অনাবশ্যক কথা জিজ্ঞেস করবার তিনটি কারণ থাকতে পারে। যেমন (১) যে কার্যে প্রয়োজন নেই, তা' জানবার আগ্রহ করা। (২) ভালবাসার উদ্দেশ্যে তার সাথে কথাবার্তার আনন্দ লাভ করা। (৩) অপ্রয়োজনীয় কথার দ্বারা সময় অতিবাহিত করা এ তিনটি বিষয়ের প্রতিকার নিম্নে, উল্লেখ করা গেল। এর জন্য দু'রকমের প্রতিকার আছে। একরকম প্রতিকার-হল জ্ঞানমূলক এবং অন্যরকম প্রতিকার হল অনুষ্ঠানমূলক। জ্ঞানমূলক প্রতিকারের দৃষ্টান্ত হল, মানুষকে বুঝে নিতে হবে যে, মৃত্যু সম্মুখে দন্ডায়মান। প্রত্যেক বাক্য সম্বন্ধেই জিজ্ঞেস করা হবে। প্রত্যেকটি নিশ্বাসই অমূল্য নিয়ামত এবং রসনা একটি গবাক্ষস্বরূপ, যে পথে কৃষ্ণনয়ন বিশিষ্টা স্বর্গীয় হুর দৃষ্টিগোচর হবে। সুতরাং এসব ব্যাপারে উদাসীনতার ফলে অত্যন্ত ক্ষতি হবে। এটাই এ ব্যাপারে জ্ঞানমূলক প্রতিকার। আর অনুষ্ঠানমূলক প্রতিকার হল, নির্জনতা অবলম্বন বা রসনার উপর প্রস্তর খন্ড স্থাপন বা অনাবশ্যক বিষয়ে নীরবতা অবলম্বন, এরূপ করতে করতে নীরবতার অভ্যাস হয়ে যাবে, অনাবশ্যক কথা দূর হয়ে যাবে এবং রসনা কর্তৃত্বাধীনে এসে যাবে।
রসনার দ্বিতীয় বিপদঃ বাহুল্য কথা বলা রসনার দ্বিতীয় বিপদ। যে কথার মধ্যে কোন উপকার নেই, এমন কথা বলা এবং উপকারী হলে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলা। এজন্যই এটা রসনার বিপদের দ্বিতীয় বিষয়বস্তু। প্রয়োজনীয় বা জরুরী কথাও সংক্ষেপে বলা যায়। একটি বাক্যে কোন বিষয় শেষ করা গেলে তজ্জন্য দ্বিতীয় বাক্য ব্যবহার করা প্রয়োজনের অতিরিক্ত এবং তজ্জন্য মাকরূহ অথবা নিন্দনীয়, যদিও তাতে কোন পাপ বা অনিষ্ট হয় না। হযরত আতা (রহঃ) বলেছেন, তোমাদের আগেকার বুযর্গগণ অতিরিক্ত কথা বলা ঘৃণা করতেন। আল্লাহর কালাম, হুযুরে পাক (দঃ) এর সুন্নত, সৎ উপদেশ এবং অসৎকার্যে নিষেধ এবং জীবিকা অর্জনের অতি প্রয়োজনীয় কথা ব্যতীত অন্য কথাকে তারা অতিরিক্ত কথার মধ্যে গণ্য করতেন। তোমাদের ডান ও বাম কাঁধে কিরামুন কাতেবীন ফিরেশতাদ্বয় আছে, তা' কি তোমরা অস্বীকার করছ? পবিত্র কুরআনে আছে, "মা ইয়ালফিজু মিন ক্বাওলিন ইল্লা লাদাইহি রাক্বীবুন আতীদ"। অর্থাৎ যে কথাই সে বলে, তার নিকট সতর্ক প্রহরী থাকে।
তোমার কি লজ্জা হয় না যে, যখন তোমার আমলনামা খোলা হবে তখন তাতে তোমার নেক আমল লিপিবদ্ধ না থেকে অধিকাংশই তোমার সংসার সম্পর্কিত কথা লিপিবদ্ধ দেখতে পাবে। জনৈক স্থাহাবী বলেছেন, মানুষ আমাকে কোন কথা জিজ্ঞেস করলে তার উত্তর যদি তৃষ্ণার্ত লোকের নিকট সুশীতল পানি অপেক্ষা অধিক মিষ্টি বোধ হয় তবু আমি অতিরিক্ত কথার ভয়ে উত্তর দানে বিরত থাকব। হযরত মুতাররিফ (রাঃ) বলেছেন, বিপদে পতিত হয়ে গর্দভের ন্যায় শব্দ করে যদি আল্লাহকে এভাবে ডাক এবং বল যে, হে আল্লাহ। তুমি এটা কর, হে আল্লাহ! তুমি ওটা কর। এরূপ বলা অপেক্ষা নীরবে আল্লাহর মহিমা ও গৌরব সম্পর্কে চিন্তা করাই অধিক উত্তম।
