হাদীস শরীফে ইব্রাহীম (আ) এর ঘটনাবলি

 " ইব্রাহীম (আ) এর ঘটনাবলি প্রসঙ্গে কোরআনুল কারীম এ স্থলে যখন ইব্রাহীম (আ) এবং তাঁর সম্প্রদায়ের কিছু বললেন, আমি পীড়িত।" আবার যখন মূর্তিগুলোকে ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ করা সম্বন্ধে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, তাঁর তখনকার জবাব কোরআনুল কারীম এরূপ উদ্ধৃত হয়েছে:

قَالَ بَلْ فَعَلَهُ كَبِيرُهُمْ هَذَا تَسْتَلُوهُمْ إِن كَانُوا يَنْطِقُونَ - (أَنْبِيَاء 

অর্থাৎঃ "ইব্রাহী বললেন, বরং তাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় মূর্তিটি এ কর্ম করেছে। অতএব, তাকে জিজ্ঞেস কর যদি তাদের বাকশক্তি থাকে।" (সূরা আম্বিয়া)

        এ দুটি বাক্যের মধ্যে একটি বাক্যও এমন নয়, যাকে প্রকৃতপক্ষে অথবা বাহ্যিকভাবে মিথ্যা বলা যেতে পারে। এ দুটি কথা তো কোরআনুল কারীমে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ছহীহ বুখারী শরীফে ও ছহীহ মুসলিম শরীফে এবং অন্যান্য কতিপয় হাদীসের কিতাবে উল্লিখিত দুটি কথা ছাড়াও তৃতীয় আর একটি কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। উক্ত হাদীসটি এরূপ শব্দে আরম্ভ হয়েছে।

لَمْ يَكْذِبُ إِبْرَاهِيمُ ابهيم النَّبِي عَلَيْهِ السَّلَامُ قَطَ إِلَّا ثَلْتُ كَذِبَاتِ الخ .

        অর্থাৎঃ "ইব্রাহীম (আ) এর জীবনে তিনটি মিথ্যা ছাড়া আর কখনো মিথ্যা বলেন নি অতঃপর বিস্তারিতভাবে সেই তিনটি কথা বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে দুটি কথা তো কোরআনুল কারীমে বর্ণিত আছে এবং তা উপরে বর্ণিত হয়েছে, তৃতীয় কথাটি হাদীসে এরূপ উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইব্রাহীম (আ) মিসর হয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন, তখন তিনি মিসরে পৌছার পূর্বেই নিজের পবিত্র বিবি হযরত সারা (রা) কে বললেন, মিসরের রাজা বড় যালিম। কোন সুন্দরী নারীকে দেখলে তাকে বলপূর্বক ছিনিয়ে নিয়ে যায়। আর তার সঙ্গী পুরুষ তার স্বামী হলে তাকে হত্যা করে ফেলে। আর অন্য কোন আত্মীয় হলে তার কোন ক্ষতি করে না। তুমি যেহেতু আমার ধর্মীয় ভগ্নী আর এই ভূ-খণ্ডে তুমি ও আমি ছাড়া অন্য কোন মুসলমান নেই, সুতরাং তুমি রাজাকে বলও যে, আমার সাথের ইনি আমার ভাই। অতএব, এরূপই বলা হল। রাতের বেলা সেই রাজা যখন অসৎ উদ্দেশ্যে হযরত সারা (রা) এর প্রতি হাত বাড়াল তৎক্ষণাৎ তার হাত অবশ হয়ে গেল এবং সে কোনক্রমেই তাঁর দেহ স্পর্শ করতে পারল না। তা দেখে সে সারাকে বলল, তোমার আল্লাহর কাছে দোয়া কর, যেন আমার হাত ভাল হয়ে যায়, তাহলে আমি তোমাকে মুক্ত করে দেব। সারা (রা) দোয়া করলেন, তার হাত ভাল হয়ে গেল, কিন্তু সে পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভুলে গিয়ে পুনরায় অসৎ ইচ্ছা পূরণ করতে চাইলে তার হাত পুনরায় অবশ হয়ে গেল। তৃতীয় বারেও অনুরূপ ঘটনা ঘটল। তখন সে বলল, মনে হচ্ছে, এই স্ত্রীলোকটি জ্বিন, মানুষ নয়। তাকে তাড়াতাড়ি আমার সম্মুখ থেকে নিয়ে যাও এবং হযরত হাজেরাকে তাঁর সাথে দিয়ে বলল, একেও তোমার সাথে নিয়ে যাও। আমি একে তোমার হাওয়ালা করে দিলাম। সারা (রা) যখন হাজেরাকে সাথে নিয়ে হযরত ইব্রাহীম (আ) এর কাছে পৌছলেন। তখন তিনি অবস্থা জানতে চাইলে হযরত সারা 'মোবারকবাদ' দিয়ে বললেন, আল্লাহ পাকের শোকর যে, তিনি এ ফাসেক ও বদকার ব্যক্তি থেকে আমাকে নাজাত দিয়েছেন এবং আপনার জন্য একজন খাদেমা সাথে দিয়েছেন। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) এ হাদীসটি বর্ণনা করে বললেন, "হে উন্নত ও শরীফ বংশের আরববাসীরা! ইনিই সেই হাজেরা, যিনি তোমাদের সকলের মাতা।"

