বকরী ও ভেড়া কত জন কুরবানী করতে পারে

 

        ইবনে হিশাম থেকে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ (স:) একটি বকরী তাঁর সমগ্র পরিবারবর্গের তরফ থেকে কুরবানী দিতেন। ইমাম হাকিম বলেন, এই হাদীসের সূত্র বিশুদ্ধ (মুস্তাদরকে হা-কিম, ৪র্থ খণ্ড, ২২৯ পৃষ্ঠা)। হযরত আবু আইউব আনসারী (রাযিঃ) বলেন, সাহাবায়ে কিরামের এক একজন তাঁর নিজের এবং তাঁর পরিবারের তরফ থেকে একটি কোরে বকরী কুরবানী করতেন (তিরমিযী, ১ম খণ্ড, ১৮২ পৃষ্ঠা, ইবনে মাজা, ২৩২ পৃষ্ঠা, মুঅত্তা ইমাম মালিক, ১৮৮ পৃষ্ঠা)। হাফিয ইবনুল কাইয়িম বলেন, নবী (স:) এর আদর্শ ছিল এই যে, একটি বকরী একজন লোক ও তার পরিবারের তরফ থেকে যথেষ্ট হোত। যদিও তাদের সংখ্যা অনেক থাকতো (যাদুল মাআ-দ ১ম খণ্ড, ২৪৮ পৃষ্ঠা)।

        মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ও মুসনাদে আবু ইয়ালাতে হযরত আবূ তালহা থেকে বর্ণিত আছে যে, একদা নবী (সঃ) দুটি ছিটকুট ভেড়া কুরবানী করেন এবং প্রথমটি যবহের সময় বলেন, এটা মুহাম্মাদ ও মুহাম্মাদের পরিবারের তরফ থেকে এবং দ্বিতীয়টির বেলায় তিনি বলেন, এটা আমার ঐ উম্মতের তরফ থেকে যে আমাকে বিশ্বাস করে এবং সত্য বলে মানে। ইবনে আবী শায়বাতে হযরত আনাস থেকেও ঐরূপ একটা বর্ণনা আছে। 

        ঐ বর্ণনাগুলো সামনে রেখে আল্লামা খাত্তাবী 'মাআ-লিম' গ্রন্থে বলেন যে, ওগুলো কুরবানীর সময় রসূলুল্লার একথা বলা যে, এটা মুহাম্মদ ও মুহাম্মদের পরিবার এবং মুহাম্মদের উম্মতের তরফ থেকে বাক্যটি প্রমাণ করে যে, একটি বকরী বা ভেড়া একজন লোক ও তার পরিবারের তরফ থেকে যথেষ্ট হবে। তাই আল্লামা শামসুল হক ডিয়ানবী (রহ:) বলেন, কুরবানীতে একটি বকরী একজন লোক ও তার পরিবারের তরফ থেকে যথেষ্ট হবে। তবে হাদঈতে নয়। ওর দলীল মুসলিম ও আবু দাউদে বর্ণিত হযরত আয়িশার রিওয়ায়াত, সুনানে দারিমী ও অন্যান্য সুনানসমূহে বর্ণিত জাবেরের হাদীস, মুঅত্তা ইমাম মালিক, তিরমিযী ও ইবনে মাজাতে বর্ণিত আবু আইয়ুব আনসারীর বর্ণনা, মুস্তদরকে হাকিমে বর্ণিত আবদুল্লাহ ইবনে হিশামের রিওয়ায়াত, ইবনে আবী শায়বায় রিওয়াতকৃত আবূ তালহা ও আনাসের হাদীস এবং মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত আবু রাফে ও আবুল আশাদ্দের দাদার বর্ণিত হাদীসসমূহ (আওনুল মাবুদ, ৩য় খণ্ড, ৫৭ পৃষ্ঠা)।

        উক্ত হাদীসগুলোর ভিত্তিতে ইমাম মালিক, ইমাম শাফিয়ী ও ইমাম আহমাদ (রহিমাহুমুল্লাহ) প্রমুখদের ফাতাওয়া এই যে, একটি বকরী একটি পরিবারের জন্য যথেষ্ট (মিরকাত, ২য় খণ্ড, ২৬১ পৃষ্ঠা)। কেবল হানাফী মযহাবের ফাওয়া এই যে, একটি বকরী একটি পরিবারের জন্য যথেষ্ট নয়, বরং কেবলমাত্র একজনের তরফ থেকে তা কুরবানী হবে। এর প্রমাণে হানাফীদের কাছে কিয়াস ছাড়া কোন হাদীস নেই। যেমন হিদায়াতে বলা হয়েছে, বকরীর ব্যাপারে কোন হাদীস নেই। তাই মসলাটি কিয়াস অনুযায়ী অনুমানভিত্তিক হবে (হিদায়া, ৪র্থ খণ্ড, ৪৪৪ পৃষ্ঠা)। হিদায়াপ্রণেতার এই দাবী ভিত্তিহীন। কারণ, একটু আগেই ১২টি হাদীস দ্বারা প্রমাণ করা হয়েছে যে, একটি বকরী একটি পরিবারের জন্য যথেষ্ট হবে। 

        এক হানাফী মুহাদ্দিস ইমাম তাহাভী উক্ত হাদীসগুলো সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন যে, ঐ হাদীসগুলো মনসূখ কিংবা রসূলুল্লাহর জন্য খাস (শারহু মাআ-নিল আ-সা-র ২য় খণ্ড, ২৫১ পৃষ্ঠা)। ওর জওয়াবে এক শাফিয়ী মুহাদ্দিস ইমাম নবভী বলেন, ইমাম তাহাভীর ঐ দাবী শুধু যবানী জমা খরচ। কারণ, কোন হাদীস মনসূখ ও রসূলুল্লাহর জনা খাস হওয়া শুধু মৌখিক দাবী দ্বারা প্রমাণিত হয়না (শারহে মুসলিম ২য় খণ্ড, ১৫৬ পৃষ্ঠা)। বরং হযরত আলী, আবু হুরাইরা ও ইবনে উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) থেকে বর্ণিত আছে যে, তাঁরা ঐরূপ করতেন। যেমন খাত্তাবী উল্লেখ করেছেন (আওনুল মাবুদ, ৩য় খণ্ড, ৫৭ পৃষ্ঠা)।

