আত্মার দৃষ্টান্তঃ পাঠক-পাঠিকা। জেনে রাখ যে, উল্লিখিত বর্ণনানুযায়ী আত্মা একটি স্থাপিত তাঁবু। যার কতগুলো দরজা আছে। প্রত্যেক দরজা থেকে তার নিকট অবস্থা জানানো হয় অথবা আত্মা একটি অট্টালিকার ন্যায়, যার চারদিক থেকে তীর নিক্ষিপ্ত হয় অথবা আত্মা একটি রক্ষিত আয়নার ন্যায়। বিভিন্ন রকম আকৃতি তার উপর প্রতিফলিত হয়। একটি আকৃতির পর আরেকটি আকৃতি ক্রমাগতভাবে তার মধ্যে আসতে থাকে। অথবা আত্মা একটি কূপের ন্যায়। বিভিন্ন নলদ্বারা বিভিন্ন প্রকার পানি তাতে পতিত হয়। প্রত্যেক অবস্থায় আত্মার মধ্যে এসব নব নব প্রভাব পতিত হয়। পঞ্চ ইন্দ্রিয় আত্মার প্রকাশ্য নল। কল্পনা, লালসা, ক্রোধ এবং মানুষের প্রকৃতি দ্বারা তৈরী যেসব স্বভাব-চরিত্র রয়েছে তা' তার গুপ্ত নল। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা যাই অর্জন করা হয় তার প্রভাব আত্মার উপর পড়ে। অতিরিক্ত ভক্ষণের ফলে এবং মেজায প্রবল
হবার কারণে যখন কাম ও সার উদ্রেক হয় তখন আত্মার উপর প্রভাব পড়ে। যদি ইন্দ্রিয় থেকে বিরত থাকা যায় তাহলে মনের মধ্যে যে কল্পনার উদয় হয় তা' বাকী থাকে। কল্পনার এই চলাচল অনুসারে আত্মাও এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় পরিবর্তিত হয়। এসব কারণে আত্মা সদাসর্বদা পরিবর্তিত হতে থাকে। হৃদয়ের মধ্যে যে বিশেষ প্রভাব পড়ে তার নাম খাওয়াতের অর্থাৎ নব নব চিন্তা-ভাবনা, নব নব উপায়ে আত্মার উপর পতিত হয়। আত্মা গাফেল থাকা অবস্থায় তা' হৃদয়ে পতিত হয়। মনে চিন্তা এলেই ইচ্ছার উৎপত্তি হয়। নিয়ত এবং সংকল্প এবং ইচ্ছা ও চিন্তা উদয় হবার পর মনের মধ্যে পতিত হয়। মোটকথা এই যে, মানুষের কার্যের প্রারন্তেই এই চিন্তা লালসা জন্মায়। লালসা সংকল্প জন্মায়। সংকল্প ইচ্ছা জন্মায় এবং ইচ্ছা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে চালনা করে।
লালসার আলোড়নকারী চিন্তা দু' প্রকার; উত্তম ও মন্দঃ এক প্রকার চিন্তা মন্দের দিকে চালনা করে অর্থাৎ যে কার্যের ফল অনিষ্টকর তার দিকে চালনা করে। অন্য প্রকার চিন্তা মঙ্গলের দিকে চালনা করে। অর্থাৎ যে কার্য আখেরাতে উপকারী তার দিকে ধাবিত করে। উভয়ই বিভিন্ন প্রকার চিন্তার কারণে তাদের ভিন্ন ভিন্ন নাম দেয়া হয়েছে। যা' উত্তম চিন্তা, তাকে এলহাম বলে। যা' মন্দ চিন্তা-মন্দের দিকে নিয়ে যায় তাকে ওয়াসওয়াসা বা কুমন্ত্রণা বলে।
