জ্ঞানমতে অপ্রামাণ্য। ইবনুল আরাবী তিরমিযীর ভাষ্যে একথা বলে ইঙ্গিত করেছেন যে, কুরবানীর জানোয়ারের ফযীলতে কোন সহী হাদীসই নেই। যার মধ্যে একটি হল এই কথা যে, ওটা তোমাদের বাহন হবে জান্নাতে যাবার। ইমাম দাইলামী মুসনাদে ফিরদাওসে আবু হুরাইরা থেকে মরফুভাবে ঐ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। কিন্তু ওর একটি রাবী ইয়াহ্ইয়া অত্যন্ত দূর্বল। (তালখীসুল হাবীর, ৩৮৪ পৃষ্ঠা)। সুতরাং হাদীসটি অতি যয়ীফ, ফলে পরিত্যাজ্য।
সেজন্য অধিকাংশ আলেম ও চার ইমামের মতে তিওয়ালা ভেড়া পাওয়া যাক বা না যাক উভয় অবস্থাতে দাঁত না-ওঠা এক বছরের কম বয়েসী মোটাতাজা ভেড়া কুরবানী করা জায়েয। কিন্তু উট, গরু ও বকরীর দাঁত না উঠলে ওদের 'জাযা' কুরবানী কারো মতে জায়েয নয় (মিরআত ২য় খণ্ড, ৩৫৩ পৃষ্ঠা)।
দুম্বা ও ভেড়ার জাযার ব্যাখ্যা
এবার কথা হল, ভেড়ার 'জাযা' বলতে কয় মাসের ভেড়া বোঝায়। এ ব্যাপারেও নানা মুনির নানা মত। হানাফী ফকীহদের মতে ভেড়ার 'জাযা' হল-যার বয়স ছ'মাস পুরো হয়েছে (আততা'লীকুল মুমাজজাদ, ২৮০ পৃষ্ঠা)। হাম্বালীদের মতও তাই। শাফিয়ী ও ভাষাবিদদের মতে-যার বয়স এক বছর পার হোয়ে দ্বিতীয় বছরে পড়েছে। ইমাম ইবনে হায্য মুহাল্লার ৭ম খণ্ডের ৩৬১ পৃষ্ঠায় বলেছেন, যে-পশু এক বছর পার কোরে দ্বিতীয় বছরে পড়েছে এবং দ্বিতীয় বছর পুরো না হওয়া পর্যন্ত সে 'জাযা'। কাসায়ী, আসমায়ী ও আবু উবায়দ প্রমুখ ভাষাবিদরাও এইরূপ বলেন। পাকিস্তানের অনন্য মুহাদ্দিস আল্লামা আতাউল্লাহ হানীফ ভুজয়্যানী বলেন, আমার নিকট প্রাধান্যযোগ্য মত হল, এক বছরের কম বয়েসী দুম্বা কুরবানী করা যথেষ্ট নয়। কারণ, 'জাযা'র ব্যাখ্যায় ভাষাবিদদের মতটাই সঠিক ও উত্তম এবং ফকীহদের মত ঠিক নয় (আত্মা'লীকা-তুস সালাফিয়্যাহ আলান নাসায়ী, ২য় খণ্ড, ১৯৬ পৃষ্ঠা)।
কুরবানীর জানোয়ারের উর্দ্ধ বয়স সম্পর্কে ইসলামী শরীআতে কোন বাঁধাধরা বয়স নেই। ঐ ব্যাপারে এতটুকু বলা হয়েছে যে, কুরবানীর জানোয়ার এত বুড়ো যেন না হয় যার নড়ার শক্তি নেই। সুতরাং উক্ত আলোচনার ভিত্তিতে একথা পরিষ্কার বোঝা যায় যে, উট-উটনী কুরবানী করতে চাইলে তার বয়স ছয় থেকে চোদ্দ-পনের হওয়া অতি উত্তম। গরু ও ষাঁড় হলে তার বয়স তিন থেকে নয়-দশ হওয়া
