হযরত হাজেরা ও হযরত ইসমাঈল (আ) এর নির্বাসন


হযরত ইসমাঈল (আ) এর জন্ম

        হযরত ইব্রাহিম (আ) বাবেল ত্যাগের বিভিন্ন দেশ ঘুরে ঘুরে অবশেষে শাম দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তাঁর গন্তব্য স্থান ছিল বায়তুল মুকাদ্দাস। তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসে আসার পথে বিভিন্ন এলাকায় যাত্রাবিরতি করেন। এভাবে অনেক দিন পর তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসে পৌঁছেন। তাঁর আগমণে আনন্দিত হয়ে হযরত সারা দুশ' স্বর্ণমুদ্রা আল্লাহর ওয়াস্তে সদকা করেছিলেন। শহরবাসী ও তাঁর প্রত্যাবর্তনে অত্যন্ত আনন্দিত হয়। এরাতেই হযরত ইব্রাহীম (আ) হযরত হাজেরার সাথে শয্যাগত হন। ফলে তাঁর চেহারার উজ্জল নূর হযরত হাজেরার চেহারায় স্থানান্তরিত হয়। হযরত হাজেরা শয্যা থেকে উঠে হযরত সারার নিকট যান। তিনি ঘটনা জানতে পেরে হযরত হাজেরার কান ছিদ্র করে দেন। হযরত ইব্রাহিম (আ) অলঙ্কার এনে হযরত হাজেরাকে পরিয়ে দেন। এতে তাঁর রূপ সৌন্দর্য পূর্বাপেক্ষা বহু গুণে বর্ধিত হয়। হযরত হাজেরার রূপ-সৌন্দর্য বেড়ে যেতে দেখে তিনি বলেন, বাহ্! বাহ! কান ছেদনের এ ত্রুটিতো আরও বেশি সৌন্দর্য দান করল। নয় মাস অতিবাহিত হওয়ার পর হযরত হাজেরার গর্ভ হতে ইসমাঈল (আ) জন্ম গ্রহণ করেন।

হযরত হাজেরা ও হযরত ইসমাঈল (আ) এর নির্বাসন

        হযরত হাজেরার গর্ভ থেকে হযরত ইসমাঈল (আ) জন্মগ্রহণ করা হযরত সারার পক্ষে অত্যন্ত মনকষ্টদায়ক হল, হযরত ইব্রাহীম (আ) এর প্রথম এবং বড় স্ত্রী পূর্ব হতে গৃহকত্রী ছিলেন। আর বিবি হাজেরা ছোট বিবি তাঁর খেদমতগার। এ সব কারণে মানবসুলভ প্রকৃতির তাড়নায় ইসমাঈল (আ) এর জন্ম হযরত সারার জন্য প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়াল। সুতরাং হযরত সারা হযরত ইব্রাহীম (আ) এর নিকট জেদ ধরলেন, বিবি হাজেরা এবং তার শিশুপুত্র আমার দৃষ্টির সম্মুখে যেন না থাকে। তাদেরকে আলাদা কোন স্থানে নিয়ে যাওয়া হোক।

        এ জেদ হযরত ইব্রাহীম (আ) এর নিকট অত্যন্ত অপছন্দনীয় হল। কিন্তু আল্লাহ্ তা'আলা তাঁকে জানিয়ে দিলেন যে, হাজেরা, ইসমাঈল এবং তোমার জন্য এতেই কল্যান যে, সারার কথা মেনে নাও।

