কুরবানীর মাহাত্ম্য কি

        রসূলুল্লাহ (স:) বলেন, ইয়াওমুন নাহরে (অর্থাৎ বকরাঈদের দিনে) আদম সন্তান যত কাজ করে তন্মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় কাজ (কুরবানীর জানোয়ারের) রক্তপাত। ঐ জানোয়ার কিয়ামতের দিনে তার শিং ও পশম এবং খুরসহ নিশ্চয়ই হাযির হবে আর ওর খুন যমীনে পড়ার আগেই আল্লাহর কাছে তা কবুলিয়তের (গৃহীত হবার) দরবারে পৌঁছে যায়। অতএব তোমরা কুরবানী কোরে নিজেদের মনকে তৃপ্ত কর (তিরমিযী, ইবনে মাজা, মিশকাত, ১২৮ পৃষ্ঠা)।

    একদা সাহাবায়ে কিরাম রসূলুল্লাহ (স:)-কে জিজ্ঞেস করেন, কুরবানী কি? হে আল্লাহর রসূল! তিনি বললেন, এটা তোমাদের পিতা ইবরাহীম আলায়হিস সালা-মের সূন্নত ও আদর্শ। তাঁরা আবার প্রশ্ন করলেন, এতে আমাদের লাভ কি? তিনি বললেন, প্রত্যেক পশমের বদলে একটি কোরে নেকী আছে (মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজা, মিশকাত ১২৯ পৃষ্ঠা)

         একদা তিনি হযরত ফাতিমা রাযিয়াল্লা-হু আনহা-কে বলেন, ঐ জানোয়ারের প্রত্যেক রক্তবিন্দুর বদলে তোমার একটি কোরে গোনাহ্ মাফ হবে এবং ঐ জানোয়ারটিকে তার খুন ও গুস্তসহ তোমার দাঁড়িপাল্লাতে সত্তর গুণ ভারী কোরে দেওয়া হবে (আবুল কাসেম ইসবাহানী, মিরআত, ২য় খণ্ড, ৩৬২ পৃষ্ঠা)। কথাটি শুনে হযরত আবু সায়ীদ খুদরী (রাযিঃ) জিজ্ঞেস করেন, ইয়া রাসূলাল্লা-হ! ঐ নেকী হযরত মুহাম্মাদ (স:) এর বংশের জন্য খাস, না সর্বসাধারণের জন্যেও? তিনি বললেন, এটা মুহাম্মাদ (স:) এর বংশ এবং সর্বসাধারণ সবারই জন্য (আব্দুবনু হুমাইদ, ইবনে আবিদ দুনয়্যা ফিল আযা-হী, বাইহাকী, কানযুল উমমাল, ৫ম খণ্ড, ১১৯ পৃষ্ঠা ও ৫১ পৃষ্ঠা, মুস্তাদরকে হাকিম, ৪র্থ খণ্ড, ২২২ পৃষ্ঠা ও নাসবুর রায়াহ, ৪র্থ খণ্ড, ২১৯ পৃষ্ঠা)।

        আল্লামা আবু বাকর ইবনুল আরাবী তিরমিযীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ আ-রিযাতুল আহ্ওয়াযীতে বলেন, কুরবানীর ফযীলত ও মাহাত্ম্য সংক্রান্ত একটি হাদীসও সহী বা বিশুদ্ধ নয় (তালখীসুল হাবীর, ২য় খণ্ড, ৩৮৪ পৃষ্ঠা)। ইমাম ইবনে হায্যও তাই বলেন (আল-মুহাল্লা, ৭ম খণ্ড, ৩৫৭ পৃষ্ঠা)। আল্লামা উবায়দুল্লাহ রহমানী বলেন, ঐ সমস্ত হাদীসগুলোর সনদ আপত্তিমুক্ত না হলেও ওরা একে অপরকে সমর্থন করার ফলে সবাই সমষ্টিগতভাবে যয়ীফ থেকে হাসানের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। আর এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আমলের ফযীলত ও মাহাত্ম্য সংক্রান্ত ব্যাপারে যয়ীফ হাদীস গ্রহণযোগ্য (মিরআত, ২য় খণ্ড, ৩৬৩ পৃষ্ঠা)।

        দারিদ্রের কারণে যার উপরে কুরবানী নেই তার কুরবানীদাতার সাথে সাদৃশ্য পেশ করার জন্য কুরবানীর দিনে মুরগী ও মোরগ কুরবানী দেওয়া আপত্তিকর। কারণ, এটা অগ্নিপূজকদের প্রথা (ফাতা-ওয়া আলমগীরী ৪র্থ খণ্ড, ৮১ পৃষ্ঠা)।

মুসাফির কুরবানী দেবে কি না

        চার মযহাবের মধ্যে কেবল হানাফী ফিরে ফতওয়া মুসাফিরের উপর কুরবানী নেই এবং যার উপরে যাকাত দেওয়া ফরয নয় তার উপরেও কুরবানী নেই। এর প্রমাণে হিদায়াতে এই হাদীস পেশ করা হয়েছে যে, হযরত আবূ বাক্স ও হযরত উমার রাযিয়াল্লা-হু আনহুমা মুসাফির অবস্থায় কুরবানী করেননি এবং হযরত আলী থেকে বর্ণিত আছে যে, ফকীর ও মুসাফিরের উপরে কুরবানী নেই (হিদায়া ৪র্থ খণ্ড, ৩৪৫ পৃষ্ঠা)।