উত্তম। বকরী ও পাঁঠা এবং ভেড়া-ভেড়ী ও দুম্বা হলে তার বয়স দুই থেকে আট-দশ হওয়া শ্রেয়। চোদ্দ বছরের বুড়ো গরু কুরবানী করা শরীআত সম্মত নয়।
ইমাম শাফিয়ী (রহঃ) বলেন, সংখ্যায় বেশী হওয়ার চেয়ে দামে বেশী হওয়াটা আমার কাছে পছন্দনীয় এবং চর্বি বেশী হওয়ার চেয়ে গোল্ড বেশী হওয়াটা উত্তম। তবে ঐ গোল্ড যেন খেতে বিস্বাদ না হয় (কিতাবুল উম্ম, ২য় খণ্ড, ১৮৯ পৃষ্ঠা ও রওযাতুত ত-লিবীন, ৩য় খণ্ড, ১৯৭ পৃষ্ঠা)।
জানোয়ারের দোষাবলী
বিভিন্ন হাদীস একত্রিত কোরলে জানোয়ারের আট রকম দোষ পাওয়া যায়, যা কোন জানোয়ারে থাকলে তা কুরবানী করা জায়েয নয়। একদা রসূলুল্লাহকে (স:) জিজ্ঞেস করা হয় যে, কুরবানীর ব্যাপারে কি কি বিষয়ে পরহেয করতে হবে? উত্তরে তিনি হাত দিয়ে এশারা কোরে বললেন, ৪টি দোষ-১। স্পষ্ট খোঁড়া, ২। স্পষ্ট কানা, ৩। স্পষ্ট রোগী, ৪। এমন রোগা পাতলা ও বুড়ো যার হাড়ে সার নেই (সুনানে আরবাআ, দারিমী ২য় খণ্ড, ৪র্থ পৃষ্ঠা, মালিক, আহমাদ, মিশকাত, ১২৮ পৃষ্ঠা)।
হযরত আলী বলেন, আমাদেরকে রসূলুল্লাহ (স:) নিখুঁত চোখ ও কানওয়ালা জন্তু ভাল কোরে দেখে নিতে হুকুম দেন এবং সামনে ও পিছনের দিক থেকে কান কাটা আর লম্বা ও চওড়ায় কানফাটা জানোয়ার কুরবানী করতে মানা করেন (সুনানে আরবাআ, আহমাদ, ইবনে হিব্বান, হাকিম, বুলুগুল মারাম ১০২ পৃষ্ঠা)। হযরত আলী বলেন, রসূলুল্লাহ (স:) শিং ভাঙা ও কান কাটা জানোয়ার কুরবানী করতে নিষেধ করেছেন (ইবনে মাজা, মিশকাত ১২৮ পৃষ্ঠা)।
মুসনাদে আহমাদ, নাসায়ী ও ইবনে মাজার রিওয়ায়াতে জাদআ বা নাক কাটা দোষেরও উল্লেখ আছে এবং তিরমিযীর বর্ণনায় কান-ছেঁদা দোষের কথা আছে। ইবনে জামাআহ বলেন, চার মযহাবের মতে কান-ফাটা ও কান-ছেঁদা জানোয়ার কুরবানী চলতে পারে।
এর প্রতিবাদে আল্লামা উবায়দুল্লাহ রহমানী বলেন, আমি এমন কোন দলীল পাইনি, যদ্বারা এটা প্রমাণিত হয় যে, কান-ফাটা ও ছেদার নিষেধাজ্ঞা মানতে হবেনা। তাই প্রাধান্যযোগ্য মত এই যে, যে-বকরীর কান সামান্য কাটা আছে, অথবা লম্বায় ফাটা আছে, কিংবা ছেঁদা আছে তার কুরবানী বৈধ নয়। ইমাম ইবনে রুশদ বলেন, যদি কোন জন্তুর দুটি কান জন্মগতভাবে না হয়ে থাকে তাহলে ইমাম মালিক ও ইমাম শাফিয়ী বলেন, তার কুরবানী জায়েয নয়। কিন্তু ইমাম আবু হানীফার মতে তা জায়েয (মিরআত, ২য় খণ্ড, ৩৫৯ পৃষ্ঠা, বিদায়াতুল মুজতাহিদ ১ম খণ্ড, ৪১৯ পৃষ্ঠা, রওযাতুত তা-লিবীন, ৩য় খণ্ড, ১৯৬ পৃষ্ঠা)।
