যখন হারাম মাল বের করে ফেলা হয় তখন তার তিনটি অবস্থা হয়। (ক) তার নির্দিষ্ট মালিক থাকলে তাকে তা' ফেরত দেয়া ওয়াজিব এবং তার অনুপস্থিতিতে তার ওয়ারিসকে দিয়ে দেয়া ওয়াজিব। যদি ওয়ারিসও অনুপস্থিত থাকে তবে মালিকের অপেক্ষা করতে হবে। (খ) হারাম জিনিসে যে মুনাফা বা উদ্বৃত্ত হয় তা' মালিকের নিকট পৌছে দেয়া বা তার উপস্থিতিতে তার প্রাপ্য একত্র করে তার নিকট দিয়ে দেয়া ওয়াজিব। (গ) যদি মালিক অজ্ঞাত থাকে এবং তাকে অনুসন্ধানেও না পাওয়া যায় এবং তার মৃত্যু হলে তার কোন ওয়ারিস বিদ্যমান আছে বা নাই তাও জানা না থাকলে তখন মালিকের নিকট ঐ দ্রব্য ফেরত দেয়া অসম্ভব বিধায় তা' নিজের নিকট রেখে দেবে। যে পর্যন্ত না ব্যপারটি প্রকাশ ও পরিষ্কার হয়। আবার অনেক সময় মালিক না থাকার কারণে হারাম মাল তাদেরকে ফেরত দেয়া সম্ভব হয় না। যেমন, গনিমত বা যুদ্ধলব্ধ সম্পত্তি। যদি একত্র করা সম্ভবও হয় তখন হাজার হাজার দীনারের মধ্যে হারাম দীনার পৃথক করা সম্ভব হয় না। এ অবস্থায় তার জন্য তা' দান করে দেয়াই উচিত। যদি মুক্ত বা ফাই মাল (যুদ্ধ ব্যতীত দ্রব্যসম্ভার) হস্তগত হয় এবং তা' সমস্ত মুসলমানের জন্য ব্যয় করার নির্দেশ থাকে। আর যদি তাতে সন্দেহ না থাকে তাহলে তা' দানকার্যে বা সেতু-পুল ইত্যাদি নির্মাণে ব্যয় করা উচিত। শাসনকর্তা নিজে তার ভার গ্রহণ করবে, যদি সে ধার্মিক এবং বিশ্বাসী হয়। আর যদি সে হালাল-হারাম বিচার না করে তাহলে শহরের কোন বিশ্বস্ত আলিমকে তা' সমর্পণ করবে বা তাকে ও শাসনকর্তাকে একত্রে এই ভার ন্যস্ত করবে। এরূপভাবে দুজনের হাতেই সমর্পণ করা উত্তম। আর যদি তা' সম্ভব না হয়, তাহলে নিজেই তার দায়িত্ব পালন করবে। কোন নির্দিষ্ট লোকের হস্তে এটা সমর্পণ করা চাই। কেননা সকলেই জনসাধারণের মঙ্গল ও কল্যাণকর কার্যাবলীর রীতিনীতি এবং পন্থা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা রাখে না।
যদি বল, যে মাল হারাম তা' জায়েয হওয়ার প্রমাণ কি? যার উপর তার স্বত্ব নেই, তাই বা সে কিরূপে দান করতে পারে? কোন কোন আলিম একে নাজায়েয বলেছেন, কেননা এটা হারাম। বর্ণিত আছে যে, হযরত ফোজায়ল (রহঃ) এর হাতে দুটো দেরহাম এসে গেলে তিনি যখন জানতে পারলেন যে, তা' হারাম, তখন তিনি 'তা' পাথরের স্তূপের মধ্যে ফেলে দিয়ে বললেন, কোন হালাল জিনিস ব্যতীত আমি দান করব না এবং যা আমি আমার জন্য ভালবাসি না, তা' অনোর জন্যও ভালবাসব না। আমরা বলব যে, তার মধ্যেও উদ্দেশ্য এবং তর্কের অবকাশ আছে। আমরা এর বিপরীত মত পছন্দ করেছি। কেননা আমাদের মতের অনুকূলে হাদীস, বুযর্গদের বাণী ও কিয়াস রয়েছে।
