জ্ঞানার্জনের দিক থেকে অন্তরের দৃষ্টান্ত

 

        উল্লেখ্য যে, জ্ঞান বা বিদ্যার পাত্র অন্তর বা আত্মা। আত্মা ঐ সূক্ষ্ম বস্তু, যে সমগ্র দেহ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপর কর্তৃত্ব করে অর্থাৎ দেহ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যার আনুগত্য ও সেবা করে। যেমন আকৃতির সাথে আয়নার সম্পর্ক, তদ্রূপ জ্ঞাতব্য বিষয়সমূহের সাথে আত্মার সম্পর্ক। অর্থাৎ কোন মূর্তি আয়নার সামনে যেরূপ দেখা যায়, তদ্রূপ বিভিন্ন জ্ঞানের বিষয় আত্মার মধ্যে প্রতিবিম্বিত হয়। আয়নার সামনে যে আকারই রাখা হয়, আয়না সেই আকারই ধারণ করে, তদ্রূপ যেসব জিনিসের পরিচয় জ্ঞান জন্যে, তার আকৃতিও আত্মার মধ্যে অঙ্কিত হয় এবং তা' পরিষ্কারভাবে দেখা যায়। প্রত্যেক জ্ঞাতব্য বিষয়েরই প্রকৃতি আছে এবং প্রত্যেক প্রকৃতিরই আকৃতি আছে সেই আকৃতিই আত্মার আয়নায় প্রতিফলিত হয় ও পরিষ্কারভাবে তা' দেখা যায়। আয়না একটি পদার্থ, আকৃতি একটি পদার্থ এবং আয়নায় তার প্রতিবিম্বও একটি পদার্থ। তদ্রূপ আত্মারও তিনটি বিভিন্ন শ্রেণী আছে। যেমনঃ (১) আত্মা (২) প্রত্যেক বস্তুর প্রকৃত গুণ (৩) আত্মার মধ্যে সেই প্রকৃত গুণের জ্ঞান এবং তা' তন্মধ্যে বিদ্যমান থাকা। যে বস্তুর দ্বারা জ্ঞান অর্জিত হয়, তার নামই আত্মা। তার মধ্যে প্রত্যেক বস্তুর প্রকৃত তত্ত্বের প্রতিচ্ছায়া পতিত হয়। জ্ঞাতব্য বিষয়ের প্রকৃত তত্ত্ব জানা বা জ্ঞানার্জনের অর্থ আত্মা আয়নার মধ্যে বস্তুর প্রকৃত তত্ত্বের প্রতিচ্ছায়ার উপস্থিতি। সুতরাং (১) জ্ঞানাধার (২) জ্ঞানের বস্তু বা জ্ঞাতব্য বিষয় এবং (৩) আন। এ তিনটি বিষয় একত্রে জড়িত। দৃষ্টান্ত স্থলে বলা যায় যে, ধারণ করা একটি কার্য। তাতে বুঝা যায় যে, কেউ কোন বস্তুকে ধারণ করে, যেমন হস্ত তরবারী ধারণ করে। এখানে হস্ত ও তরবারী একত্র হলে ধারণ কাজটি পূর্ণ হয়। হস্ত ও তরবারী পৃথক পৃথক থাকলে ধারণ করা হয় না। অরূপ আত্মার মধ্যে কোন একটি আতব্য বস্তুর প্রতিচ্ছায়া পতিত হবাত নামই আন। জ্ঞানের বস্তু ও আত্মার অস্তিত্ব আছে। কিন্তু আনের অস্তিত্ব নেই। কেননা কোন বস্তুর প্রকৃত তত্ত্বের অর্জনের সাথে আত্মার সম্পর্কের নামই জ্ঞান। তরবারী আছে এবং হস্ত আছে কিন্তু ধারণ করা কথাটি বলা যায় না, যে পর্যন্ত না তরবারী হাতের মধ্যে আসে। এ কথা সত্য বটে যে, ধারণ কর। কাজটি তখন হয়, যখন প্রকৃত তরবারী হাতের মধ্যে আসে। তদ্রূপ জানার বস্তুটি আত্মায় না আসলে তার জ্ঞান হয় না। যে ব্যক্তি অগ্নিকে জানে, সে তার আত্মার মধ্যে প্রকৃত অগ্নিকে পায় এরূপ বলা যায় না। কিন্তু অগ্নির প্রকৃত তত্ত্ব বা প্রকৃতি বা প্রতিচ্ছবি স্বভাব অনুযায়ী তার অন্তরে উপস্থিত হয়। আয়নার দৃষ্টান্ত আরা তা' বুঝান উত্তম। প্রকৃত মানুষটি আয়নার মধ্যে থাকে না। আয়নার মধ্যে থাকে শুধু তার আসল আকৃতির প্রতিচ্ছায়া, তদ্রূপ আত্মার ভিতর আসে সমস্ত বিদ্যার প্রকৃত রূপের প্রতিচ্ছায়া, তারই নাম জ্ঞান।

        তত্ত্বজ্ঞানের পাঁচটি বাধাঃ এ পাঁচটি বিষয়ের জন্য আয়নার মধ্যে কোন বস্তুর আকৃতি প্রতিফলিত হয় ন। (১) আয়না উত্তম না হওয়া অর্থাৎ যে জিনিস দ্বারা তা' তৈরী তা' বিনষ্ট হওয়া, অথবা আয়নার আকৃতি ঠিক না হওয়া (২) আয়নার উপর ময়লা মলিনতা ও মরিচা পড়ে যাওয়া, (৩) আয়না আকৃতির দিকে না থাকা, বা আকৃতির পিছনে থাকা, (৪) আয়না ও আকৃতির মধ্যে কোন জিনিস থাকা, (৫) যে আকৃতি দেখা হয় সে আকৃতি আয়নার সামনে না থাকা, আত্মারূপ আয়নারও তদ্রূপ অবস্থা। তারও পাঁচটি প্রতিবন্ধক আছে। মানবাত্মা প্রত্যেক কার্যের ও সত্যের প্রকৃত ছবি ধরবার জন্য যোগ্যতা রাখে বটে, কিন্তু তার মধ্যে যখন সে জ্ঞান আসে না, তখন মনে করতে হবে যে, পাঁচটি প্রতিবন্ধকের জন্য তা' আসছে না।