ফিরেশতা ও শয়তানঃ এখন তোমরা বুঝতে পারলে যে, এসব চিন্তা নতুন নতুনভাবে জন্মলাভ করে। প্রত্যেক নতুন জিনিসেরই এক জন্মদাতা আছে। নতুন নতুন জিনিসে যত বেশী বিভিন্নতা হয় তার বিভিন্ন উপাদানের পরিমাণও তত বেশী হয়। আল্লাহতায়ালার বিধান এই, যে জিনিসটি যেরূপ হয় তার উপাদানও তদ্রূপ হয়। অর্থাৎ উপাদানের উপরই জিনিসের শৃঙ্খলা থাকে। যেমন কোন গৃহের দেয়াল অগ্নির আলো দ্বারা আলোকিত হলে তার ছাদ ধুয়ার দ্বারা কাল বর্ণ ও অন্ধকার হয়ে যায়। তার এরূপ কাল বর্ণ হয়ে যাওয়া অগ্নি প্রজ্জ্বলন নয়। তদ্রূপ আত্মার আলো ও অন্ধকারের দুটো পরস্পর বিরোধী কারণ আছে। যে কারণ কল্যাণের দিকে আহ্বান করে তাকে ফিরেশতা বলা যায়। যে কারণ অমঙ্গলের দিকে আহ্বান করে তাকে শয়তান বলা যায়। মঙ্গলের এলহাম বা প্রেরণা স্বীকার করবার জন্য আত্মা যে লতীফার সাহায্য গ্রহণ করে তাকে তাওফীক বলা হয়। আর শয়তানের কুমন্ত্রণা স্বীকারের জন্য যা' গ্রহণ করা হয় তাকে পথভ্রষ্টতা বলা হয়। বিভিন্ন অবস্থার বিভিন্ন নাম আছে। ফিরেশতা বলতে আল্লাহর এমন সৃষ্ট জিনিস বুঝায় যার কাজ মঙ্গল কার্যের প্রেরণা দেয়া, বিদ্যার উপকার প্রদান করা, সত্য প্রকাশ করা, মঙ্গল কার্যের ওয়াদা করা এবং সৎকার্যের আদেশ দেয়া। আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করে এসব কার্যে নিযুক্ত করেছেন। শয়তান তার বিপরীত জিনিসের নাম। তার কার্য মন্দের ওয়াদা করা, অশ্লীল কার্যের আদেশ দেয়া, নেককাজ ও দানকার্যের ইচ্ছা করলে দরিদ্রতার ভয় প্রদর্শন করা ইত্যাদি। এলহামের বিপরীত শব্দ কুমন্ত্রণা বা ওয়াসওয়াসা। আর অপমানের বিপরীত শব্দ তাওফীক। আল্লাহতায়ালার নিম্নোক্ত আয়াতে তার সমর্থন রয়েছে। যেমন "ওয়া মিন কুল্লি শাইয়িন খালাকুনা যাওজাইনি"। অর্থাৎ প্রত্যেক জিনিসকে দু'প্রকার সৃষ্টি করেছি। আল্লাহ ব্যতীত সব জিনিসই পরস্পর বিরোধী। আল্লাহ এক তাঁর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, তিনি সত্য, তিনিই বিভিন্ন প্রকার জিনিস সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং আত্মা শয়তান ও ফিরেশতার দ্বন্দ্বের মধ্যে থাকে। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, আত্মার মধ্যে দুটো প্রেরণা আছে, একটি ফিরেশতার প্রেরণা তা' কল্যাণ এবং মঙ্গলের দিকে আহবান করে এবং সত্যের সমর্থন করে। যে তার আত্মার মধ্যে এই প্রেরণা অনুভব করে সে যেন জেনে লয় যে, তা' আল্লাহর তরফ থেকে আসে এবং সে যেন তখন আল্লাহর প্রশংসা করে। অন্য একটি প্রেরণা শত্রু থেকে আসে। তা' সন্দেহের দিকে নিয়ে যায় এবং সত্যকে মিথ্যা বলে। আর নেককার্যে নিষেধ করে। যে আত্মার মধ্যে এরূপ প্রেরণা অনুভব করে সে যেন বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে। অতঃপর তিনি আল্লাহতায়ালার এ আয়াত পাঠ করলেন: "শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্র্যের ভয় দেখায় এবং তোমাদেরকে মন্দ কাজের আদেশ দেয়।" হযরত হাসান বছরী (রহঃ) বলেন যে, দুটো চিন্তা আত্মার মধ্যে ঘুরতে থাকে। একটি আল্লাহর তরফ থেকে এবং অন্যটি শয়তান অর্থাৎ শত্রু থেকে। আল্লাহ ঐ বান্দার উপর করুণা বর্ষণ করেন যে এই চিন্তার সময় থেমে যায়। যদি ঐ চিন্তা আল্লাহর তরফ থেকে আসে বলে সে জানে সে তা' প্রচার করে। আর যদি তা' শত্রু থেকে আসে বলে সে মনে করে তবে সে তার সাথে সংগ্রাম করে। