পশু গাভিন হওয়া দোষ কি

 গাভিন হওয়া দোষ কি

        এই উপমহাদেশে একথা রটে আছে যে, গাভিন জন্তুর কুরবানী চলেনা। কিন্তু এই রটনার প্রমাণে কুরআন ও হাদীস থেকে কোন দলীল পাওয়া যায় না। বরং হাদীস দ্বারা বোঝা যায় যে, গাভিন জন্তু এবং সদ্য বাচ্চা হওয়া জন্তু কুরবানী করতে কোন আপত্তি নেই। যেমন হযরত আবু সায়ীদ খুদরী(রাঃ) বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ(সঃ)! আমরা নহর করি এবং গরু ও বকরী যবহ করি। অতঃপর তাদের পেট থেকে বাচ্চা পাই। সেটা আমরা ফেলে দেব, না খাব? তিনি বললেন, যদি তোমরা চাও তাহলে খাও। কারণ, তার যবাহ তার মায়ের যবহের মত (আবু দাউদ, ২য় খণ্ড, ৩৫ পৃষ্ঠা, মিশকাত ৩৫৭ পৃষ্ঠা)। এই হাদীস প্রমাণ করে যে, গাভিন গরু যবহ করতে মানা নেই এবং কারো রুচিতে না বাধলে সে যবহ করা গাভিন জন্তুর বাচ্চা খেতে পারে।

        হযরত আলী (রাঃ) বলেন, গরু সাতজনের তরফ থেকে হাদীসটির একজন রাবী হুজাইয়্যা ইবনে আদী বলেন, একদা আমি হযরত আলীকে জিজ্ঞেস করলাম, ঐ গরু যদি বাচ্চা দিয়ে দেয় তাহলে? তিনি বলেন, তাহলে ঐ বাচ্চাকে ওর মায়ের সাথে যবৃহ কর (তিরমিযী, ১ম খণ্ড, ১৮১ পৃষ্ঠা)। একজন লোক একটি গরু কুরবানীর জন্য কেনে। অতঃপর গরুটির বাচ্চা হোয়ে পড়ে। লোকটি হযরত আলীকে জিজ্ঞেস করলেন, এর জায়গায় অন্য জানোয়ার বদলে নেব না কি? তিনি বললেন, না। বরং একে এবং এর বাচ্চাকে ইয়াওমুন নাহরে (কুরবানীর দিনে) সাত জনের তরফ থেকে যবহ কর (তাহাবী, ২য় খণ্ড, ২৫১ পৃষ্ঠা)। অন্য এক বর্ণনায় আছে, মুগীরাহ বলেন, আমরা হযরত আলীর সাথে রুহ্হ্বা নামক জায়গাতে ছিলাম। অতঃপর একজন লোক হামদান থেকে একটি গরুকে বাছুরসহ হাঁকিয়ে আনলো। তারপর সে হযরত আলীকে বললো, আমি এই গরুটি কুরবানী করার জন্য কিনেছি। এর বাচ্চা হোয়ে পড়েছে। এখন কি করব? তিনি বললেন, বাছুরটি দুধ খাবার পর যে দুধ বাঁচবে তা তুমি খেতে পার। অতঃপর যখন কুরবানীর দিন আসবে তখন একে এবং এর বাছুরকে সাতজনের তরফ থেকে যবহ কর (বাইহাকী, তালখীসুল হাবীর, ৩৮৭ পৃষ্ঠা)। ইবনে আবী হাতিম ইলাল গ্রন্থে হাদীসটি উল্লেখ করেছেন এবং মুহাদ্দিস আবু আওয়া-না হাদীসটিকে সহী বলেছেন। উপরোক্ত ৪টি হাদীস প্রমাণ করে যে, গাভিন গরু কুরবানী করতে শরীআতে মানা নেই এবং কুরবানীর জন্য কেনা জন্তু যদি দুধ দেয়, তাহলে বাছুরের দুধ খাওয়ার পর বাঁচাও দুধ খেতে আপত্তি নেই।