        আত্মার প্রথম প্রতিবন্ধকঃ আত্মার স্বভাবতঃই দোষ থাকা। যেমন বালকের আত্মার অসম্পূর্ণতার জন্য তাতে প্রত্যেক বস্তুর আকৃতি পতিত হয় না।

        আত্মার দ্বিতীয় প্রতিবন্ধকঃ অধিক মোহ ও লালসার কারণে আত্মার উপর পুঞ্জীভূত পাপরূপ ময়লা পড়ে যাওয়া, তাও আত্মা নির্মল ও উজ্জ্বল হবার প্রতিবন্ধক হয় এবং সেই অন্ধকার ও পুঞ্জীভূত ময়লারাশির জন্য সত্য তাতে প্রতিফলিত হয় না। তারই সমর্থনে হুযুরে পাক (দঃ) এর হাদীস উক্ত হয়েছে। যথাঃ "যে ব্যক্তি পাপকার্য করতে থাকে তার বুদ্ধি চলে যায়। তা' আর তার নিকট কখনও ফিরে আসে না। অর্থাৎ তার আত্মার উপর মরিচা পড়ে যায় এবং তার প্রভাব থেকে যায়। যদি তারপর সে কোন নেককাজ করে এবং গুনাহর কাজ না করে, তাহলে নিঃসন্দেহে তার আত্মার উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। যখন আবার সে পাপকাজ করে, সেই, উপকার চলে যায়। পাপকাজ করবার পূর্বে আত্মার যে নির্মল অবস্থা ছিল তার পাপের কারণে তা' আর বর্ধিত হয় না। এটাই প্রকাশ্য ক্ষতি, এর কোন প্রতিকার নেই। যে আয়নার উপর ময়লা পড়ে গেছে তা' মার্জনী দ্বারা ঘষে মেজে নিলেও তা' থেকে সম্পূর্ণ ময়লা দূর হয় না। এ ময়লা পতিত হবার পূর্বে আয়নার যে ঔজ্জ্বল্য ও স্বচ্ছতা ছিল মার্জনা করলেও আর সে ঔজ্জ্বল্য ফিরে আসে না। আত্মার উজ্জ্বলতা গুনাহর পর তাওবাহ করলেও পাওয়া যায় না। আল্লাহর আনুগত্যের দিকে অগ্রসর হলে এবং কামরিপুর আদেশ অনুযায়ী না চললে আত্মা উজ্জ্বল ও নির্মূল হয়। তজ্জন্যই আল্লাহতায়ালা বলেছেন, "ওয়াল্লাযীনা জাহাদু ফীনা লানাহদিয়াল্লাহুম সুবুলানা"। অর্থাৎ যারা আমার বিষয় পরিশ্রম করে নিশ্চয়ই তাদেরকে আমি পথ দেখাব।

         হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, "মান আমালা বিমা আলিমা ওয়ারায়াহুল্লাহু ইলমা মালাম ইয়া'লাম।" অর্থাৎ যে তার বিদ্যা অনুযায়ী কাজ করে আল্লাহ তাকে এমন জ্ঞান দান করেন যা সে পূর্বে জানত না।

        আত্মার তৃতীয় প্রতিবন্ধকঃ অনুসন্ধানের প্রকৃত বিষয়বস্তু থেকে পথভ্রষ্ট হওয়া। অনুগত সং আত্মা নির্মল হলেও সত্য অনুসন্ধান না করবার কারণে এবং অনুসন্ধানের বিষয়বস্তুর মুখোমুখী না হবার কারণে সত্যের ঔজ্জ্বল্য তার মধ্যে সম্পূর্ণ বিকীর্ণ হয় না। যে বিষয় সে চিন্তা করে তাই তার আত্মার মধ্যে প্রকাশ পায়। যেমন যে ব্যক্তি শারীরিক সুস্থতার দিকে বা উপার্জনের বিভিন্ন পন্থার দিকে নিজের পরিশ্রমকে লাগিয়ে রাখে। নিজের চিন্তা ও ভাবনা আল্লাহর উপস্থিতি ও তত্ত্বজ্ঞানের দিকে না লাগায় কার্যকলাপের বিপদের বিষয়ে এবং নিজ গুপ্ত দোষত্রুটির বিষয়ে চিন্তা করে তাই তার নিকট প্রকাশ পায়। সে স্বীয় কার্যের দ্বারা পার্থিব সমস্ত বিষয়ে বন্দী হয়ে যায় এবং তজ্জন্য সত্যের জ্যোতি তার নিকট প্রকাশ পায় না। যারা শুধু পার্থিব আমোদ-প্রমোদের মোহে নিমজ্জিত হয়ে রয়েছে তাদের সম্বন্ধে তোমার কি ধারণা হয়? ওগুলো কিরূপে প্রকৃত কাশফের প্রতিবন্ধক না হয়ে পারে?

