হযরত ইসমাঈল (আ) কে কোরবানী

        হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, এক রাতে হযরত ইব্রাহীম (আ) স্বপ্নে দেখলেন, কে যেন তাঁকে বলছে, ইব্রাহীম। আল্লাহর নামে কোরবানী করুন। তিনি স্বপ্ন মোতাবেক দুশ' উট কোরবানী করেন। তিনি পরপর তিন রাত এরূপ স্বপ্ন দেখেন এবং তিন বার তিনি প্রত্যুসে দুশ করে উট কোরবানী করেন। চতুর্থ রাতে আবার স্বপ্ন দেখলেন-কে যেন সুস্পষ্ট করে বলল পুত্র ইসমাঈল (আ)কে কোরবানী করুন। আম্বিয়ায়ে কিরামের স্বপ্ন ও ওহী। নিদ্রা হতে জাগ্রত হয়ে প্রথমে হযরত ইবরাহীম (আ) বিবি সারাহকে বললেন, গত রাতে স্বপ্নে আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে সন্তান কোরবানী করতে। আর ইসমাঈল ব্যতীত আমার অন্য কোন সন্তানও নেই। তোমার অনুমতি পেলে পবিত্র মক্কায় গিয়ে প্রিয় একমাত্র পুত্র ইসমাঈলকে আল্লাহর রাহে কোরবানী করে তাঁর নির্দেশে পালন করতে পারি বিবি সারাহ বললেন, ঠিক আছে, যান। বিবি সারাহর সম্মতি পেয়ে হযরত ইবরাহীম (আ) উস্ট্রে আরোহন পূর্বক পবিত্র মক্কায় অবস্থিত বিবি হাজেরার নিকট পৌছেন। এ সময় হযরত ইসমাঈল (আ)এর বয়স মাত্র নয় বছর। হযরত ইবরাহীম (আ) বিবি হাজেরা কে বলেন, ইসমাঈলের মাথা আঁচড়িয়ে চোখে সুরমা ও মেশক আম্বর লাগিয়ে পরিষ্কার বস্ত্রাদি পরিয়ে সাজিয়ে দাও। সে আমার সাথে দাওয়াতে যাবে। বিবি হাজেরা নির্দেশ মত যথারীতি পুত্রকে সাজিয়ে বলেন, তোমার পিতার সাথে দাওয়াতে যাও।

        হযরত ইবরাহীম (আ) পূর্বেই ছুরি ও রশি স্বীয় আস্তিনের নিচে গোপন করে রেখেছিলেন। বিবি হাযেরার সম্মুখে থেকে বেরিয়ে ইসমাঈল (আ) পিতার পেছনে পেছনে চলেছেন। এ সময় অভিশপ্ত ইবলীস এসে বিবি হাজেরাকে বলল, তোমার ইসমাঈল কোথায়? তিনি বলেন, সে তার পিতার সাথে দাওয়াতে গেছে। ইবলীস বলল, আফসোস! নিরপরাধ ছেলেটিকে তার পিতা জবাই করতে নিয়ে গেছে। বিবি হাজেরা বললেন, মাআাযাল্লাহ! পিতা কি কখনও তার নিরপরাধ সন্তানকে জবাই করতে পারে। আর না অন্য কেউ এমন আজব কথা কখনও শুনেছেন। এবার ইবলীস বলল, ইসমাঈলকে কোরবানী করতে আল্লাহ্ আদেশ করেছেন। বিবি হাজেরা বললেন, এটা যদি আল্লাহর আদেশই হয়ে থাকে, তবে আমি তাতে সন্তুষ্ট। অভিশপ্ত শয়তান বিবি হাজেরার কাছে সুবিধা করতে না পেরে হযরত ইসমাঈল (আ) এর কাছে আসে। তার ধারণা ইসমাঈল (আ) এখনও ছোট। কাজেই তাঁকে বিভ্রান্ত করা সম্ভব হবে।

