হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সল্লাল্লা-হু আলাইহি অসাল্লাম নবী হবার পর মক্কায় তেরটি বছর কাটান। তারপর তিনি আল্লাহ্র নির্দেশে মদীনায় চলে যান। অতঃপর কিছুদিনের মধ্যে তিনি আল্লাহর তরফ থেকে কুরবানী দেবার আদেশ পান। এই হুকুম পাবার পর তিনি দশ বছর বেঁচেছিলেন। তাই ঐ দশ বছরই তিনি কুরবানী করতে থাকেন। যেমন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাযিঃ) বলেন, রসূলুল্লাহ (সঃ) দশ বছর মদীনায় অবস্থান করেন এবং কুরবানীও করতে থাকেন (তিরমিযী, ১ম, খণ্ড, ১৮২ পৃষ্ঠা, মিশকাত ১২৯ পৃষ্ঠা।) হাফেয ইবনুল কাইয়িম বলেন, তিনি (স:) কখনো কুরবানী ফাঁক দেননি। (যা-দুল মাআ-দ, ১ম খণ্ড, ২৪৬ পৃষ্ঠা।) উক্ত বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কুরবানী সুন্নতে মোআক্কাদা। এটা ফরয ও ওয়াজিব নয়।
তবে কোন কোন হাদীস দ্বারা বাহ্যতঃ মনে হয় যে, কুরবানী অজেব বা অবশ্য পালনীয় কাজ। যেমন ইবনে মাজার একটি হাদীসে আছে:- রসূলুল্লাহ (স:) বলেন, যে-ব্যক্তি কুরবানীর সামর্থ রাখে অথচ কুরবানী করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে। (ইবনে মাজা, ২৩২ পৃষ্ঠা।) আল্লামা জামালুদ্দীন আবদুল্লাহ যায়লায়ী বলেন, এই হাদীসটি মুসনাদে আহমাদ, মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, মুসনাদে আবু ইয়ালা, সুনানে দারাকুতনী ও মুস্তাদরকে হাকিম প্রভৃতিতেও বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু এর কয়েকটি বর্ণনার সনদ রসূলুল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছয় না, বরং তা সাহাবী আবূ হুরাইরা পর্যন্ত শেষ হোয়ে যায়। সুতরাং হাদীসটি মরফু নয়, বরং মাউকুফ (নাসবুর রা-য়াহ ৪র্থ খণ্ড ২০৭ পৃষ্ঠা)। ইমাম তাহাভীও বলেন, মাউকূফ হওয়াটা সঠিক। তথাপি এ হাদীসে কুরববানী ওয়াজিব হওয়ার স্পষ্ট নির্দেশ নেই (ফাতহুল বারী ১০ম খণ্ড ১ম পৃষ্ঠা)। এই হাদীসটির একজন রাবী আবদুল্লাহ ভুবনে আইয়্যাশকে ইমাম আবু দাউদ এবং ইমাম নাসায়ী যয়ীফ ও দুর্বল বলেছেন (ইবনে মাজার উক্ত পৃষ্ঠায় বায়নাস সুতুর দেখুন)। সুতরাং হাদীসটি দলীল যোগ্য নয়। আল্লামা ইবনুল জাওযী 'তাহকীক গ্রন্থে বলেন, এই হাদীসটি ওয়াজিব প্রমাণ করে না। যেমন ঐ হাদীস-যে ব্যক্তি রসুন খায় সে যেন আমাদের নামায পড়ার জায়গার নিকটেই না আসে-উক্ত হুকুমটিকে অজের প্রমাণ করে না (নাসবুর রায়াহ ৪র্থ খণ্ড ২০৭ পৃষ্ঠা)।