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, মু'মিনের আত্মা আল্লাহর দু' অঙ্গুলীর মধ্যে অবস্থিত রক্ত, মাংস, অস্থি, গ্রন্থি এবং অঙ্গুলী ও হস্ত থেকে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র, কিন্তু দ্রুত পরিবর্তন, নড়া- চড়া ও পরিবর্তনের শক্তিই অঙ্গুলির প্রাণ। তুমি অঙ্গুলির দিকে দৃষ্টি না করে তার নড়াচড়া এবং পরিবর্তনের দিকে লক্ষ্য কর। যেরূপ তুমি তোমার অঙ্গুলী দ্বারা অন্যান্য সব কাজ কর। আল্লাহতায়ালা শয়তান ও ফিরেশতাকে নিজ শক্তি বলে বশীভূত করে তার নিজের কার্যসমূহ করে যচ্ছেন। যেরূপ তোমার অঙ্গুলী কোন জিনিস উলটানোর জন্য তোমার অধীন হয়ে থাকে তদ্রূপ ফিরেশতা ও শয়তান মানব হৃদয়ে পরিবর্তনের জন্য আল্লাহতায়ালার অধীন থাকে। আত্মা তার জন্মলগ্ন থেকেই ফিরেশতার প্রেরণা এবং শয়তানের প্ররোচনা গ্রহণের জন্য একই সমান। এদের একটির উপর অন্যটির কোন প্রাধান্য নেই, আত্মা যদি কাম ও মোহের অনুসরণ করে, বাসনা ও কামনার প্রতি অনুরক্ত হয় তখন তার একটি অন্যটির উপর প্রবল হয় অর্থাৎ যদি কাম ও ক্রোধের প্রবৃত্তি অনুসারে কাজ করে তখন তার উসীলায় শয়তানের প্রাধান্য প্রকাশ পায়। আত্মা তখন শয়তানের আগার এবং খনিস্বরূপ হয়ে যায়। কেননা কামরিপু শয়তানের চারণভূমি এবং চলাচলের স্থানস্বরূপ। পক্ষান্তরে যখন কামরিপুর সাথে সংগ্রাম করে তাকে প্রাধান্য না দেয়া হয় এবং ফিরেশতার স্বভাব সে অনুকরণ করে তখন তার আত্মা ফিরেশতাগণের বিশ্রামস্থল এবং অবতরণের স্থান সদৃশ হয়ে যায়। আবার যখন আত্মা কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মাৎসর্য ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকে না তখন এটা বিস্ময়ের ব্যাপার নয় যে শয়তান তার মধ্যে বাস করে এবং তথায় কুমন্ত্রণা নিয়ে ঘুরাফিরা করতে থাকে। এজন্য হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যার মধ্যে শয়তান না আছে। ছাহাবায়ে কিরাম আরজ করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ (দঃ)। আপনার মধ্যেও আছে? তিনি বললেন, হাঁ, আমার মধ্যেও শয়তান আছে। তবে আল্লাহতায়ালা তার উপর আমাকে সাহায্য করছেন এবং তজ্জন্য সে আমার বশীভূত রয়েছে। শয়তান নেককার্য ব্যতীত আমাকে কিছু করতে বলে না। কামরিপুর মাধ্যমে শয়তা য়তানের সে দৌরাত্ম। আল্লাহতায়ালা যাকে কামরিপু দমনে সাহায্য করেন থাস্থান ব্যতীত তা' অন্যস্থানে ব্যবহার বা প্রয়োগ করে না এবং সে তা' শুধু ন্যায়সঙ্গত সীমার মধ্যে ব্যবহার করে। অর্থাৎ তার কামরিপু তাকে মনে মন্দের দিকে নিয়ে যায় না। শয়তান তখন তার বশীভূত থাকে। সে তাকে তখন মঙ্গল ব্যতীত আদেশ করে না, কিন্তু যখন হয় তখন সে শয়তানকে কামরিপুর প্ররোচনা অনুসারে দুনিয়ার ার স্মরণ আত্মার উপর প্রবল হয় তখন সে কুমন্ত্রণাকারীরূপে দেখতে পায়। যখন আত্মা আল্লাহর যিকিরের দিকে প্রত্য প্রত্যাবর্তন করে তখন শয়তান পশ্চাদ্দিকে সরে যায়। তার স্থান তখন সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। এ সময় ফিরেশতা অগ্রসর হয়ে তাকে সৎকার্যে প্রেরণা যোগায়। আত্মার যুদ্ধক্ষেত্রে আত্মা জয়লাভ না করা পর্যন্ত শয়তান ও ফিরেশতার সৈন্যদলে সংঘর্ষ অনবরতই লেগে থাকে। জয়লাভ করবার পর আত্মা শান্তি লাভ করে এবং নিজের স্থান দখল করে লয়। এ সময় শয়তান তার মধ্যে বশ্যতা স্বীকারপূর্বক চলাচল করে। কিন্তু অধিকাংশ আত্মার মধ্যেই শয়তানের সৈন্যদল জয়লাভ করে কর্তৃত্ব করে। এটা এমন ওয়াসওয়াসা বা কুমন্ত্রণাপূর্ণ যা' দুনিয়াকে আখেরাতের উপর প্রাধান্য দেয় এবং আখেরাতকে দূরে সরিয়ে রাখে। আত্মার লোভের অনুকরণই শয়তানের কর্তৃত্বের কারণ। তোমরা যে পর্যন্ত আত্মাকে কাম ও মোহরূপ শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে মুক্ত না কর সে পর্যন্ত যুদ্ধে আত্মার জয়লাভ করা সম্ভব নয়। এ জয়লাভের ভিত্তি আল্লাহর যিকির এবং এটাই ফিরেশতাদের প্রেরণার লক্ষণ।
হযরত জাবের বিন ওবায়দাহ (রহঃ) বলেছেন, আমি একদা আবদুল্লাহ বিন যিয়াদের নিকট হৃদয়ের মধ্যে শয়তানের কুমন্ত্রণার বিষয় অভিযোগ করলে তিনি বললেন, চোর যেরূপ গৃহে প্রবেশ করে, শয়তানও অদ্রূপ আত্মার মধ্যে প্রবেশ করে। যদি গৃহের মধ্যে কিছু থাকে শয়তান তা' নিয়ে যায়। আর গৃহে কিছু না থাকলে সে গৃহ ত্যাগ করে চলে যায়। মোটকথা যে আত্মা কাম, ক্রোধ ও মোহ থেকে মুক্ত শয়তান তার মধ্যে প্রবেশ করে না। এজন্যই আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, "ইন্না ইবাদী লাইছা লাকা আলাইহিম সুলত্বান"। অর্থাৎ আমার বান্দার উপর তোমার কোনই আধিপত্য নেই। যে ব্যক্তিই প্রবৃত্তি অনুসারে চলে সে প্রবৃত্তির দাস, আল্লাহর দাস নয়। এজন্যই আল্লাহতায়ালা তার উপর শয়তানকে প্রভুত্ব দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, "যে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তিকে মাবুদরূপে গ্রহণ করেছে তাকে কি তুমি দেখেছ? এতে দেখা যায় যে, প্রবৃত্তিই তার খোদা এবং উপাস্য। আর সে প্রবৃত্তির দাস। এজন্যই হযরত আমর ইবনুল আস (রাঃ) হুযুরে পাক (দঃ) এর নিকট আরজ করেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (দঃ)। শয়তান আমার