কুরবানী মোট কয়দিন করা যায়

 কুরবানী কখন শুরু হবে

        একদা রসূলুল্লাহ (সঃ) ঈদের নামায শেষ করেই কুরবানীর গো দেখতে পেলেন, যা তাঁর নামায শেষ করার আগেই যবহ করা হয়েছিল। তখন তিনি বললেন, যে ব্যক্তি তার নিজের অথবা আমাদের নামাযের আগে যবৃহ করেছে সে যেন তার বদলে আর একটি জানোয়ার যবহ করে। (বুখারী ও মুসলিম)। অন্য বর্ণনায় তিনি বলেন, যে ব্যক্তি নামাযের আগে যবহ করে সে নিজেরই জন্য তা যবহ করে এবং যে ব্যক্তি নামায পরে যবহ করে সে তার কুরবানী পুরো করে এবং মুসলমানদের রীতিনীতি সঠিকভাবে পালন করে (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত ১২৬ ও ১২৮ পৃষ্ঠা)।

        হযরত বারা ইবনে আযিব বলেন, একদা কুরবানীর দিনে রসূলুল্লাহ )স:) আমাদের সামনে খুতবা দিয়ে বললেন:- لا يضحين أحد حتى يصلى অর্থাৎ কোন ব্যক্তি নামায না পড়া পর্যন্ত কখনই যেন কুরবানী না করে (মুসলিম, ২য় খণ্ড, ১৫৪ পৃষ্ঠা)। তিরমিযীর বর্ণনায় আছে:- لا يذ بحن أحدكم حتى يصلى

        অর্থাৎ নামায না পড়া পর্যন্ত তোমাদের কেউই যেন কখনো যবহ না করে (তিরমিযী, ১ম খণ্ড, ১৮২ পৃষ্ঠা)।

        উক্ত হাদীসগুলো পরিষ্কার প্রমাণ করে যে, ঈদুল আযহার নামাযের আগে কুরবানী কোন মতেই হবেনা। যদি কেউ তা করে তা কুরবানী না হোয়ে শুধু গোস্ত খাওয়া হবে এবং মুসলমানী রীতিনীতি বিরুদ্ধ কাজ হবে। এই হুকুম শহরবাসী ও পল্লীবাসী সবারই জন্য এক। এতে কোনরকম পার্থক্য নেই। তাই মালিকী, শাফিয়ী ও হাম্বালীদের ফওয়ায় শহরবাসী ও পল্লীবাসী সবারই জন্য ঈদের নামাযের আগে কুরবানী হবেনা (মিরআত, ২য় খণ্ড, ৩৩৬ পৃষ্ঠা)।

        কিন্তু হানাফী ফিক্‌ বলে, পল্লীবাসী ফজরের পরই (ঈদের নামায না পড়েও) কুরবানী করতে পারবে। শুধু তাই নয়, বরং কোন শহরবাসী যদি তাড়াতাড়ি কুরবানী করতে চায় তাহলে সে পলিসি )حيلة( কোরে তার জানোয়ারটা শহরের বাইরে কোন পল্লীতে পাঠিয়ে দেবে এবং ফজর বা সুবহে সাদেক (কাকভোর) উদয়ের পরই সেটাকে সে কুরবানী কোরে নেবে (হিদায়া, ৪র্থ খণ্ড, ৪৪৫-৪৪৬ পৃষ্ঠা)। শহর ও গ্রামবাসীর এই পার্থক্যের দলীল হিসেবে হিদায়াতে কোন হাদীস বা কুরআনের আয়াত পেশ করা হয়নি। সুতরাং ফাওয়াটি কিয়াসী ও অনুমান ভিত্তিক। তাই দিল্লী মিঞা সাহেব মাদ্রাসার সাবেক শায়খুল হাদীস আল্লামা মুহাম্মাদ ইউনুস দেহলভী (রহ:) বলেন, হানাফীদের ঐ ফাওয়া সম্পূর্ণ ভুল এবং হাদীসের খেলাফ (দস্তুরুল মুত্তাকী, ১৫৩ পৃষ্ঠা)। এ ব্যাপারে ইমাম ইবনে হাম বলেন, ইমাম আবু হানীফার ঐ উক্তি রসূলুল্লাহর খেলাফ বেদলীল কথা (আলমুহাল্লা, ৭ম খণ্ড, ৩৭৪ পৃষ্ঠা)।


কুরবানী মোট কয়দিন

        কুরবানী মোট কয়দিন চলতে পারে-এ ব্যাপারে বিভিন্ন উলামায়ে কিরাম ও ইমামদের ৫টি মত পাওয়া যায়। যেমন ইমাম ইবনে হাযম ও আল্লামা উবায়দুল্লাহ রহমানী সাহেব বলেন:

