হযরত হাসান বছরী (রহঃ) বলেছেন, দুনিয়ায়ই মৃত্যুর অপমানের কারণ; সুতরাং জ্ঞানীর জন্য তা' আনন্দ রেখে যায় না। হযরত রবী ইবনে খায়ছম বলেছেন, মৃত্যুর চেয়ে অধিক অদৃশ্য উত্তম বস্তুর জন্য কোন মুমিন ব্যক্তি অপেক্ষা করে না। তিনি বলতেন, আমার মৃত্যু হলে তোমরা তা' কাউকে জানিও না। মৃত্যু আমার প্রভুর নিকট আমাকে নিয়ে যাবে। কোন বুযর্গ ব্যক্তি তার কোন বন্ধুর নিকট এক পত্রে লিখেছিলেন, হে ভ্রাতঃ! যে আগারে যাবার পর তুমি মৃত্যুর আশা করবে, তথায় যাবার পূর্বে বর্তমান আগারে মৃত্যুকে ভয় করবে। হযরত ইবনে সীরীন (রহঃ) এর নিকট মৃত্যুর বিষয় উল্লেখ করা হলে, তার সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মৃত্যু হত। খলীফা ওমর ইবনে আবদুল আযীয (রহঃ) প্রত্যেক রাত্রে আলিমদেরকে একত্র করে তাদের নিকট মৃত্যু, কিয়ামত ও আখেরাতের কথা শ্রবণ করতেন। তারপর তারা এমন করুণ স্বরে ক্রন্দন করতেন যে, মনে হত যেন তাঁদের সামনে কোন মৃত দেহ স্থাপন করা হয়েছে। হযরত ইব্রাহীম তাইমী (রহঃ) বলেছেন, দু'টি বস্তু আমার নিকট থেকে দুনিয়ার স্বাদ হরণ করে নিয়েছে। একটি মৃত্যু চিন্তা, দ্বিতীয় আল্লাহর সম্মুখে দণ্ডায়মান হবার ভয়। হযরত কা'ব (রাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি মৃত্যুকে চিনতে পেরেছে, সাংসারিক চিন্তা-ভাবনা তার উপর সহজ হয়েছে। হযরত মুতাররফ (রহঃ) বলেছেন, আমি একদা স্বপ্নে দেখলাম যেন কোন এক ব্যক্তি বছরার কোন এক মসজিদে বসে বলছে, মৃত্যু চিন্তা আল্লাহভীরুদের হৃদয় কর্তন করে ফেলেছে। আল্লাহর কসম। তাদেরকে তুমি বিভ্রান্ত দেখতে পাবে।
হয়রত আশআছ (রহঃ) বলেছেন, আমরা হযরত হাসান বছরী (রহঃ) এর নিকট গেলে তিনি কেবল মৃত্যু, দোযখ ও পরলোক সম্পর্কেই আমাদের সাথে বেশী আলোচনা করতেন। হযরত সুফিয়ার (রাঃ) বলেছেন, একজন রমণী হযরত আয়েশা (রাঃ)এর নিকট তার নিজের মনের কাঠিন্য সম্বন্ধে অভিযোগ করেছিল। তাতে তিনি বললেন, মৃত্যুকে অধিক স্মরণ কর, তাতে তোমার অন্তর কোমল হবে। বস্তুতঃ সে তা' করে আশাতিরিক্ত ফল পেয়েছিল। অতঃপর সে হযরত আয়েশা (রাঃ) এর নিকট ধন্যবাদ জ্ঞাপন করল। হযরত ঈসা (আঃ)এর নিকট মৃত্যুর বিষয় উল্লেখ করা হলে, তাঁর ধমনীতে রক্তের স্রোত প্রবলবেগে প্রবাহিত হত। হযরত দাউদ (আঃ)এর সম্মুখে মৃত্যু ও কিয়ামতের কথা উল্লেখ করা হলে তিনি এত বেশী রোদন করতেন যে, তাতে তাঁর মস্তকের কেশরাজি দণ্ডায়মান হয়ে যেত। যখন তাঁর সামনে রহমতের কথা উল্লেখ করা হত, তখন তিনি তাঁর পূর্বাবস্থায় ফিরে আসতেন। হযরত হাসান বছরী (রহঃ) বলেছেন, আমি কখনও কোন জ্ঞানী লোককে এরূপ দেখিনি যে, মৃত্যুর কথা আলোচনা করলে ভয়ে সে বিমর্ষ হয়ে পড়ত না। খলীফা ওমর ইবনে আব্দুল আযীয (রহঃ) কোন আলিমকে বলেছিলেন, আমাকে আপনি কিছু উপদেশ দিন। তিনি বললেন, আপনার পিতা থেকে হযরত আদম (আঃ) পর্যন্ত কোন লোকই মৃত্যু থেকে অব্যাহতি পায়নি। এখন আপনার পালা এসেছে। হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আযীয (রহঃ) একথা শুনে রোদন করতে লাগলেন। হযরত রবী ইবনে খায়াছাম (রহঃ) তাঁর গৃহের মধ্যে একটি কবর খনন করিয়েছিলেন। তিনি তথায় দৈনিক কয়েকবার করে শয়ন করতেন। এতে তাঁর মৃত্যুর কথা সর্বদা হৃদয়মধ্যে জাগরিত থাকত। তিনি বলতেন, যদি আমার হৃদয় থেকে মৃত্যু চিন্তা এক পলকের জন্যও চলে যায়, আমার হৃদয় নষ্ট হয়ে যাবে।