নামাযে কিরাতের মধ্যে প্রবেশ করে। হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, এটা খানজার নামক শয়তান। যখন তুমি তা' অনুভব করবে তার থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করবে এবং তিনবার তোমার বাম পার্শ্বে থু থু নিক্ষেপ করবে। হযরত আমর ইবনুল আস (রাঃ) আমি অদ্রূপ করবার পর থেকে আল্লাহতায়ালা আমার নিকট থেকে তাকে দূর করে দিয়েছেন।
হাদীস শরীফে আছে, অজুর মধ্যে ওয়ালহান নামক একটি শয়তান আছে। তোমরা তার থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করবে। শয়তান যে কুমন্ত্রণা দেয় আল্লাহর স্মরণ ব্যতীত আত্মা.. থেকে সে কুমন্ত্রণা দূর হয় না, কেননা যখনই তার আত্মার মধ্যে কোন কিছুর স্মরণ পতিত হয় তার মধ্যে পূর্বে যা' ছিল তা' সে স্মরণ নিশ্চিহ্ন করে ফেলে। শুধু আল্লাহতায়ালা এবং তার সঙ্গে যে জিনিসের সম্পর্ক থাকে তা' নিশ্চিহ্ন হয় না। জেনে রাখবে, শয়তানের সমস্ত কুমন্ত্রণার বিপরীত বস্তু আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা। আর এটাই তোমাদের ঐ কথার অর্থ যা' হল, আমি আল্লাহর নিকট বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি। মহান এবং গৌরবান্বিত আল্লাহ ব্যতীত আর কারও কোন শক্তি ও সামর্থ্য নেই। যার নিকট আল্লাহর যিকির প্রবল এবং যে পরহেজগার সে শয়তানের কুমন্ত্রণা দূর করতে সমর্থ হয়। এরূপ লোকের নিকট শয়তান গোপনে তার অন্যমনষ্কতার সুযোগে আত্মার মধ্যে যাতায়াত করে। তজ্জন্য আল্লাহতায়ালা বলেন, "যারা খোদাভীরু যখন শয়তানের দল তাদেরকে আক্রমণ করে তারা শুধু তাকিয়ে থাকে। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, "মিন শাররিল ওয়াসওয়াসিল খান্নাছ” অর্থাৎ শয়তানের কুমন্ত্রণার মন্দ থেকে। আল্লাহতায়ালার এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে হযরত মুজাহিদ (রহঃ) বলেছেন, এটা আত্মার উপর একটি প্রশস্ত চিহ্ন। যখন সে আল্লাহর যিকির করে, শয়তান ভগ্ন- মনোরথ হয়ে পালিয়ে যায়। আবার যখন সে অন্যমনষ্ক হয় তখন শয়তান এসে তার আত্মার উপর আসন গেড়ে বসে। আল্লাহর যিকির ও শয়তানের কুমন্ত্রণার মধ্যে সম্পর্ক আলো ও অন্ধকারের সম্পর্কের ন্যায় বা দিবস ও রাত্রির প্রভেদের ন্যায়। উভয়ের এই বৈপরীত্যের জন্যই আল্লাহতায়ালা বলেন, "শয়তান তাদের উপর প্রভুত্ব করেছে এবং তাদেরকে আল্লাহর স্মরণ ভুলিয়ে দিয়েছে।" হযরত রাসূলে করীম (দঃ) বলেছেন, নিশ্চয়ই শয়তান আদম সন্তানের হৃদয়ে তার শুঁড় স্থাপন করে। সে আল্লাহর যিকির করলে শয়তান তা' গুটিয়ে নেয়। আর সে যিকির বিশ্বরণ হলে শয়তান তার হৃদয়কে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরে। হযরত ইবনে ওয়াজাহ (রহঃ) নিম্নোক্ত হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, কোন লোক যদি চল্লিশ বছর বয়সে পদার্পণ করেও তাওবাহ না করে, শয়তান তার হস্ত দ্বারা ঐ ব্যক্তির মুখমন্ডল মুসেহ করে বলে, যার নাজাত নেই তার মুখমন্ডল মুসেহ করলাম। বস্তুতঃ লালসা, লিন্দা আদম সন্তানের রক্ত ও মাংসে মিশ্রিত হয়ে গেছে এবং তার রক্ত ও মাংসে শয়তানের রাজত্ব চলছে। তার আত্মার চতুষ্পার্শ্ব শয়তান ঘিরে রেখেছে। এজন্যই হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, শয়তান আদম সন্তানের মধ্যে রক্ত চলাচলের ন্যায় চলাচল করে। ক্ষুধা দ্বারা তার চলাচল কিছুটা সংকীর্ণ হয়। তার কারণ এই যে, ক্ষুধাই কামরিপুকে নিস্তেজ করে দেয় এবং কামরিপুই শয়তানের চলাচলের যন্ত্র। আল্লাহতায়ালা শয়তানের কথা উল্লেখ করে বলেন, "(শয়তান বলেছিল) আমি তাদের জন্য তোমার সমস্ত পথে নিশ্চয়ই বসে থাকব। তারপর তাদের সম্মুখ থেকে, পিছন থেকে, ডান থেকে এবং বাম থেকে তাদের নিকট আসব। মানুষের হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, শয়তান কয়েকটি পথের উপর মানুষের জন্য বসে থাকে। তারপর ইসলামের পথে সে বসে থেকে বলে, তুমি কি তোমার ধর্ম এবং তোমার পূর্বপুরুষের ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে? যখন সে তা' অমান্য করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সো তার জন্য হিজরতের পথে বসে থেকে বলে, তুমি কি তোমার মাতৃভূমি এবং ধন-সম্পত্তি ত্যাগ করে দেশত্যাগী হবে? যখন সে তার কথা অমান্য করে হিজরত করে সে জিহাদের পথে বসে থেকে বলে, তুমি নিজেকে এবং নিজের ধন-সম্পদকে ধ্বংস করে দিয়ে কি জিহাদ করবে? তাতে তুমি প্রাণ ত্যাগ করলে তোমার স্ত্রীগণ অন্য স্বামী গ্রহণ কবে এবং তোমার ধন-সম্পদ ভাগ-বণ্টন হয়ে যাবে। সে তার কথা অমান্য করে জিহাদ করে। তিনি আরও বলেছেন, যে ব্যক্তি এসব কাজ করে মৃত্যুবরণ করে তাকে বেহেশতে প্রবেশ করানো আল্লাহর উপর কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। হুযুরে পাক (দঃ) ওয়াসওয়াসার অর্থ উল্লেখ করে বলেছেন যে, এটা এক অসৎ চিন্তা। যা' মুজাহিদের হৃদয়ে উপস্থিত হয়। যথাঃ সে নিহত হলে তার স্ত্রীগণের পুনর্বিবাহ হবে ইত্যাদি। এ চিন্তাই তাকে জিহাদ থেকে বিরত রাখে। এ সমস্ত চিন্তা-ভাবনার কথা সবারই জানা আছে, এ ধরনের কুমন্ত্রণা প্রায় প্রত্যেকেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা দ্বারা অবগত হয়।
