ইসলামীক তালাকের বর্ণনা

        তালাকের বর্ণনাঃ তালাক হালাল বা সিদ্ধ হলেও হালাল জিনিসের মধ্যে এটা আল্লাহর নিকট সর্বাধিক অপ্রিয়। কেননা, তালাক দ্বারা স্ত্রীলোককে অত্যধিক কষ্ট দেয়া হয়। আর এটা স্বতঃসিদ্ধ যে অন্যকে অযথা কষ্ট দেয়া গুনাহর কার্য। আল্লাহ বলেন, যদি তারা তোমাদেরকে মান্য করে তবে তোমাদের বিরুদ্ধে অন্য কোন পথ অনুসন্ধান রো না। অর্থাৎ তার সাথে করো বিচ্ছেদ ঘটাবার কোন উপায় অবলম্বন করো না। যদি তোমার পিতা তোমার অপছন্দ আমি আমার করে তবে তাকে তালাক দেবে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলেছেন, আমি স্ত্রীকে খুবই ভালবাসতাম। কিন্তু আমার পিতা তাকে অপছন্দ করতেন। তিনি নি আমাকে আমার নালাম। তিনি স্ত্রীকে ভালবাসতামন। আদেশ করলে আমি তা' হুযুরে পাক (দঃ) কোরা বুঝা গে বললেন, হে ওমরের পুত্র। তুমি তোমার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দাও। এর দ্বারা বুঝা গেল যে, পিতার আদেশ পালন করা অগ্রগণ্য। অবশ্য হযরত ওমর (রাঃ)এর মত পিতা বিনা কার কারণে পুত্রকে ঐরূপ নির্দেশ দেন নি। ঐ স্ত্রীলোকটি তার স্বামীকে খুবই কষ্ট দিত এবং পরিজনর উপর কঠিন হৃদয় ছিল। এর দ্বারা সে বহু গুনাহে লিপ্ত হয়েছিল।

        যখন কোন স্ত্রী তার স্বভাব নষ্ট করে ফেলে অথবা ধর্মভ্রষ্টা হয়ে পড়ে তখন তার প্রতি এরূপ ব্যবস্থা গ্রহণই উত্তম। আল্লাহতায়ালা বলেন, "লা ইয়াখরুজুন্না ইল্লা আইয়া'তীনা বি ফাহিশাতিন মুবাইয়্যিনাতিন" অর্থাৎ কোনরূপ প্রকাশ্য অশ্লীল কার্য না করা পর্যন্ত তাদেরকে গৃহ থেকে বের করো না। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) এ আয়াতের অর্থ করতে গিয়ে বলেছেন, যখন সে তার পরিবারবর্গের উপর রুক্ষ ও কর্কশ ব্যবহার শুরু করে এবং স্বামীকে কষ্ট দেয় তখন তার দ্বারা অশ্লীলতা প্রকাশ পায়। ইদ্দতের অনুচ্ছেদে এ বিষয়ে বর্ণনা করা হবে।

        পক্ষান্তরে যদি স্বামী তার স্ত্রীর উপর অযথা অত্যাচার করে তাহলে তাকে কিছু অর্থ বা মালামাল দিয়ে তার থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেয়ার অধিকার ও উপায় অবলম্বন করা স্ত্রীর জন্য সিদ্ধ। তবে স্বামী স্ত্রীকে যা দিয়েছে স্ত্রীর নিকট থেকে তার বেশী গ্রহণ করা উচিত নয়। কেননা এভাবে স্ত্রীকে রিক্ত করা ও অন্যায়ভাবে কষ্ট দেয়া স্বামীর জন্য একটি অন্যায় ব্যবসাস্বরূপ। আল্লাহ বলেন, "লা জুনাহা আলাইহিমা ফী মাফতাদাত বিহী" অর্থাৎ যে পরিমাণ মাল স্ত্রী স্বামী থেকে পেয়েছে সেই পরিমাণ বা তার চেয়ে কম ফিরয়ে দিলে ফেদিয়ার উপযুক্ত হয়। অবশ্য কোন কারণ ব্যতীত স্ত্রী স্বামীর নিকট তালাক প্রার্থনা করলে (গুনাহগার হবে) বেহেশতের সুঘ্রাণ পাবে না। অন্য এক বর্ণনায় আছে, তার জন্য বেহেশত হারাম হবে। অপর এক হাদীসে রয়েছে যে, স্বামীর নিকট অযথা তালাক প্রার্থনাকারিনী মুনাফিকদের অন্তর্ভুক্ত হবে।

