হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেন, 'ইবাদত-বন্দেগীর জন্য আল্লাহর নিকট যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনের চেয়ে প্রিয়তম দিন আর নেই। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, এ দিনসমূহে ইবাদত করা কি জেহাদ ফী সাবীলিল্লাহর চেয়েও বেশি প্রিয়? তিনি বললেন, জেহাদ ফী সাবীলিল্লাহর চেয়ে বেশি প্রিয়, তবে কেউ জান-মাল নিয়ে জেহাদে গিয়ে আর প্রত্যাবর্তন না করলে তার জেহাদ যিলহজ্জের প্রথম দশ দিনের আমলের সমান হতে পারে।
হযরত জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (ছঃ) বলেছেন, 'ইবাদতের জন্য আল্লাহ তা'আলার নিকট এ দশ দিন অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ দিন আর নেই। জিজ্ঞেস করা হল, আল্লাহর পথে জেহাদও কি এর সমান নয়? রাসূলে আকরাম (ছঃ) জবাব দিলেন, না। তবে জেহাদে যদি কারো ঘোড়া আহত হয় এবং খোদ মুজাহিদ যদি ধূলি-মলিন হয়, তবে তার জেহাদ উল্লিখিত দিনগুলোর আমলের সমান হতে পারে।
হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) বর্ণনা করেন, এক যুবকের অভ্যাস ছিল, যিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখা দিলেই সে রোযা রাখতে শুরু করত। রাসূলুল্লাহ (ছঃ) তা জানতে পেরে যুবককে জিজ্ঞেস করলেন, হে যুবক। তুমি এ দিনগুলোতে রোযা রাখ কেন? সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল। আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কোরবান হোন, এ দিনগুলো পবিত্র হজ্জের নায়ীক ও হজ্জ আদায়ের মোবারক সময়। হজ্জ আদায়কারীদের সাথে আমিও নেক আমলে ও আশায় অংশীদার হই, তাদের সাথে আমার দোআও আল্লাহ্ কবুল করে নিবেন। এরপর রাসূলে আকরাম (হঃ) বলেন, 'তোমার এক একটি রোযার বিনিময়ে একশ দাস মুক্ত করার, একশ উট আল্লাহর পথে দান করার এবং জেহাদের সাজ-সামানে পরিপূর্ণ একটি ঘোড়া জেহাদের জন্য দেয়ার সওয়াব রয়েছে। তার মধ্যে ৮ই যিলহজ্জ (ইয়াওমুত তারবিয়া)-এর রোযার বিনিময়ে এক হাজার দাস মুক্ত করার, এক হাজার উট দান করার এবং সাজ-সামানসহ জেহাদের জন্য এক হাজার ঘোড়া দান করার সওয়াব রয়েছে। আবার ৯ই যিলহজ্জ (ইয়াওমুল আরাফা)-এর রোযার বিনিময়ে দু'হাজার দাস মুক্ত করার, দুহাজার উট দান করার, জেহাদের সাজ-সামানসহ দু'হাজার ঘোড়া দান করার সওয়াব রয়েছে। হাদীস শরীফে আরও বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর রাসূল (ছঃ) বলেছেন-
_আরাফার দিন (৯ই যিলহজ্জ)-এর রোযা দু'বছর রোযা রাখার সমতুল্য, আর আশূরা (১০ই মহাররম)-এর রোযা এক বছর রোযা রাখার সমতুল্য।'
আল্লাহ্ তা'আলা এরশাদ করেন- وَ وَعَدْنَامُوسَى ثَلَاثِينَ لَيْلَةً وَأَتْمَمْتُهَا بِعَشْرٍ .
হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ্ তা'আলা দিনসমূহের মধ্যে চারটি, মাসসমূহের মধ্যে চারটি, নারীদের মধ্যে চার জন, সর্বপ্রথম যারা জান্নাতে প্রবেশ করবে তাদের মধ্যে চার জন এবং স্বয়ং জান্নাত যে সকল নেক বান্দার প্রত্যাশী তাদের মধ্যে চার জনকে নির্বাচন করে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন। সেগুলো হচ্ছে নিম্নরূপ:
১. জুমু'আর দিনঃ জুমু'আর দিনে সে মুহূর্তে আল্লাহর কাছে যা প্রার্থনা করবে, আল্লাহ্ তা'আলা তা দান করবেন। প্রার্থিত বস্তু ইহকালের হোক বা পরকালের হোক।
২. আরাফার দিন: (যে দিনে পবিত্র হজ্জ অনুষ্ঠিত হয়) যখন হয়, আল্লাহ্ তা'আলা ফখর করে ফেরেশতাদের বলেন, 'হে ফেরেশতারা। তোমরা দেখ, আমার বান্দারা হাজির হয়েছে ধুলি-মলিন অবস্থায়, তাদের কেশ অগোছালো, আমার জন্য তারা ধন-সম্পদ ব্যয় করেছে, দৈহিকভাবে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়েছে; তোমরা সাক্ষী থাক, আমি তাদের মাফ করে দিলাম।
৩. ঈদুল আযহা (কোরবানীর দিন): ঈদুল আযহার দিনে বান্দার কোরবানীর পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার পূর্বেই আল্লাহ্ তা'আলা তার সব গুনাহ মাফ করে দেন।
৪. ঈদুল ফেতেরের দিন: রমযানের রোযা রাখার পর ঈদুল ফেতেরের নামায আদায়ের উদ্দেশে লোকজন যখন বের হয়, তখন আল্লাহ্ তা'আলা ফেরেশতাদের ডেকে বলেন, প্রত্যেক শ্রমিক শ্রমদানের পর পারিশ্রমিক চেয়ে থাকে, আমার বান্দারা পূর্ণ মাস রোযা রেখে আজ ঈদের দিন তারা আমার নিকট পারিশ্রমিকের আশায় এসেছে। হে ফেরেশতারা। তোমরা সাক্ষী থাক, আমি তাদের ক্ষমা করে দিলাম। এক ঘোষণাকারী ঘোষণা দিয়ে থাকে, 'যে উন্মতে মুহাম্মদী। তোমরা এমন অবস্থায় ফিরে যাও যে, তোমাদের গুনাহসমূহ নেকীর দ্বারা পরিবর্তন করে দেয়া হয়েছে।'
যে চারটি মাসকে নির্বাচন করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে- ১. রজব ২. যিলকদ, ৩. যিলহজ্জ, ৪. মহররম।
বিশেষ মর্যাদাবান যে চার জন মহিলাকে নির্বাচিত করা হয়েছে তাঁরা হচ্ছেন-১. হযরত মারইয়াম বিনতে ইমরান, ২. হযরত খাদীজা বিনতে খুওয়াইলেদ, জগতের সকল মহিলার মধ্যে সর্বপ্রথম ইনিই আল্লাহ্ ও রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছেন। ৩. ফেরাউনের স্ত্রী হযরত আছিয়া বিনতে মোযাহেম। ৪. হযরত ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ (ছঃ), তিনি জান্নাতবাসিনী মহিলাদের নেত্রী। যারা সকলের পূর্বে জান্নাতে প্রবেশ করবে, এক এক সম্প্রদায় থেকে এক একজন, সে চার জন হচ্ছেন- ১. আরবদের মধ্য থেকে সাইয়্যিদুনা হযরত মুহাম্মদ (ছঃ), ২. পারস্যের লোকদের মধ্য থেকে হযরত সালমান ফারেসী (রাঃ), ৩. রোমীয়দের মধ্য থেকে হযরত সোহায়ব রোমী (রাঃ) ও ৪. হাবশাবাসীদের মধ্য থেকে হযরত বেলাল (রাঃ)।
জান্নাত যাদের জন্য উদগ্রীব, তাদের মধ্য থেকে এ চার জনকে নির্বাচন করা হয়েছে ১. হযরত আলী (রাঃ) ২. হযরত সালমান ফারেসী (রাঃ), ৩. হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসের (রাঃ) ও ৪. হযরত মেকদাদ ইবনে আসওয়াদ (রাঃ)।
রাসূল (ছঃ) বলেন, ৮ই যিলহজ্জে যে ব্যক্তি রোযা রাখল, আল্লাহ তাকে হযরত আইয়ুব (আঃ)-এর কঠিন রোগ-পরীক্ষায় ধৈর্য ধারণের ন্যায় সওয়াব প্রদান করবেন। আর যে আরাফার দিনে (৯ই যিলহজ্জ) রোযা রাখল, আল্লাহ্ তা'আলা তাকে হযরত ঈসা (আঃ)-এর ন্যায় সওয়াব দান করবেন।
রাসূলে আকরাম (ছঃ) থেকে আরও বর্ণিত হয়েছে, যখন আরাফার দিন আসে, তখন আল্লাহ্ তাঁর রহমত ছড়িয়ে দেন। এ দিনে যে পরিমাণ লোকদের জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়া হয়, অন্য কোনদিন তা দেয়া হয় না। যে ব্যক্তি আরাফার এ দিনে রোযা রাখে, তার গত বছর ও আগামী বছরের গুনাহ মাফ হয়ে যায়। কবীরা গুনাহ মাফের জন্য তওবা করতে হবে। আরাফার দিনের রোযার উসিলায় বিগত ও আগামী এ দু'বছরের গুনাহ মাফ হওয়ার তাৎপর্য হলো, এ দিনটি দুই ঈদের মাঝখানে পড়েছে, এ দুটি মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত খুশির দিন। এতে তাদের জন্য গুনাহ মাফের চেয়ে অধিক খুশির বিষয় আর কী হতে পারে? আর আশুরার দিনের (১০ই মহররম) আগমন ঘটে দু'ঈদ অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর। তাই এ দিনের রোযা দ্বারা এক বছরের গুনাহ মাফ হয়। আরেক কারণ হচ্ছে, আশূরার দিনটি হচ্ছে হযরত মুসা (আঃ)-এর জন্য, আর আরাফার দিন আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (ছঃ)-এর জন্য। তাঁর সম্মান সব আম্বিয়ায়ে কেরামের উপর।
0 Comments