প্রত্যেক চিন্তারই একটি কারণ থাকে এবং সেই কারণের একটি নাম থাকে, যদ্বারা ঐ চিন্তাকে চিনতে পারা যায়। শয়তান যদি এর কারণ হয় তাও জানা যায়। কোন মানুষ এই চিন্তা ও শয়তান থেকে মুক্ত নয়। তবে তাদের পাপ এবং শয়তানের অনুসরণের মধ্যে প্রভেদ রয়েছে। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, এমন কোন মানুষ নেই যার সঙ্গে একটি শয়তান নেই।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা ওয়াসওয়াসা, এলহাম, ফিরেশতা, শয়তান, তাওফীক এবং অপমান শব্দের মর্মকথা পরিষ্কারভাবে বুঝা গেল। এখন যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, শয়তান কি জিনিস? তার কি দেহ আছে? অথবা সে কি অশরীরি? যদি তার দেহ থাকে সে কি প্রকারে মানবদেহের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে? এসব কথা এই বাহ্যিক বিদ্যার মধ্যে বর্তমানে আলোচনা করা প্রয়োজনীয় নয়। এ ধরনের তর্কের উদাহরণ ঐ ব্যক্তির উদাহরণের ন্যায় যার বস্ত্রের মধ্যে একটি সাপ প্রবেশ করেছে। সে তা' দূর না করে এবং তার অনিষ্ট থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা না করে সর্পের রং আকৃতি, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ইত্যাদি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করতে থাকে। একেই বলে চরম বোকামী এবং অজ্ঞতা। যখন তুমি জেনে নিলে যে, মানুষের হৃদয়ে এমন চিন্তা-ভাবনা উদয় হয় যা' মন্দের দিকে চালনা করে এবং এ কথাও প্রকাশ পেল যে, সে চিন্তা-ভাবনার কোন কারণ আছে। আর যখন এটাও নিশ্চিতরূপে জানা হল যে, ভবিষ্যতে যে মন্দের দিকে আহ্বান করবে সে পরম শত্রু। যখন উপরোক্ত আলোচনা থেকে তোমার সে শত্রুকে চিনতে পেরেছ তখন তার সঙ্গে তোমার যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া উচিত। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে তার শত্রুতার বিষয় বলে দিয়েছেন। তার প্রতি বিশ্বাস না করতে এবং তার থেকে সতর্ক হতে বলেছেন। যেমন আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন, "নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের জন্য পরম শত্রু। তাকে শত্রুই গ্রহণ করবে। সে তার দলকে ডাকে যেন তোমরা দোযখী হয়ে যাও। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, "হে আদম সন্তান! আমি কি তোমাদেরকে বলি নি যে, তোমরা শয়তানের তাবেদারী করোনা । নিশ্চয়ই সে তোমাদের জন্য পরম শত্রু; সুতরাং নিজেকে এই শত্রু থেকে রক্ষা করা প্রত্যেকেরই কর্তব্য। এটা না করে তার জন্য, বংশ বা বসবাস সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করোনা, অবশ্য একথা সত্য যে, তার কুমন্ত্রণা দূর করবার জন্য তার অস্ত্রশস্ত্রের বিষয় জিজ্ঞেস করা উচিত। জেনে রাখবে, শয়তানের অস্ত্র কাম এবং মোহ। এ দুটোই তার নিকট সারা জগতের বিরুদ্ধে যথেষ্ট।
ফিরেশতাদের হাকীকত বা প্রকৃত পরিচয় আরেফীন বা খোদাতত্ত্ব জ্ঞানী লোকদের নিকট সুবিস্তৃত প্রান্তর সদৃশ। যারা আধ্যাত্মিক বিদ্যায় নিমগ্ন থাকে, বাহ্যিক বিদ্যার মাধ্যমে তাদের পরিচয় অনুসন্ধান করা প্রয়োজন হয় না।
