হালাল ও হারাম বস্তুর পার্থক্যের বর্ণনা

        পাঠক-পাঠিকা। জেনে রাখ, যে ব্যক্তি তাওবাহ করে অথচ তার দখলে হালাল ও হারাম মাল মিশ্রিত থাকে, তখন তার দুটি পন্থা অবলম্বন করা অপরিহার্য। প্রথমতঃ তাকে মিশ্রিত হালাল ও হারাম মাল পরস্পর পৃথক করতে হবে এবং তাকে হারাম মাল ব্যবহারের নিয়ম জানতে হবে। জেনে রাখ, যে ব্যক্তি তাওবাহ করে অথচ তার হাতে অত্যাচারের হারাম মাল অথবা গচ্ছিত হারাম মাল সমান থাকে অথবা অন্য যে-কোন প্রকার হারাম মাল থাকে, তখন সে হারাম মাল পৃথক করা সহজসাধ্য। যদি তা' নিজ মালের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে যায়, তবে তার দুটো অবস্থা হতে পারে। যথা:

        (১) একই প্রকার মালের সঙ্গে হারাম মাল মিশে যাওয়া; যেমন, খাদ্যশস্য, টাকা পয়সা এবং তেল জাতীয় জিনিস ইত্যাদি।

        (২) হারাম মাল ভিন্ন প্রকার মালের সঙ্গে মিশে যাওয়া; যেমন, দাসদাসী, ঘরবাড়ি এবং পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি। যদি হরাম মাল একই প্রকারের মালের সঙ্গে মিশে যায় অথবা তা' সমস্ত মালের মধ্যে বিস্তৃত থাকে, তবে তা' ঐ ব্যক্তির মালের মত হয়, যে ব্যবসা-বাণিজ্য করে উপার্জন করে বটে; কিন্তু সে জানে যে, তারমধ্যে মিথ্যা কথা দ্বারাও কিছু অর্জিত হয়েছে অথবা অত্যাচারলব্ধ তেলের মুনাফা তার হালাল তেলের সঙ্গে মিশে গেছে। অথবা এভাবে খাদ্যশস্য বা নগদ স্বর্ণ ও রৌপ্যের অর্থের সাথে মিশ্রিত হয়েছে। এ ব্যাপারটিও দু'রকম হতে পারে। যেমন, মিশ্রিত মালের পরিমাণ জানা থাকতে পারে বা জানা নাও থাকতে পারে। যদি পরিমাণ জানা থাকে; যেমন, অর্ধেক মাল হারাম, তখন তা' পৃথক করে ফেলবে। যদি তা' পৃথক করা কষ্টকর হয়, তবে তারও দুটো উপায় আছে; একটি বিশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করা এবং অন্যটি প্রবল ধারণার সঙ্গে গ্রহণ করা। দুটোই আলিমদের মতে নামাযের মধ্যে রাকাতের ন্যায়। এটা দৃঢ়বিশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ না করলে আমরা জায়েয বলব না। এটা বলা সম্ভব নয়, যে মাল তার দখলে আছে, তা' সবই হারাম; বরং তা' বলা কঠিন বৈকি। সুতরাং প্রবল ধারণার বলে, চিন্তা-ভাবনাপূর্বক ঐ মাল গ্রহণ করা জায়েয কিন্তু একীন বা দৃঢ়বিশ্বাসের সাথে তা' গ্রহণ করাই সতর্কতা বা পরহেজগারী। যদি পরহেজগারী আকাঙক্ষী হও তাহলে যে পরিমাণ হালাল মাল আছে বলে দৃঢ় বিশ্বাস হয়, সে পরিমাণ রেখে অবশিষ্ট মাল বের করে ফেলবে। আর যদি প্রবল ধারণার সাহায্যে তা' গ্রহণ কর, তবে তার পন্থা এইঃ

