ধন-সম্পত্তির বিবাদ

         রসনার পঞ্চম বিপদঃ ধন-সম্পত্তির বিবাদ-বিসম্বাদ হল রসনার পঞ্চম বিপদ। এ বিবাদ অত্যন্ত জঘন্য। এ বিবাদ-বিসম্বাদ প্রথম তর্ক-বিতর্কের এবং বাদানুবাদের পরেই শুরু হয়। তর্ক-বিতর্কের অর্থ অন্যের দোষ-ত্রুটি দেখিয়ে কথা কাটাকাটি করা। ধন-সম্পত্তির বিষয় নিয়ে যে ঝগড়া-বিবাদ হয়, তাকে খুছুমাত বলে। এ জাতীয় ব্যাপার নিয়ে যে কথার কাটাকাটি ও ঝগড়া-বিবাদ হয়, তদ্বারা ধন-সম্পত্তি অর্জন বা স্বত্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন। ইন্না আরপান্তার রিজালি ইলাল্লাহি আলাস্থল বিয়ায়।" অর্থাৎ আল্লাহর নিকট সর্বাধিক ক্রোধভাজন ঐ ব্যক্তি, যে ধন-সম্পদ নিয়ে সর্বাদিও বিবাদ করে। তিনি আরও বলেছেন, যে ব্যক্তি অজ্ঞতা বশতঃ ধন সম্পদ নিয়ে অন্যের সাথে বিবাদ করে, সে অনবরত। আল্লাহর অসন্তুষ্টির মধ্যে থাকে, যে পর্যন্ত সে নিরন্ত না হয়। কোন বিজ্ঞ লোক বলেছেন, তোমরা ধন-সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ করো না। কেননা তা' ধর্মকে বিনষ্ট করে। পরহেজগার লোকগণ কখনও ধন-সম্পদ নিয়ে বিবাদ করে না।

        হযরত কোতায়বা (রহঃ) বলেছেন, আমার নিকট দিয়ে হযরত বাশার ইবনে আবদুল্লাহ (রহঃ) যেতেছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, তুমি এখানে বসে আছ কেন? আমি বললাম, আমার ও আমার চাচাত ভাইয়ের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ আছে। তজ্জন্য এখানে বসে আছি। তিনি বললেন, আমার উপর তোমার পিতার যথেষ্ট অনুগ্রহ ছিল। আমি তার বিনিময়ে তোমাকে পুরস্কৃত করতে চাই। আল্লাহর কসম ধন-সম্পত্তি নিয়ে বিবাদের চেয়ে আমি ধর্মের অধিক অনিষ্টকারী এবং হৃদয় নিমগ্নকারী আর কিছু দেখি নি। তখন আমি সেখান থেকে চলে যাবার উপক্রম করলে আমার প্রতিপক্ষ আমাকে বলল, তুমি কোথায় যাচ্ছ? আমি বললাম, আমি তোমার সাথে আর বিবাদ করব না। সে বলল, তা' হলে তুমি এতক্ষণে বুঝেছে যে, ওটা আমারই স্বত্ত্ব। আমি বললাম, না, তা নয়। তবে আমি এ বিবাদ থেকে সরে থাকাই সম্মানজনক মনে করি। তখন সে বলল, তোমার নিকট থেকে আর আমি কিছু চাইব না। ওটা তোমার স্বত্ব। 