        আত্মার চতুর্থ প্রতিবন্ধকঃ আত্মার উপর পর্দা সত্য প্রকাশের প্রতিবন্ধক হয়। যে ব্যক্তি তার লালসা ও লোভের অনুসরণ করে এবং শুধু তারই চিন্তায় ব্যস্ত থাকে তার নিকট সত্য প্রকাশ পায় না। কেননা তার আত্মার উপর তখন পর্দা পড়ে যায়। বাল্যকাল থেকে তাকলীদ গণ্ডিবদ্ধ সমাজের অন্ধ বিশ্বাস এবং তার প্রতি উত্তম ধারণা বা বিশ্বাস হৃদয়ে শিকড় গেড়ে যায় তাই তার প্রকৃত সত্য অনুসন্ধানের মধ্যে ঘুরাফেরা করে তার হৃদয়ে সত্য প্রকাশে বাধা দেয়। তার প্রকাশ্য তাকলীদ বা অন্ধ আনুগত্যের বিপরীত উত্তম কথা সে গ্রহণ করে না। এটাই বড় একটি প্রতিবন্ধক, যা অধিকাংশ কালামপন্থীর এবং মাযহাবের অনুপযুক্ত লোকদের উপর পতিত হয়েছে; বরং অধিকাংশ ধার্মিক লোকদের উপর তা' পতিত হয়েছে। যারা আসমান ও যমিনের রাজত্ব সম্বন্ধে চিন্তা করে, তাদের অন্ধবিশ্বাসের মধ্যে তারা বিচরণ করে। এ অন্ধ বিশ্বাস তাদের আত্মার উপর জমাট বেঁধে গেছে এবং তার শিকড় দৃঢ়ভাবে আত্মার উপর গজিয়ে গিয়েছে; সুতরাং সত্য প্রকাশের জন্য তা' এক বিরাট অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আত্মার পঞ্চম প্রতিবন্ধকঃ এটা হল অজ্ঞতা। এ অজ্ঞতা কোন বিশেষ কারণে হয়ে থাকে। তার ফলে অনুসন্ধানের বিষয় বস্তুর উপর দোষ পতিত হয়। যেমন যদি কোন বিদ্যার্থী কোন অজ্ঞাত বিষয়ের অনুসন্ধান করে তাহলে যে পর্যন্ত সে অনুসন্ধানের বস্তুর সাথে সম্পর্কিত জিনিসের চিন্তা না করে এবং সে চিন্তা আলিমদের বিশেষ পন্থানুযায়ী না করে সে পর্যন্ত অনুসন্ধানের জিনিস পাওয়া সম্ভব হবে না। কেননা অনুসন্ধানের বিদ্যাসমূহ স্বাভাবিক নয় এবং তা' অন্য বিদ্যার উপর ভিত্তি করে অর্জন করতে হয়। প্রত্যেক বিষয়ের জ্ঞান অর্জন করতে হলে তার পূর্বে দুটি বিদ্যা অর্জন করা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। উভয় বিদ্যার সংমিশ্রণের ফলে তৃতীয় প্রকার জ্ঞান জন্মে। যেমন উট ও উটনীর মিলনের ফলে উটের বাচ্চা পাওয়া যায়। যে ব্যক্তি অশ্বের বাচ্চা পেতে চায় সে গর্দভ, উট ও মানুষ একত্র করলে তা' পাবে না। বরং পুরুষ অশ্ব ও স্ত্রী অশ্বের মিলনের মাধ্যমে তা' পাওয়া যাবে। প্রত্যেক জ্ঞানের অবস্থাও তদ্রূপ। তার দুটো বিশেষ মূল আছে এবং উভয়ের মিলনের একটি পন্থা আছে। সেই সংমিশ্রণের ফলে তৃতীয় একটি উপকারী বিদ্যা পাওয়া যায়। এই নিয়ম এবং মিলনের পদ্ধতি জানা না থাকলে তৃতীয় বিদ্যা জন্মে না। আয়নার সামনে না দাঁড়ালে নিজের আকৃতি দেখা যায় না, পশ্চাদ্দেশ আয়নার দিকে না রাখলে স্বীয় আকৃতি দেখা যাবে না। কেননা আয়না পশ্চাদ্দেশের সামনে রাখলেও পশ্চাদ্দেশ দেখা যাবে না। কেননা তখন আয়না চক্ষুর সামনে থাকে না। অথচ চক্ষুই দেখবার যন্ত্র। অন্য একটি আয়না পেছনে রাখলে এবং আয়নার মুখোমুখি হলে ও পশ্চাদ্দেশ মধ্যখানে থাকলে তখন তা' দেখা যেতে পারে। তদ্রূপ বিদ্যা অর্জনের জন্য অনেক আশ্চর্য পন্থা আছে। দুনিয়ায় এমন কেউ নেই যে, এসব পন্থার বিষয় সম্পূর্ণ জ্ঞাত আছে।

        সুতরাং এসব প্রতিবন্ধক থাকলে আত্মার উপর সত্যের জ্যোতি পতিত হয় না এবং সমস্ত ব্যাপারে প্রকৃত তত্ত্ব জানা যায় না। অন্যথায় প্রত্যেক আত্মাই স্বভাবতঃ সত্য জানার জন্য উপযোগী থাকে, কেননা আত্মা খোদায়ী পদার্থ ও সম্মানিত সমস্ত গুণ থেকে তা' পৃথক। এই বিশেষ গুণ ও সম্মানের বিষয় আত্মা জ্ঞাত। এজন্যই আল্লাহতায়ালা বলেছেন, "আমি আসমান যমিন ও পর্বতের উপর এই আমানত রেখেছিলাম। তারা এটা বহন করতে অস্বীকার করল এবং ভয় করল কিন্তু মানুষ তা' বহন করে লয়েছে। নিশ্চয়ই সে অত্যাচারী-অজ্ঞ। যেমন কুরআনে পাকে উক্ত হয়েছেঃ "ইন্না আরাদ্বনাল আমানাতা আলাসসামাওয়াতি অল আরদ্বি অল জিবালি ফাআবাইনা আইয়্যাহমিলনাহা অ আশফাকুনা মিনহা অ হামালাহাল ইনসানু ইন্নাহ্ কানা জালুমান জাহলা"।

