কুরবানীর উত্তম দিন ১০ই যুলহিজ্জাহ
চান্দ্র বৎসরের শেষ মাসের নাম যুলহিজ্জাহ। এই মাসের ১০ম তারীখকে আরাবীতে ইয়াঙ্গুন নাহ্র বলে। আরাবী নাহ্র শব্দের অর্থ সীনা বা বুক। উটের সীনায় বিশেষ প্রক্রিয়ায় খঞ্জরের খোঁচা মেরে রক্তপাত কোরে উট বধ করাকে ইসলামী পরিভাষায় 'নাহ্বর' বলে। ব্যাপক অর্থে নাহ্র শব্দের অর্থে যব্হও বোঝায়। যেমন মুঅত্তা ইমাম মালিকের ১৮৮ পৃষ্ঠায় একটি হাদীসে উট ও গরু উভয়কে বধ করার ব্যাপারে 'নাহর' শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যদিও গরুকে যবহ করা হয়। নাহর করা হয় না।
এই ইয়াখুন নাহরের ফযীলত ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (স:) বলেন, ইয়ামুন নাহরে আদম সন্তান যত কাজ করে তন্মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় কাজ (কুরবানীর জানোয়ারের) রক্তপাত। ঐ জানোয়ার তার শিং, পশম ও খুরসহ কিয়ামতের দিনে নিশ্চয়ই হাযির হবে। তার ঐ খুন যমীনে পড়ার আগেই আল্লাহর কাছে তা মর্যাদার স্থানে পৌঁছে যায়। অতএব তোমরা কুরবানী দ্বারা নিজের মনকে তৃপ্ত কর (তিরমিযী, ইবনে মাজা, মিশকাত ১২৮ পৃষ্ঠা)।
এই হাদীসের ভিত্তিতে মিশকাতের ব্যাখ্যাকার আল্লামা মোল্লা আলী কারী বলেন, প্রত্যেক দিন কোন না কোন ইবাদতের জন্য খাস। তেমনি ইয়াঙ্গুন নারকে সেই বিশেষ ইবাদতের জন্য বিশেষিত করা হয়েছে যে-ইবাদত হযরত ইবরাহীম (আ:) করে ছিলেন। অর্থাৎ কুরবানী ও তকবীর পাঠ। মানুষের মুক্তিপণ হিসেবে ভেড়া যবহের চেয়ে কোন জিনিস যদি উত্তম হোত তাহলে ভেড়া যবহের বিনিময়ে হযরত ইসমায়ীল (আ:) এর মুক্তিপণ হোত না (মিরকাত, ২য় খণ্ড, ২৬৭ পৃষ্ঠা)।
উক্ত হাদীস প্রমাণ করে যে, ১০ই যুলহিজ্জাহ ইয়াঙ্গুন নাহরে কুরবানী করার সওয়াব বেশী। যদিও তা ১১ই, ১২ই ও ১৩ই যুলহিজ্জাহ পর্যন্ত বৈধ। এই কারণেই মনে হয় একবার রসূলুল্লাহ (স:) নিজে ৬৩টি এবং হযরত আলীকে দিয়ে ৩৭টি, মোট একশো উট ইয়াওমুন নাহরেই কুরবানী করেছিলেন (মুসলিম ১ম খণ্ড, ৩৯৯ পৃষ্ঠা)। যদিও তিনি একশো উটকে মাত্র একদিনে কুরবানী কোরে হয়রান ও পেরেশান না হোয়ে পরের দু-তিন দিনেও ধীরেসুস্থে কুরবানী করতে পারতেন। যেমন তাঁর অনেক উম্মত কোরে থাকে। তাই হানাফী ফকীহ্রাও বলেন, প্রথম দিন উত্তম এবং পরের দিনগুলো অনুত্তম (ফাতাওয়া আলমগীরী, ৪র্থ খণ্ড, ৭৮ পৃষ্ঠা)।
রাতে কুরবানী অপছন্দনীয়
তাবারানী কাবীরের একটি যয়ীফ হাদীসে এবং বায়হাকীর একটি হাদীসে নবী (স:) রাতে কুরবানী করতে নিষেধ করেছেন (তালখীসুল হাবীর, ৩৮৫ পৃষ্ঠা)। উক্ত হাদীসের ভিত্তিতে ইমাম মালিকের ফাওয়ায় রাতে কুরবানী নাজায়েয ও অবৈধ। এই ফাওয়া সম্পর্কে ইমাম ইবনে হায্য বলেন, ইমাম মালিকের আগে আমি কোন সালাফ বা পূর্ববর্তী মনীষীকে রাতে কুরবানী নাজায়েয বলতে পাইনি (আল-মুহাল্লা, ৭ম খণ্ড, ৩৭৯ পৃষ্ঠা)।
উক্ত হাদীসগুলো যয়ীফ বলে হানাফী ও শাফিয়ীদের ফতওয়ায় রাতে কুরবানী জায়েয হলেও তা না করাই শ্রেয়। কারণ স্বরূপ হানাফী ফিক্হ 'আল জওহারাতুন নাইয়িরাহ্'-তে বলা হয়েছে যে, রাতে কুরবানী করলে জানোয়ারের সব শিরাগুলো কাটা নাও হতে পারে। ইমাম শাফিয়ী বলেন, কুরবানীর গোস্ত গ্রহণকারীরা রাতের কারণে বঞ্চিত হতে পারে। তাই দিনে কুরবানী শ্রেয় (ফাতাওয়া আলমগীরী, ৪৭ খণ্ড, ৭৯ পৃষ্ঠা ও কিতাবুল উম্ম, ২য় খণ্ড, ১৮৮ পৃষ্ঠা)।
কুরবানীর জানোয়ার কি কি
কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আট রকম জন্তু দ্বারা কুরবানী করা যায়। হযরত আলী (রাযিঃ) কুরআনের ৪টি আয়াতের সমন্বয়ে উক্ত আট রকম জানোয়ারের মসলা প্রমাণ করেছেন। আয়াতগুলো এই: সুরায়ে মায়িদার প্রথম আয়াতে আল্লাহ বলেন: أحلت لكم بهيمة الانعام তমাদের জন্য পালিত জন্ত হালাল করা হয়েছে। সূরায়ে হজ্জের ৩৪ আয়াতে আল্লাহ বলেন: وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا
لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ
আর প্রত্যেক জাতির জন্য আমি কুরবানীর নিয়মকানুন নির্দিষ্ট কোরে দিয়েছি, যাতে তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে ঐ পালিত জন্তু যবহ করার সময় যা তিনি তাদেরকে (খোরাকী স্বরূপ) দান করেছেন। এই আয়াতটিতে কুরবানীর জন্য 'বাহীমাতুল আনআ-ম' বা পালিত জন্তুর কথা আল্লাহ বলেছেন। ফলে প্রশ্ন ওঠে যে, ঐ পালিত জন্তু কি কি? তার জওয়াবে সূরায়ে আনআ-মের ১৪২ আয়াতে আল্লাহ ومن الانعام حمولة وفرشا কিছু রয়েছে মোটবাহী এবং কিছু আছে ভূতলশায়ী। অতঃপর পরের আয়াতটিতে তিনি বলেন, ঐ পশুগুলো আট রকম ومن الفنان نین ومن المعز اثنين দুম্বা হতে দুটি (অর্থাৎ নর ও মাদি) এবং বকরী হতে দুটি (নর ও মাদি)। উট হতে দুটি (নর ও মাদি) এবং গরু হতে দুটি (নর ও মাদি)। বাহীমাতুল আনআম শব্দের কুরআনী ব্যাখ্যা দ্বারা একথা স্পষ্ট প্রমাণিত হল যে, কুরবানী উক্ত আট রকম জানোয়ার দ্বারাই করা উচিত।
হযরত আলীর উক্ত গবেষণালব্ধ অভিমতের ভিত্তিতে হাফিয ইবনুল কাইয়িম বলেন, উপরোক্ত আট রকম জানোয়ারের মধ্যে কুরবানী সীমাবদ্ধ। উক্ত জন্তগুলো ছাড়া আর কোন পশু রসূলুল্লাহ (স:) এবং সাহাবায়ে কিরাম থেকে কুরবানী ও আকীকার ব্যাপারে প্রমাণিত নেই (যাদুল মাআ-দ, ১ম খণ্ড, ২৪৫ পৃষ্ঠা)।
হযরত আনাস বলেন, রসূলুল্লাহ (স:) শিংওলা ছিটফুট ভেড়া কুরবানী করেছিলেন (বুখারী মুসলিম, মিশকাত ১২৭ পৃষ্ঠা)। হযরত আয়িশা বলেন, রসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর বিবিদের তরফ থেকে গরু কুরবানী দিয়েছিলেন (বুখারী, মুসলিম, নাসায়ী, আবূ দাউদ, নাইলুল আওতার ৪র্থ খণ্ড, ৩৩৭ পৃষ্ঠা)। হযরত ইবনে উমার বলেন, নবী (সঃ) ঈদগাহে (বকরী বা গরু) যবহ করতেন এবং (উট) নহর করতেন (বুখারী, মিশকাত ১২৭ পৃষ্ঠা)। উক্ত হাদীসগুলো প্রমাণ করে যে, রসূলে আকরম (স:) ভেড়া, দুম্বা, উট, গরু ও বকরী কুরবানী দিতেন এবং উল্লিখিত আট রকম জানোয়ার কুরবানী করতেন। হযরত আসমা বলেন, আমরা রসূলুল্লাহ্র যুগে ঘোড়া যবহ করেছিলাম। তখন আমরা মদীনায় ছিলাম এবং ঐ ঘোড়ার গো খেয়েছিলাম (বুখারী, ৮২৮ পৃষ্ঠা, নাসায়ী ২য় খণ্ড, ১৮৩ পৃষ্ঠা)। আল্লামা সুহাইলী উল্লেখ করেছেন, আসমা (রাযিঃ) বলেন, আমরা রসূলুল্লাহ্র যুগে ঘোড়া কুরবানী করেছিলাম এবং হযরত আবু হুরাইরা থেকেও বর্ণিত আছে যে, তিনিও উহা কুরবানী করেছিলেন। তালখীসুল হাবীরের অন্য নুস্থায় (সংস্করণে) আছে যে, তিনি মোরগ কুরবানী করেছিলেন (তালখীসুল হাবীর, ৩৮৪ পৃষ্ঠা)।
হাসান ইবনে সালেহের মতে দশ জনের তরফ থেকে একটি নীলগাভী এবং একজনের তরফ থেকে একটি হরিণও কুরবানী করা বৈধ (ফাতহুল আল্লাম, ২য় খণ্ড, ২৯৬ পৃষ্ঠা, সুবুলুস সালা-ম ২য় খণ্ড, ২০৬ পৃষ্ঠা)। শেষের তিনটি রিওয়ায়াত ব্যতিক্রম, যা রসূলুল্লাহ (স:) এর সুন্নত নয়। অতএব আহলে হাদীসদের মতে ঘোড়া, নীলগাভী, হরিণ ও মোরগ প্রভৃতি কুরবানী বৈধ নয়।
0 Comments