        যদি তোমার কাছে ব্যবসার মাল থাকে এবং তন্মধ্যে কিছু হারাম ও কিছু হালাল এবং যদি তোমার ধারণা হয় যে, হালাল অর্ধেক, হারাম এক তৃতীয়াংশ এবং সন্দেহজনক এক ষষ্ঠাংশ, তবে তার হুকুম প্রবল ধারণার বিধান অনুযায়ী হবে। প্রত্যেক দ্রব্যের ক্ষেত্রেই এরূপ নিয়ম অবলম্বন করবে। হালাল, হারাম ও সন্দেহজনক অংশ পৃথক করতে হবে, যতটুকু হারাম বলে দৃঢ় ধারণা হবে, ততটুকু পৃথক করবে। যে পরিমাণ হালাল বলে দৃঢ় ধারণা হবে, সে পরিমাণ পৃথক করবে এবং তা' রেখে দেয়া তোমার জন্য জায়েয হবে; তবে পৃথক করাই পরহেজগারী। সন্দেহজনক বস্তু রেখে দেয়। নাজাযেয নয় কিন্তু তা' বর্জন করাই পরহেজগারী। এরূপ সতর্কতা বা পরহেজগারী অবলম্বন আবশ্যক। কেননা এর মধ্যে কষ্টকর ব্যাপার আছে এবং তোমার কাছে যা আছে, তোমার তা' হালাল বলেই ধারণা থাকে। কিন্তু কখনও কখনও তা' দুর্বদ ধারণারশতও হতে পারে। সুতরাং যদি হালাল হওয়ার ব্যাপারে প্রবল ধারণা না থাকে, তবে তা' গ্রহণ না করা চাই।

        যদি বল, দৃঢ়বিশ্বাস অবলম্বন সত্ত্বেও যে ব্যক্তি তার মাল থেকে সন্দেহজনক হারাম মাল বের করে, তার নিকট এটা হারাম বলে জানা নাও থাকতে পারে। হয়ত তার কাছে যা বাকী থাকবে, তা' হারাম হতে পারে, এ অবস্থায় ঐ মাল বের করা অনর্থক, তা' সবই হারাম। যদি এ অবস্থায় ঐ মাল জায়েয হয় তাহলে, একটি মৃত প্রাণীর গোশত, নয়টি যবেহ করা প্রাণীর গোশতের সঙ্গে মিশিয়ে দিলে তন্মধ্যে একটি অংশ হারাম জেনে পৃথক করা এবং বাকী নয় অংশ রেখে দেয়া জায়েয হবে। যদি কেউ বলে যে, যে নয়টি অংশ রাখা হয়েছে, তার মধ্যে হারাম বস্তু আছে এবং যে অংশ ফেলে দেয়া হয়েছে তার মধ্যে হালাল বস্তু আছে। এই প্রশ্নের জবাবস্বরূপ নিম্নে দৃষ্টান্ত পেশ করা হলঃ কোন ব্যক্তির কাছে দুটি দেরহাম আছে, তন্মধ্যে একটি হারাম; কিন্তু জানা নেই যে, কোনটি হারাম। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) কে এরূপ মাসয়ালা জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি বললেন, নিশ্চিতরূপে না জানা পর্যন্ত দুটো দেরহামই আপনার পাত্র কোনটি, আমি চিনি না। আপনি এর মধ্য থেকে আপনার পাত্রটি নিয়ে যান। ইমাম সাহেব তখন দুটো পাত্রই ত্যাগ করলেন। তখন ঋণদাতা বললেন, আপনার পাত্র এটি। আপনাকে আমার পরীক্ষা করার উদ্দেশ্য ছিল। ইমাম সাহেব ঋণ পরিশোধ করে দিয়ে তার পাত্র ত্যাগ করলেন। এটাই তার প্রকৃত পরহেজগারীর পরিচয়। আমরা এরূপ ত্যাগ স্বীকারকে ওয়াজিব বলি না। উল্লিখিত মাসয়ালার মধ্যে যদি দ্বিতীয় দেরহামের মালিক তখন নির্দিষ্ট থাকে এবং দুই দেরহামের ভিতর ঋণ গ্রহণকারী একটি মালিককে দিয়ে দেয় এবং প্রকৃত অবস্থা জেনে মালিক খুশী থাকে, তখন গ্রহণকারীর পক্ষে অন্য দেরহামটি হালাল হয়ে যায়। এজন্য এর দুটো অবস্থা হয়। যে দেরহাম মালিক পায় আল্লাহর জ্ঞানে গ্রহণকারী অন্য দেরহাম নিলে তখন উদ্দেশ্য সাধিত হয়। যদি মালিক দ্বিতীয় দেরহাম নেয় তখন একের দেরহাম অন্যের নিকট বিনিময় করে লওয়া বলে গণ্য হয়। যদি তা' না হয় তাহলেও কথাবার্তার দ্বারা তারা বিনিময় করে। যদি তারা তা' না করে পরস্পর আদান-প্রদান দ্বারা পরস্পরের জিনিসের বিনিময় হয়। 