        এতে বুঝা যাচ্ছে যে, আত্মার এমন এক গুণ আছে, যা আসমান যমিন ও পাহাড় পর্বতের নেই। তজ্জন্য তাদেরকে মানবের অধীন করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহর আমানত বহন করবার উপযোগী করে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এই আমানতই মারেফাত বা তত্ত্বজ্ঞান এবং তাউহীদ। এই আমানত বহন করবার জন্য মানবাত্মা মূলতঃ উপযুক্ত। কিন্তু আমরা যেসব প্রতিবন্ধকের কথা উপরে উল্লেখ করেছি। তজ্জন্য আত্মা তার প্রকৃত তত্ত্বে পৌঁছতে পারে না। এজন্যই হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, "প্রত্যেক মানব সন্তান স্বভাব ধর্মের উপর জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু তার পিতামাতা তাকে ইয়াহুদী, খৃষ্টান ও মাজুসী বানায়।” যেমন কুরআনে পাকে উক্ত হয়েছেঃ "কুলু মাওলুদিন ইয়লাদু আলাল ফিত্বরাতি অইন্নামা আবাওয়া যু ইয়ুহাদ্দানিহী অ ইয়ুনাছ ছারানিহী অ ইয়ুমাজ্জিসানিহী"।

        হুযুরে পাক (দঃ) আবার বলেছেন, যদি শয়তানের দল আদম সন্তানের হৃদয়ের চারদিকে চলাচল না করত, তবে নিশ্চয়ই স্বগীয় রাজত্ব দেখতে পেত। এ হাদীসেও দেখা যায় যে, উপরোক্ত পঞ্চ কারণ স্বর্গীয় রাজ্য দেখার পক্ষে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। হযরত ওমর (রাঃ) বণ্না করেছেন,হুযুরে পাক (সঃ)কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আল্লাহ কোথায়? যমিনে কি আসমানে? তিনি বললেন, তিনি তাঁর মু'মিন বান্দাদের হৃদয়ের মধ্যে। অন্য হাদীসে আছে, আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন, "আমার দুনিয়া আমার জন্য যথেষ্ট নয়, আমার আসমান আমার জন্য যথেষ্ট নয় কিন্তু আমার বিনম্র প্রশান্ত মু'মিনের হৃদয়মধ্যে আমার স্থাল যথেষ্ট।

        অন্য হাদীসে আছে, হুযুরে পাক (সঃ)এর নিকট আরজ করা হয়েছিল, ইয়া রাসুলাল্লাহ (দঃ)। সবচেয়ে উত্তম লোক কে? তিনি বললেন, যে মু'মিনের আত্মা মাখযুস, সে-ই সর্বোত্তম। আরয করা হল, 'মাখযুস' কাকে বলে? তিনি বললেন, খোদাভীরু পবিত্র আত্মাকে মাখমুস খলে। যার মধ্যে প্রবঞ্চনা-প্রতারণা নেই, বিশ্বাসঘাতকতা নেই, হিংসা-বিদ্বেষ নেই। এজন্যই হযরত ওমর (রাঃ) বলেছেন, যখন আল্লাহর ভয় বা তাকওয়া আমার অন্তর থেকে (পাপের) পর্দা সরিয়ে দিল, তখন আল্লাহর সাথে আমার আত্মার সাক্ষাত হয়েছে। যে ব্যক্তি আত্মা থেকে পাপের পর্দা উঠিয়ে ফেলে, তার আত্মার মধ্যে তখন অদৃশ্য জগতের রূপ প্রকাশ হয়ে যায়। তখন বেহেশত তার অন্তর চোখে ভেসে উঠে, যার সামান্য অংশের বিস্তৃতি আসমান ও ধমিনব্যাপী। আসমান ও যমিন সম্পূর্ণ বেহেশত বেষ্টন করতে অসমর্থ, কেননা আসমান ও যমিন বলতে আমরা যে সমগ্র প্রকাশ্য জড় জগত দেখি, তা-ই বুঝে থাকি। তাদের দিক বহু বিস্তৃত। তাদের কোণ বহু দূরবর্তী। কিন্তু তবুও তাদের সীমা আছে। অদৃশ্য জগত চক্ষুর দৃষ্টির বহির্ভূত। তা' চর্মচক্ষু ধরতে সক্ষম নয়। তার সীমা নেই। একথা সত্য বটে যে, মানবাত্মার মধ্যে তার কিয়দংশ প্রকাশ পায়। কিন্তু যদি আত্মার নিজের গুণের তুলনায় বা আল্লাহর সম্পর্কে বিবেচনা কর, তার শেষ নেই। সুতরাং এ প্রত্যক্ষ চাক্ষুষ জগত ও অদৃশ্য জগত যখন এক সময়ে একত্র করা হয়, তখন তাকে হযরতে রবুবিয়ত বা আল্লাহর সত্তা নামে অভিহিত করা যায়। কেননা তা' সব বস্তুকে ঘিরে রয়েছে। আল্লাহ, আল্লাহর কার্যাবলী ও তাঁর রাজ্য ব্যতীত আর কোন বস্তুর অস্তিত্ব নেই। তাঁর বান্দাগণও তাঁর কার্যের অন্তর্ভুক্ত। তন্মধ্যে আত্মার উপর যে ঔজ্জ্বল্য প্রকাশ পায়, তা-ই একদল আলিমের নিকট প্রকৃত বেহেশত। সত্যপ্রিয় লোকদের নিকট বেহেশত সত্য হবার তা-ই কারণ। তাদের বেহেশতের বিস্তৃতি তাদের আল্লাহর তত্ত্ব জ্ঞানের প্রসার অনুসারে হয়। যে পরিমাণ আল্লাহর জাত বা সত্তা, গুণাবলী ও কার্যাবলী তার নিকট প্রকাশ পায়, সে পরিমাণ তার রাজ্য বিস্তৃত হয়ে থাকে। আল্লাহকে মেনে চলা অঙ্গ প্রত্যঙ্গের কার্যাবলী। সবারই উদ্দেশ্য হৃদয়কে নির্মল, পবিত্র এবং উজ্জ্বল করা। যে ব্যক্তি তাকে উজ্জ্বল করবে, সে মুক্তি পাবে। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেছেন, "কাদ আফলাহা মান তাযাকক্কা"। আত্মার এ পবিত্রতার উদ্দেশ্য তার মধ্যে ঈমানের নূর অর্জন করা, অর্থাৎ মারেফাতের তত্ত্ব জ্ঞানের নূর প্রজ্জ্বলিত করা। আল্লাহতায়ালা এই উদ্দেশ্যেই বলেন, "ফা মাই- ইয়ুরিদিল্লাহু আইয়্যাহদিয়াহু ইয়াশরাহ ছাদরাহু লিলইসলামি"। অর্থাৎ আল্লাহতায়ালা বলেন, "আফা মান শারাহাল্লাহু ছাদরাহ লিল ইসলামি ফাহুওয়া আলা নূরিম মিররাব্বিহী"। অর্থাৎ আল্লাহ যার বক্ষকে ইসলামের জন্য প্রসারিত করেছেন, তিনি তার প্রভুর নূরের মধ্যে অবস্থান করেন।

