প্রিয় পাঠক-পাঠিকা। জেনে রাখ যে, মৃত্যুর সময়ে মৃত্যুপথযাত্রীর যে উত্তম অবস্থা হওয়া আবশ্যক, তার চিহ্ন এই; চেহারা প্রশান্ত এবং সৌম্য হওয়া, রসনায় কালেমায় তাইয়্যেব জারী থাকা এবং এবং অন্তরে উত্তম ধারণা পোষণ করা। প্রশান্ত চেহারা সম্বন্ধে হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, তিনটি অবস্থায় মৃত ব্যক্তির দিকে লক্ষ্য কর; যথাঃ যখন তার ললাট থেকে ঘর্ম নির্গত হয়। যখন তার চক্ষুদ্বয় থেকে অশ্রু প্রবাহিত হয়, তখন তার ওষ্ঠাধর বিশুষ্ক হয় আল্লাহর রহমতের চিহ্ন তার উপর অবতীর্ণ হয়। তখন কালেমা শাহাদত উচ্চারণ করা উত্তম চিহ্ন। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেছেন যে, হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, তোমাদের মুমূর্ষ লোকদেরকে লাইলাহা ইল্লাল্লাহু শিখিয়ে দাও (যা হোযায়ফাহর বর্ণনায় আছে) কেননা তা' পূর্ববর্তী পাপ নিশ্চিহ্ন করে দেয়। হযরত ওসমান (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি মৃত্যুর সময় জানে যে, আল্লাহ ব্যতীত উপাস্য নেই সে বেহেশতে প্রবেশ করবে। হযরত ওসমান (রাঃ) বলেছেন, যখন কারও মৃত্যুর সময় উপস্থিত হয় তাকে লাইলাহা ইল্লাল্লাহু শিখিয়ে দাও, কেননা যে লোক মৃত্যুর সময় তা' উচ্চারণ করে প্রাণত্যাগ করে সে বেহেশতে যাবে।
হযরত ওমর (রাঃ) বলেছেন, তোমরা তোমাদের মুমূর্ষু লোকদের সামনে যাও এবং তাদেরকে আল্লাহর নাম স্মরণ করিয়ে দাও। কেননা তোমরা যা দেখনা তারা তা' দেখে এবং তাদেরকে লাইলাহা ইল্লাল্লাহু শিখিয়ে দাও। হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বলেছেন, আমি হুযুরে পাক (দঃ)কে বলতে শুনেছি, মৃত্যুর ফিরেশতা এক মুমূর্ষ ব্যক্তির নিকট উপস্থিত হয়ে তার হৃদয়ের দিকে লক্ষ্য করে তথায় সে কিছুই দেখতে পেল না। তারপর সে তার রসনাকে ছিন্ন করে তার এক পার্শ্বে দেখল যে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু কালামটি উচ্চারিত হচ্ছে। আল্লাহতায়ালা এই কালামের ইখলাছের দরুন তাকে ক্ষমা করে দিলেন। যে এই কালেমা মুমূর্ষু লোকদেরকে শিক্ষা দেয়। এর মধ্যে তার কোন কিছু অতিরঞ্জিত করা উচিত নয়। অতি শান্তভাবে শুধু এই কালেমাটি-ই বলা উচিত। কেননা অনেক সময় রুগীর পক্ষে কোন কিছু শিক্ষা করা কষ্টকর হয়। এই কালেমা উচ্চারণের উদ্দেশ্য এই যে, সেই সঙ্কট সময়ে আল্লাহ ভিন্ন তার মনে যেন অন্য কোন চিন্তা না থাকে। যখন আল্লাহ ব্যতীত তার অন্য কোন মাকছুদ না থাকে, মৃত্যু দ্বারা তার নিকট অগ্রসর হওয়া তার পক্ষে অতীব আনন্দের বিষয় হয়। যদি তার হৃদয় সংসার আসক্তিতে নিমগ্ন থাকে, তার সুখ সম্পদে নিমজ্জিত থাকে এবং কলেমা শাহাদাতও তার রসনার অগ্রভাগে থাকে। তবে সে তার প্রকৃত পরিচয় উপলব্ধি করে না, তখন ব্যাপার কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তা' কবুল করতে পারেন। ইচ্ছা করলে নাও করতে পারেন। আল্লাহ সম্পর্কে উত্তম ধারণা এ সময়ে একান্ত আবশ্যক। আমরা তা' আশা-আকাঙ্ক্ষার অধ্যায়ে উল্লেখ করেছি।
আল্লাহর সম্বন্ধে উত্তম ধারণা করা
আল্লাহর সম্বন্ধে উত্তম ধারণার বিষয়ে বহু হাদীস উক্ত হয়েছে। একদা হযরত ওয়াছেলাহ এক রুণীর নিকট গিয়ে বললেন, আল্লাহ সম্বন্ধে তুমি কি ধারণা পোষণ করছ, তা' আমাকে বল। তিনি বললেন, আমার পাপের চিন্তা আমাকে নিমজ্জিত করে রেখেছে এবং আমাকে ধ্বংসের সম্মুখীন করেছে, তবে আমি আমার প্রভুর করুণা আশা করি। তার কথা শুনে হযরত ওয়াছেলাহ তাকবীর উচ্চারণ করলেন এবং গৃহের অন্যান্য লোকগণও তাকবীর পড়লেন। তিনি বললেন, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। আমি হুযুরে পাক (দঃ) কে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহতায়ালা বলেন, আমার বান্দাহ আমার সম্বন্ধে যে ধারণা করে, তার নিকট আমি আছি; সুতরাং সে যা ইচ্ছা করে আমার সম্বন্ধে যেন সেই বিষয়ে উত্তম ধারণা হয়।
