বাইহাকী, দারাকুতনী ও মুস্তাদরাকে হাকিমে বর্ণিত হাদীসে আছে যে, রসূলুল্লাহ (স:) ৯ই যুলহিজ্জাহ আরফার দিন ফজর নামাযের পর থেকে আইয়্যামে তাশরীকের শেষ দিন ১৩ই যুলহিজ্জার আসর পর্যন্ত তকবীর দিতেন। ইমাম শওকানী বলেন, ঐ রিওয়ায়াতগুলোর সনদে আম্র ইবনে বিশ্র এবং জাবির জু'ফী প্রমুখ পরিত্যাজ্য ও দুর্বল রাবী রয়েছেন। সুতরাং হাদীসগুলো গ্রহণযোগ্য নয় (নায়লুল আওতার ৩য় খণ্ড, ২০৩ পৃষ্ঠা)।
হাফেয ইবনে হাজার আস্কালানী বলেন, বাইহাকী হযরত ইবনে মসউদের সহচরবৃন্দ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ঐ ব্যাপারে রসূলুল্লাহ থেকে কোন প্রমাণই পাওয়া যায় না (ফতহুল বারী, ২য় খণ্ড, ৪৬২ পৃষ্ঠা)। এইজন্য ঐ বিষয়ে আলিমদের মধ্যে মতভেদ হয়েছে। আল্লামা কাসতালানী বলেন, ঐ ব্যাপারে ৭৬টি বিবরণ আছে (কাসতালানী ২য় খণ্ড, ২০৮ পৃষ্ঠা)। ইবনুল মুনযির বলেন, ঐ সম্পর্কে সাহাবী থেকে যেসব উক্তি বর্ণিত হয়েছে তন্মধ্যে সঠিক উক্তি হযরত আলী ও ইবনে মসউদের কথা। তা হল আরফার দিন (৯ই যুলহিজ্জার) ফজর থেকে মিনার দিনগুলোর শেষ পর্যন্ত (ফতহুল বারী ২য় খণ্ড, ৪৬২ পৃষ্ঠা)।
এভাবে ৯ই থেকে ১৩ই আসর পর্যন্ত তকবীর দিলে ২৩ ওয়াক্ত নামাযের পর ২৩ বার তকবীর হবে। হানাফীদের দুই মুফতী ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদের মত তাই। কিন্তু ইমাম আবূ হানীফা (রহ:) বলেন, আরফার দিন ফজর থেকে নাহরের দিন আসর পর্যন্ত। ফলে ৮ ওয়াক্ত নামাযে আটবার তকবীর হবে। ইমাম মালেক ও শাফিয়ী বলেন, নাহরের দিন যোহর থেকে আইয়্যামে তাশরীকের শেষদিনের ফজর পর্যন্ত। এভাবে ১৫ ওয়াক্ত নামাযে ১৫ বার তকবীর হবে (ফাতহুল বায়ান, ১ম খণ্ড, ২৬৫ পৃষ্ঠা)।
সাহাবী ইকরিমা বলেন, আল্লাহর উক্তি 'অক্রুরুল্লাহ ফী আইয়্যামিম মাদুদা-তে' যিক্ এর ভাবার্থ আইয়্যামে তাশরীকে ফরয নামাযগুলোর পরে তকবীর দেওয়া (তফসীর ইবনে কাসীর, ১ম খণ্ড, ২৪৫ পৃষ্ঠা)। ইক্রিক্রমা এই উক্তি ও পূর্বে বুখারী শরীফের বরাত দিয়ে উল্লেখিত ইবনে আব্বাসের উক্তি এবং ইবনে উমার ও আবূ হুরাইরা প্রমুখের আমল একত্রিত করলে একথা পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয় যে, যুলহিজ্জার ১লা থেকে ১৩ই যুলহিজ্জার সূর্য ডোবার আগে পর্যন্ত যতটা সম্ভব এবং যেখানে যেখানে সম্ভব তকবীর দিতে হবে এবং প্রথম দশকে তকবীর ছাড়া তাস্বীহ, তাহলীল ও তাহমীদ নবী (স:) এর ফরমান মোতাবেক খুব বেশী কোরে করতে হবে। আহলে হাদীস উলামায়ে কিরামের মত তাই। দিল্লী রহমানিয়া মাদ্রাসার শায়খুল হাদীস আল্লামা আহমাদুল্লাহও (রহ:) তাইই বলেন (আল ইতিসাম ১লা এপ্রিল ১৯৬৬ সংখ্যা)।