        প্রশ্নের উদয় হবে যে, যখন মানুষের কোন সম্পত্তিতে স্বত্ব থাকে, তা' পুণ্যরুদ্ধার বা রক্ষা করবার চেষ্টা তার অবশ্যই করতে হয়। কেননা হয়ত এ কোন অত্যাচারী আত্মসাৎ করে নিয়েছে। এ অবস্থায় কি করতে হবে? এক্ষেত্রে বিবাদ করাও কি নিন্দনীয় হবে? এর উত্তর এই যে, জেনে রাখ, দাবী কখনও সত্য হয়, কখনও মিথ্যা হয়। কখনও সত্য কোন দিকে তা' না জেনেও দাবী করা হয়। যেমন বিচারকের সম্মুখে উকীলের সুয়াল-জবাব। উকীল জানেনা কোন দিকে সত্য নিহিত। সুতরাং যে কোন পক্ষের প্রতিনিধি হয়ে সে বিচারকের সামনে তর্ক- বিতর্ক করে তার স্বত্বের অনুসন্ধান করে। কিন্তু কখনও সত্য দাবীর মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত দাবী থাকে। কখনও সে বিবাদ লাগিয়ে দেয়, যেন সে প্রতিদ্বন্দ্বীর উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না তাকে কষ্ট দিতে পারে। এই বিবাদের মধ্যে সে এমন শব্দ ব্যবহার করে, যাতে তার প্রতিদ্বন্দ্বী কষ্ট পায়। প্রমাণের সাহায্যের জন্য বা সত্য প্রকাশের জন্য তার কোনই প্রয়োজন হয় না। কখনও প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করবার জন্য সে বিবাদ করে এবং লোকদেরকে বলে বেড়ায়, আমার উদ্দেশ্য তার সম্মান নষ্ট করা। যদি আমি তার নিকট থেকে এই ধন নিতে পারি, আমি কূপের মধ্যে ফেলে দেব, ভাতে আমি ইতস্তঃতও করব না। তার এ উদ্দেশ্য বড়ই ঘৃণিত ও নিন্দনীয়। নিযাতিত ব্যক্তির শরীয়তের পন্থা দ্বারা স্বত্বের প্রমাণ দেয়া এবং অতিরঞ্জন ও অতিরিক্ততা পরিত্যাগ করা প্রয়োজন অনুযায়ী জায়েয হয়। যদি কষ্ট দেয়া তার উদ্দেশ্য না হয় তবে তার কার্য হারাম হয় না। তবে অন্য উপায় থাকলে তা' পরিত্যাগ করাই উত্তম। যদি ধন সম্পর্কিত বিবাদে মধ্যম সীমা পর্যন্ত রসনাকে সংযত করে রাখতে পার, তাহলে মার্জনীয়, এ বিবাদ হৃদয়কে সংকীর্ণ করে এবং ক্রোধকে উত্তেজিত করে, যখন এটা ক্রোধকে উত্তেজিত করে, তখন সে তার বিপক্ষকে ভুলে যায় এবং তখন প্রতিদ্বন্দ্বীদ্বয়ের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ অবশিষ্ট থেকে যায়। এমনকি তখন একজন অপরজনের অনিষ্টের চেষ্টায় ব্যস্ত থাকে এবং একজনের দুঃখে অন্যজন সুখী হয় এবং একজন অন্যজনের সম্মান নষ্ট করে। যে ব্যক্তি ধন-সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ আরম্ভ করে, তার নিকট এসব নিষিদ্ধ বিষয় উপস্থিত হয়। তাতে তার মন ব্যস্ত থাকে। এমন কি তখন নামাযের মধ্যে তার প্রতিবাদীর চিন্তায় তার মন লিপ্ত থাকে। তখন কর্তব্যের সীমায় তা' নিবদ্ধ থাকে না। সুতরাং বিষয় সম্পত্তি-সম্পর্কিত বিবাদ সব অনিষ্টের মূল। বাদ-প্রতিবাদ এবং ধর্মবিষয়ের তর্ক-বিতর্কও তদ্রূপ অনিষ্ট ও ক্ষতির মূল। বিশেষ প্রয়োজন ব্যতিরেকে এতে লিপ্ত হওয়া কোন ক্রমেই উচিত নয়। আবার প্রয়োজনের সময়ই রসনা সংযত করা উচিত এবং বিবাদ থেকে মনকে মুক্ত রাখা উচিত। এটা পাপ মার্জনারই কারণ হয়। যে ব্যক্তি বিষয়- সম্পত্তির বিবাদে ওয়াজিবের সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকে, সে পাপ থেকে নিরাপদ থাকে। তার বিবাদকে নিন্দনীয় বলা যায় না। তবে নিজের নিকট যথেষ্ট ধন থাকার কারণে যদি বিবাদের বিষয় হওয়া সত্ত্বেও বিবাদ হতে মুক্ত থাকতে পারে তবে তার পক্ষে তা' খুবই উত্তম। আর বিবাদ ত্যাগ না করলেও তার গুনাহ হবে না।