পাঠক-পাঠিকা। জেনে রাখ, অতিরিক্ত কথার কোন সীমা নেই। কিন্তু আল্লাহর কিতাবে আবশ্যকীয় কথার সীমা আছে, আল্লাহতায়ালা বলেন, "লা খাইরা ফী কাছীরিম মিন ফাজওয়াহুম ইল্লা মান আমারা বিছাদাক্বাতিন আও মা'কফিন আও ইছলাহুম বাইনান নাসি"- অর্থাৎ তাদের অনেক গুপ্ত পরামর্শের মধ্যে কোন মঙ্গল নেই, তবে দান করতে বা সৎকার্য করতে বা মানুষের মঙ্গল বিধান করতে যে পরামর্শ দেয়া হয় তাতে মঙ্গল রয়েছে। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি তার রসনা থেকে অতিরিক্ত বাকা নিবারণ করে এবং তার ধন-সম্পত্তি হতে উদ্বৃত্ত ধন ব্যয় করে প্রকৃতপক্ষে সে-ই ধন্য। এখন তোমরা লক্ষ্য কর, মানুষ কিরূপ পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এখন তারা উদ্বৃত্ত ধন-সম্পদও সঞ্চয় করে রাখে এবং রসনা থেকে বাক্য নিবারণ করা দূরের কথা রসনার লাগাম ছেড়ে দিয়েছে। হযরত মুতাররিফ ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন, আমি বনূ আমের সম্প্রদায়ের একদল লোকের সাথে হুযুরে পাক (দঃ) এর দরবারে উপস্থিত ছিলাম। তারা তাঁকে লক্ষ্য করে বলল, আপনি আমাদের পিতা। আমাদের উপর বদান্যতা দেখিয়েছেন। আপনি আমাদের বহু উপকার সাধন করেছেন ইত্যাদি। হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, তোমরা তোমাদের মূল বক্তব্য প্রকাশ কর। শয়তান যেন তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট না করে। অত্র হাদীসের মর্মে বুঝা যাচ্ছে, প্রশংসা সত্য হলেও তা' অধিক দীর্ঘ হলে শয়তান তা' অতিরিক্ততার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেছেন, তোমাদের অতিরিক্ত কথার জন্য তোমাদেরকে সাবধান করছি। মনে রেখ, যে বাক্য অতি প্রয়োজনীয় তা-ই মানুষের জন্য যথেষ্ট। হযরত মুজাহিদ (রাঃ) বলেছেন, প্রত্যেকটি কথাই লিপিবদ্ধ হয়। এমন কি যে মিথ্যা কথার দ্বারা মানুষ তার শিশু সন্তানকে সান্ত্বনা দেয় যেমন তোমাকে আমি এই জিনিস দেব ঐ জিনিস দেব এই মিথ্যাগুলোও লিপিবদ্ধ হয়। হযরত হাসান বছরী (রহঃ) বলেছেন, হে আদম সন্তান। তোমাদের জন্য আমলনামা খুলে রাখা হয়েছে এবং তজ্জন্য দু'জন ফিরেশতাও ন্যস্ত করা হয়েছে। তারা তোমাদের কার্যাবলী ও বাক্যসমূহ লিপিবদ্ধ করছে। এখন ইচ্ছা করলে তুমি অধিক কথা বল, ইচ্ছা করলে কম কথা বল।
0 Comments