প্রিয় পাঠক-পাঠিকা। জেনে রাখ, যে ব্যক্তি সংসারে নিমগ্ন এবং তার প্রবঞ্চনায় প্রবঞ্চিত, তার লোভে ব্যস্ত, নিশ্চয়ই তার মন মৃত্যুস্মরণ থেকে উদাসীন। সে তা' স্মরণ করে না। যখন তাকে তা' স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়, সে তা' ভালবাসে না। আল্লাহ তায়ালা তাদের সম্বন্ধে বলেছেন, বল, যে মৃত্যু থেকে তোমরা পলায়ন কর, নিশ্চয়ই তা' এমন যে, তা' তোমাদের সাথে সাক্ষাত করবেই। তারপর তোমাদের দৃশ্য ও অদৃশ্য দুনিয়ার মালিকের নিকট ফিরিয়ে দেয়া হবে। তোমরা যে কাজ করেছ, তিনি তা' তোমাদেরকে তখন জানিয়ে দেবেন। যেমন কুরআনে পাকে রয়েছেঃ "কুল ইন্নাল মাওতাল্লাযী তাফিররুনা মিনহু ফাইন্নাহু মুলাক্বী কুম-জুমা তুওয়াদ্দুনা ইলা আলিমিল গাইবি অশশাহাদাতি ফা ইয়ুনাব্বিউকুম বিমা কুনতুম তা'মালুন।
মানুষ তিন শ্রেণীতে বিভক্ত, যথাঃ (১) সংসারপ্রিয় ব্যক্তি, (২) অনুতপ্ত ব্যক্তি এবং (৩) আরিফ বা খোদাতত্ত্ব জ্ঞানী। সংসারপ্রিয় ব্যক্তি মৃত্যুকে স্মরণ করে না, যদিও কোন সময় সে তা' স্মরণ করে, সে সংসারের প্রতি দুঃখ প্রকাশ করে তা' স্মরণ করে এবং মৃত্যুর নিন্দা করতে থাকে। এই মৃত্যু-চিন্তা তাকে আল্লাহ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়।
অনুতপ্ত ব্যক্তি মৃত্যুকে অধিক স্মরণ করে যেন তার মনে ভয়ের উদয় হয় এবং সে তাওবাহকে পূর্ণ করে। অনেক সময় সে মৃত্যুকে ভালবাসে না। কেননা সে ভয় করে তাওবাহ শেষ করার পূর্বে এবং চরিত্র সংশোধন করার পূর্বে মৃত্যু তার প্রাণ হরণ করে নিয়ে যেতে পারে বলে। এই ভয়ে সে মৃত্যু সম্বন্ধে মন্দ ধারণা করতে বাধ্য হয়। এটা হযরত রাসূলে করীম (দঃ) এর নিম্নোক্ত হাদীসের আওতায় পড়ে না। "যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করতে চায় না আল্লাহও তার সাথে সাক্ষাৎকে মন্দ জানে না। তবে সে তার ত্রুটির জন্য আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ হওয়াকে ভয় করে। সে ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে প্রিয়জনের সাথে সাক্ষাৎ করতে বিলম্ব করে। কেননা তার সাথে সাক্ষাতের প্রস্তুতির জন্য সে ব্যস্ত থাকে। সে তার সাথে সাক্ষাতকে ঘৃণা করে না। এর চিহ্ন এই যে, সে সদাসর্বদা তার সাথে সাক্ষাতের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে এই কাজ ব্যতীত তার আর অন্য কোন কাজ থাকে না।
আরিফ বা চক্ষুষ্মান ব্যক্তি সদাসর্বদা মৃত্যুকে স্মরণ করে। কেননা সে তার প্রিয়জনের সাথে সাক্ষাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। প্রেমিক প্রিয়জনের সাথে সাক্ষাৎ করা কখনও ভুলতে পারে না। অধিকাংশক্ষেত্রেই তার মৃত্যু বিলম্বিত হয়। সে মৃত্যুর দ্রুত আগমনকে ভালবাসে যেন এই পাপালয় থেকে সে রক্ষা পেতে পারে; এবং বিশ্বপ্রভুর সান্নিধ্য লাভ করতে পারে। হযরত হোযায়ফা (রাঃ) এর যখন মৃত্যু উপস্থিত হল, তিনি বললেন, অভাবের সময় বন্ধু এসেছে। অনুতাপ করে কোন লাভ হবে না। হে আল্লাহ! যদি তুমি জান যে, ধনের চেয়ে অভাব আমার নিকট অধিক প্রিয়। স্বাস্থ্যের চেয়ে ব্যাধি আমার নিকট অধিক প্রিয়, জীবন ধারণ অপেক্ষা মৃত্যু আমার নিকট অধিক প্রিয়। তাহলে মৃত্যুকে আমার উপর সহজ করো। যে পর্যন্ত আমি তোমার সাথে সাক্ষাৎ করি।