        বোখারী শরীফে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে যে রেওয়াতটি উদ্ধৃত হয়েছে তা নিম্নে প্রদত্ত হল- ইব্রাহীম (আ) বিবি হাজেরা (রা) এবং তাঁর শিশু সন্তান ইসমাঈলকে নিয়ে চললেন। যেখানে বর্তমান কা'বাগৃহ অবস্থিত তথায় একটি বড় বৃক্ষের নীচে যমযম কূপের বর্তমান স্থানের উপরের অংশে তাঁদেরকে ছেড়ে গেলেন। এ স্থানটি তখন অনাবাদ এবং জনহীন বিরান ভূমি ছিল। পানির নামচিহ্নও ছিল না। সুতরাং ইব্রাহীম (আ) এক মোশক পানি ও এক থলে খেজুর তাঁর কাছে রেখে দিলেন। অতঃপর মুখ ফিরিয়ে চলতে লাগলেন বিবি হাজেরা (রা) তাঁর পিছু পিছু চলতে চলতে বললেন, হে ইব্রাহীম। আপনি আমাদেরকে উপত্যকা ভূমিতে কোথায় বিবি ছেড়ে যাচ্ছেন? যেখানে মানুষও নেই, কোন সহায়ও নেই, কোন দুঃখের সাথীও নেই। হাজেরা অনবরত এরূপ বলে চললেন, কিন্তু ইব্রাহীম (আ) নীরবে চলে যাচ্ছিলেন, অবশেষে বিবি হাজেরা জিজ্ঞেস করলেন, আপনার আল্লাহই কি আপনাকে এরূপ আদেশ করেছেন, তখন হযরত ইব্রাহীম (আ) বললেন, "হ্যাঁ, এটা আল্লাহরই আদেশ।" বিবি হাজেরা তা শুনে বললেন, আল্লাহর হুকুম হয়ে থাকলে এতে কোন সন্দেহ নেই যে, তিনি আমাদেরকে ধ্বংস ও বিনষ্ট করবেন না। অতঃপর ফিরে আসলেন, ইব্রাহীম (আ) চলতে চলতে একটি টিলার উপর এমন স্থানে পৌছলেন যে, তিনি হযরত হাজেরা ও ইসমাঈল (আ) এর দৃষ্টিপথ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তখন বর্তমান কা'বাগৃহের দিকে মুখ করে হাত তুলে এ দোয়া করলেন:

رَبَّنَا إِنِّي أَسْكَنْتُ مِنْ ذُرِّيَّتِي بِوَادٍ غَيْرِ ذِي زَرْعٍ عِنْدَ بَيْتِكَ الْمُحَرَّمِ رَبَّنَا ليُقِيمُوا الصَّلوة فَاجْعَلْ أَفْئِدَةً مِّنَ النَّاسِ تَهْوِى إِلَيْهِمْ وَارْزُقْهُمْ مِنَ الثَّمَرَتِ لعَلَّهُمْ يَشْكُرُونَ - (إِبْرَاهِيمُ)

        অর্থাৎঃ "হে আমাদের প্রতিপালক! আমি আমার বংশধরদের কতককে বসবাস করার জন্য আপনার সম্মানিত ঘরের কাছে রাখলাম। হে আমাদের রব। যেন তারা নামায কায়েম করে অতএব, আপনি কিছু লোকের অন্তর তাদের প্রতি অনুরাগী করে দিন এবং ফলাদি দ্বারা তাদের রিযিকের সরঞ্জাম প্রস্তুত করে দিন যেন তারা আপনার শোকর আদায়কারী হয়।" -(সূরা ইব্রাহীমঃ ৩৭)

