কুরবানী কার কার তরফ থেকে দিতে হবে
কোন পরিবারের প্রধান ছাড়া ঐ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের তরফ থেকে কুরবানী দিতে হবে কিনা-ব্যাপারে ইমাম ইবনে হাজম বলেন, যদি কেউ তার বিবি কিংবা ছেলেমেয়ে অথবা বাঁদীর তরফ থেকে কুরবানী দেয় তাহলে তা উত্তম, কিন্তু না দিলে আপত্তি নেই (আল মুহাল্লা, ৭ম খণ্ড, ৩৫৫ পৃষ্ঠা)। এ ব্যাপারে হানাফীদের ফাওয়া এই যে, যার উপরে কুরবানী ওয়াজিব তার উপরে তার বড় ছেলেমেয়ে এবং স্ত্রীর তরফ থেকে কুরবানী দেওয়া ওয়াজেব নয়। থাকলো নাবালক ছেলেমেয়ে, ওদের ব্যাপারে যা-হিরী রিওয়ায়েতের ফাওয়া হল কুরবানী দেওয়া ওয়াজিব নয়, তবে দেওয়াটাই উত্তম। ফাতাওয়া কাযীখানে আছে যে, কোন নাবালক সন্তানের কাছে যদি মূলধন থাকে তাহলে হানাফী কিছু ফকীহদের মতে তার বাপের উপরে কুরবানী ওয়াজেব (ফাতা-ওয়া আলমগীরী, কানপুরী ছাপা, ৪র্থ খণ্ড, ৭৭ পৃষ্ঠা)। বাদায়িতে আছে, যদি কোন সামর্থবান নাবালক কুরবানীর দিনে সাবালকত্বে পৌঁছে যায় তাহলে হানাফী সমস্ত ককীহের ঐক্যমতে তার উপরে কুরবানী ওয়াজিব (ঐ, ৭৮ পৃষ্ঠা)।
ভারতের বিখ্যাত হানাফী মুফতী মওলানা কিফায়াতুল্লাহ (রহ:) বলেন, যদি কোন পিতার অধীনে কয়েকজন সাবালক রোজগারী পুত্র থাকে এবং তারা সবাই যদি যাকাত দেবার মালিক হয় তাহলে সবারই তরফ থেকে একটি কোরে কুরবানী দিতে হবে। যদি তার বিবিরাও যাকাত দেবার মালিক হয় তাহলে তাদেরও কুরবানী আলাদাভাবে দিতে হবে (কিফায়াতুল মুফতী, ৮ম খণ্ড, ১৯৩ পৃষ্ঠা, ফতওয়া নং ২২৪)। এ ব্যাপারে আহলে হাদীসদের ফতওয়া ঐরূপ ইমাম ইবনে হায্য বলেছেন যেরূপ। অর্থাৎ কোন সামর্থবান ব্যক্তি যদি তার অধীনস্থ স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের তরফ থেকে কুরবানী দেয় তাহলে উত্তম, না নেই। তার দলীল হল পূর্বে বর্ণিত হাদীসসমূহ।
দিলে আপত্তি কলকাতা-মেটিয়াবুরুজের আহলে হাদীসদের মধ্যে এই ফাওয়া প্রচলিত আছে যে, কোন পরিবারের প্রধান যদি কুরবানী দেবার সামর্থ রাখে তাহলে তার অধীনস্থ স্ত্রী এবং সাবালক ও নাবালক ছেলেমেয়ের মাথা গুণে প্রত্যেক সাতজন পিছু একটি কোরে গরু বা উট কুরবানী দেওয়া হয়। এই হিসেবে যেসব সামর্থবান পরিবারের সদস্য সংখ্যা সাতের অধিক হয় তারা একাধিক গরু বা উট কুরবানী দিয়ে থাকেন, বরং প্রচলিত ফতওয়া অনুযায়ী সমাজ রক্ষার খাতিরে দিতে বাধ্য হন। অন্যথায় অনেককে পরের কটাক্ষ শুনতে হয়। এইরূপ ফাওয়ার প্রমাণে কোন হাদীস আমার নযরে পড়েনি। তাই বলছি, এই ফাতওয়ার প্রমাণে কোন হাদীস যদি সারা পৃথিবীর কোন আলেম জেনে থাকেন তাহলে ঐ হাদীসটা হাদীসগ্রন্থের খণ্ড ও পৃষ্ঠার বরাতসহ আমাকে জানালে বাধিত হব। অন্যথায় আমার তো মনে হয় যে, যে-একান্নভুক্ত পরিবারের সদস্য সংখ্যা সাতের অধিক পূর্বোক্ত হাদীস অনুযায়ী তাদের সবার তরফ থেকে একাধিক গরু বা উট, না দিয়ে একটি কুরবানীই যথেষ্ট। তবে কোন সামর্থবান ব্যক্তি যদি অগণিত নেকী লাভের উদ্দেশ্যে একাধিক কুরবানী দেয় তাতে আপত্তি নেই। বরং দেওয়াটাই উচিত।। যেমন মেটিয়াবুরুজের সামর্থবান ব্যক্তিরা সাতভাগ হিসেবের হাদীস অনুযায়ী একাধিক গরু কুরবানী দিয়ে থাকেন! দৃষ্টান্ত স্বরূপ, যেমন একবার রসূলুল্লাহ (স:) একশো উট কুরবানী দিয়েছিলেন (মুসলিম, ১ম খণ্ড, ৩৯৯ পৃষ্ঠা)। তাছাড়া একাধিক কুরবানী দিতে তিনি মানাও করেননি। ইমাম ইবনে হাযম তাই বলেন (আল মুহাল্লা, ৭ম খণ্ড, ৩৮১ পৃষ্ঠা)।