ইমাম আবু হানীফা, শাফিয়ী ও অধিকাংশ আলিমের মতে শিং ভাঙা জন্তুর কুরবানী বৈধ। ঐ শিং যতটাই ভাঙা হোক না কেন। কিন্তু ইতিপূর্বে আলী বর্ণিত ইবনে মাজার হাদীসটি প্রমাণ করে যে, অর্ধেক ও তার বেশী শিং ভাঙা এবং অর্ধেক ও তার বেশী কান কাটা পশুর কুরবানী বৈধ নয় (নাইলুল আওতার ৪র্থ খণ্ড, ৩৪৮ পৃষ্ঠা)। যদি কোন জন্তুর জন্মগতভাবে শিং না উঠে থাকে এবং লেজও না থাকে তাহলে তা কুরবানী করা জায়েয। যে জন্তুর দাঁত কিছুটা ভেঙে গেছে তার সম্পর্কে কাযী হুসায়ন (রহ:) ইমাম শাফিয়ী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, এ ব্যাপারে নবী (স:) থেকে কোন নিষেধাজ্ঞা বর্ণিত নেই।
তাবারানী আওসাতে ও হাকিমে একটি যয়ীফ হাদীসে আছে, যদি কোন জন্তুর পালান ও পাছার গোস্ত কেটে নেওয়া হয় তাহলে তার কুরাবানী বৈধ নয়। তবে হাঁ, কোন জানোয়ার নিখুঁত কেনার পরে, যদি তাতে কোন খুঁত হোয়ে যায় তাহলে তাতে কোন আপত্তি নেই। কারণ, হযরত আবু সায়ীদ বলেন, একদা কুরবানী দেবার জন্য আমি একটা দুম্বা কিনি। তারপর একটি নেকড়ে বাঘ তার উপরে হামলা কোরে তার পাছার কিছু গোস্ত কামড়ে নিয়ে পালায়। তাই আমি ঐ ব্যাপারে নবী (সঃ) কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, ঐটাই কুরবানী কর (ইবনে মাজা, আহমাদ, বায়হাকী)।
ইমাম আহমাদ, ইমাম মালিক ও ইমাম শাফিয়ীদের (রহমাতুল্লাহে আলায়হিম) মত তাই। ইমাম নবভী লিখেছেন, কোন জন্তুর চুলকানী-রোগ সম্পর্কে অধিকাংশ আলিম বলেন, তা বেশী হোক কিংবা কম, ঐ জানোয়ার কুরাবানী করা ঠিক নয়। কারণ, ইহা গোল্ড ও শিরাকে বিগড়ে দেয় (মিরআত, ২য় খণ্ড, ৩৬১ পৃষ্ঠা, রওয়াতুত তা-লিবীন, ৩য় খণ্ড, ১৯৪ পৃষ্ঠা)।
যদি কোন জানোয়ার বুড়ো হওয়ার ফলে তার পালান শুকিয়ে যায় তাহলে সে অস্থিসার শূন্যের পর্যায় পড়ার কারণে কুরবানীর অযোগ্য হবে। আর ইখতিয়া-রা-তে ফিহিয়্যাহ গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, যদি কোন জন্তুর কিছু দাঁত পড়ে যায় তাহলেও তার কুরবানী বৈধ হবে (আস্টিলাহ অভিবাতুল ফিহিয়্যাহ, ৩য় খণ্ড, ১০ ও ১১ পৃষ্ঠা)। বাজারে যদি নিখুঁত জন্তু পাওয়া যায় তাহলে খুঁতওয়ালা সস্তা জানোয়ার কিনে কুরবানী দেওয়া সিদ্ধ নয়।
0 Comments