         ইমাম তাহাভীর দাবী অনুযায়ী ঐ হাদীসগুলো যদি মনসুখ কিংবা রসূলুল্লাহর জন্য খাস হোত তাহলে রসূলুল্লাহর ইন্তেকালের পর উল্লিখিত সাহাবায়ে কিরাম ওগুলোর উপরে আমল করলেন কি করে? তাই বলছি, হাদীস পাওয়া সত্ত্বেও যাঁরা কিয়াসী ফাতওয়া দিয়েছেন আল্লাহ তাঁদের উপরে রহম করুন এবং তাঁদের ভক্তদের হাদীস মোতাবেক চলার সুমতি দিন--আমিন!

উট-গরু এবং বকরী-ভেড়ার ভাগাভাগিতে পার্থক্য

        ভারতীয় মুহাদ্দিস আল্লামা আবদুর রহমান মুবারকপুরী (রহ:) বলেন, হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, উট ও গরুর ভাগাভাগি এক বাড়ীর কিংবা বিভিন্ন বাড়ীর লোকেদের মধ্যে হতে পারে। কিন্তু বকরী ও ভেড়াতে ভাগাভাগি এক বাড়ীরই লোকেদের মধ্যে হতে হবে। বিভিন্ন পরিবারের লোকেদের মধ্যে ভাগাভাগি বকরীতে প্রমাণিত নেই (তুহফাতুল আহওয়াযী, ২য় খণ্ড, ৩৫৮ পৃষ্ঠা)। ইমাম শাফিয়া (রহঃ) বলেন, হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় যেসব সাহাবী ভাগাভাগিতে শরীক হয়েছিলেন তাঁরা বিভিন্ন গোত্রের এবং বিভিন্ন বংশের লোক ছিলেন (কিতাবুল উম্ম, ২য় খণ্ড, ১৮৮ পৃষ্ঠা)।

মৃতব্যক্তির তরফ থেকে কুরবানীর মসলা

আনাশ(রঃ) বলেন, আমি হযরত আলী (রাযিঃ)-কে দুটি দুম্বা কুরবানী করতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি ব্যাপার? তিনি বললেন, রসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর তরফ থেকে আমাকে কুরবানী করার অসিয়াত করে গেছেন। তাই আমি তাঁর তরফ থেকে ঐ কুরবানী করছি (আবু দাউদ, তিরমিযী, মিশকাত ১২৮ পৃষ্ঠা। বাইহাকী, ৯ম খণ্ড, ২৮৮ পৃষ্ঠা)। মুস্তাদরকে হাকিমেও একটি সহী রিওয়ায়াত আছে যে, তিনি দুটি দুম্বা নবী (সঃ)-এর তরফ থেকে কুরবানী করেন এবং দুটি নিজের তরফ থেকে। উক্ত হাদীস প্রমাণ করে যে, মৃতব্যক্তির তরফ থেকে কুরবানী দেওয়া জায়েয (মিরকাত, ২য় খণ্ড, ২৬৫ পৃষ্ঠা)।

        এ ব্যাপারে তিরমিযী শরীফের ভাষ্যকার আল্লামা মুবারকপুরী বলেন, কেবল মৃতব্যক্তির তরফ থেকে কুরবানী দেওয়ার ব্যাপারে আমি একটিও সহী মরফু হাদীস রসূলুল্লাহ (স:) থেকে পাইনি। থাকলো আলী বর্ণিত হাদীস, ওটা যয়ীফ।

        তাই কোন ব্যক্তি যদি একটি কুরবানী কেবল মরা লোকদের তরফ থেকে করে এবং তাতে জ্যান্ত লোককে শরীক না করে তাহলে সাবধানতা অবলম্বনমুলক হিসেবে গোটা কুরবানীটাই সদাকাহ করা উচিত। যেমন আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক 'গুনয়‍্যাতুল আলমায়ী' গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন।

         তবে কোন ব্যক্তি যদি একটি কুরবানী নিজের এবং কিছু মৃতব্যক্তির তরফ থেকে দেয় কিংবা নিজের এবং স্বীয় পরিবার ও কিছু মরা লোকের তরফ থেকে দেয় তাহলে তার গোস্ত নিজে খেতে এবং পরিবারবর্গকে খাওয়াতে কোন আপত্তি নেই। আর ঐ কুরবানী গোটাটাই তাকে খয়রাত করতে হবে না। এ ব্যাপারে হানাফী ফকীহ আল্লামা মোহাম্মাদ আমীন ইবনে আবিদীন বলেন, যদি কেউ মৃতব্যক্তির তরফ থেকে কুরবানী করে তাহলে ঐ কুরবানীর গোস্ত খাওয়া ও সদাকার ব্যাপারে ঐরূপ করবে যেমন সে নিজের কুরবানীর ব্যাপারে করে। আর ওর নেকীটা মৃতব্যক্তি পাবে (তুহফাতুল আহওয়াযী, ২য় খণ্ড. ৩৫৪ পৃষ্ঠা, আওনুল মাবুদ ৩য় খণ্ড, ৫১ পৃষ্ঠা, রদদুল মুহতার, ৫ম খণ্ড, ২৮৫ পৃষ্ঠা)।

Post a Comment

0 Comments