        উক্ত দুটি হাদীসের ব্যাপারে হেদায়ায় বর্ণিত সমস্ত হাদীসের বরাত উদ্ধারকারী আল্লামা যায়লায়ী হানাফী বলেন, দুটি হাদীসই গরীব ও বিরলসূত্র (নাসবুর রায়াহ, ৪র্থ খণ্ড, ২১১ পৃষ্ঠা)। দেওবন্দের সাবেক শাইখুল হাদীস আল্লামা আর শাহ কাশ্মীরী (রহ:) যাঁকে 'হাফিযুদদুনয়্যা, বলে আখ্যায়িত করতেন সেই হাফিয ইবনে হাজার আস্কালানীও বলেন, উক্ত হাদীস দুটি আমি কোথাও খুঁজে পাইনি। তাছাড়া হযরত আবু বাক্স ও হযরত উমার সফরে কেন, কেন সও তাঁরা কুরবানী করেননি এই ভয়ে, যাতে লোকেরা কুরবানীকে অজেব মনে না করে (হিদায়াহ মুজতাবায়ী দিল্লী ছাপার ৪র্থ খণ্ডের ৪৪৫ পৃষ্ঠার টিকায় মুদ্রিত আদদিরায়াহ দেখুন)। ইবনে আবিদ দুনয়‍্যা আযাহীতে, ইমাম হাকিম কুনা-তে এবং বায়হাকী ও সায়ীদ ইবনে মনসুর প্রমুখও বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আবু বাক্স, হযরত উমার'ও বদরী সাহাবী হযরত আবু মসউদ প্রমুখ কোনদিনই কুরবানী করেননি (কানযুল উমমাল, ৫ম খণ্ড, ১১৮ পৃষ্ঠা ও তালখীসুল হাবীর, ২য় খণ্ড, ৩৮৬ পৃষ্ঠা)।

        এ ব্যাপারে ভারতীয় মুহাদ্দিস তিরমিযীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ তুহফাতুল আহ্ওয়াযী প্রণেতা আল্লামা আবদুর রহমান মুবারকপুরী এবং তাঁর শিক্ষাগুরু ইমাম নাযীর হোসায়ন দেহলভী বলেন, কুরবানী দেনেওয়ালাকে যাকাত দেনেওয়ালা ও ঘরে বসবাসকারী হওয়ার এবং মুসাফির না-হওয়ার শর্তের ব্যাপারে হাদীসে কোন দলীল পাওয়া যায় না। বরং মুসাফিরের কুরবানী করার ব্যাপারে হাদীসে ফিরে উল্টো দলীল পাওয়া যায়। যেমন ইমাম বুখারী (রহ:) মুসাফিরের কুরবানী করার ব্যাপারে একটি বাব বা পরিচ্ছেদ রচনা করেছেন এবং ঐ বাবের অধীনে একটি হাদীসও উল্লেখ করেছেন যে, রসূলুল্লাহ (স:) মক্কা সফরে কুরবানী করেছিলেন (ফাতা-ওয়া নাযীরিয়্যাহ, ২য় খণ্ড, ৪৫৩ পৃষ্ঠা)

        তাই ইমাম ইবনে হাযম বলেন কুরবানীর ব্যাপারে মুকীম ও মুসাফির অর্থাৎ ঘরে বসবাসকারী ও সফরকারীর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। থাকলো নায়ী বর্ণিত, হযরত উমার হজ্জ করতেন কিন্তু কুরবানী দিতেন না-হাদীসটি মুরসাল এবং হযরত আলী বর্ণিত-মুসাফেরের উপরে কুরবানী নেই-হাদীসটির এক রাবী হা-রিস ডাহা মিথ্যুক। আর ইবনে মসউদের সাথীগণ হজ্জে কুরবানী দিতেন না এ দ্বারা একথা প্রমাণিত হয় না যে, মুসাফিরকে আদৌ কুরবানী দিতে হবেনা। বরং ওর দ্বারা শুধু এইটুকু প্রমাণিত হয় যে, তাঁরা কুরবানী দিতেন না। কিন্তু রসূলুল্লার হাদীসের মোকাবেলায় অন্য কারো আমলই দলীলযোগ্য হতে পারে না। কারণ, কুরবানী করা ভাল কাজ। এই ভাল কাজ থেকে বিরত থাকা ততক্ষণ বৈধ হবেনা যতক্ষণ রসূলুল্লাহ (স:) থেকে কোন হাদীস না পাওয়া যাবে (আল মুহাল্লা, ৭ম খণ্ড, ৩৭৫ পৃষ্ঠা)। 

        অতএব কোন মুসাফির যদি সফরে থাকাকালিন কুরবানী দেবার সামর্থ রাখে তাহলে সে রসূলুল্লাহ (স:) এর আজীবন-সুন্নত পালনের চেষ্টা অবশ্যই করবে। যদি কারো পক্ষে সৎ নিয়্যাতে আল্লাহর ওয়াস্তে সওয়াবের উদ্দেশ্যে ধার কোরে কুরবানী দেওয়া সম্ভব হয় তাহলে সে তাও করার চেষ্টা করবে।

Post a Comment

0 Comments