        যদি কোন জন্তুর বাচ্চা না থাকে এবং সে দুধও দেয় তাহলে ঐ দুধও খাওয়া যেতে পারে। কিন্তু ইমাম আবু হানীফা (রঃ)বলেন, দুধ দোওয়া যাবেনা, বরং তার পালানে পানি ছিটিয়ে দিতে হবে, যাতে তার দুধ শুকিয়ে যায়। তেমনি তিনি আরো বলেন, কুরবানীর জানোয়ারের বাচ্চা হলে তাকে যবহ না কোরে জ্যান্ত বাচ্চা মিসকীনদের দিয়ে দিতে হবে। আর বাচ্চাটি যদি মায়ের সাথে যবহ হোয়ে যায় তাহলে ঐ যবহকৃত বাচ্চাটি মিসকীনদের দান করতে হবে। ইমাম আবু হানীফার (রহ:) এই ফতওয়া কিয়াস ও অনুমান ভিত্তিক, হাদীস ভিত্তিক নয়।

        ফলকথা উটনী, গরু, বকরী ও ভেড়ার গাভিন হওয়াটা শরীআতের দৃষ্টিতে দোষ নয়। যদিও আমাদের দেশের অনেকের বিবেকে তা বাধে। কিন্তু একথা মনে রাখবেন যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আইনের কাছে বিবেক খাটে না। তাই হানাফী জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলিম মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ:) জওহারাতুন নাইয়িরাহ ২য় খণ্ড, ২৫৩ পৃষ্ঠার বরাত দিয়ে লিখেছেন: গাভিন জন্তুর কুরবানী জায়েয। যদি তার বাচ্চা জ্যান্ত বের হয় তাহলে তাকেও যবহ করতে হবে। দেওবন্দের মুফতীয়ে আযম মাওলানা মুহাম্মাদ শফী (রহ:) বাদায়িত্ গ্রন্থের হাওয়ালা দিয়ে ঐ ফতওয়াই দিয়েছেন (বেহেস্তী যেওর, ৩য় খণ্ড, ৪২ পৃষ্ঠা ৪৩ নং মসলা ও জওয়া-হিরুল ফিক্‌হ্ন ১ম খণ্ড, ৪৫১ পৃষ্ঠা)।

        ইমাম নবভী বলেন, যদি কোন জানোয়ারের পালান ও পাছার গোল্ড জন্মগতভাবে না থাকে তাহলেও তার কুরবানী বৈধ (রওযাতুত ত-লিবীন, ৩য় খণ্ড, ১৯৬ পৃষ্ঠা)।

খাসী হওয়া খুঁত কি

        কোন নর জন্তুর অণ্ডকোষ বের কোরে দিলে তাকে খাসী বলা হয়। মানুষের জন্য এই খাসী হওয়াটা হারাম বলা হয়েছে। যেমন হযরত উসমান ইবনে মাযউন খাসী হতে চাইলে, রসূলুল্লাহ (স:) বলেন, যে ব্যক্তি খাসী হয় সে আমাদের মধ্যে নয়। (শারহুস সুন্নাহ, মিশকাত, ৬৯ পৃষ্ঠা)। অর্থাৎ সে মুসলমানই নয়। কিন্তু জন্তুদের যাসী করার ব্যাপারে কুরআনে ও হাদীসে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। ইমাম নবতী ও ইমাম বাগাভী বলেন, যে জন্তুর গোস্ত খাওয়া হয়না তাকে খাসী করা হারাম এবং যার গোল্ড খাওয়া হালাল তাকে ছোট বেলায় খাসী করা জায়েজ, বড় বেলায় নয়।

        আল্লামা কুরতবী বলেন, কোন লাভের জন্য যেমন গোশ্ত সুস্বাদু করা অথবা কোন বিপদ দূর করার জন্য কোন জন্তুকে খাসী করা জায়েয। সচরাচর দেখা যায় যে, পাঁঠা ও ষাঁড়ের গা থেকে বিশ্রি দূর্গন্ধ বের হয়। কিন্তু ওদেরকে খাসী করলে ঐ দূর্গন্ধ দূর হোয়ে যায় এবং ওদের গোশুও খেতে সুস্বাদু মনে হয়। সুতরাং খাসী হওয়াটা খুঁত নয়। (ফাতহুল বারী, ১০ম খণ্ড, ৭ পৃষ্ঠা)। নর জন্তুর ঐ দূর্গন্ধের কারণে মনে হয় রসূলুল্লাহ (স:) যাকাতে নর জন্তু দান করতে মানা করেছেন। তিনি বলেন, যাকাতে বুড়ো জানোয়ার ও দোষওয়ালা পশু এবং নর জন্তু যেন না দেওয়া হয়। (বুখারী ১৯৬ পৃষ্ঠা)।