         তালাক প্রদানকালে স্বামী চারটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখবেঃ (১ ) স্বামী স্ত্রীকে এমন তোহরে অর্থাৎ তার পবিত্রাবস্থায় তাকে তালাক দেবে, যখন সে তার সঙ্গে সঙ্গম করে নি। কেননা হায়েজের সময় বা পবিত্রতার অবস্থায় সঙ্গম করে তালাক দিলে তা' বেদআত ও হারাম হবে। তোহরকাল দীর্ঘ মুদ্দতবিশিষ্ট হওয়ার কারণে যদি স্বামী স্ত্রীর সহিত সঙ্গম করে ফেলে তাহলে সে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিবে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) তাঁর স্ত্রীকে হায়েজের মধ্যে তালাক দিলে হুযুরে পাক (দঃ) হযরত ওমর (রাঃ) কে বললেন, তাকে বল, সে যেন তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয় এবং তার হায়েজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে রেখে দেয়। তারপর আবার তার হায়েজ হলে সে হায়েজ হতে পবিত্র হওয়ার পর ইচ্ছে হলে তাকে পুনরায় তালাক দেবে। আর তালাক দিতে ইচ্ছে না হলে রেখে দেবে।

 (২) এক তালাকের উপরই সংক্ষেপ করা চাই। তিন তালাক কোন মতেই একত্র করবে না। মুদ্দতের পর এক তালাক উদ্দেশ্যের পক্ষে উপকারী এবং যদি মুদ্দতের মধ্যে অনুতপ্ত হয় তাহলে তাকে ফিরিয়ে আনার অবকাশ থাকে। যদি একই সঙ্গে তিন তালাক দেয়া হয় তবে অনুতপ্ত হয়ে স্ত্রীকে পুনরায় বিবাহ করতে চাইলে তাকে হিলার আশ্রয় নিতে হবে এবং তাকে তালাকের ইদ্দত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে তখনই সে বিবাহ করতে পারবে ভাং বরং অন্য পুরুষের সহিত তার বিবাহ হতে হবে। সে বিবাহ করে সঙ্গমের পর যদি তাকে তালাক দেয় তবে সেই তালাকের ইদ্দতের পর প্রথম তালাকদাতা স্বামী তাকে বিবাহ ভরতে পারবে। বলাবাহুলা যে, এতে উক্ত স্ত্রীর প্রতি স্বামীর স্বভাবতঃই বিতৃষ্ণা আসে। এজন্য বলেছি যে, এক তালাক দেয়াই যখন উদ্দেশ্যের পক্ষে যথেষ্ট হয় তখন একই সাথে তিন তালাক দেয়ার কোন কারণ নেই; বরং অযথা বিপদাপন্ন হতে হয়। অবশ্য আমি একথা বলি নি যে স্ত্রীকে একসঙ্গে তিন তালাক দেয়া হারাম। কিন্তু এটা মাকরূহ সন্দেহ নেই।