        আল্লাহর নূরের তিনটি স্তরঃ আত্মার উপর এই ঈমানের নূর বা জ্যোতির তিনটি স্তর আছে। প্রথম স্তরে সাধারণ লোকের ঈমানের নূর। তা' শুধু অন্ধ বিশ্বাসের নূর।

দ্বিতীয় স্তরে, কালামপন্থীদের ঈমানের নূর। তা' এক প্রকার প্রমাণের সঙ্গে মিশ্রিত। এর স্তর সাধারণ লোকদের ঈমানের স্তরের ন্যায়।

তৃতীয় স্তরে আরেফীনদের বা আল্লাহওয়ালাদের ঈমানের নূর। তা' একীনের নূর বা নিশ্চিত বিশ্বাসের দীপ্তি। দৃষ্টান্ত দ্বারা নূরের এই স্তরসমূহের বর্ণনা পেশ করব। যায়েদ যে তার গৃহে আছে, তা' তিন প্রকারে প্রমাণ করা যায়। প্রথম প্রকারের প্রমাণ হল শ্রবণজনিত বিশ্বাস। যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলে না, বলে তোমার জানা আছে এবং যে ব্যক্তি মিথ্যাবাদী বলে পরিচিতও নয়। সে যদি বলে যে, যায়েদ গৃহে আছে তখন তোমার অন্তর সে কথা বিশ্বাস করবে। শ্রবণ থেকে এ বিশ্বাস জন্মে। এটা সাধারণ লোকের বিশ্বাস। তাদের যখন বুঝের বয়স হয়, তখন তাদের পিতামাতা থেকে তারা এসব কথা শুনে, আল্লাহ আছেন, তাঁর জ্ঞান আছে, তাঁর ইচ্ছে আছে, তাঁর শক্তি আছে এবং তাঁর অন্যান্য গুণ আছে। আল্লাহতায়ালা যে রাসুলগণকে প্রেরণ করেছেন এবং তাঁরা যে কিতাব বা ধর্মগ্রন্থ নিয়ে এসেছেন। তা' বিশ্বাস করতে পিতা-মাতাগণ তাদের সন্তানদেরকে বলে। তারা তা' শ্রবণ করে বিশ্বাস করে লয় এবং তার উপর প্রতিষ্টিত থেকে শান্তিলাভ করে। তাদের মন এর বিরুদ্ধে যায় না। কেননা তাদের পিতামাতা ও তাদের ওস্তাদগণের উপর তাদের উত্তম ধারণা থাকে।

        এ ঈমানই আখেরাতের মুক্তির কারণ হবে। এরা সৌভাগ্যশালীদের প্রথম স্তরে অবস্থিত। কিন্তু এরা আল্লাহর নিকটবর্তীদের অন্তর্গত নয়। কেননা এদের মধ্যে ইয়াকীনের নূরের সাহায্যে কাশফ বা অন্তর্চক্ষু উন্মীলন, অন্তর্দৃষ্টি এবং বক্ষ প্রসারণের মত ব্যাপারগুলো অনুপস্থিত। এক বা একাধিক লোক থেকে যা শ্রবণ করা হয়, তাদের বিশ্বাসের কারণে তার মধ্যে দোষত্রুটি থাকতে পারে। ইয়াহুদী খৃষ্টানগণ তাদের পিতামাতাগণ থেকে যা' শ্রবণ করে, তাতে তারা সন্তুষ্ট থাকে, যদিও তাদের বিশ্বাস দোষত্রুটির উপর প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং তারা তাদের সন্তানগণকে ভুলের বিষয়ই বিশ্বাস করতে বলে। মুসলমানগণ সত্য বিষয়ে বিশ্বাস করে। কেননা সত্য কলেমা তাদের হৃদয়ে স্থান লাভ করেছে।