        সুমিষ্ট বাক্যের কল্যাণঃ সুমিষ্ট বাক্যের সর্বনিম্নস্তর প্রীতি প্রকাশ করা। বিবাদের মধ্যে কর্কশ বাক্য ব্যবহার না করা প্রতিবাদ ও আক্রমণ থেকে অনেক উত্তম। বিবাদ করতে গেলেই বিপক্ষকে অজ্ঞ, মূর্খ বা মিথ্যাবাদীর দোষে দোষারোপ করতে হয়। কেননা যে অন্যের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করে, ধর্মমত নিয়ে বাদানুবাদ করে বা ধন-সম্পত্তি নিয়ে বাদানুবাদ করে, সে তার বিপক্ষকে মূর্খ বা মিথ্যাবাদী বলে। প্রিয় ও সুমিষ্ট বাক্য তার মুখে আসে না। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, সুমিষ্ট বাক্য এবং খাদ্যদানই তোমাদেরকে বেহেশতে শান্তি দান করবে। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, মানুষের সাথে সুন্দর কথা বলবে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে যদি কেউ তোমাকে সালাম দেয় তুমিও তার উত্তর দেবে। যদিও সে অগ্নিপূজক হয়। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, যখন তোমরা সালামদ্বারা সম্ভাষিত হও তখন অধিক সুন্দর সালাম দ্বারা সম্ভাষণ কর। অথবা তার-ই ন্যায় কর। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, যদি ফিরাউন আমাকে বলত, ভাল আছেন? আমি তার উত্তর দিতাম। হযরত আনাস (রাঃ) বলেছেন, হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই বেহেশতের মধ্যে প্রকোষ্ঠ আছে। তার বহির্ভাগ থেকে অন্তর্ভাগ দেখা যায় এবং অন্তর্ভাগ থেকে বহিভাগ দেখা যায়। এগুলো আল্লাহতায়ালা ঐ লোকের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন, যে খাদ্য দান করে এবং কথাবার্তায় বিনম হয়।

        বর্ণিত আছে যে, একস্য হযরত ঈসা (আঃ)-এর নিকট দিয়ে একটি শূকর যাচ্ছিল। তিনি তাকে বললেন, সালাম করে যাও। তাকে বলা হল, হে রুহুল্লাহ। এ শূকর কি কথা বলতে পারে? তিনি বললেন, আমার রসনার অভ্যাস মন্দ হোক তা' আমি ভালবাসি না। আমাদের মহানবী (সঃ) বলেছেন, খুরমার একটি দানা হলেও তা' দান করে দোযখের অগ্নি দূরে রাখ। যদি তা' না পার, সুন্দর বাক্য দ্বারা তা' দূরে রাখ। হযরত ওমর (রাঃ) বলেছেন, নেকী সহজ জিনিস। তা' সহাস্যবদন এবং বিনম্ন বচন। কোন বিজ্ঞ লোক বলেছেন, বিনম্র বচন গুপ্ত হিংসাকে পরীক্ষা করে যা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে বিরাজ করে। অন্য এক বুযর্গ বলেছেন, যে কথা বললে তোমার প্রভু অসন্তুষ্ট হন না, অথচ তোমার বন্ধু সন্তুষ্ট হয়, তাতে তুমি কৃপণতা করো না। কেননা তার বিনিময়ে তিনি সৎকার্যকারীদেরকে পুণ্য দান করবেন। সুমিষ্ট বাক্যের কল্যাণ সম্পর্কে এসব কথা বলা হল, এর বিপরীত কথা বাদানুবাদ, তর্কবিতর্ক এবং বিবাদ-বিসম্বাদ। কর্কশ ব্যবহার হৃদয়কে কষ্ট দেয়, জীবিকা উপার্জন সংকীর্ণ করে। ক্রোধ উৎপাদন করে এবং বক্ষকে সংকীর্ণ করে।

