পশু যবহের নিয়মাবলী

 

        হযরত আনাস বলেন, একদা রসূলুল্লাহ (স:) নিজহাতে শিংওলা দুটি ছিটফুট দুম্বা কুরবানী করেন। আমি দেখলাম যে, তিনি ওদের ঘাড়ে পা দিয়ে বিসমিল্লাহ এবং আল্লা-হু আকবার বলে যবহ করলেন। আয়িশার বর্ণনায় আছে, তিনি তাঁকে বললেন, একটি ছুরি আনো এবং ওটাকে পাথরে ঘষে শান দাও। আমি তাই করলাম। তারপর তিনি ছুরিটা ধরলেন এবং দুম্বাটা ধরে শুইয়ে ফেললেন। অতঃপর যবহ করলেন। তারপর বললেন, বিসমিল্লাহ, আল্লা-হুম্মা তাকাব্বাল মিম মুহাম্মাদিন অআ-লি মুহাম্মাদিও অমিন উম্মাতি মুহাম্মাদ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত, ১২৭ পৃষ্ঠা)।

        উক্ত হাদীসগুলো দ্বারা কতিপয় বিষয় প্রমাণিত হয়। যেমন (ক) নিজহাতে কুরবানী করা (খ) ছুরি শান দেওয়া (গ) জানোয়ারকে শোয়ানো (ঘ) দুআ পড়া (ঙ) ছুরি চালানো বা যবহ করা। উক্ত বিষয়গুলোর বিশদ বর্ণনা এই।

নিজহাতে কুরবানী করা উচিত

        উপরোক্ত আনাস বর্ণিত বুখারী ও মুসলিমের হাদীস সহ অগণিত হাদীস প্রমাণ করে যে, রসূলুল্লাহ (সঃ) নিজহাতে কুরবানী করতেন এবং সাধ্যমত অন্য কাউকে দিয়ে কুরবানী করাতেন না। অতএব তাঁর উম্মতেরও উচিত তাঁর আদর্শ যথাসাধ্য পালনের চেষ্টা করা এবং নিজহাতে কুরবানী করা। আল্লামা মাযহার বলেন, প্রত্যেকেরই নিজহাতে কুরবানী করা সুন্নত। কারণ, যবহ করাটা একটী ইবাদত। আর নিজের ইবাদত নিজে করাই উত্তম। যদিও এই ইবাদত অন্যকেও দিয়ে করানো বৈধ (মিরকাত, ২য় খণ্ড, ২৬০ পৃষ্ঠা)।

        অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, নিজহাতে কুরবানী করার ফলে এবং কুরবানী করার সময় কুরবানীগাহে হাযির থাকার ফলে অনেক কাপুরুষ ও ভীরু ব্যক্তির কাপুরুষতা ও ভীরুতা কেটে গিয়ে তাদের মনে সাহসের সঞ্চার হয়েছে।

        মুসলিম শরীফ ১ম খণ্ড, ৩৯৯ পৃষ্ঠায় আছে, একবার নবী (স:) নিজে ৬৩টি জন্তু যবহ করার পর ৩৭টি জানোয়ার হযরত আলীকে দিয়ে যবহ করিয়েছিলেন। এই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, অন্যকে দিয়েও কুরবানী করা যায়। তবে তা উত্তম নয়, বরং জেহাদী-জাতির প্রত্যেক সদস্যকে নিজহাতে কুরবানী কোরে কিছুটা সাহসী হওয়া উচিত। যদি কেউ সক্ষম হোয়েও নিজ হাতে কুরবানী না করে তাহলে কুরবানীর সময় সে যেন ঘরের কোণে বসে না থাকে, বরং কুরবানীর জন্তর পাশে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। যেমন একটি যয়ীফ হাদীসে আছে যে, রসূলুল্লাহ (স:) হযরত ফাতিমাকে তার কুরবানীর কাছে গিয়ে দাঁড়াতে এবং সেখানে হাযির থাকতে নির্দেশ দিয়েছিলেন (হাকিম, বাইহাকী, মিরআত, ২য় খণ্ড, ৩৫০ পৃষ্ঠা)।

মেয়েরাও কুরবানী করতে পারেঃ

ইমাম বুখারী তরজমাতুল বা-ব বা পরিচ্ছেদের শিরোনামায় এবং ইমাম হাকেম স্বীয় মুস্তাদরকে মুসাইয়েব ইবনে রাফি থেকে বর্ণনা করেছেন যে, সাহাবী আবু মুসা আশআরী (রাযিঃ) তাঁর মেয়েদেরকে নিজহাতে তাঁদের কুরবানীর জানোয়ার যবহ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন (বুখারী, ৮৩৩ পৃষ্ঠা ও ফতহুল বারী, ১০ম খণ্ড, ১৯ পৃষ্ঠা)।