         বিবি হাজেরা (রা) কয়েকদিন পর্যন্ত ইব্রাহীম (আ) এর রেখে যাওয়া খেজুর এবং পানি থেকে আহার করলেন এরপর ইসমাঈলকে দুধ পান করাতে থাকলেন, কিন্তু পরিশেষে এমন সময় এসে গেল খাবার বলতে আর কিছুর থাকল না। তখন তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন। যেহেতু তিনি তৃষ্ণার্ত ও ক্ষুধার্ত ছিলেন, তাঁর বুকের দুধও শুকিয়ে গিয়েছিল। শিশুটি তৃষ্ণায় এবং ক্ষুধায় ছটফট করছিল, তখন হাজেরা ইসমাঈলকে ছেড়ে দূরে গিয়ে বসলেন, যেন এমন করুণ সময়ে প্রাণের তুল্য পুত্রের দুর্দশা নিজের চক্ষে দেখতে না পান। অবশেষে নিকটস্থ 'ছাফা' পাহাড়ের উপর আরোহণ করলেন, কোন আল্লাহর বান্দাকে কিংবা পানি দেখতে পান কি না? কিন্তু কিছুই দেখতে না পেরে শিশুর মহরতে দৌড়িয়ে উপত্যকায় তার নিকটে এলেন, অতঃপর অপরদিকে নিকটস্থ পাহাড় মারওয়ার উপর আরোহণ করলেন। সেখানেও যখন কিছুই দেখতে পেলেন না, পুনরায় দ্রুত দৌড়িয়ে উপত্যকায় শিশুর কাছে ফিরে এলেন। ছাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ে সাতবার দৌড়ালেন। নবী করীম (ছ) এস্থানে পৌছে বললেন, সেই "ছাফা ও মারওয়ার মধ্যস্থলের দৌড়" যা হজ্জের সময় লোকে করে থাকে। অবশেষে শেষবার যখন বিবি হাজেরা মারওয়ার উপর উঠলেন, তখন কানে একটি আওয়ায আসল। তিনি চমকে উঠলেন এবং মনে মনে ভাবলেন, "কেউ ডাকছে।" কর্ণপাত করলেন, পুনরায় সে আওয়ায শুনলেন। বিবি হাজেরা বললেন, "যদি তুমি সাহায্য কারী হও, তবে সম্মুখে আস তোমার আওয়ায শুনতে পেয়েছি। অতঃপর দেখলেন, আল্লাহর ফেরেশতা জিব্রায়ীল (আ) স্বীয় পায়ের গোড়ালি দ্বারা সেই স্থানে আঘাত করলেন, যেখানে বর্তমান যমযম কূপ রয়েছে। তৎক্ষণাৎ সে স্থান থেকে পানি ফুলে উঠতে লাগল। বিবি হাজেরা (রা) তা দেখে পানির চতুর্দিকে বাঁধ দিতে লাগলেন, কিন্তু পানি ফুলেই উঠল। রাসূলে করীম (ছ) এ স্থানে পৌছে বললেন, "আল্লাহ্ তা'আলা ইসমাঈলের মাতার উপর রহম করুন, যদি তিনি যমযমকে এরূপে না রুখতেন এবং তার চতুর্দিকে বাঁধ না দিতেন, তবে তা মহা শক্তিশালী প্রস্রবণে পরিণত হত।" বিবি হাজের পানি পান করলেন, ফেরেশতা তাকে বললেন, ভয় ও চিন্তা করো না, আল্লাহ তোমাকে এবং এই শিশুকে বিনষ্ট করবেন না। তা বায়তুল্লাহ শরীফের স্থান।" যা নির্মাণ করার ভার এই শিশু ও তার পিতা ইব্রাহীম (আ) এর অদৃষ্টে নির্ধারিত হয়েছে। এ কারণে আল্লাহ্ এ খান্দানকে ধ্বংস করবেন না। বাইতুল্লাহর সেই স্থানটি নিকটে দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু পানির স্রোত ডান দিকে ও বাম দিকের সেই অংশকে সমান করে যাচ্ছিল। 