(১) ইবনে আবী শায়বায় বর্ণিত আছে যে, ইবনে সীরীন ও দাউদ যাহিরীর মতে কুরবানী কেবলমাত্র ১ দিন। অর্থাৎ ১০ই যুলহিজ্জাহ সূর্য ডোবা পর্যন্ত। এই মতের প্রমাণে কোন হাদীস নেই। এটা ওঁদের ব্যক্তিগত ফাওয়া।

(২) সায়ীদ ইবনে জুবায়ের এবং জাবির ইবনে যায়দ বলেন, শহরসমূহে একদিন এবং মিনায় অবস্থানকারীদের জন্য তিনদিন। এটাও তাদের বিবেকপ্রসূত ফতওয়া।

(৩) আবু সালমা ইবনে আবদুর রহমান ইবনে আওফ এবং সুলাইমান ইবনে য়্যাসারের মতে ১০ই যুলহিজ্জাহ থেকে মুহাররমের চাঁদ ওঠা পর্যন্ত। অর্থাৎ ২০ বা ২১ দিন। এটি হল বায়হাকী ও মারাসীলে আবূ দাউদের রিওয়ায়াত। এই রিওয়ায়াত সম্পর্কে পূর্বোক্ত আল্লামা রহমানী বলেন, এই হাদীসটি রসূলুল্লাহর মরফু হাদীস নয়, কিংবা সাহাবীদের মওকুফ রিওয়ায়াতও নয়। বরং এটি মাক্ত বা সূত্রছিন্ন হাদীস। যা হাদীস শাস্ত্রের সমস্ত নীতিবিদদের মতে দলীলের অযোগ্য, বিধায় পরিত্যাজ্য।

(৪) ইবনে আবী শায়বা ও মুঅত্তা ইমাম মালিকে হযরত উমার, আলী, ইবনে উমার, ইবনে আব্বাস, আবূ হুরাইরাহ ও আনাস (রাযিয়াল্লা-হু আনহুম) থেকে বর্ণিত আছে যে, কুরবানী ইয়াওমুন নাহর ও তার পরে দুদিন। অর্থাৎ ১০ই, ১১ই ও ১২ই যুলহিজ্জাহ মোট তিন দিন। এটা হল হানাফী, মালিকী ও হামবালীদের অভিমত। এই ৬টি হাদীস সম্পর্কে ইমাম ইবনে হায্য বলেন, হযরত আনাস বর্ণিত হাদীসটির সনদ ছাড়া বাকি সূত্রগুলো বিশুদ্ধ নয়। প্রত্যেকটার সনদে কোন না কোন রাবী দোষযুক্ত আছেন। এগুলো সম্পর্কে আল্লামা রহমানী বলেন, এইসব হাদীসগুলো মওকুফ। অর্থাৎ সবগুলোই উক্ত সাহাবীদেরই উক্তি। রসূলুল্লার উক্তি নয়। কোন বিষয়ে সাহাবীদের মোকাবেলায় যদি রসূলুল্লাহর মরফু হাদীস পাওয়া যায় তাহলে সেটাই নীতিবিদ মুহাদ্দিসদের মতে অগ্রাধিকার যোগ্য।

৫) ইবনে হিব্বান, বায়হাকী, দারাকুতনী, বাযযার, ইবনে আদী, মুসনাদে আহমাদ, ও ইবনে আবী শায়বা প্রভৃতিতে বর্ণিত আছে, নবীয়ে করীম (সঃ) বলেন, আইয়্যামে তাশরীকের দিনগুলো যঙ্গের দিন। অর্থাৎ কুরবানী হবে ১০ই, ১১ই, ১২ই ও ১৩ই যুলহিজ্জাহ পর্যন্ত। মোট ৪ দিন। ইমাম শাফিয়ীর মত তাই।

        আল্লামা ইবনে হাজার হায়সামী বলেন, এই হাদীসটির অনেকগুলো সনদ একে অপরের সমর্থন করায় হাদীসটি হাসানের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। তাছাড়া এই হাদীসটি মরফু। অর্থাৎ স্বয়ং রসূলুল্লাহর (সঃ) হাদীস। এটা কোন সাহাবীর মওকুফ হাদীস নয়। তাই আল্লামা রহমানী বলেন, উক্ত পাঁচটি উক্তির মধ্যে এই শেষোক্ত মতটি আমার নিকট প্রাধান্যযোগ্য। এজন্য আহলে হাদীসদের মতে কুরবানী মোট ৪ দিন (আলমুহাল্লা, ৭ম খণ্ড, ৩৭৭-৩৭৮ পৃষ্ঠা ও মিরআত, ২য় খণ্ড, ৩৬৩-৩৬৪ পৃষ্ঠা)।