এই উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আল্লামা ওবায়দুল্লাহ রহমানী সাহেবের মতও তাই। হানাফীদের বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম তাহাবী বলেন, আমাদের বড় বড় আল্লামাগণ (মাশায়েখ) যুলহিজ্জার দশদিনে তকবীর দিতেন। আল্লামা আমীর ইমানী সুবুলুস সালামে ঐ উক্তি উল্লেখ করেছেন (মিরআত ২য় খণ্ড, ৩৫৭ পৃষ্ঠা)। তাফহীমুল বুখারী প্রণেতা দেওবন্দী হানাফীও পরিষ্কার লিখেছেন, যুলহিজ্জার ঐ দশদিনে তকবীর বলা সালাফদের (সাহাবী ও তাবেয়ী প্রমুখদের) আমল ছিল। অতএব যুলহিজ্জার ১লা তারীখ থেকে ১৩ই যুলহিজ্জার আসর পর্যন্ত মোট তের দিন তাকবীর দেওয়া সাহাবায়ে কিরামের সুন্নত। তাই আমাদের সবারই উচিত ঐ সুন্নত পালন কোরে তের দিন তাকবীর দেওয়া।
তকবীরের শব্দাবলী
দুই ঈদে যে তকবীর পড়তে হবে তার শব্দাবলী হাদীসে কয়েক রকম পাওয়া যায়। যেমন, হযরত জাবির থেকে মরফুভাবে বর্ণিত-. الله أكبر الله أكبر لا إله الا الله والله اكبر الله أكبر ولله الحمد . (আল্লা-হু আকবর আল্লা-হু আকবর লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু অল্লা-হু আকবার আল্লা-হু আকবার অলিল্লা-হিল হাম্দ (দারাকুতনী ১৮২ পৃষ্ঠা)। এই তকবীরের মধ্যে তকবীর, তাহলীল ও তাহমীদ তিনটিই আছে।
মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাকে হজরত সালমান ফারসী থেকে বর্ণিত আছে- الله اكبر الله أكبر الله أكبر كبيرا (আল্লা-হু আকবার আল্লা-হু আকবার আল্লা-হু আকবার কাবীরা) (ফতহুল বারী, ২য় খণ্ড, ৪৬২ পৃষ্ঠা)। ইমাম শাফিয়ী কিতাবুল উম্মে বলেন, এই তকবীর পড়া উত্তম-আল্লা-হু আকবার কাবীরাও আল্হামদু লিল্লা-হি কাসীরা অসুবহা নাল্লা-হি বুকরাতাও অআসীলা লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ অলা না'বুদু ইল্লা-ইয়্যাহ মুখলিসীনা লাহুদ্দীন অলাও কারিহাল কা-ফিরূন লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু অহ্দাহূ সদাকা অ'দাহূ অনাসারা আব্দাহূ অআ'য্যা জুনদাহ্ অহাযামাল্ আহযা-বা অহ্দাহূ লা-ইলা-হা ইল্লা-ল্লা-হ্ আল্লাহু আকবার (কাসতালানী, ২য় খণ্ড, ২০৯ পৃষ্ঠা)। তকবীরের উক্ত শব্দাবলীর মধ্যে যে কোন একটি পড়লে চলবে। কেউ যদি সবগুলো পড়তে চায় তাও পড়তে পারে। যুলহিজ্জার প্রথম দশকে রোযা ও যিক্রের যেমন হুকুম দেওয়া হয়েছে তেমনি অন্যান্য মুসলমানদের ঐ ১০ দিন নখ চুল কাটা মানা করা হয়েছে।
0 Comments