হুযুরে পাক (দঃ) এর নিকট একদা একটি রন্ধনকৃত বকরীর মাংস উপস্থিত করা হলে, উক্ত মাংস বলে দিল যে, তা' হারাম। তিনি তখন তা' দান করতে আদেশ দিয়ে বললেন যে, যুদ্ধবন্দীদেরকে এ মাংস ভক্ষণ করতে দাও। যখন আল্লাহতায়ালার এ আয়াত অবতীর্ণ হলঃ "আলিফ লাম মীম গুলিবাতির রূম" অর্থাৎ রোমকগণ নিকটবর্তী স্থানে পরাজিত হয়েছে। কিন্তু তাদের এ পরাজয়ের পর শীঘ্রই তারা জয়যুক্ত হবে। মুশরিকগণ এ বাণীকে মিথ্যা ধারণা করতঃ হুযুরে পাক (দঃ) এর ছাহাবীদের সাথে বিদ্রূপ করতে লাগল এবং বলল যে, তোমাদের নেতা কি বলে? তাঁরা বললেন, তিনি বলছেন যে, রোমকগণ শীঘ্রই জয়লাভ করবে। এ ব্যাপার নিয়ে হুযুরে পাক (দঃ) এর ছাহাবী হযরত আবুবকর (রাঃ) মুশরিকদের সাথে বাজী ধরলেন। অতঃপর যখন আল্লাহতায়ালা তার বানী সত্যরূপে প্রমাণ করলেন (অর্থাৎ রোমকগণ পারসিকদের সাথে যুদ্ধে জয়লাভ করল) তখন হযরত আবুবকর (রাঃ) হুযুরে পাক (দঃ) এর সম্মুখে ঐ বাজীর মাল নিয়ে হাজির হলেন, তখন হুযুরে পাক (দঃ) বললেন যে, এ হারাম মাল, এ মাল দান করে দাও। তখন মুসলমানগণ আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলেন। হুযুরে পাক (দঃ) উক্ত মাল সম্পর্কে ঐরূপ নির্দেশ দেয়ার পর বাজী নিষেধের আয়াত নাযিল হয়েছিল।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) একবার একটি দাসী খরিদ করলেন। কিন্তু তার মূল্য দেয়ার জন্য বহু অনুসন্ধান করা সত্ত্বেও দাসীর মনিবের সন্ধান পেলেন না। তখন সে মূল্য গরীবকে দান করে দিয়ে বললেন, হে মাবুদ। যদি মনিব রাজী থাকে, আমি তার পক্ষ থেকে এ দান করলাম। আর যদি সে রাজী না থাকে, তবে আমার যেন এর ছওয়াব নছীব হয়। হযরত হাসান বছরী (রঃ) কে জিজ্ঞেস করা হল, কোন ব্যক্তি গনিমতের মাল আত্মসাৎ করলে এবং মুজাহিদগণ স্থান ত্যাগ করে চলে যাওয়ার পর ঐ ব্যক্তির অনুতাপ এলে ও সে তাওবাহ করলে, তখন তার কি করতে হবে? তিনি বললেন যে, ঐ গনিমতের মাল সে দান করে দেবে। কথিত আছে যে, এক ব্যক্তির মনে কুমন্ত্রণার সৃষ্টি হওয়ায় সে গনিমতের একশ' দীনার আত্মসাৎ করল। তারপর সেনাপতির নিকট সে দীনারগুলো ফেরত দিতে চাইলে তিনি তা' গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন। কেননা মুজাহিদগণ তার পূর্বেই চলে গিয়েছিল। তারপর তা' খলীফা মুয়াবিয়ার দরবারে পেশ করা হলে তিনিও তা' গ্রহণ করতে রাজী হলেন না। তারপর লোকটি জনৈক দরবেশের নিকট দীনারগুলো নিয়ে গেলে তিনি বললেন, এ থেকে এক পঞ্চমাংশ মুয়াবিয়াকে দাও, বাকী অংশ দান করে দাও। এ কথা হযরত মুয়াবিয়ার কর্ণগোচর হলে তিনি খুবই দুঃখিত হলেন, এজন্য যে, এই বিধানের কথা তাঁর মনে একবারও উদয় হয় নি। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ), হারেছ মুহাসাবী (রহঃ) এবং আরও অন্যান্য সুফীগণ ঐরূপ মাল দান করার মত সমর্থন করেছিলেন।
উল্লিখিত ক্ষেত্রে কিয়াসের সমাধান হল, প্রকৃত মালিকের সন্ধান না পাওয়া গেলে এরূপ হারাম মালের ব্যাপারে দুটো ব্যবস্থা আছে, যেমন এ মাল নষ্ট করে দেয়া অথবা কোন জনহিতকর কাজে ব্যয় করা। তবে এ মাল নদীগর্ভে ফেলে দেয়া অপেক্ষা জনহিতকর কাজে ব্যয় করা উত্তম। এ মাল নদীতে ফেললে তা' একেবারে অনর্থক নষ্ট হয়ে যায় অর্থাৎ এ মাল না মালিক পায়, না অন্য কেউ পায়, না এতে কারও কোনরূপ উপকার হয়। তার চেয়ে বরং এ মাল কোন ফকীরের হাতে পৌঁছলে সে মালের মালিককে দেয়া করবে। তাতে একদিকে যেমন মালিকের বরকত হবে, অন্যদিকে ফকীরের অভাব ঘুচবে। এই ছওয়াব ও বরকত মালিকের অজানা অবস্থায়ই অর্জিত হয়। 'হালাল জিনিস ব্যতীত দান করা যায় না" এ কথা তখন প্রযোজ্য হয়, যখন উক্তরূপ মাল দান করে দাতা তা' থেকে ছওয়াব অন্বেষণ করে। কিন্তু যদি তা' না করা হয়; বরং ঐ মাল থেকে মুক্তি লাভের প্রয়োজনে তা' দান করে দেয়া হয়, তবে ঐরূপ হারাম মাল দান করা উত্তম, না তা' নষ্ট করে দেয়া উত্তম, তাতে সন্দেহ দেখা দিলে দান করাই উত্তম মনে করতে হবে। কেউ কেউ বলে যে, যাতে আমি নিজে সন্তুষ্ট নই, তা' অন্যকে দিতেও আমাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত নয়। এ কথা ঠিক বটে, কিন্তু উল্লিখিত দ্রব্য আমাদের জন্য হারাম। কেননা অমাদের আবশ্যতা নেই, দরিদ্রের জন্য হালাল। কেনন। শরীয়ত তাদের জন্য এ মাল হালাল করেছে। যখন মানুষের মঙ্গলের জন্য তা' হালাল হওয়া দরকার করে, তখন তা' হালাল বলা ওয়াজিব। যখন তা' দরিদ্রের জন্য হালাল, তখন আমরাও তাদের জন্য তা' হালাল বলে পছন্দ করব এবং বলব যে, এই মাল তাদের নিজেদের জন্য ও তাদের পরিবারবর্গের জন্য ব্যয় করা হালাল।
তারা দরিদ্র, তজ্জন্য তাদের নিজেদের এবং তাদের পরিবারবর্গের জন্য যা প্রয়োজনীয় তা' গ্রহণ করা জায়েয। কাজেই যদি তা' দরিদ্রকে দান করা হয়, তা' জায়েয হয়। কিন্তু যদি নিজেই গরীব হয়, তখন তার তা' গ্রহণ করা জায়েয হবে না কেন? এর মাসয়ালা থেকে কতগুলো মাসয়ালার উদ্ভব হয়।এর মাসয়ালা থেকে কতগুলো মাসয়ালার উদ্ভব হয়।
0 Comments