        উক্ত মতগুলো সম্পর্কে সাবেক পশ্চিম পাকিস্তান জমঈয়তে আহলে হাদীসের প্রাক্তন সভাপতি আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মাদ দাউদ গযনডী (রহ:) বলেন, মাত্র একদিন কুরবানীর অভিমতটি কুরআনের সূরা হজ্জের ২৮ নং আয়াত

وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللهِ في أَيَّامٍ مَّعْلُومَةٍ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ

        এর সম্পূর্ণ বিপরীত এবং অন্য কোন আয়াত দ্বারাও প্রমাণিত হয়না যে, কুরবানীর দিন কেবলমাত্র একদিন। তেমনি ১০ই যুলহিজ্জাহ থেকে মোহাররমের চাঁদ ওঠা পর্যন্ত ২০ বা ২১ দিনের মতটি মুরসাল হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হলেও ওর মোকাবেলায় মরফু হাদীস থাকায় ঐ মতটি মুহাদ্দিসীনে কিরামের নীতি অনুযায়ী ধোপে টেকেনা।

        হাফিয ইবনে হাজার আস্কালনী ফাতহুল বারীতে মুসনাদে আহমাদ বর্ণিত আবু উমামার একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন যে, মুসলমানেরা কুরবানীর জানোয়ার কিনতো এবং তাকে খুব মোটা তাজা করতো।

পরিশেষে যুলহিজ্জাহ মাসের শেষে তাকে যবহ করতো। এই হাদীস সম্পর্কে ইমাম আহমাদ বলেন, হাদীসটি আজব ধরণের। যাহোক, এই বর্ণনাটি উক্ত মুরসাল রিওয়ায়াতের সমর্থক নয়। কারণ, এটা তো মুরসালও নয়, বরং এটা হল ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদের উক্তি। ৩ দিনের অভিমত সংক্রান্ত হাদীসটি মরফু নয়। তাই মরফু হাদীসের মোকাবেলায় এই হাদীসটি টিকতে পারেনা। থাকলো ৪ দিনের অভিমতটি। জুবায়র ইবনে মুইম বর্ণিত ঐ হাদীসটির সনদ সুত্রছিন্ন হলেও দারাকুতনীতে এই হাদীসটি মুত্তাসিল বা অবিচ্ছিন্ন সুত্রভাবে বর্ণিত এই হাদীসটি মরফু।

         আইয়্যামে তাশরীক সম্পর্কে সবাই একমত যে, তা হল ঈদের পর তিনদিন। ইমাম দারাকুতনী এই হাদীসটিকে দুটি ভিন্ন ভিন্ন সনদে মুত্তাসিলভাবে বর্ণনা করেছেন। আর হাফেয ইবনুল কাইয়িম যা-দুল মাআ-দে জুবায়র ইবনে মুহম এর হাদীস ছাড়াও জাবের থেকে এই হাদীসটিই উসামা ইবনে যায়দের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন। যিনি বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য রাবী। এ সব ছাড়াও সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আইয়্যামে তাশরীককে 'আইয়া-মু আক্লিন ওয়া শুরবিন' অর্থাৎ খাওয়া ও পান করার দিন বলা হয়েছে। যার ফলে ঐ তিনদিনে রোযা রাখাও হারাম। সুতরাং ঈদের পরের তিনটি দিন যখন ঐসব হুকুমের মধ্যে গণ্য হয় তখন কি কারণে কুরবানী যবৃহ করা থেকে শেষ দিন-অর্থাৎ ১৩ই যুলহিজ্জাহ বাদ দেওয়া যেতে পারে?

        হাফিয ইবনুল কাইয়িম যা-দুল মাআ-দে এই অভিমতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং সেইসঙ্গে এর সমর্থনে হযরত আলী থেকেও তিনি এই উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে, কুরবানীর দিন, ঈদের দিন এবং তারপরে আরো ৩ দিন। ইমাম ইবনে তাইমিয়া কিতাবুল ইখতিয়া-রা-তে বলেন, কুরবানীর শেষ সময় আইয়্যামে তাশরীকের শেষ দিন। এটাই ইমাম শাফিয়ীর মত এবং ইমাম আহমাদের দুটি উক্তির একটি উক্তি এটাই। হাফেয ইবনে কাসীর এবং ইমাম শওকানী এই মতটিকে সবচেয়ে বেশী প্রাধান্য দিয়েছেন (তফসীর ইবনে কাসীর, ২য় খণ্ড, ৫৩ পৃষ্ঠা ও নাইলুল আওতার, ৪র্থ খণ্ড, ৩৫৯ পৃষ্ঠা। পাক্ষিক আহলে হাদীস দিল্লী ৭ই ফেব্রুয়ারী ১৯৭১ সংখ্যা থেকে সংকলিত)।

Post a Comment

0 Comments