        উক্ত হাদীস প্রমাণ করে যে, মেয়েরাও নিজহাতে কুরবানী করতে পারে। আহলে হাদীসদের মত তাই। কিন্তু ইমাম মালিকের মতে মেয়েদের কুরবানী আপত্তিকর এবং শাফিয়ীদের মতে মেয়েরা নিজেরা কুরবানী না কোরে অন্য কাউকে দিয়ে করাবে (ফাতহুল বারী, ১০ম খণ্ড, ১৯ পৃষ্ঠা)। 

        ইমাম নবভী বলেন, যদি কেউ অন্যের দ্বারা যবহ করায় তাহলে সে যেন যন্ত্রের নিয়মকানুন জানা মুসলমান হয় এবং অগ্নিপূজক ও প্রতিমাপূজক না হয়। তবে সে কিতাবী অর্থাৎ ইহুদী বা খৃষ্টান হলে চলবে। কিন্তু কিতাবীর তুলনায় মুসলমান বালক উত্তম এবং মুসলিম বালকের চেয়ে হায়েযওলী নারী শ্রেয় (রওযাতুত তা-লিবীন, ৩য় খণ্ড, ২০০ পৃষ্ঠা)। যাতে কোরে নারীগণও সাহসী হয় এবং শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে বীরাঙ্গনা খাওলার মত শত্রুদের ঘায়েল করতে সমর্থ হয় এবং ভয়ে না পালায়।

ছুরি শান দেওয়ার কারণ এবং সাবধানতা অবলম্বনঃ

        রসূলুল্লাহ (স:) বলেন, আল্লাহ তাবারক অতাআ-লা প্রত্যেক জিনিষের প্রতি সুন্দর ব্যবহার অপরিহার্য করেছেন। অতএব যখন তোমরা হত্যা কর তখন সুন্দরভাবে হত্যা কর এবং যখন তোমরা যবৃহ কর তখন সুন্দরভাবে যবহ কর। আর তোমাদের প্রত্যেকে যেন তার ছুরিটা শান দিয়ে নেয় এবং যবহকৃত জন্তুকে যেন আরাম পৌঁছায় (মুসলিম, মিশকাত, ৩৫৭ পৃষ্ঠা, তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাজা, নাসবুর রায়াহ, ৪র্থ খণ্ড, ১৮৭ পৃষ্ঠা)। 

        আবদুল্লাহ ইবনে উমার থেকে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ (সঃ) ছুরি শান দেবার এবং জানোয়ার থেকে তা লুকোবার নির্দেশ দিয়েছেন আর তিনি এও বলেছেন যে, তোমাদের কেউ যখন যবহ করবে তখন সে যেন খুব তাড়াতাড়ি যবহ করে (ইবনে মাজা, ২৩৬ পৃষ্ঠা)। ইবনে আব্বাস বলেন, একদা এক ব্যক্তিকে একটি বকরী শুইয়ে ফেলে ছুরি শান দিতে দেখে নবী (স:) বলেন, তুমি কি ওকে কয়েকটি মরণ দিতে চাও? শোয়াবার আগে ছুরিটি শান দাওনি কেন? (মুস্তাদরকে হাকিম, ৪র্থ খণ্ড, ২৩১ পৃষ্ঠা, তালম্বীসুল হাবীর, ৩৮৬ পৃষ্ঠা)। মুঅত্তা ইমাম মা-লিকে বর্ণিত আছে যে, একজন লোক একটি বকরীকে শুইয়ে ফেলে ছুরি শান দেওয়ায় হযরত উমার তাকে চাবুক মেরে বলেন, তুমি কি এর রূহকে শাস্তি দিচ্ছ? (শান দেবার) এই কাজটি ওকে ধরবার আগে করনি কেন (নাসবুর রায়াহ, ৪র্থ খণ্ড, ১৮৮ পৃষ্ঠা, কানযুল উম্মাল, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ১৪০ পৃষ্ঠা)?

        উক্ত ৪টি হাদীস প্রমাণ করে যে, জানোয়ারকে শোয়াবার আগে তার অগোচরে খুব ভাল কোরে ছুরিটা শান দিয়ে যত জলদি সম্ভব তাকে যবহ করতে হবে এবং যত কম কষ্ট দিয়ে তাকে যবহ করা যায় তার সাধ্যমত চেষ্টা করতে হবে।

        তাই ইমাম নবভী বলেন, জানোয়ারের সামনে ছুরি শান দেওয়া এবং একটি জন্তুর উপস্থিতিতে অন্যটাকে যবহ করা এবং যবহের জায়গায় জন্তুকে টেনে টেনে নিয়ে যাওয়া অনুচিত (শারহে মুসলিম, ২য় খণ্ড, ১৫২ পৃষ্ঠা)। কিছু বিজ্ঞ আলিম বলেন, যবহের সময়ও জানোয়ারটি যাতে ছুরি দেখা না পায় সেজন্য তার চোখ দুটো হাত দিয়ে ঢেকে দেওয়া উচিত এবং উক্ত আদবকায়দা সাধ্যমত পালন করা উচিত।

Post a Comment

0 Comments