একদা হুযুরে পাক (দঃ) একজন মুমুর্ষু যুবকের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, যুবক। তুমি কেমন আছ? সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আল্লাহর করুণার আশা করি এবং আমার পাপের জন্য ভয় করি। তখন হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, কোন কোন বান্দার মনে এ দুটি অবস্থা এসময় বর্তমান থাকলে, সে যা আশা করে, আল্লাহ তাকে তা' দিয়ে থাকেন এবং সে যা ভয় করে তা' থেকে নিরাপদ রাখেন। হযরত ছাবেত বুনানী (রহঃ) বলেছেন, একজন যুবক অত্যন্ত আমোদপ্রিয় লোক ছিল। তার মাতা তাকে অনেক উপদেশ দিত এবং বলত, হে প্রিয় বৎস। তোমার নিকট যে এক চরম দিন উপস্থিত হবে সেদিনটির কথা স্মরণ কর এবং সেভাবে চল। যখন ঐ যুবকের উপর মৃত্যু নেমে এল, তার মাতা তখন বিষণ্ণ বদনে তাকে লক্ষ্য করে বলল, হে প্রিয় বৎস! আমি তোমাকে এই বিপদে পতিত হবার কথা বার বার বলে এসেছি; বহু সতর্ক করেছি, কিন্তু তুমি আমার কথায় আমল দাওনি। যুবক তার মাতাকে লক্ষ্য করে বলল, হে মাতঃ! তুমি চিন্তা করো না। আমার প্রভু করুণার আধার। আমি নিশ্চয়ই আশা করি যে, তিনি অদ্য আমাকে তার কিছু করুণা প্রদান করবেন। হযরত ছাবেত বুনানী (রহঃ) বলেন, আল্লাহর প্রতি ঐ যুবকের এরূপ উত্তম ধারণার জন্য সত্যিই আল্লাহ ঐ যুবকের প্রতি করুণা প্রদর্শন করেছিলেন।
হযরত জাবের ইবনে ওয়াদ্দারা (রহঃ) বলেছেন, কোন এক যুবকের অত্যধিক অহংকার ছিল। তার মৃত্যু উপস্থিত হলে, তার মাতা তাকে বলল, হে প্রিয় বৎস! এসময় তুমি কিছু কথাবার্তা বলে যাও। পুত্রটি বলল, তা' বলছি। তবে তুমি আমার আংটি নিয়ে যেও না। কেননা তার মধ্যে আল্লাহর নাম খোদিত আছে। হয়তো তারই বরকতে আল্লাহ আমার উপর করুণা বর্ষণ করবেন। মৃত্যুর পর ঐ যুবককে যখন দাফন করা হল, তখন এক বুযর্গ স্বপ্নযোগে দেখতে পেলেন যে, ঐ যুবক তাকে বলছে, আপনি আমার মাতাকে এ খবরটি জানিয়ে দেবেন যে, আল্লাহর নাম খোদিত আংটি আমার জন্য উপকারে এসেছে। আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। একবার জনৈক মরুবাসী ব্যক্তির ভয়ানক অসুখ হল, তার এক বন্ধু তাকে লক্ষ্য করে বলল যে, রোগের লক্ষণে যা বোঝা যাচ্ছে, হয়তো তুমি বেশীদিন আর এজগতে থাকবে না। বন্ধুর কথা শুনে সে লোকটি বলল, আমি নিজেও বুঝতে পেরেছি আমার মৃত্যু আয়ন্ন। তবে তুমি বলত, মৃত্যুর পর আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে? বন্ধু বলল, মৃত্যুর পর সবাইকে আল্লাহর নিকট নিয়ে যাওয়া হয়। লোকটি বলল, সেতো খুবই ভাল কথা, আল্লাহর নিকট যেতে আমার কোন অনিচ্ছা নেই, কেননা আমার এ বিশ্বাস রয়েছে যে, আল্লাহতায়ালা নিশ্চয়ই আমার সাথে উত্তম ব্যবহার করবেন। হযরত আবু মো'তামার (রহঃ) বলেছেন, আমার পিতা আমাকে তার মৃত্যুকালে বলেছিলেন, হে মো'তামার। আমার সাথে এখন এমন সহজ কথা বল, যেন আমি তদবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করতে পারি ও আল্লাহর সম্বন্ধে আমার উত্তম ধারণা থাকে। তার কথা শুনে উপস্থিত লোকগণ তখন তার পূর্বকৃত নেক আমলগুলি উল্লেখ করতে লাগল, যেন আল্লাহর সম্বন্ধে তার উত্তম ধারণা বজায় থাকে।
0 Comments