তিন প্রকার চিন্তাঃ চিন্তা সাধারণতঃ তিন প্রকার হয়ে থাকে। যথাঃ (১) অসৎ চিন্তা। একপ্রকার চিন্তার কথা স্পষ্ট জানা যায় যে, তা' মন্দের দিকে আহ্বান করে। তার কুমন্ত্রণাও গুপ্ত নয়। (২) সৎ চিন্তা। সৎ চিন্তা মঙ্গলের দিকে আহ্বান করে কোন সন্দেহ নেই। (৩) সৎ ও অসৎ মিশ্রিত চিন্তা। অন্য প্রকার চিন্তায় সন্দেহ আছে তা' ফিরেশতার তরফ থেকে আসে বা মঙ্গলের স্থানে মন্দকে উপস্থিত কা শয়তানের রাও এর নাম এলহাম। এতে করে। এর তরফ থেকে আসে তা' জানা যায় শয়তানের তা' পার্থক্য ক । তা' একটি কুমন্ত্রণা অধিকাংশ নেককারদেরকে শয়তান স্পষ্ট মন্দের দিকে ডাকতে। না। কেননা করা কই কষ্টকর। মঙ্গলের আকৃতিতে তাদের নিকট পেশ করে। এটাই বড় প্রবঞ্চনা। এতে অধিকাংশ লোকই বিনাশ প্রাপ্ত হয়। যেমন শয়তান পারে না।। তখন সে সেই মন্দকে এরূপে আলিমকে বলে, তুমি কি লোকদের অবস্থা দেখছ উপদেশর না? তারা যে অজ্ঞতার কারণে মৃত, অবহেলা উদাসীনতার কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত, দোযখের নিকটবর্তী। অনুগ্রহ বশতঃ আল্লাহর বান্দাগণকে ধ্বংস থেকে রক্ষা ব্রা তোমার কি কর্তব্য নয়? তোমার ওয়াজ ও উপদেশ দ্বারা তাদেরকে বিপদ থেকে উদ্ধার করবে। আল্লাহতায়ালা তোমাকে অন্তর্দৃষ্টি, উজ্জ্বল হৃদয়, বাগ্মীতাসম্পন্ন রসনা এবং সুন্দর স্বর দান করেছেন। তুমি কিরূপে আল্লাহর নিয়ামতকে অস্বীকার করতে পার এবং তাঁর অসন্তুষ্টির শিকার হতে পার? বিদ্যা প্রচারের ব্যাপারেও তাদেরকে সরল পথে আহ্বানের ব্যাপারে তুমি কিভাবে নীরব থাকতে পার? এ প্রকারের উপদেশ সে উক্ত আলিমকে সদাসর্বদাই দিতে থাকে এবং খুবই সূক্ষ্ম কুমন্ত্রণার দ্বারা তাকে মানুষকে উপদেশ দানের জন্য নিযুক্ত করে। তারপর শয়তান তাকে সুন্দর পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করতে অলংকৃত বাক্য ব্যবহার করতে এবং ওয়াজ ও বক্তৃতার মধ্যে বিভিন্ন রকম সাজসজ্জা করতে, মন্ত্রণা দেয় এবং বলে, যদি তুমি এসব পন্থা অবলম্বন না কর তবে তাদের হৃদয়ে তোমার ওয়াজের কোন প্রভাব পড়বে না এবং তারা সত্যের দিকে হেদায়েতও পাবে না। এরূপ পরামর্শ সে অনবরতই আলিমের হৃদয়মধ্যে প্রবেশ করাতে থাকে। এসব পরামর্শ দ্বারা আলিমকে রিয়ার মধ্যে পতিত করা, মানুষের তাকে সাদরে গ্রহণ করা, যশঃ ও খ্যাতির আস্বাদ দান করা, অধিক ভক্ত ও অনুরক্ত সৃষ্টি করা এবং এই শ্রেণীর আরও বিভিন্ন লোভ তার মনে সৃষ্টি করে দেয়াই শয়তানের উদ্দেশ্য। এভাবেই সে মানুষকে ওয়াজ-নসীহত দ্বারা হেদায়েতের দিকে নয়; বরং অনিষ্টের দিকেই চালনা করে। অথচ সে- নিজে মনে করে যে, সে উত্তম কার্য করতেছে।
0 Comments