দ্বিতীয় প্রকার প্রমাণঃ গৃহের মধ্য হতে যায়েদের বাক্য এবং স্বর শুনে বুঝা যায় যে, যায়েদ গৃহে আছে। কিন্তু এই বাক্য ও স্বর দেয়ালের অপর দিক থেকে আসে। প্রথম শ্রেণীর শ্রবণজনিত বিশ্বাস থেকে এ দ্বিতীয় শ্রেণীর শ্রবণজনিত বিশ্বাস প্রবল। কেননা শ্রবণ তো রয়েছেই, তারসাথে যায়েদের স্বর ও বাক্য দ্বারাও তা' বুঝা গেছে। অবশ্য এতেও ভুল হতে পারে, কেননা অনেক সময় স্বর নকলও করা হয়।

তৃতীয় প্রকার প্রমাণঃ কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করা ও প্রবেশ করে স্বচক্ষে দর্শন করা। এটাই হল প্রকৃত মারেফাত বা পরিচয় জ্ঞান যা প্রত্যক্ষ দর্শন। এটা আল্লাহর নিকটবর্তীদের এবং ছিদ্দীকগণের জ্ঞান সদৃশ। তারা এভাবেই প্রত্যক্ষ দর্শন করে বিশ্বাস করে। তাদের ঈমানের মধ্যে সর্বসাধারণের ঈমান এবং কালামপন্থীদের ঈমানও জড়িত থাকে। স্পষ্ট নিদর্শন দ্বারা তাদের ঈমান পার্থক্য করা যায়। তাদের ঈমান বা বিশ্বাসের মধ্যে ভুলের অবকাশ নেই।

        তবে তাদের মধ্যেও আবার জ্ঞান ও কাশফের পার্থক্য আছে। আনের পার্থক্যের দৃষ্টান্ত এই যে, যায়েদকে গৃহের মধ্যে অতি নিকটে দর্শন করলে এবং সূর্যাস্তের সময়ে গৃহের বারান্দায় দর্শন করলে দর্শনকার্য সম্পূর্ণ হয়। পক্ষান্তরে যায়েদকে গৃহের মধ্যে বহু দূর থেকে দেখে বা রাত্রে তার আকৃতির ন্যায় দেখে বিশ্বাস হয় যে, যায়েদ গৃহে আছে। কিন্তু সম্পূর্ণ আকৃতি সে স্পষ্টভাবে দেখে নি। আধ্যাত্মিক তত্ত্বের ব্যাপারেও এই তারতম্য হয়ে থাকে। জ্ঞানের পরিমাণ সম্বন্ধেও তারতম্য আছে। যথা: আমার ও বকরের সঙ্গে যায়েযকে দেখা। এ উভয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। যায়েদকে একাকী দেখাই অধিক বিশ্বাস, বিশ্বাসযোগ্য এবং নির্ভরযোগ্য। এ জ্ঞানের পরিমাণ সম্পর্কে আত্মার অবস্থা আল্লাহতায়ালাই উত্তম জ্ঞাত।

        জ্ঞানগত, ধর্মীয়, আখেরাত সম্পর্কিত বিদ্যা সম্বন্ধে আত্মার অবস্থাঃ উল্লেখ্য যে, আত্মা স্বভাবতই সমস্ত বস্তুর প্রকৃত অবস্থা জানবার উপযুক্ত। কিন্তু আত্মার মধ্যে যে বিভিন্ন জ্ঞান প্রযুক্ত হয়, তা' দু' শ্রেণীতে বিভক্ত। এক শ্রেণী হল, বুদ্ধি সম্পর্কিত জ্ঞান আর এক শ্রেণী হল, শরীয়ত সম্পর্কিত জ্ঞান। বুদ্ধি সম্পর্কিত জ্ঞান আবার দু' প্রকার। ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জ্ঞান। বুদ্ধি সম্পর্কিত জ্ঞান আবার দু'শ্রেণীতে বিভক্ত। যথাঃ স্বাভাবিক জ্ঞান এবং অর্জিত জ্ঞান। অর্জিত জ্ঞানও আবার দু'প্রকার, ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জ্ঞান। বুদ্ধি সম্পর্কিত জ্ঞান দ্বারা আমরা মৌলিক স্বাভাবিক এবং প্রয়োজনীয় জ্ঞান বুঝি। এটা "তাকলীদ” (অন্ধবিশ্বাস) বা শ্রবণ থেকে অর্জিত হয় না। স্বাভাবিক অতি প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অর্থ ঐ জ্ঞান যা, কোথা থেকে বা কি প্রকারে অর্জিত হয়, তা' জানা যায় না। যথা একই ব্যক্তি দুটি বিভিন্ন স্থানে একই সময়ে থাকতে পারে না। বা একই বস্তু নতুন ও পুরাতন, গতিশীল ও গতিশূন্য একই সময়ে হতে পারে না। মানুষ শিশুকাল থেকে এই জ্ঞান তার স্বভাবে অঙ্কিত দেখতে পায় এবং সে জানে না যে কখন বা কোথা থেকে এই জ্ঞান অর্জন করেছে? অর্থাৎ সে এই জ্ঞান উদয় হবার নিকটবর্তী কোন কারণ দেখতে পায় না। আল্লাহতায়ালা তাকে সৃষ্টি করে যে হেদায়েত দিয়েছেন, তাও তার স্বাভাবিক জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পর্কিত অর্জিত জ্ঞান। এ জ্ঞান শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা থেকে অর্জন করা হয়। এ দু'প্রকার জ্ঞানকেই বুদ্ধি বলা হয়। হযরত আলী (রাঃ) বলেছেনঃ

শ্রুত জ্ঞান-বুদ্ধি এবং জন্মগত জ্ঞান

মূলতঃ এ দুটোই আল্লাহতায়ালার দান

চোখ যার অন্ধ কিংবা চোখ নেই যার

সূর্যালোকে হবে তার কোন উপকার?