        এ হাদীসটি বিভিন্নরূপে হাদীসের কিতাবসমূহের উদ্ধৃত রয়েছে। বুখারী শরীফেও আরো একটি দীর্ঘ হাদীস রয়েছে। যা 'শাফআতের হাদীস' নামে অভিহিত। বুখারী শরীফের বিভিন্ন অধ্যায়ে যথা সূরায়ে বাক্বারার তাফসীর অধ্যায়ে, কিতাবুল ইস্তেরক্বাকে এবং কিতাবুত্তাওহীদে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে হযরত ইব্রাহীমের যে আলোচনা হয়েছে, এর সারমর্ম হলো:

        "হাশরের ময়দানে যখন সমস্ত মানুষ আদম (আ), নূহ (আ) এবং অন্যান্য আম্বিয়ায়ে কেরামের নিকট আল্লাহর দরবারে সুপারিশের আবেদন জানিয়ে বিফল হবে, তখন হযরত ইব্রাহীম (আ) এর নিকট আবেদন জানাবে যে, আপনি খলীলুল্লাহ আপনি আল্লাহ পাকের দরবারে সুপারিশ করে দিন, যেন তাড়াতাড়ি আমাদের সি মিল মীমাংসা হয়ে যায়। তিনি বলবেন, আমি আল্লাহ পাকের কাছে লজ্জিত আছি, কেননা, আমি পৃথিবীতে তিনটি মিথ্যা কথা বলেছিলাম। "আমি পীড়িত," "বরং তোমাদের সর্বাপেক্ষা বড় মূর্তিটিই এ কাজ করেছে," আর নিজের বিবিকে বলেছিলাম "আর্থ তোমার ভাই।"

        বোখারী ছাড়াও এই রেওয়ায়াতটি মুসলিম, মুসনাদে আহমদ, ছহীহ ইবনে খুযাইমা, মুস্তাদরাকে হাকেম, মু'জা ভাররানী, মুছাল্লেফ ইবনে আবি শাইবা, তিরমিযী এবং মুসনাদে হাবিউয়ানা হাদীসের কিতাবগুলোতে বিভিন্ন সাহাবায়ে কেরাম (রা) হতে রেওয়ায়াত করা হয়েছে।

        এ রেওয়ায়েতটি হাদীসের কিতাবস্হে মোটামুটি এবং সবিস্তার বিভিন্ন রকমে রেওয়ায়েত করা হয়েছে। কোন কোনটিতে শুধু মোটামুটিভাবে এতটুকু উল্লেখ আছে যে, "প্রত্যেক নবী তখন নিজের ত্রুটি-বিচ্যুতি বর্ণনা করে আপড়ি প্রকাশ করবেন যে, তিনি সুপারিশ করতে পারেন না।" আর কোন হাদীসে ইব্রাহীম (আ) এর উত্তরের মধ্যে শুধু তিনটি মিথ্যার কথাই বলা হয়েছে। কোন হাদীসে এ তিনটির বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখ করা হয়েছে, আর এ রেওয়ায়াত গুলোরই কোন কোনটিতে এটাও উল্লেখ আছে যে,

مَا مِنْهَا كَذِبَةٌ إِلَّا مَا حَلَ بِهَا عَنْ دِينِ اللَّهِ .