        সে ইসমাইল (আ) এর নিকট আসে বলল, ইসমাঈল। তুমি কোথার যাচ্ছ? তিনি বলেন, পিতার সাথে দাওয়াতে যাচ্ছি। ইবলিস বলল, আরে না। তিনি তো তোমাকে কোরবানী করতে নিয়ে যাচ্ছেন। হযরত ইসমাঈল (আ) জবাবে বলেন, কোন পিতা তার নিরপরাধ সন্তানকে হত্যা করেন, এটা কি তুমি কখনও শুনছ। এবার ইবলীস বলল, তাঁকে আল্লাহ তা'তালা আরুপ করার হুকুম করেছেন। তখন হযরত ইসমাঈল (আ) বললেন, আমাকে জবাই করা যদি আল্লাহর আদেশে হয়ে থাকে তবে আমার জীবন আল্লাহর রাহে উৎসর্গীকৃত। 

        অনেক দূর যাওয়া পর হযরত ইসমাইল (আ) জিজ্ঞেস করলেন, হে আমার পিতা আপনি আমাকে কোথায় নিয়ে চলেছেন। তখন ইবরাহীম (আ) কোরআনের ভাষায় বলেন

         অনন্তর ছেলেটি (ইসমাঈল) যখন চলাপেরা করার মত বয়সে পৌঁছুল যখন তিনি বলেন, হে বৎস! আমি স্বপ্নে  দেখেছি তোমাকে জবাই করছি। অতএব চিন্তা করে দেখ তোমার মত কি?-(সূরা ছফফাত: ১০২) 

        ইসমাঈন (আ) পিতাকে বলেন-

يابَتِ افْعَلُ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِن شَاءَ الله من الشيوي .

        অর্থ। যে আমার পিতা আপনি যা করতে আদিষ্ট তা করে ফেলুন, ইনশাআল্লাহ্ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। (সূরা ছফফাত: ১০২)

        স্বপ্নের কথা ছেলেকে বললেন। সপ্নের কথা শুনে পূন্যবান সন্তানও তা কবুল করলেন। পুত্র পিতাকে বললেন, হে আমার পিতা। আল্লাহর তা'আলার আদেশ পালনে আপনি ত্বরা করুন। ইনশাআল্লাহ্ আমাকে আপনি ধৈর্যশীল পাবেন। আমি আল্লাহর অনুগত বান্দা বিদ্রোহী নই। হে আমার পরম শ্রদ্ধেয় পিতা। আপনি তরা করুন যেন ইবলীস প্রতারিত করতে না পারে। সে কুমন্ত্রণা দিয়ে আমাকে বিভ্রান্ত করবে। আর যে কোন প্রকারে আমাকে বিভ্রান্ত করাই অভিশপ্ত ইবলীসের কামনা। তিনি বললেন, ইবলীস যদি তাঁকে বিভ্রান্ত করতে আসে তবে, তিনি তাকে পাথর নিক্ষেণ করবেন। সেমতে ইবলীস তাঁকে বিভ্রান্ত করতে এলে পিতা পুত্র উভয়ে মিলে পাপিষ্ঠ ইবলীসকে লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপ করেন। হজ্জের দিনসমূহে এ পাথর নিক্ষেপ হজ্জের একটি বিশেষ অনুষ্ঠান। হজ্জের সময় প্রতিদিন সাত বার করে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করতে হয়।

        অতঃপর হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আ) যে স্থানে বর্তমানে মিনা বাজার বলা হয় সে স্থানে উপনীত হন, হাজীরা হজ্জের সময় এখানে কেরাবানী করে থাকেন। এখানে এসে ইবরাহীম (আ) পুত্রকে পুনরায় বলেন, এখন তোমার কি পরামর্শ। তিনি বলেন, আমার হাজার জীবন হলেও তা আল্লাহর জন্য উৎসর্গীকৃত। আপনি স্বপ্নে যা সেখেছেন তা বাস্তবায়ন করুন। কেননা, এটা শোকর করার বিষয়, অসন্তুষ্টি প্রকাশের নয়। সুতরাং আপনি নিশ্চিন্তে আল্লাহর হুকুম পালন করুন। আল্লাহ্ তা'আলা বলেন-

 فَلَكًا أَسْلَمًا وَتَلَهُ لِلجيين

    অর্থাৎ। অতপর যখন তাঁরা উভয়ে হুকুম মানলেন এবং পিতা পুত্রকে কাত করে শোয়ালেন।-(সূরা ছফফাত : ১০৩)