        জন্মগত স্বাভাবিক বুদ্ধি সম্বন্ধে হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করছেন, "য খালাজ্বাল্লাহু খালস্তার আকরামা আলাইহি মিনাল আঙুলি'। অর্থাৎ আল্লাহতায়ালা বুদ্ধি অর্থাৎ জ্ঞানের চেয়ে তার নিকট আর কিছু অধিক সম্মানিত বস্তু সৃষ্টি করেন নি। দ্রুত বুদ্ধি সম্পর্কে হুযুরে পাক (দঃ) হযরত আলী (রাঃ)কে বলেছিলেন, যখন লোক বিভিন্ন প্রকার সৎকার্য দ্বারা আল্লাহর হয়, তখন তুমি তোমার বুদ্ধি দ্বারা তাঁর নিকটবর্তী হতে পারবে। স্বাভাবিক আন দ্বারা আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া সম্ভব নয়; বরং অর্জিত জ্ঞান দ্বারা আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া সম্ভব। হযরত আলী (রাঃ) এর দৃষ্টান্ত দেয়ার কারণ হল, যেসব বুদ্ধি দ্বারা মহাপ্রভুর নিকটবর্তী হওয়া যায়, তা' তিনি কার্যে পরিণত করে আল্লাহর নিকটবর্তী হয়েছিলেন।

        মানবাত্মার চক্ষুর অনুরূপ দৃষ্টি শক্তিসম্পন্ন চক্ষুর মধ্যে যেরূপ দৃষ্টিশক্তি আছে, তদ্রূপ আত্মার মধ্যেও দৃষ্টিশক্তি আছে। ঐ দৃষ্টির নাম বুদ্ধি বা জ্ঞান, এ দৃষ্টিশক্তি একটি লতীফা-- মৌলিক উপাদান যা অন্ধ ব্যক্তির মধ্যে পাওয়া যায় না। শুধু দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন মানুষের মধ্যেই পাওয়া যায়, যদিও সে দু' চক্ষু বন্ধ করে অথবা রাতের অন্ধকারে আগমন করে। তদ্রূপ আত্মার মধ্যে যে জ্ঞান অর্জন করা হয়, চক্ষুর দৃষ্টিশক্তির ন্যায় বিরাজমান থাকে। জ্ঞান চক্ষুদ্বারা সমস্ত বস্তু দৃষ্টিগোচর হয়। শিশুকাল থেকে বালেগ বা বয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত জ্ঞানোদয়ের বিলম্ব ঘটে, যেরূপ সূর্যোদয় ও তার জ্যোতি দৃষ্টির উপর পতিত না হওয়া পর্যন্ত চক্ষুর দৃষ্টির বিলম্ব হয়। যে কলমের দ্বারা আল্লাহতায়ালা আত্মার ফলকের উপর জ্ঞান লিপিবদ্ধ করেছেন, তা' সূর্যের জ্যোতির ন্যায় বিকীর্ণ হয়। বুদ্ধির বয়স হবার পূর্বে বালকের বুদ্ধির উদয় হয় না। কেননা তখন তার আত্মার ফলক জ্ঞানের ফুৎকার গ্রহণের জন্য উপযুক্ত হয় না। কলম আল্লার সৃষ্টি জগতে বিদ্যাসমূহের চিত্রাঙ্কনের জন্য একটি উপাদান সদৃশ। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, "আল্লামা বিল জ্বালামি আল্লামাল ইনসানা মা লাম ইয়া'লাম"। অর্থাৎ তিনি কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন, যা মানুষ জানত না, তা' তাকে শিক্ষা দিয়েছেন।

        আল্লাহর কলম মানুষের কলমের অনুরূপ নয়। যেরূপ আল্লাহর গুণাবলী মানুষের গুণাবলীর ন্যায় নয়। তাঁর কলম কাষ্ঠ বা অন্য বস্তুর দ্বারা তৈরীও নয়, যেমন তিনি নিজে কোন উপাদানে তৈরী নন এবং তাঁর কোন দৈর্ঘ্য প্রন্থও নেই। সুতরাং গুপ্ত সূক্ষ্ম দৃষ্টি এবং চক্ষুর বাহ্যিক দৃষ্টির মধ্যে এসব পার্থক্য করা সঙ্গত। তবে সম্মানের দিক থেকে এ মাপের কোন সম্পর্ক নেই।