হযরত মুতাররফ ইবনে আবদুল্লাহ (রহঃ) বলেছেন, মৃত্যু আরামপ্রিয় লোকদের শক্তি হরণ করেছে; সুতরাং এমন শক্তি অন্বেষণ কর, যার মৃত্যু নেই। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীয (রহঃ) আব্বাকে বলেছিলেন, অধিক পরিমাণে মৃত্যু চিন্তা কর, তাতে দুটো উপকার পাবে। তুমি যদি সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে থাক, তবে তা' তোমার নিকট তিক্ত হয়ে পড়বে। আর যদি তুমি দুঃখ দারিদ্র্যে বেষ্টিত থাক, তোমার সম্পদ এসে যাবে। হযরত আবু সোলায়মান দারানী (রহঃ) বলেছেন যে, আমি হারুনের মাতাকে বলেছিলাম, তুমি কি মৃত্যুকে ভালবাস? সে বলল, তালবাসি না। আমি জিজ্ঞেস করলাম এর কারণ কি? সে বলল, যদি তুমি কোন ব্যক্তিকে ভাল না বাস, তুমি তার সাথে সাক্ষাত করতে ইচ্ছা কর না। আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত না হয়ে কিরূপে আমি তার সাথে সাক্ষাত করতে চাইব?
মৃত্যুচিন্তার ধারা
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা। জেনে রাখ যে, মৃত্যু অতীব ভয়াবহ এবং এই বিপদ অতীব কঠিন। মানুষ মৃত্যু সম্বন্ধে কম চিন্তা করে বলে অন্যমনস্ক হয়ে আছে। যে তাকে দাংস করে, সেও সম্পূর্ণ হৃদয় দিয়ে তার বিষয় চিন্তা করে; বরং সাংসারিক মোহে নিমগ্ন হয়ে তার বিষয় চিন্তা করে; সুতরাং মৃত্যুচিন্তা তার হৃদয়ে প্রভাব বিস্তার করে না। মৃত্যুচিন্তার ধারা এইঃ সকল বস্তু থেকে হৃদয়কে মুক্ত করবে, শুধু মৃত্যুচিন্তা সামনে রাখবে। ঐ ব্যক্তির ন্যায় হবে যে, বিস্তৃত ভয়সস্কুল বিজন প্রান্তরে সফর করতে ইচ্ছা করে বা সমুদ্র ভ্রমণে যাত্রা করে। সে শুধু সেই বিষয়ই ভাবতে থাকে। যখন মৃত্যুচিন্তা তার হৃদয়কে জুড়ে বসে এবং তা' প্রবল হয়, তখন তার সাংসারিক সুখ ও আনন্দ হ্রাস পেতে থাকে। তার মন ভেঙ্গে যায়।
মৃত্যুচিন্তার উত্তম পন্থা প্রতিবেশী ও সমবয়সীগণের মৃত্যু, তাদের মৃত্তিকার নিম্নে অবস্থান এবং তাদের চেহারা ও অবস্থার কথা স্মরণ করা। তাদের সুন্দর মূর্তি কিরূপে মৃত্তিকা নষ্ট করে দিয়েছে, তাদের কবরের মধ্যে তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কিভাবে ধূলিসাৎ হয়েছে। তাদের ভার্যাগণ কিরূপে ধূলি-ধূসরিত বেশে এবং তাদের ইয়াতীম সন্তানগণ সাহায্যহীন অবস্থায় দিনাতিপাত করছে, তাদের ধন-সম্পদ কিরূপে নষ্ট হয়ে গেছে, তাদের মসজিদ শূন্য হয়ে রয়েছে, তাদের মজলিস জন-মানবশূন্য, তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, এসব ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করা। এভাবে একজন একজন করে স্মরণ করবে এবং তাদের প্রত্যেকের অবস্থা, তাদের মৃত্যুর ঘটনা, তাদের অবয়ব, আকৃতি, তাদের আমোদ-প্রমোদ, তাদের আরাম-আয়েশ ও আনন্দ স্ফূর্তিতে বসবাস করা এবং মৃত্যুকে সম্পূর্ণরূপে ভুলে থাকা ইত্যাদি কথাগুলো মনের মধ্যে স্মরণ করতে থাকবে।