         এ সময় হযরত ইসমাঈল (আ) তিনটি অসিয়ত করেছিলেন-প্রথমতঃ আমার হস্ত পদ খুব শক্ত করে বাঁধেন। কেননা, মানুষের জীবন তার কাছে খুবই প্রিয়, ছরি চালনার সময় যেন নড়েচড়ে না উঠি। আল্লাহ না করুন, যদি এক ফোঁটা রক্তও আপনার পরিধেয় বস্ত্রে লাগে তাহলে কিয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে আমি অপরাধী সাব্যস্ত হব। এ অপরাধের কারণে জাল্লাহর জাযাব ভোগ করার শক্তি আমার নেই। দ্বিতীয়ত: আমার মুখমণ্ডল যমীনের দিকে রাখবেন। অর্থাৎ আমাকে উপুড় করে শোয়াবেন। যাতে আমার চেহারা আপনার চোখে না পড়ে। আর আমি ও যেন আপনার চেম্বারা দেখতে না পাই। কেননা, পিতা পুত্রের পরস্পরের প্রতি স্বভাজাত বাৎসল্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠা বিচিত্র দত্ত এবং এ বাৎসল্য যেন আমাদের উভয়ের অপরাধের কারণ না হতে পারে। তৃতীয়ত: আপনি যখন ঘরে ফিরে যাবেন, তখন আমার বাদিত জলয় মায়ের কান্তে সালাম বলবেন এবং আমার রক্তমাখা বস্তু তাঁকে দেবেন এটা আমার মায়ের মানসিক প্রশান্তির উপকরণ হবে। কেনা, আমার মায়ের দ্বিতীয় কোন সন্তান নেই। তখন হযরত ইবরাহীম (আ) জামার ভেতরে লুকিয়ে রাখা রশি বের করে ইসমাঈল (আ) এর হস্ত-পদ মজবুত করে বেঁধে ফেলেন এবং চেহারা যমীনের দিক করে শোয়ালেন। ইসমাঈল (আ) বলেন, হে আমার মহান পিতা আমার হাত খুলে দিন। কেননা, যে বান্দা আল্লাহর দারবা হতে পলায়নকারী তাকেই তো হাত-পা বেঁধে আল্লাহর দরবারে আনা হয়। কিন্তু হযরত ইবরাহীম (আ) তা করেন নি। তিনি হাত-পা বেঁধে শোয়ায়ে পুত্রের গলায় জোরে চুরি চালান কিন্তু এতে ইসমাঈল (আ) এর দেহের কিছুমাত্রও কাটেনি। এবার ইসমাঈল (আ) বললেন হে পিতা। চুরির ধারালো বুক খুব জোরে চাপুন, সম্ভবত তাতে কাটা যাবে। তিনি তাই করলেন। কিন্তু তাতেও কিছু মাত্র কাটল না।শেষে হযরত ইবরাহীম (আ) ক্রোধান্নিত হয়ে হস্তস্থিত ছুরি যমীনের উপর ছুঁড়ে মারেন। এবার ছুরি বলল, হে আল্লাহর নবী। আল্লাহ আপনাকে বলছেন কাটতে আর আমাকে বলছেন কাটা হতে বিরত থাকতে। আপনাকে একবার হুকুম করেছেন কাটতে আর আমাকে দশ বার নিষেধ করেছেন। আপনার হুকুমের চেয়ে আমার কাছে আল্লাহ্ হুকুমই উত্তম। ইবরাহীম (আ) ও ছুরির এ কথোপকথানের মাঝেই পেছন দিক থেকে আওয়াজ ভেসে এল-

اللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ لَا إِلَهُ اللهُ اللهُ أَكْبَرُ وَلِلَّهِ أَكْبَرُ وَاللَّهِ الْحَمْدُ .

        পেছনে ফিরে দেখলেন, হযরত জিবরাঈল (আ) উক্ত ধ্বনি করতে করতে এগিয়ে আসছেন। উল্লিখিত ঘটনার বিবরণে আল্লাহ পাক বলেন-

         আর আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইবরাহীম। তুমি তোমার স্বপ্ন সত্যে পরিণত করেছ। আমি এভাবেই পূণ্যবানদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয়ই এটা ছিল এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। এবং আমি তৎপরিবর্তে একটি জবাইর পশু দান করলাম। আর আমি পরবর্তীদের জন্য অবশিষ্ট রেখেছি যে, সালাম ইবরাহীমের ওপর। নিঃসন্দেহে এভাবেই আমি পুণ্যবানদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয়ই সে আমার মু'মিন বান্দাদের মধ্য হতে উত্তম বান্দা, এবং তাকে সুসংবাদ প্রদান করেছি ইসহাকের, সে নবী এবং নেকারদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (সূরা ছফাত: ১০৪-১১২)