রসনার ষষ্ঠ বিপদঃ কথা সাজিয়ে অথবা বাক্য সুবিন্যাস করে বলা রসনার ষষ্ঠ বিপদ। বাগ্মীতা প্রদর্শন করা, শব্দের মিল করে কথা বলা, উপমা দৃষ্টান্ত প্রয়োগ করতঃ বক্তৃতা করা, এগুলো সবই কৃত্রিম বলে নিন্দিত এবং কষ্টকর বলে অবাঞ্ছনীয়। হযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, "আনা অ আত্বক্বিয়াউ উম্মাতী বারায়ুম মিনাত্ তাকাল্লুফি"। অর্থাৎ আমি এবং আমার উন্মতের মধ্যে ধর্মভীরু লোকগণ কৃত্রিমতা থেকে মুক্ত। তিনি আরও বলেছেন, তোমাদের মধ্যে আমার নিকট সর্বাপেক্ষা ক্রোধভাজন এবং আমার মজলিস থেকে সর্বাধিক দূরবর্তী ঐ লোকগণ যারা বাহুল্য কথা বলে, বাক্য বিন্যাস করে কথা বলে এবং কৃত্রিমতা অবলম্বন করে। হযরত ফাতেমা (রাঃ) বলেন, হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, যারা নানারূপ উপাদেয় খাদ্য দ্বারা বর্ধিত হয়, নানারূপ পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করে এবং বানাওটি করে কথা বলে, তারা আমার উম্মতের মধ্যে মন্দ। তিনি আরও বলেছেন, তোমরা সতর্ক হও, কথায় অতিরঞ্জনকারীগণ কিন্তু ঝাংসপ্রাপ্ত। একথাটি তিনি তিনবার বলেছেন। হযরত ওমর (রাঃ) বলেছেন, কথার মধ্যে বাগ্মীতা শয়তানের বাগ্মীতার অনুরূপ।

        একদা হযরত সা'দ (রাঃ) এর পুত্র তাঁর নিকট এসে মূলকথা বলার পূর্বে দীর্ঘ ভূমিকা-বাক্যেই বহু সময় ব্যয় করল। তখন তিনি তাঁর পুত্রকে বললেন, তুমি তো তোমার মূল প্রয়োজনের কথা বহু দূরে নিক্ষেপ করেছ। শোন, আমি হুযুরে পাক (দঃ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, মানুষের উপর এমন এক যুগ আসবে, যখন তারা রসনার দ্বারা বাক্য গিলিত চর্বন করবে। এতে দেখা যায় যে, হযরত সা'দ (রাঃ) এর পুত্রের এ ধরনের আবেদনের বর্ণনা তাঁর নিকট মন্দ বিবেচিত হয়েছিল। এটাও রসনার এক আপদ বৈ কি। প্রত্যেক সাজানো এবং সুবিন্যস্ত বান্ধাই এর অন্তর্গত। যে সব বক্তৃতা অভ্যাস বহির্ভূত, তাও এরই শামিল। 

        কথাবার্তায় এবং আলোচনায় কৃত্রিমতা করা নিষিদ্ধ। হুযুরে পাক (দঃ) পর্তস্থিত একটি মৃত সন্তানের বিনিময়ে একটি গোলামকে মুক্তি দেয়ার জন্য ব্যবস্থা দিয়েছিলেন। এক বাক্তি বলল, যে সন্তান আহার করে নি, পান করে নি, শব্দ প্রকাশ করে নি নিঃশ্বাস গ্রহণ করে নি, তা'র হি ক্ষতিপূরণ দিতে হবে? হয়রে পাক (দঃ) বললেন, মূর্খদের মধ্যে কি তুমি দলাদলি আনতেজ। আরবদের বাক্যবিন্যাসের ন্যায় তুমি বাক্য বিন্যাস করছ? মোট কথা তিনি তার ঐরূপ কথা মন্দ মনে করলেন। কেননা তার মধ্যে কৃত্রিমতা বানাওটি ছিল। প্রত্যেক বিষয়ই সংক্ষেপ করে বলা উচিত। কোন কিছু বলার উদ্দেশ্য বিষয়টি প্রকাশ পাওয়া। এর বাইরে যা কিছু বলা হয় সবই বানাওটি; এবং বানাওটি বাক্যই নিন্দিত। অবশ্য খুৎবাহ এবং ওয়াজ এর মধ্যে শামিল নয়। কেননা খুৎবাহ এবং ওয়াজের উদ্দেশ্য হল, হৃদয়ের মধ্যে ধর্মের জন্য উৎসাহ দান করা। অন্তরের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করা হৃদয় আয়ত্তাধীন রাখা এবং তা' বিস্তৃত করা; সুতরাং তন্মধ্যে শব্দ বিন্যাসের প্রভাব থাকে। কিন্তু যে সব কথা পরস্পরের মধ্যে হয়ে থাকে, তার মধ্যে ছন্দযুক্ত কথা বলা বা বানাউটিপূর্বক বাক্যোচ্চারণ করা নিন্দনীয়। তাতে রিয়া, বাগ্মীতা প্রকাশ করা ইত্যাদি দোষ জন্মে। এগুলো শরীয়ত সমর্থিত নয়।

Post a Comment

0 Comments