        অর্থাৎ: "রাসূলুল্লাহ (ছ) বলেছেন, ইব্রাহীম (আ) এর এ তিনটি মিথ্যার মধ্যে প্রত্যেকটিই আল্লাহর দ্বীনের হেফাযতের জন্যই বলা হয়েছে।"

        কোরআনুল কারীম হযরত ইব্রাহীম (আ) এর নিম্নরূপ বৈশিষ্ট্যগুলো স্পষ্টরূপে উল্লেখ করেছে।

ا وَاذْكُرْ فِي الْكِتٰبِ إِبْرَاهِيمَ - أَنَّهُ كَانَ صَدِيقًا بَيْبًا - (مَرْيَمُ)

        ১. অর্থাৎ: "এ কিতাবে উল্লিখিত ইব্রাহীম (আ)এর কথা স্মরণ করুন, নিঃসন্দেহে তিনি একজন সত্যনিষ্ঠ নী ছিলেন।" -(সূরা মারইয়াম: ৪১)

ان إِبْرَاهِيمَ كَانَ أُمَّةً قَانِتَا لِلَّهِ حَنِيفًا - وَلَمْ يَكُ مِنَ الْمُشْرِكِينَ - شَاكِرًا لانعيه . اجتَبهُ وَهَدَبَةٌ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ - (النَّحْلُ)

    ২. অর্থাৎঃ "নিঃসন্দেহ, ইব্রাহীম ছিলেন এক উম্মত, আল্লাহর অনুগত, একনিষ্ঠ এবং তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। তিনি ছিলেন আল্লাহর অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞ, আল্লাহ পাক তাঁকে মনোনীত করেছিলেন এবং সরল পথে পরিচালিত করেছিলেন!" -(সূরা নাহল: ১২০-১২১)

ثُمَّ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ أَنِ اتَّبِعَ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا - (النَّحْلُ)

       ৩. অর্থাৎঃ “(হে মোহাম্মদ।) অতঃপর আমি আপনার প্রতি অহী প্রেরণ করলাম যে, আপনি একনিষ্ঠভাবে ইব্রাহীমের দ্বীনের অনুসরণ করুন।" (সূরা নাহল: ১২৩)

وَلَقَدْ أَتَيْنَا إِبْرَاهِيمَ رَشْدَهُ مِنْ قَبْلِ وَكُنَّا بِهِ عَلِمِينَ - (الْأَنْبِيَاءُ)

    ৪. অর্থাৎঃ "আর নিঃসন্দেহ, ইব্রাহীমকে সৎ পথের জ্ঞান দিয়েছিলাম। আর আমি তাঁর সম্বন্ধে সম্যক অবহিত ছিলাম।" -(সূরা আম্বিয়া : ৫১)

        এ আয়াতগুলোর এবং এই রকমের আরো বহু আয়াত হযরত ইব্রাহীম (আ) এর সে সব বিশেষ গুণাবলির উল্লেখ করেছে এবং অকাট্য প্রমাণসমূহ পেশ করেছে যার পরে এক নিমেষের জন্য তাঁর মত পবিত্র ও উচ্চ মর্যাদাশালী ব্যক্তিত্বের সম্বন্ধে 'মিথ্যার' কল্পনাও হতে পারে না। মিথ্যা সংঘটিত এবং কার্যে পরিণত হওয়া তো দূরের কথা। চাই তা প্রকৃত অর্থেই হোক কিম্বা শুধু বাহ্যিক আকারের মিথ্যাই হোক।

Post a Comment

0 Comments