সুনানে আরবাআ ও মুসনাদে আহমাদের একটি হাদীসে আছে-হে মানবমণ্ডলী! প্রত্যেক পরিবারের উপর প্রতি বছরে একটি কোরে কুরবানী ও আতীরাহ নিশ্চয়ই আছে। এই হাদীস সম্পর্কে হাফিয ইবনে হাজার আস্কালানী বলেন, এ হাদীসটিতেও কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার স্পষ্ট শব্দ নেই। তাছাড়া এই রিওয়ায়াতে কুরবানীর সাথে "আতীরারও” উল্লেখ আছে, যা সর্বসম্মত মতে ওয়াজিব তো নয়ই, বরং অন্য হাদীস দ্বারা বাতিল বলে প্রমাণিত (ফতহুল বারী ১০ম খন্ড ২য় পৃষ্ঠা)।
কোন সহী ও বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা কুরবানী অজেব প্রমাণিত না হলেও রসূলুল্লাহ্র সর্বদা আমল দ্বারা কারো কারো মনে অজেব হওয়ার 'সন্দেহ হয়। তাই একজন লোক নবীজীর সুন্নতের আশেক আবদুল্লাহ ইবনে উমারকে জিজ্ঞেস করেন, কুরবানী কি ওয়াজেব অর্থাৎ অবশ্য পালনীয় কাজ কি? উত্তরে তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সঃ) কুরবানী দিতেন এবং মুসলমানেরাও করতেন। এই উত্তরে প্রশ্নকারী দ্বিধামুক্ত না হওয়ায় তিনি আবার প্রশ্ন করেন, এটা ওয়াজিব কি না? উত্তরে তিনিও আবার বললেন, তুমি বুঝতে পারছো না। আমি তো বলছি, রসূলুল্লাহ (স:) কুরবানী করতেন এবং তাঁরপর সাধারণ মুসলমানেরাও কুরবানী দিত। তারপর থেকে এই সুন্নত জারী আছে (তিরমিযী ১ম খণ্ড ১৮২ পৃষ্ঠা ও ইবনে মাজা ২৩২ পৃষ্ঠা)।
ইমাম তিরমিযী বলেন, আহলে ইল্ম বা কুরআন হাদীস জ্ঞানীদের আমল এই ছিল যে, কুরবানী ওয়াজিব নয়, বরং নবী (সঃ)-এর সুন্নতের মধ্যে এটি একটি সুন্নত (তিরমিযী ১ম খণ্ড ১৮২ পৃষ্ঠা)। মুসনাদে আহমাদ, আবু ইয়ালা, তাবারানী, দারাকুতনী ও হাকিম প্রভৃতিতে একটি যয়ীফ হাদীসে ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত আছে, রসূলুল্লাহ (স:) বলেন, আমার উপর কুরবানী ফরয, কিন্তু তোমাদের উপর নয় (ফতহুল বারী ১০ম খণ্ড ৪র্থ পৃষ্ঠা)। অন্য বর্ণনায় আছে, তিনি (স:) বলেন কুরবানী আমার উপরে ফরয এবং তোমাদের উপরে সুন্নত (তাবারানী কানযুল, উমমা-ল ৫ম খণ্ড ৪৩ পৃষ্ঠা)।
কুরবানী "সুন্নত” হওয়া সম্পর্কে সহী ও যয়ীফ হাদীসে স্পষ্ট উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও কোন কোন যয়ীফ হাদীস দ্বারা পরোক্ষভাবে তা ওয়াজিব হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়ার কারণে উলামায়ে কিরামের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে যে, কুরবানী সুন্নত, না ওয়াজিব অর্থাৎ শুধু করণীয়, না অবশ্য পালনীয়? ইমাম আবু হানীফার (রহ:) মতে প্রত্যেক স্বাধীন, ধনী ও ঘরে অবস্থানকারী মুসলমানের উপরে কুরবানী ওয়াজিব (হিদায়া ৪র্থ খণ্ড ৪৪৩ পৃষ্ঠা)। ইমাম শাফিয়ী (রহ:) বলেন, কুরবানী সুন্নত। একে আমি ত্যাগ করা পছন্দ করিনা (কিতাবুল উম্ম ২য় খণ্ড ১৮৭ পৃষ্ঠা)। ইমাম মালিক বলেন, কুরবানী সুন্নত; ওয়াজিব নয় এবং কোন ব্যক্তি সামর্থ থাকা সত্ত্বেও একে বর্জন করে আমি তা পছন্দ করি না (মুআত্তা ইমাম মালিক ১৮৯ পৃষ্ঠা)। ইনি ইমাম আবু হানীফার মত "ঘরে অবস্থানকারীর" শর্ত লাগাননি। ইমাম আহমাদ বলেন, সামর্থ থাকা সত্ত্বেও তা বর্জন করা আপত্তিকর। হানাফীদের ইমাম আবু ইউসুফ, মালিকীদের ইমাম আশহাব এবং জমহুর ও অধিকাংশ আলিমের মতে তা সুন্নতে মুআক্কাদা (ফতহুল বারী ১০ম খণ্ড ১ম পৃষ্ঠা)। ইমাম ইবনে হাযম বলেন, কুরবানী সুন্নত, ফরয নয়। কোন সাহাবী থেকেও সহী সনদে প্রমাণিত নেই যে, কুরবানী ওয়াজিব (মুহাল্লা ৭ম খণ্ড ৩৫৫-৩৫৮ পৃষ্ঠা)।
উপরোক্ত সমস্ত বর্ণনার সার এই যে, কুরবানী বিশ্বনবী (স:) এর আজীবন সুন্নত এবং তাঁর ইন্তেকালের পর থেকে মুসলিম জাহানের উচিত। যেমন হযরত আয়িশা রাযিঃ) একদা রসূলুল্লাহ (স:)-কে জিজ্ঞেস সার্বজনীন আমল এবং ইসলামের এক মহান বৈশিষ্ট্য। তাই কোন সামর্থবান মুসলমানের পক্ষে কুরবানী ত্যাগ করা মোটেই উচিত নয়। এমনকি ধার করেও যদি কুরবানী দেওয়া সম্ভব হয় তাও দেওয়া করেন যে, আমি দেনা কোরেও কুরবানী দেব কি? তিনি (সঃ) বললেন, হাঁ। কারণ, এই দেনা শোধ হবেই (দারাকুতনী, ২য় খণ্ড, ৫৪৪ পৃষ্ঠা)। এই হাদীসটি যয়ীফ হলেও মুহাদ্দিসীনে কিরাম ও ফকীহদের নিকট আমলযোগ্য। তবে কুরবানী-দাতাদের একটা কথা সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে যে, ঐ টাকা যেন সূদের টাকা না হয় এবং তাদের কুরবানী যেন লোক দেখানো কিংবা দুনিয়ায় নাম পাওয়া অথবা অহংকার প্রকাশ প্রভৃতির জন্য না হয়। কারণ, কুরবানীর ব্যাপারে আল্লাহ বলেন:
لَن يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا
وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِن يَنَالُهُ التَّقْوى مِنْكُمْ
(লাঁই য়্যানা-লাল্লা-হা লুহুমুহা অলা-দিমা-উহা অলার্কিই য্যানা-লুহুত্ তাওয়া-মিনকুম) অর্থাৎ আল্লাহ্র কাছে (তোমাদের) কুরবানীর জানোয়ারের গোস্ত এবং খুন কখনই পৌঁছয়না। বরং তোমাদের মনের তাওয়া ও খোদাভীতিই তাঁর কাছে পৌঁছয় (সূরা হজ্জ, ৩৭ আয়াত)। হাবীল ও কাবীলের কুরবানীর ব্যাপারেও আল্লাহ বলেন:
إنما يَتَقَبَّلُ اللهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ
(ইন্নামা-য়্যাতাকাব্ বালুল্লা-হু মিনাল মুত্তাকীন) অর্থাৎ আল্লাহ কেবল মুত্তাকী ও আল্লাহভীরুদেরই কুরবানী কবুল কোরে থাকেন (সুরা মা-য়িদা, ২৭ আয়াত)।
0 Comments