অনুতপ্ত ব্যক্তি মৃত্যুকে ভাল না বাসার কারণ আছে এবং আরিফ ব্যক্তিও তা' ভাল না বাসার কারণ আছে। সর্বাপেক্ষা আরিফ শ্রেণীর লোক উত্তম। সে নিজের জন্য জীবন ও মরণকে পছন্দ করে না। বরং তা' সকল বস্তুর চেয়ে তার নিকট অধিক প্রিয়, কেননা তা' তার প্রভুর নিকট অধিক প্রিয়। অতিরিক্ত ভালবাসার দরুন তাকে তাসলীম ও সন্তোষের মাকামে পৌছে দেয়। এটাই চরমসীমা। প্রত্যেক অবস্থায়ই মৃত্যু চিন্তায় পুণ্য ও কল্যাণ আছে। সংসারমত্ত লোকেরও মৃত্যুস্মরণে উপকার হয়। কেননা সে তাতে সংসার থেকে পৃথক হয়ে পড়ে সংসারের সুখম্পদের বিঘ্ন জন্মায় এবং যে বস্তুই সংসারের সুখ-সম্পদ হরণ করে তাই তার নাজাতের কারণ হয়।
মৃত্যুচিন্তার কল্যাণ
হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, ভোগ-বিলাস বিনষ্টকারী চিন্তা অধিক পরিমাণে কর। অর্থাৎ মৃত্যুকে স্মরণ করে ভোগ-বিলাসকে বিনষ্ট কর, যে পর্যন্ত মৃত্যুর প্রতি তোমাদের মন অনুরক্ত হয় এবং আল্লাহর দিকে মন যায়। তিনি আরও বলেছেন যে, আদম সন্তান মৃত্যুর অবস্থা যেরূপ জানে, পশুপক্ষী যদি তা' তদ্রূপ জানত তাহলে তোমরা স্থূলকায় জীবজন্তুর মাংস ভক্ষণ করতে পেতে না। একদা হযরত আয়েশা (রাঃ) হুযুরে পাক (দঃ) এর নিকট আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহু! শহীদগণের সাথে কি কারও পুনরুত্থান হবে? তিনি বললেন, হাঁ, ঐ ব্যক্তির হবে, যে দিন রাতে বিশবার মৃত্যুকে স্মরণ করে। এই কল্যাণের কারণ এই যে, মৃত্যু স্মরণ এই প্রবঞ্চনার আগার থেকে তাকে দূরে সরিয়ে দেয়; এবং পরলোকের প্রস্তুতির জন্য তাকে বাধ্য করে। মৃত্যু চিন্তা থেকে উদাসীনতা সংসারের প্রতি সততার দিকে আহ্বান করে। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, মুমিনের উপহার মৃত্যু, তাঁর এই কথা বলার কারণ, দুনিয়া মু'মিনের কারাগার, কেননা সে এর মধ্যে দুঃখ ও কষ্টে কালাতিপাত করে। খাহেশকে দমন করে এবং শয়তানকে তাড়িয়ে দেয়; সুতরাং এই শাস্তি থেকে তাকে মৃত্যুই উদ্ধার করে। এইজন্য তার পক্ষে মৃত্যু উপহার সদৃশ।
হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, মৃত্যু প্রত্যেক মুসলমানের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে। মুসলমান শব্দের দ্বারা তিনি ঐ সত্যবাদী ও প্রকৃত মুমিনের কথা বলেছেন, যার রসনা ও হস্ত থেকে অন্যান্য মুসলমানগণ নিরাপদ থাকে। যার মধ্যে মু'মিনদের স্বভাব-চরিত্র প্রতিফলিত হয় এবং যার মন হঠাৎ উত্থিত ভাব ও ক্ষুদ্র পাপ ব্যতীত অন্য পাপ দ্বারা কলুষিত হয় না। মৃত্যু চিন্তা তাকে এসব দোষ থেকে পবিত্র করে। মহাপাপ ত্যাগ করলে এবং ফরজ কার্য করলে মৃত্যু তার কাফফারা করে। হযরত আতা খোরাসানী (রহঃ) বলেছেন, একদা হুযুরে পাক (দঃ) এক মজলিসের নিকট দিয়ে যেতেছিলেন, তথায় হাসি কৌতুক চলতেছিল, হুযুরে পাক (দঃ) তাদেরকে বললেন, হাস্য-কৌতুক বিনষ্টকারীকে স্মরণ করে তোমাদের মজলিসকে সুন্দর কর। তারা জিজ্ঞেস করল, হাস্য কৌতুক বিনষ্টকারী কি? তিনি বললেন, মৃত্যু। হযরত আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে,
0 Comments