        (১) মাসয়ালাঃ কোন ব্যক্তি অন্যান্য লোকের সঙ্গে ওয়ারিসসূত্রে কোন সম্পত্তির অধিকারী হলে এবং তাদের শাসনকর্তা বা তাদের উপর কর্তৃত্বকারীদেরকেও উক্ত সম্পত্তি জোরপূর্বক নিয়ে যাওয়ার পর যদি সে তাদেরকে ঐ সম্পত্তির নির্দিষ্ট অর্ধেক বা কোন অংশ ফেরত দেয় তা' সমস্ত ওয়ারিসগণ তাদের নিজ নিজ অংশানুযায়ী বণ্টন করে নেবে।

        (২) মাসয়ালা ও কোন অত্যাচারী শাসনকর্তা থেকে কোন ভূ-সম্পত্তি অর্জন করার পর যদি সে তাওবাহ করে তাহলে ঐ সম্পত্তির যে মুনাফা হয়েছে তার মূল্য নির্ধারণপূর্বক তা' উক্ত শাসনকর্তাকে ফিরিয়ে দেয়া কর্তব্য হবে। যেসব সম্পত্তি বলপূর্বক লওয়া হয় এবং তার মুনাফা উপভোগ করা হয়, তার ক্ষতিপূরণ এভাবে পূর্ণ করে দেয়ার হুকুম। যে পর্যন্ত অত্যাচারের ক্ষতিপূরণ না দেয়া হয় সে পর্যন্ত তার তাওবাহ কবুল হয় না। সে সম্পত্তির যদি কোন অতিরিক্ত উন্নতি করা হয়, তাও মালিককে দিয়ে দিতে হবে। যদি তার ভাড়া আদায় করা হয় ভাণ্ড দিতে হবে। দাস-দাসী, পোশাক-পরিচ্ছদ, তৈজসপত্র ইত্যাদি যেসব জিনিস ভাড়া দেয়া হয় না এবং যার ভাড়া নির্ধারণ করা কঠিন তা' জ্ঞান ও বিবেকের সাহায্যে নির্ধারণ করবে। যখন কারবারের চুক্তি বাতিল হয়ে যায় তখন মূল্য ক্রেতাকে ফেরত দেয়া হবে এবং উক্ত দ্রব্য। মালিককে ফেরত দেবে। যদি কারবারের ব্যাপকতার জন্য এটা সম্ভব না হয়, তাহলে যা দখলে থাকে তা' হারাম হয়। মালিক মূল মাল গ্রহণ করবে তার জন্য অতিরিক্ত মাল হারাম। অতিরিক্ত মাল দানের জন্য বের করা তার প্রতি ওয়াজিব। তাতে জোরপূর্বক দখলকারীর বা মালিকের স্বত্ব নেই।

        (৩) মাসয়ালাঃ কোন ব্যক্তি যদি ওয়ারিস সূত্রে কোন সম্পত্তি লাভ করে এবং সে সম্পত্তি হারাম কি হালাল উপায়ে অর্জিত তা' জানা না থাকে এবং যদি তা' হারাম হওয়ার কোন চিহ্ন না থাকে, তবে সমস্ত আলিমের মতানুযায়ী তা' হালালরূপে গণ্য হবে। যদি সে তার মধ্যে হারাম মালের অস্তিত্ব আছে বলে জানে অথচ তার পরিমাণের বিষয়ে সন্দেহ থাকে, তবে অনুমান করে সে হারাম মালের পরিমাণ বের করে ফেলবে। যদি তার তা' জানা না থাকে কিন্তু এ কথা জানা থাকে যে, মালিক অত্যাচারী বাদশাহর কর্মচারী ছিল এবং তার কার্যকালে সে কিছু হারাম গ্রহণ করে নি আর কিছু গ্রহণ করে থাকলেও এই দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তার হস্তে কিছুই ছিল না। এটি এমন এক সন্দেহর ক্ষেত্র যে, তা' থেকে বিরত থাকা উত্তম। অবশ্য তা' ওয়াজিব নয়। আর যদি সে জানে যে, তার কিছু মাল অত্যাচারলব্ধ ছিল তখন বুদ্ধি দ্বারা সেই দ্রব্য থেকে তা' বের করে ফেলবে। কোন এক আলিম বলেছেন যে, মালিকের তাতে গুনাহ হবে। কিন্তু ওয়ারিশের কোন গুনাহ নেই। যখন হারাম মাল অন্য মালের মধ্যে মিশ্রিত হয়ে যায় তখন দখলকারীর মৃত্যুতে তা' হালাল হতে পারে না।

Post a Comment

0 Comments