হযরত ইব্রাহীম (আ) এর হিজরত

 ফোরাত নদীর পশ্চিম তীরের দিকে হিজরত

        হযরত ইব্রাহীম (আ) স্বীয় পিতা আযর এবং সম্প্রদায় থেকে পৃথক হয়ে ফোরাত নদীর পশ্চিম তীরের নিকটবর্তী এক জনপদে চলে গেলেন, যার অধিবাসীরা কালদানী সম্প্রদায় নামে প্রসিদ্ধ ছিল, এখানে কিছুকাল অবস্থান করলেন, হযরত সারা (রা) এবং হযরত লূত (আ) তাঁর সাথে ছিলেন। কিছু দিন পরে এখান থেকে খারান কিম্বা হারানোর দিকে যাত্রা করলেন। সেখানে গিয়ে হানাফী ধর্মের তাবলীগ আরম্ভ করলেন। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে অহরহ নিজের পিতা নি একনিষ্ঠভারে আযরের জন্য মাগফেরাতের দোয়া করতেন এবং তার হেদায়াত লাভের জন্য আল্লাহরর নিকট দোয়া করতেন। কেননা, আযরের পক্ষ হতে সর্ব প্রকারের শত্রুতা প্রকাশ সত্ত্বেও তিনি আযরের সাথে ওয়াদা করেছিলেন যে, "যদিও আমি আপনাকে ছেড়ে যাচ্ছি এবং আফসোস যে, আপনি আল্লাহর হেদায়াতের প্রতি লক্ষ্য করলেন না, তবুও আমি সর্বদা আল্লাহর দরবারে আপনার মাগফেরাতের জন্য দোয়া করতে থাকব। অবশেষে আল্লাহ্ তা'আলার ওহী হযরত ইব্রাহীমকে জানিয়ে দিল যে, আযর ঈমান আনবে না এবং সে ঐসব লোকের মধ্যে অন্যতম যারা নিজেদের উত্তম যোগ্যতাকে নষ্ট করে এরূপ নাফরমান হয়ে গিয়েছে, যাদের সম্বন্ধে আল্লাহ বলেছেনঃ

خَتَمَ اللهُ عَلَى قُلُوبِهِمْ وَعَلَى سَمْعِهِمْ - وَعَلَى أَبْصَارِهِمْ غِشَاوَةٌ - (بَقَرَة) 

অর্থাৎঃ "আল্লাহ্ তাদের অন্তরে এবং কর্ণে মোহর মেরে দিয়েছেন, এবং তাদের চোখের উপর আবরণ রয়েছে।" -(সূরা বাক্বারা: ৭)

হজরত ইব্রাহীম (আ) তা জানতে পেরে আযারের সাথে তাঁর নিঃসম্পর্কতা পরিষ্কার কথায় ঘোষণা করে নিচ্ছে যে, "নিতার সম্বন্ধে আমি যে কল্পিত আশা পোষণ করছিলাম তার অবসান ঘটেছে: সুতরাং এখন আর তার জন্য অং কামী' কাওমের স প্রার্থনা করা বৃথা। কোরআনুল কারীম এ ঘটনাটিকে নিম্নরূপ ব্যক্ত করেছেঃ

"স্বীয় পিতার জন্য ইব্রাহীমের ক্ষমা প্রার্থনা শুধু এ কারণে ছিল যে, তিনি পিতার সাথে এবিয়য়ে ওয়াদাবদ্ধ ছিলেন। অতঃপর যখন এটা তাঁর নিকট সুস্পষ্ট হল যে, সে আল্লাহর শত্রু, তখন ইব্রাহীম তার সাথে সম্পক ছিন্ন করলেন। নিঃসন্দেহ, ইব্রাহীম ছিলেন কোমল হৃদয়, ধৈর্যশীল।" -(সুরা তাওবা: ১১৪)

ফিলিস্তীনের দিকে হিজরত

        অতঃপর ইব্রাহীম (আ) আল্লাহর দ্বীন প্রচার করতে করতে ফিলিস্তীনে গিয়ে উপনীত হলেন। এ সফরেও হয়রা সারা এবং হযরত লুত (আ) সস্ত্রীক তাঁর সাথে ছিলেন। কোরআনুল কারীমে উল্লেখ রয়েছে:

نَامَن لَهُ لُوط - وَقَالَ إِنِّي مُهاجر إلى ربى - أَنَّهُ هُوَ الْعَزيزُ الْحَكِيمُ (مَنكَبوت)

        অর্থাৎ :"অতঃপর লূত তাঁর উপর ঈমান আনলেন এবং বললেন, "আমি আমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে হিজরত করব, নিঃসন্দেহ, তিনি ক্ষমতাশালী হেকমতওয়ালা।" (আন কাবুত : ২৬)