        (৩) স্ত্রীকে তালাক দিয়ে তজ্জন্য সূক্ষ্ম ওজর তুলবে না; বরং তাকে কিছু উপহার দেবে। আল্লাহ
 বলেন, তাদেরকে ভরণ-পোষণ দিবে, এটা স্বামীর উপর ওয়াজিব। কেননা মূল বিবাহকালে এর কোন মহরানা থাকে না। হযরত ইমাম হাসান (রাঃ) অনেক স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন এবং অনেক বিবাহ করেছেন। একদিন তিনি এক ছাহাবীকে তাঁর স্ত্রীদের মধ্যে দুজনকে তালাক দিয়েছেন বলে খবর পাঠালেন এবং তিনি তাকে বললেন, তাদেরকে বল, তোমাদের প্রতি সুবিচার করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, তিনি তাদের প্রত্যেককে দশ হাজার করে দেরহাম দিতে আদেশ দিলেন। উক্ত ছাহাবী যখন তাঁর নিকট ফিরে এলেন, তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তাদের অবস্থা কি? তিনি বললেন, একজন আপনার প্রদত্ত দিরহাম গ্রহণ করে মাথা নত করে রয়েছে। সে কিছু বলল না। অন্যজন ক্রন্দন করে বলতেছিল যে, একজন প্রেমাস্পদের সাথে বিচ্ছেদের তুলনায় এ অতি নগণ্য। একথা শুনে ইমাম হাসান (রাঃ) মাথা নত করলেন এবং তাঁর মনে দয়ার উদ্রেক হল। তিনি বললেন, যদি আমি তালাক প্রদত্ত কোন নারীকে পুনরায় গ্রহণ করতাম তাহলে নিশ্চয়ই আমি একে আবার বিবাহ করতাম। একদা হযরত হাসান (রাঃ) মদীনার ফকীহ এবং গভর্ণর হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফের (রাঃ) এর নিকট গেলেন, তিনি ব্যতীত তখন মদীনায় হযরত হাসান (রাঃ)এর সমকক্ষ আর কিউই ছিল না। হযরত আয়েশা (রাঃ) হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফের (রাঃ) যোগ্যতার প্রমাণস্বরূপ বলেছিলেন, আমি এতদূর থেকে না এলেই উত্তম হত। কেননা, এখানে হুযুরে পাক (দঃ) এর ছয়জন অতি প্রিয়পাত্র ব্যক্তি রয়েছেন, তন্মধ্যে আবদুর রহমান ইবনে আওফও (রাঃ) একজন। যাই হোক হযরত হাসান (রাঃ) তাঁর গৃহে গেলে হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) তাঁকে যথেষ্ট সম্মান দেখালেন এবং সাদরে স্বীয় মজলিসে বসালেন। আর বললেন, আমাকে সংবাদ দিলে ত আমি নিজেই আপনার নিকট উপস্থিত হতাম। কিন্তু হযরত হাসান (রাঃ) বললেন, আমার আপনার নিকট প্রয়োজন রয়েছে। হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) হযরত হাসান (রাঃ) বললেন, আমি আপনার কন্যাকে বিবাহ করতে চাই। তাঁর কথা শুনে হযরত আবদুর রহমান (রাঃ) মাথা নত করলেন। তারপর মাথা উঠিয়ে বললেন, আল্লাহর কসম! আপনার চেয়ে দুনিয়ায় আমার নিকট অধিক সম্মানিত লোক দ্বিতীয়টি নেই। কিন্তু আপনি উত্তমরূপে জানেন যে, আমার প্রিয় কন্যা আমারই এক মাংসখন্ড। তাকে যে কষ্ট দেয় সে আমাকেই কষ্ট দেয় এবং তাকে যে খুশী করে আমাকেই সে খুশী করে। আপনি বড় তালাকপ্রিয় লোক। আমার বড়ই ভয় হচ্ছে যে, হয়ত বা আপনি তাকেও তালাক দিয়ে বসেন। ফলে আপনার সাথে আমার সুসম্পর্ক বিঘ্নিত হতে পারে। কিন্তু আপনার প্রতি আমি কোনরূপ বিরূপ হয়ে যাই বা আপনার প্রতি আমার মনে কোন দ্বিভাব উপস্থিত হয় তা' আমি চাই না। আপনি খোদ হযরত রাসূলে করীম (দঃ)এর একখন্ড মাংস। যদি আপনি আমার সহিত এই শর্ত করতে পারেন যে, আপনি আমার কন্যাকে তালাক দিবেন না, তাহলে আমি তাকে আপনার নিকট বিবাহ দিতে পারি। একথা শুনে হযরত হাসান (রাঃ) সেখান থেকে উঠে নীরবে চলে গেলেন। হযরত আলী (রাঃ) হযরত হাসান (রাঃ) এর অতিরিক্ত তালাকপ্রিয়তার জন্য তাঁকে তিরস্কার করেছিলেন। ঘটনাটি বলার উদ্দেশ্য এই যে, তালাক যত নিকৃষ্টই হোক না কেন, তা' হারাম নয়; বরং হালাল। আল্লাহ বলেছেন, "তোমাদের মধ্যে যারা বিধবা এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা সৎ, তাদেরকে বিবাহ কর। তারা যদি দরিদ্র হয় আল্লাহ তাদেরকে তাঁর নিজ ভাণ্ডার থেকে যথেষ্ট দান করবেন।" আল্লাহ আরও বলেন, "যদি তারা উভয়ে পরস্পরে পৃথক হয়ে যায় আল্লাহ তাদের প্রত্যেককেই তাঁর ভান্ডার হতে যথেষ্ট দান করবেন"।

        (৪) বিবাহ এবং তালাকের সময় স্ত্রীর গোপনীয় বিষয়সমূহ প্রকাশ করবে না। বিশুদ্ধ হাদীসে এ সম্পর্কে নিষেধ এসেছে এবং এ সম্পর্কে বিশেষভাবে সতর্ক করা হয়েছে। জনৈক ধার্মিক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইলে এক ব্যক্তি তাকে জিজ্ঞেস করল, আপনার স্ত্রীর কোন দোষ আপনাকে এত বিব্রত করছে? তিনি বললেন, কোন জ্ঞানী ব্যক্তিই তার স্ত্রীর গোপন কথা প্রকাশ করে না। অতঃপর যখন তিনি তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিলে, তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, আপনি তাকে কেন তালাক দিলেন? তিনি জবাবে বললেন, কোন বেগানা স্ত্রীর গুপ্ত বিষয় আমি কিরূপে বলব?

Post a Comment

0 Comments