        উল্লিখিত আলোচনা থেকে অবধারিত হচ্ছে যে, প্রথম সুসংবাদ ছিল হযরত ইসমাঈল (আ) এর এবং জবাই সংক্রান্ত সব কাহিনী তাঁকে কেন্দ্র করে অথচ ইহুদীরা বলছে, হযরত ইবরাহীম (আ) ইসহাককে কোরবাণী করেছেন আর তাঁকে কোরবানী করতেই ইবরাহীম (আ) স্বপ্নে আদিষ্ট হয়েছেন। কিন্তু এ অভিমত সম্পূর্ণ ভ্রান্ত এবং অমূলক মিথ্যা প্রচারণা মাত্র। কেননা, ইসহাক (আ) এর সুসংবাদের সাথে হযরত ইয়াকুব (আ) এর সুসংবাদও প্রদান করা হয়েছে। আর সুসংবাদ ছিল তাদের নবী হবার। হযরত ইবরাহীম (আ) এ সুসংবাদ শ্রবণে বুঝে ফেলেছিলেন। অথচ তখনও উভয় বিষয় প্রকাশ পায়নি। অর্থাৎ তখন হযরত ইসহাক (আ) ইসমাঈল ও ইসহাক (আ)এর মাধ্যমে হযরত ইবরাহীম (আ) এর বংশধারা বহুদূর বিস্তার লাভ করে। ইসহাক (আ) এর মাধ্যমে হযরত ইবরাহীম (আ) এর বংশধারা বহুদূর বিস্তার লাভ করে। ইসহাক (আ) এর বংশধারায় বনী ইসরাঈলের সব নবী রাসূল জন্মগ্রহণ করেছেন। আর ইসমাঈল (আ) এর বংশে আরব দেশে প্রেরিত নবী রাসূলরা জন্মগ্রহণ করেছেন। তন্মধ্যে খাতামুল আম্বিয়া মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছ) রয়েছেন। তিনিই সর্বশেষ নবী ও রাসূল। তাঁর পরে কিয়ামত পর্যন্ত আর কোন নবী রাসূল দুনিয়ায় আসবেন না। যা হোক আল্লাহ্ পাক ইসমাঈল (আ) এর পরিবর্তে এক জান্নাতী দুম্বা পাঠিয়ে দেন, তাই কোরবানী হয়ে যায়। অনেকের মতে ইসমাঈল (আ) এর পরিবর্তে যে জান্নাতী দুম্বা কোরবানী করা হয়েছিল তার দেহ সাদা এবং মাথা কাল ছিল।

        বর্ণিত আছে, হযরত আদম (আ) এর পুত্র হাবিল দুম্বা কোরবানী করেছিলেন। হাবিলের কোরবানীর পর আল্লাহ তাআলা দীর্ঘ দু হাজার বছর পর্যন্ত এ দুম্বাটি জান্নাতে লালন পালন বড় করে অবশেষে হযরত ইসমাঈল (আ)এর স্কুলে কোরবানীর জন্য প্রদাণ করেন। পরবর্তীকালে ইবরাহীম (আ) ঐ দুম্বার চামড়া দিয়ে দস্তরখানা বানিয়ে তাতে বসিয়ে মেহমানদারী করতেন। সেটির পশম দ্বারা বিবি সারাহ একখানা চাদর বুনেন। সে চাদর হযরত ইবরাহীম (আ) তাবুতে সাকীনায় রেখে দিয়েছিলেন। একদিন হযরত জিবরাঈল (আ) তাবুতে সাকীনা নিয়ে রাসুলুল্লাহ (ছ) এর কাছে আসেন। তিনি তাবুতে সাকীনায় রক্ষিত দুম্বার পশমের চাদরখানা হযরত ওমর (রা) কে খেরকা তৈরি করার জন্য দাম করেন। খেরকাটি জীবনভর হযরত ওমর (রা)এর কাছে রক্ষিত ছিল বলে কথিত আছে।

Post a Comment

0 Comments