         এই হাদীসটির ব্যাখ্যায় আল্লামা কাসতালানী ও ইমাম নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান (রহিমাহুমাল্লাহ) সূরা বাকারার ২৬৭ নং আয়াত পেশ কোরে বলেন, ঐ আয়াতে আল্লাহ বলেন, তোমরা দান করা বস্তুর মধ্যে 'খবীস' বা অরুচিকর জিনিষ দেবার ইচ্ছাই কোরনা। (কাসতালানী ৩য় খণ্ড, ও আওনুল বারী, ৪র্থ খণ্ড, ৫১ পৃষ্ঠা)। বুখারী শরীফের উক্ত দুই ভাষ্যকারের ব্যাখ্যা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, পাঁঠা ও ষাঁড় প্রভৃতি নরজন্ত রসূলুল্লাহ (স:) এর কাছে অরুচিকর খাদ্যের মধ্যে গন্য ছিল। যদিও ঐগুলো খাওয়া এবং ওদের কুরবানী করা হালাল। সেইজন্য নবী (সঃ) প্রায়ই খাসী-ভেড়া যবহ করতেন। যেমন হযরত জাবির বলেন, একবার নাবী (স:) যবহের দিনে (অর্থাৎ কুরবানীর দিনে) শিংওলা ছিটফুট দুটি খাসী-ভেড়া যবহ করেন। (আহমদ, আবু দাউদ, ইবনে মাজা, দারিমী, ২য় খণ্ড, ৩য় পৃষ্ঠা, মিশকাত, ১২৮ পৃষ্ঠা)।

        অন্য বর্ণনায় হযরত আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত আছে যে, রসূলুল্লাহ (স:) যখনই কুরবানী করার ইচ্ছা করতেন তখন শিংওয়ালা মোটাতাজা বড়সড় দুটি ছিটফুট দুম্বার খাসী কিনতেন। অতঃপর একটি তাঁর সেইসব উম্মতের তরফ থেকে যবহ করতেন যারা আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষী দিয়েছে এবং যারা তাঁর রসূল হবার সাক্ষী দিয়েছে। আর দ্বিতীয় জানোয়ারটি তিনি তাঁর নিজের এবং পরিবারবর্গের তরফ থেকে যবহ করতেন। (ইবনে মাজা, ২৩২ পৃষ্ঠা)। এই হাদীসটিতে একটি শব্দ 'কা-না' )گان( আছে এবং তার সাথে 'ইযা' )151( অব্যয়ের যোগ আছে। যাদের একত্রে যোগ হলে আরাবী ব্যাকরণ অনুযায়ী কোন কাজ একবার নয়, বরং তা বারবার করা বোঝায়। যাকে বাংলা ভাষায় 'প্রায়ই' শব্দটি দিয়ে বোঝানো হয়। খাসি কুরবানীর ব্যাপারে বহু সাহাবী থেকে বিভিন্ন হাদীস পাওয়া যায়। যেমন হযরত আয়েশা, আবু হুরাইরা, আবু রাফে ও আবুদ দারদা প্রমুখের রিওয়ায়াত সমুহ। যেগুলোকে হাফিয যায়লায়ী হানাফী নাসবুর রা-য়ার ৪র্থ খণ্ড, ২১৫/২১৬ পৃষ্ঠায় এবং হাফেয ইবনে হাজার আদ্দদ্দিরায়ার ৩২৬ পৃষ্ঠা ও তালখীসুল হাবীরের ৩৮৫ পৃষ্ঠায় সন্নিবিষ্ট করেছেন। (মিরআত, ২য় খণ্ড, ৩৫৮ পৃষ্ঠা)।

        কুরআনের সূরা নিসার ১১৯ নং আয়াত-ফলাইয়োগাইয়েরোন্না খাল্কাল্লাহ- এর তফসীরে কেউ কেউ 'খাসী করা' ভাবার্থ নিয়েছেন। কিন্তু ঐ তফসীরে রসূলুল্লাহ থেকে বর্ণিত নয়। সুতরাং খাসীকে 'মুসলাহ' বা অঙ্গ বিকৃত বলা ভিত্তিহীন। খাসী যদি বিকলাঙ্গ ও খুঁত হোত তাহলে আল্লাহর রসূল প্রায়ই খাসীর কুরবানী করতেন না। (ফাতাওয়া নাযীরিয়‍্যাহ, ২য় খণ্ড, ৪৬৫ পৃষ্ঠা)।

Post a Comment

0 Comments