        হাদীসে এসেছে ওসমান যুন্নুরাইন (রা) যখন নিজের পবিত্র স্ত্রী সঙ্গে নিয়ে আবিসিনিয়ার দিকে হিজরত করকে তখন রাসূলুল্লাহ (ছ) বললেন, "নিঃসন্দেহ লুত (আ) এর পর ওসমানই সর্বপ্রথম মুহাজির, যিনি স্বস্ত্রীক হিজরত করেছেন।

        হযরত ইব্রাহীম (আ) ফিলিস্তীনের পশ্চিম অঞ্চলে বসতি স্থাপন করলেন। সে সময় এ অঞ্চলটি কেনআনীদে অধীনে ছিল। অনন্তর সেখান থেকে অল্পকাল পরেই হযরত ইব্রাহীম (আ) শাকীম (নাবালেস) চলে যান তথা কিছুকাল অবস্থান করার পরও ক্রমাগত পশ্চিম দিকেই অগ্রসর হতে লাগলেন, এমন কি শেষ পর্যন্ত মিসর পর্যন্ত তি পৌছলেন।

মিসরে হিজরত এবং হযরত হাজেরা (রা)

        নাবালেস থেকে হিজরত করে যখন মিসরে পৌছলেন, তখন বুখারী ও মুসলিম শরীফের রেওয়ায়াত অনুযায়ী যালেম রাজার সে ঘটনাটি ঘটল, যা কিয়ৎ পূর্বে লিখিত হয়েছে, আর তাওরাতে এ ঘটনাটি নিম্নরূপে উদ্ধৃত হয়েছে। "অতঃপর যখন ইব্রাহীম মিসরে পৌঁছলেন, মিসরবাসীরা দেখল, তাঁর সাথে যে মেয়েলোকটি রয়েছে সে দুই সুন্দরী। ফেরআউনের উমরারা তাঁকে দেখে ফেরাউনের নিকট তার রূপের খুব প্রশংসা করল এবং তাঁ। ফেরআউনের হেরেমে অভ্যন্তরে নিয়ে গেল, ফেরআউন এর বিনিময়ে ইব্রাহীমের প্রতি অনুগ্রহ করল, তাকে তো বকরী, গাভী, বলদ, গাধা, গাধী, দাস-দাসী, বাঁদী ও উট দান করল। আল্লাহ তা'আলা ফেরআউন ও তার খান্দানা ইব্রাহীমের স্ত্রী সারার কারণে ভীষণ মার মারলেন, তখন ফেরআউন ইব্রাহীমকে ডেকে বলল, তুমি আমার সাথে এ কি করলে? কেন বললে না যে, এ মেয়েলোকটি আমার স্ত্রী? তুমি কেন বললে যে, সে আমার ভগ্নী, এমন কি আ তাকে আমার স্ত্রী বানাবার জন্য গ্রহণ করলাম। দেখ, এ তোমার স্ত্রী উপস্থিত। তাকে নিয়ে এখান থেকে চলে যায় আর ফেরআউন তাঁর সম্বন্ধে লোকদেরকে আদেশ করল, তখন তারা তাঁকে, তাঁর স্ত্রীকে এবং তাঁর সাথে যা কিছুদি সবকিছুসহ রওয়ানা করে দিল।"

        ছহীহ বুখারী ও মুসলিমের রেওয়ায়েতে এবং তাওরাতের এ রেওয়ায়েতটির মধ্যে পার্থক্য হল, বুখারী ও মুসয়া শরীফে হযরত সারার বদদোয়ায় অত্যাচারী রাজা ফেরআউন তার পক্ষাঘাতগ্রস্থ হওয়াকে শয়তানের (জ্বিনের) অর্জ মনে করে সারা হতে নিজের জান বাঁচাল, আর হযরত হাজেরাকে তাঁর হাওলা করে দিয়ে ইব্রাহীম (আ)কে সাথীবৃন। দরবারে অত্যন্ত সাজসরঞ্জামসহ মিসর থেকে চলে যাওয়ার অনুমতি দিল।

        অবশ্য এসব রেওয়ায়াত এতটুকু কথা সুনিশ্চিতরূপে বুঝা যায় যে, হযরত ইব্রাহীম (আ) স্বীয় বিবি সারা এবং ভ্রাতুষ্পুত্র লুতসহ মিসর গিয়েছিলেন এবং তা সেই সময় যখন মিসরের রাজত্ব এমন এক খান্দানের হাতে ছিল যারা 'সামী' কাওমের সাথে সম্পর্ক রাখত। এরূপে তার হযরত ইব্রাহীমের সাথে বংশগতরূপে সংশ্লিষ্ট ছিল। মিসরে পৌঁছে ইব্রাহীম (আ) ও ফেরআউনের মধ্যে অবশ্যই এমন ঘটনা ঘটেছিল যদ্দ্বারা সে নিশ্চিতরূপে বুঝেছিল যে, ইব্রাহীম (আ) ও ফেরআউনের খান্দান আল্লার প্রিয় ও মনোনীত খান্দান। তাঁদেরকে নানা প্রকারের মাল দৌলত ও উদ্দেশ্যে স্বীয় কন্যা হাজেরাকেও হযরত ইব্রাহীম (আ) এর সাথে বিবাহ দিয়ে দিল, তিনি তৎকালীন প্রথা অনুযায়ী স্বামীর বড় বিবির খেদমতগার সাব্যস্ত হলেন।এ ঐতিহাসিক অনুমান ও ধারণা প্রধান সাক্ষ্য ইহুদীদের কাছেও  বিদ্যমান রয়েছে।