কুরবানীতে ভাগাভাগী কিরূপ হবে
মুসলিম, তিরমিযী, আবূ দাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাজা, দারাকুতনী ও মুজামে তাবারানী প্রভৃতিতে বহু হাদীস বর্ণিত আছে যে, উট ও গরুতে সাতজন লোক ভাগে কুরবানী দিতে পারে। তিরমিযী, নাসায়ী, মুসনাদে আহমাদ, সহীহ ইবনে হিব্বান ও মুস্তাদরকে হাকিম প্রভৃতিতে কতিপয় হাদীস আছে যে, উটে দশজন লোক ভাগে কুরবানী দিতে পারে (নাসবুর রায়াহ, ৪র্থ খণ্ড, ২০৯-২১০ পৃষ্ঠা, কানযুল উমমাল, ৫ম খণ্ড, ৪৪ পৃষ্ঠা)।
উটে ভাগ সম্পর্কে সাত ও দশ উভয় প্রকার হাদীস বর্ণিত হওয়ায় ইসলামী পণ্ডিতদের মধ্যে কিছু মতভেদ হয়েছে। তাই হানাফী, শাফিয়ী ও অধিকাংশ বিদ্বানের মতে উটে ৭ ভাগ হবে এবং ইব্রাতে রসূল বা রসূলুল্লাহর বংশধর বলে কথিত পণ্ডিতবর্গ এবং ইসহাক ইবনে রাহ্অয়হে ও ইমাম ইবনে খুযায়মার মতে উটে দশ ভাগ চলবে। তবে গরুর ব্যাপারে সবাই একমত যে, তা সাতজনের তরফ থেকে হবে। ইমাম শওকানী বলেন, কুরবানীতে উটে দশজন এবং হাঙ্গতে উটে সাতজনের মসলা সঠিক (নায়লুল আওতার, ৪র্থ খণ্ড, ৩৫৪ পৃষ্ঠা)। ইমাম আহমাদের মতে উভয়ক্ষেত্রেই সাতজন। আল্লামা উবায়দুল্লাহ রহমানী বলেন, কুরবানীতে উটে দশভাগের ব্যাপারে ইবনে আব্বাস বর্ণিত স্পষ্ট হাদীস যখন রয়েছে তখন হাঙ্গর সাথে কিয়াস করার কি প্রয়োজন? (মিরআত, ২য় খণ্ড, ৩৫৫ পৃষ্ঠা)। অর্থাৎ আহলে হাদীস মতে উটেও দশভাগ চলবে।
ভাগাভাগিতে কোন শর্ত আছে কি
ইমাম আবু হানীফা, ইমাম শাফিয়ী ও ইমাম আহমাদের মতে কুরবানী এবং হাঈ দুটোতেই উট ও গরুতে সাতভাগ হবে। তার বেশী ভাগ চলবেনা। সেইসাথে ইমাম আবু হানীফা (রহ:) এই শর্তও লাগান যে, ঐ ভাগীদাররা যেন সবাই কুরবানীদাতা হয়। কিন্তু ইমাম শাফিয়ী, ইমাম আহমাদ এবং অন্যান্য বিদ্বানদের মতে কোন শর্ত নেই (মিরআত, ২য় খণ্ড, ৩৫৫ পৃষ্ঠা)।
কুরবানী তে যে ভাগাভাগি হবে ঐ ভাগীদারগণ অধিকাংশ আলিমের মতে একবাড়ীর হোক, কিংবা বিভিন্ন পরিবারের হোক, আত্মীয় হোক কিংবা অনাত্মীয় হোক তাতে কোন আপত্তি নেই (ঐ, পৃষ্ঠা-ঐ, মুঅত্তা ইমাম মুহাম্মাদ, ২৮৩ পৃষ্ঠা, রওযাতুত ত-লেবীন, ৩য় খণ্ড, ১৯৮ পৃষ্ঠা)। তবে ইমাম মালেক হাঙ্গর উপর অনুমান কোরে বলেন, যে, কুরবানীতে ভাগীদারগণ যেন আত্মীয়দের মধ্যে হয়, অনাত্মীয় না হয় (বিদায়তুল মুজতাহিদ ওয়া নিহায়তুল মুক্তাসিদ,
১ম খণ্ড, ৪২১ পৃষ্ঠা)। তিনি অন্যত্রে বলেন, একটি উট, কিংবা একটি গরু অথবা একটি ভেড়া বা বকরী একজন পরিবার প্রধান ও তার পরিবারের তরফ থেকে যথেষ্ট হবে। যদিও তাদের সংখ্যা সাতের অধিক হয়। তবে এই শরিক নেকী ও সওয়াবে হবে, দামে ও মূল্যে হবেনা এবং অচেনা লোকেদের মধ্যে হবেনা (আল মুহাল্লা, ৭ম খণ্ড, ৩৮১ পৃষ্ঠা)। অধিকাংশ মুহাদ্দিসীনে কিরামের মতানুযায়ী আহলে হাদীসদের মতে কুরবানীর ভাগাভাগিতে পূর্বোক্ত ইমামদের মত কোন কিছুরই শর্ত নেই। তবে সেইসঙ্গে একথা জেনে রাখা ভালো যে, গরু ও উটের ভাগীদার সাত বা দশ পরিবারের একজন কোরে ব্যক্তি ভাগীদার হবে (মিরআ-ত, ২য় খণ্ড, ৩৫৫ পৃষ্ঠা)। সাত বা দশ পরিবারের সমস্ত ব্যক্তি ভাগীদার হবে এমন প্রমাণ হাদীসে পাওয়া যায় না।
0 Comments