        আত্মার দৃষ্টি ও দৃষ্টিহীনতাঃ আত্মার দৃষ্টি সূক্ষ্ম লতীফা, তদ্বারা আধ্যাত্মিক বস্তু দৃষ্ট হয়। এ লতীফা অশ্বারোহীর ন্যায় এবং চক্ষু অশ্বের ন্যায় আত্মার পক্ষে অশ্বারোহীর অন্ধতা, অশ্বের অন্ধতার চেয়ে অধিক অনিষ্টকর। অর্থাৎ আত্মার অন্ধতা বাহ্যিক চোখের অন্ধতার চেয়ে বেশী ক্ষতিকর। এ দু'টি বস্তুর মধ্যে একটির সঙ্গে অন্যটির কোন সম্পর্ক নেই। তবে বাহ্যিক দৃষ্টির সাথে অন্তর্দৃষ্টির কিছু সাদৃশ্য আছে বলে আল্লাহতায়ালা আত্মা দৃষ্টির নামোচ্চারণ করে ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন তিনি এরশাদ করেছেনঃ "মা কাযাবাল ফুওয়াদু মা রায়া"। অর্থাৎ হৃদয় যা দেখেছে, সে তা' মিথ্যা বলে নি। এখানে হৃদয়ের দর্শনক্ষমতা আছে বলে বলা হয়েছে। অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন: "অকাযালিকা নুরী ইব্রাহীমা মালাকুতাস সামাওয়াতি অল আরদ্বি"। অর্থাৎ আমি এরূপে ইব্রাহীমকে আসমান ও যমিনের রাজত্ব দেখিয়েছি। এখানে বাহ্যিক দর্শনকে লক্ষ্য করে বলা হয় নি। কেননা অন্যান্য লোককেও তা' দেয়া হয়েছে। তাই বুঝা যাচ্ছে যে, এখানে অন্তর্দৃষ্টির কথাই বলা হয়েছে। তা' পরীক্ষার স্থলে উপস্থিত করা হয়েছে। এজন্যই দৃষ্টির বিপরীত বস্তুকে অন্ধতা বলে অভিহিত করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, "মান কানা হাবিহী ফী আ'মা ফাহওয়া ফিল আখিরাতি আ'মা অ আদ্বাত্ম সাবীলা।" অর্থাৎ যে ব্যক্তি এই দুনিয়ায় অন্ধ, সে আখেরাতেও অন্ধ থাকবে এবং অধিক পথভ্রষ্ট হবে। এর অর্থ আত্মার অন্ধতা। এটাই বুদ্ধি সম্পর্কিত জ্ঞানের বর্ণনা।

        শরীয়ত সম্পর্কিত জ্ঞান: নবীদের উপর তাকলীদ বা অন্ধবিশ্বাসের রূপে এ ধর্মীয় জ্ঞান বা বিদ্যা অর্জন করা হয়। তা' আল্লাহর কিতাব এবং রাসুলে করীম (দ:) এর সুন্নত শিক্ষা এবং শ্রবণ করবার পর এবং অর্থ বুঝবার পর অর্জন করা হয়। এ উপায় দ্বারা আত্মার পূর্ণ নির্মলতা এবং নানাবিধ রোগ থেকে আত্মার মুক্তি অর্জন করা যায়, আত্মার মুক্তির জন্য বুদ্ধি সম্পর্কিত জ্ঞান অতীব প্রয়োজনীয় হলেও যথেষ্ট নয়। যেরূপ শারীরিক সুস্থতার জন্য যেসব বস্তু প্রয়োজনীয় তা' প্রয়োগ না করলে শুধু বুদ্ধিই তজ্জন্য যথেষ্ট হয় না। চিকিৎসকগণের নিকট হতে ওষুধের ও আরোগ্যের বিশেষ পন্থা শিক্ষা করা অতীব প্রয়োজনীয়। শুধু বুদ্ধিই আরোগ্যের পথ দেখাবে না এবং বুদ্ধি ব্যতীত শ্রবণও তার পক্ষে যথেষ্ট নয়। সুতরাং এর জন্য শ্রবণ ব্যতীত শুধু বুদ্ধিই যথেষ্ট নয় এবং বুদ্ধি ব্যতীত শুধু শ্রবণই যথেষ্ট নয়।

         যে ব্যক্তি বুদ্ধিকে সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করে শুধু তাকলীদ বা অন্ধ বিশ্বাসের দিকে আগমন করে, সে মূর্খ। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কুরআন ও সুন্নতের আলোকে ত্যাগ করে শুধু বুদ্ধিকেই যথেষ্ট মনে করে, সে অহঙ্কারী। সুতরাং এ দুটোর মধ্যে যে কোন একটি ত্যাগ করলে চলবে না। অতএব দুটোকেই একত্রে রাখতে হবে। বুদ্ধি সম্পর্কিত বিদ্যা খাদ্যের ন্যায় এবং ধর্মীয় বিদ্যা ওষুধের ন্যায়। রুগ্ন ব্যক্তি ঔষধ ত্যাগ করে শুধু আহার করলে তার অনিষ্ট হবে। আত্মার রোগের ক্ষেত্রেও তদ্রূপ। শরীয়তের উপকারী দাওয়াই ব্যতীত তার প্রতিকার সম্ভব নয়। ইছলাহ বা সংশোধনের জন্য যেসব কর্তব্যাবলী ও কার্যাবলী নবীগণ শিক্ষা দিয়ে গিয়েছেন, তা-ই এই শরীয়তের ওষুধ। যে ব্যক্তি শরীয়তের ইবাদাতরূপ ওষুধ দ্বারা তার রুগ্ন আত্মার চিকিৎসা করে না এবং শুধু জ্ঞান সম্পর্কিত বিদ্যাই যথেষ্ট মনে করে, সে অনিষ্টের এবং ক্ষতির সম্মুখীন হয়, যেরূপ ওষুধ ব্যতীত রুগ্ন ব্যক্তিকে শুধু খাদ্য দান করলে তার দেহের ক্ষতি হয়।

        জ্ঞান-বিজ্ঞান ধর্মের বিরোধী কি-না। কেউ কেউ ধারণা করে যে, জ্ঞান-বিজ্ঞান ধর্মীয় ইলমের পরিপন্থী এবং তাদের উভয়ের সমন্বয় ঘটা সম্ভব নয়। এরূপ ধারণা দৃষ্টিহীনতা অর্থাৎ অজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত হয়। আমরা আল্লাহর নিকট তা' থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। এরূপ ধারণাকারীগণ শরীয়তের এক বিদ্যাকে অন্য বিদ্যার পরিপন্থী মনে করে। যার ফলে শেষ পর্যন্ত দিকভ্রান্ত হয়ে তারা ধর্ম থেকে এমনভাবে বের হয়ে যায় যেরূপ আটা যাঁতা থেকে বের হয়ে যায়। 

Post a Comment

0 Comments