        'সিফরুল ঈশা' নামক ইহুদীদের নির্ভরযোগ্য ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, হযরত ইব্রাহীম (আ) এর কালে মিসরের বাদশাহ্ হযরত ইব্রাহীম (আ) এর স্বদেশী লোক ছিল। এরূপে ইহুদীদের গণ্যমান্য রেওয়ায়েতগুলো দ্বারা এ বিষয়টিও পরিষ্কার হয়ে যায় যে, হযরত হাজেরা (রা) মিসর রাজের কন্যা ছিলেন না বাঁদী বা দাসী ছিলেন। তাওরাতের একজন নির্ভরযোগ্য তাফসীরকার 'রাব্বী শেলুমলু ইসহাক' কিতাবে পয়দায়েশে বাব ১৬, আয়াত ১ নংএর মধ্যে লিখেছেন- "যখন সে (বাক্ হউন মিসরের বাদশাহ) সারার কারামত দেখল তখন বলল, আমার কন্যা এর ঘরে বাঁদী হয়ে থাকা অন্য ঘরে রাণী হয়ে থাকার চেয়ে উত্তম।"

        এ তাফসীর এবং তাওরাতের আয়াত একত্রিত করলে এই সত্যটি স্পষ্ট হয়ে পড়ে যে, তাওরাতে হাজেরাকে কেবল এজন্য বাঁদী বলা হয়েছে যে, মিসরের বাদশাহ তাঁকে ইব্রাহীম (আ) ও সারার হাওয়ালা করে দেয়ার সময় বলেছেন, "সে হযরত সারার খেদমতগার থাকবে।" এ অর্থ ছিল না যে, তিনি বাঁদী ছিলেন, কেননা, 'রাব্বী শেলুমলু' বর্ণনা করেছেন যে, হাজেরা মিসরের ফেরআউনের কন্যা ছিলেন। বুখারী শরীফে হযরত আবূ হুরাইরা হতে যালিম বাদশাহর যে বর্ণনাটি উদ্ধৃত হয়েছে এতেও বাক্যটি উল্লেখ আছে এবং তা রাব্বী শেলুমলুর তাফসীরের দৃঢ়তা পোষণ করে।

واحدمها هاجرة .

        অর্থাৎঃ "আর হাজেরাকে হযরত সারার হাওয়ালা করে দিলেন, যেন তাঁর খেদমতগার থাকেন।"

    সুতরাং বনি-ইসরাঈলদের এ বিদ্রুপ সঠিক নয় যে, "বনি-ইসমাঈল আমাদের চেয়ে এ কারণে হীন যে, তারা বাঁদীর বংশধর আমরা হযরত ইব্রাহীমের বিবি হযরত সারার বংশধর। তাদের এ উক্তি প্রকৃত ঘটনা ও ইতিহাস বিরোধী। আর তাওরাতের অন্যান্য বিষয় বস্তুতে যেমন পরিবর্তন পরিবর্ধন করা হয়েছে, তদ্রুপ এ বিষয়টিকেও পরিবর্তন পরিবর্ধন করা হয়েছে। ঘটনার সমস্ত বিবরণ বাদ দিয়ে কেবল "বাঁদী" শব্দটিকে বাকী রাখা হয়েছে।

        'হাজেরা' আসলে হিব্রু ভাষায় 'হাগার'। তার অর্থ বেগানা ও অপরিচিত। তার জন্মভূমি যেহেতু মিসরে ছিল, সুতরাং এ নামটি চালু হয়ে গিয়েছে, কিন্তু এ নীতি অনুসারে ধারণা ও অনুমানের নিকটবর্তী হল 'হাগার'এর অর্থ বিচ্ছিন্ন বা পৃথক। আরবিতে 'হাজের' শব্দের অর্থও তাই। ইনি যেহেতু নিজ জন্মভূমি হতে পৃথক হয়ে বা হিজরত করে হযরত ইব্রাহীম (আ) এর জীবন সঙ্গীনী এবং হযরত সারার খেদমতগার হলেন, এ সামঞ্জস্যেই তিনি 'হাজেরাহ' নামে অভিহিত হলেন।

Post a Comment

0 Comments