আবার চিন্তা করবে যে, তাদের সেই মোহময় ভুলের মধ্যেও হঠাৎ মৃত্যু উপস্থিত হয়ে কিরূপ ক্ষিপ্রতার সাথে তাদেরকে এ সংসার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। আরও চিন্তা-করবে যে, এখন কবরের মধ্যে তাদের সুন্দর দেহাকৃতি কেমন হয়ে গেছে। তাদের পদদ্বয় গলে গেছে, গ্রন্থিসমূহ বিনষ্ট হয়ে গেছে, তাদের রসনা এখন কীটের খাদ্য হয়েছে, অথচ সেই রসনার দ্বারা তারা কত হাস্য-কৌতুক করত। মৃত্তিকা তাদের শক্ত দন্তরাজিকে ভক্ষণ করে ফেলেছে, যে তদবীরের দশ বছর পর্যন্ত তাঁর কোন আবশ্যকতা ছিল না, সে এমন সময় সেই তদবীর করেছে যখন তার মাত্র মৃত্যুর একমাস অবশিষ্ট ছিল, তার আশা পরিপূর্ণ না হতে মৃত্যু এমন সময়ে মৃত্যু তার নিকট উপস্থিত হয়েছিল যে, তা' সে ভাবতেও পারেনি। তখন তার নিকট মালাকুল মাওত বা যমদূত এসে আত্মপ্রকাশ করেছে। এসব কথা চিন্তা করলে মনে এই অবস্থার সৃষ্টি হয় যে, সেও তাদেরই ন্যায় এবং তার গাফলতীও তাদেরই গাফলতীর ন্যায় এবং অতি শীঘ্রই তার দশাও ত তাদেরই দশার ন্যায় হবে।
হযরত আবু দারদা (রাঃ) বলেছেন, যখন মৃত লোকের কথা বলা হয় তা' শুনে তুমি নিজেকে তাদের অন্যতম বলে মনে করবে। হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি অপরের অবস্থা দেখে নিজের জন্য উপদেশ গ্রহণ করতে পারে সে-ই প্রকৃত ভাগ্যবান। হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আযীয বলেছেন তোমরা কি দেখছ না যে, তোমরা প্রত্যেক দিন প্রাতে বা সন্ধ্যায় কোন মুসাফিরকে আল্লাহর নিকট যাওয়ার সামান প্রস্তুত করে দিচ্ছ এবং তাকে মাটির মধ্যে গর্ত খনন করে রাখছ, অথচ সে তার বন্ধু-বান্ধবকে ছেড়ে যাচ্ছে এবং বিষয়-সম্পদ থেকে পৃথক হয়ে যাচ্ছে। কবরে প্রবেশ করে এরূপ চিন্তার সাথে সংযুক্ত থাকা এবং রুগ্ন লোককে দেখতে যাওয়ায় মনে মৃত্যুর চিন্তা জাগরূক হয় এবং তা' প্রবল হয়। পরিশেষে তা-ই তার লক্ষ্যস্থল হয়। এ সময়ে সে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয় এবং এই প্রবঞ্চনাময় সংসার থেকে তার মন উঠে যায়। এসব না করে শুধু বাহ্যিক যিকির দ্বারা এবং রসনাকে সিক্ত করে অতি অল্পই উপকার পাওয়া যায়। যদি পার্থিব কোন বস্তু মনকে মুগ্ধ করে, তখনই তার স্মরণ করা উচিত যে, আমার এই বস্তু ত্যাগ করে যেতে হবে। হযরত ইবনে মুতী (রহঃ) একদা তাঁর বাসগৃহের দিকে লক্ষ্য করে অত্যন্ত প্রীতি লাভ করলে তিনি রোদন করতে লাগলেন এবং বললেন, আল্লাহর কসম, যদি মৃত্যু না থাকত তবে আমি তোমার প্রতি দৃষ্টিপাত করে আনন্দিত হতে পারতাম। যেখানে আমাকে অবশ্যই যেতে হবে, সেই স্থান যদি সংকীর্ণ না হত, তাহলে এই প্রশস্ত দুনিয়া দেখে আমার চক্ষু শীতল হত। এই কথা বলে তিনি অধিকতর উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করতে লাগলেন।
0 Comments