        সে সময়েই বনি জোরহামের একটি গোত্র সে উপত্যকার এসে থামল। তারা অনতিদূরেই দেখতে পেল, পাখী উড়ছে। জোরহামীরা বলল, নিঃসন্দেহে এটা পানির লক্ষণ। সেখানে অবশ্যই পানি আছে। জোরহামীরাও এসে হযরত হাজেরার কাছে সেই স্থানে বসবাস করার অনুমতি চাইল। হযরত হাজেরা বললেন, অবস্থান করতে পার, কিন্তু পানির মালিকানা সত্ত্বের অংশীদার হতে পারবে না। জোরহামীরা আনন্দের সাথে তা মেনে নিল এবং সেখানেই বসবাস করতে লাগল। রাসূলুল্লাহ (ছ) বলেছেন, বিবি হাজেরা নিজেও পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও সঙ্গ লাভের জন্য চাচ্ছিলেন যে, কেউ এখানে এসে বসবাস করুক। সুতরাং তিনি আনন্দের সাথে বনি জোরহামকে তথায় বসবাস করার অনুমতি প্রদান করলেন। জোরহামীরা লোক পাঠিয়ে নিজ নিজ বংশের অবশিষ্ট লোকদেরকে সেখানে নিয়ে এল। অনন্তর এখানে ঘরবাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করতে লাগল। এদের সাথেই ইসমাইল থাকতেন আর খেলাধুলা করতেন আর তাদের থেকে তাদের ভাষা শিখতেন। তিনি বড় হলে তাঁর চালচলন এবং তাঁর সৌন্দর্য জোরহামীদের খুব পছন্দ হল, তারা তাদের বংশের এক মেয়ের সাথে তাঁর বিবাহ দিল। এর কিছুকাল পরেই হযরত হাজেরা ইন্তিকাল করেন। হযরত ইব্রাহীম (আ) পরিবারকে দেখার জন্য আগমন করতেন। একবার তিনি তশরীফ আনলে কিন্তু ইসমাঈল (আ) তখন গৃহে ছিলেন না। তাঁর স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, জীবিকার অন্বেষণে বের হয়েছেন। ইব্রাহীম (আ) বললেন, তোমাদের দিনাতিপাত কিভাবে চলছে? সে বলল, নিতান্ত মুছিবত ও পেরেশানীর মধ্যে দিয়ে চলছে এবং অত্যন্ত দুঃখ ও কষ্টের মধ্যে আছি। ইব্রাহীম (আ) তা শুনে বললেন, ইসমাঈলকে আমার সালাম বলও এবং বলে দিও যে, সে যেন তার দরজার চৌকাঠ বদলে ফেলে। ইসমাঈল (আ) গৃহে ফিরে আসলে ইব্রাহীম (আ) এর নূরে নবুওয়াতের চিহ্ন ও আভাস পেয়ে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, কেউ কি এখানে এসেছিল? স্ত্রী সবকিছু খুলে বললেন, সব শুনে ইসমাইল (আ) বললেন, তিনি আমার পিতা ইব্রাহীম (আ) ছিলেন। তাঁর পরামর্শ হল, আমি তোমাকে তালাক প্রদান করি। সুতরাং আমি তোমাকে আমার বিবাহ বন্ধন হতে বিছিন্ন করে দিলাম।

        ইসমাঈল (আ) অতঃপর দ্বিতীয় বিবাহ করলেন। আর একদিন হযরত ইব্রাহীম (আ) আগের মতই ইসমাঈল (আ)এর অনুপস্থিতিতে তাঁর গৃহে তশরীফ আনলেন এবং ইসমাইল (আ) এর পূর্বের স্ত্রীকে যা জিজ্ঞেস করেছিলেন তাঁকেও তাই জিজ্ঞেস করলেন। বিবি বললেন, আল্লাহর শোকর, তাঁর অনুগ্রহে আমাদের দিনাতিপাত ভালোই চলছে। জিজ্ঞেস করলেন, কি খেতে পাও? ইসমাঈলের বিবি বললেন, গোশত। ইব্রাহীম (আ) জিজ্ঞেস করলেন, পান করতে কি পাও? তিনি বললেন, 'পানি'। হযরত ইব্রাহীম (আ) দোয়া করলেন "হে আল্লাহ। তাদের গোশত এবং পানিতে বরকত দান করুন। অনন্তর বিদায়কালে সংবাদ দিয়ে গেলেন, তোমার স্বামীকে বলও, সে যেন আপন গৃহের দরজার চৌকাঠ সংরক্ষিত রাখে। হযরত ইসমাঈল গৃহে প্রত্যাবর্তন করলে, তাঁর বিবি সমস্ত ঘটনা তাঁকে শুনালেন এবং ইব্রাহিম (আ) এর নির্দেশটিও পৌঁছালেন। ইসমাঈল (আ) বললেন, ইনি আমার পিতা ইব্রাহীম (আ) এবং তাঁর সংবাদ হল, তুমি যেন সারা জীবন আমার সঙ্গিনী থাক।...

        এ দীর্ঘ বর্ণনাটি বোখারীর কিতাবুর রু'ইয়া ও কিতাবুল আম্বিয়ায় দু'স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে। রেওয়ায়ত দুটি হতে প্রমাণিত হয় যে, ইসমাঈল (আ) বর্ণনা কৃষিবিহীন উপত্যকায় অর্থাৎ মক্কায় দুগ্ধপোষ্য অবস্থায় পৌছেছিলেন।

Post a Comment

0 Comments