নফস, রূহ, কলব এবং আকল কী

        পাঠক-পাঠিকা। জেনে রাখ, নফস, রূহ, কলব ও আকল এ চারটি শব্দই আমাদের পরবর্তী আলোচনার সময় ব্যবহার করব। আলিমদের মধ্যে খুব অল্পসংখ্যক লোকই রয়েছেন যারা এ শব্দগুলোর অর্থের পার্থক্য, সীমা এবং প্রকৃত মর্ম অনুধাবন করতে পারেন। এ বিষয়টি অবগত না হওয়ার কারণে তাদের অধিকাংশ সময়ই ভুল-ভ্রান্তি হয়ে যায়। আমাদের আলোচ্য বিষয়ের সঙ্গে যতটুকু সম্পর্ক রয়েছে ঠিক ততটুকু অর্থই আমরা উল্লেখ করব।

        (ক) কলবঃ এ শব্দটি দু'অর্থে ব্যবহৃত হয়। প্রথম অর্থ হৃদপিন্ড। তা' একটি মাংসখন্ড যা' মানুষের বক্ষদেশের বাম পার্শ্বে অবস্থিত। এর অভ্যন্তর ভাগ শূন্য বা ফাঁকা। উক্ত শূন্যস্থানে কাল বর্ণের রক্ত বিদ্যমান। ঐ কাল' রক্তই রূহ বা প্রাণের উৎস স্থল। এ হৃদপিন্ডই আবার রক্ত চলাচলের কেন্দ্রস্থল। হৃদপিন্ডের আকৃতি ও প্রকৃতির পরিচয় দান করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। সেটা চিকিৎসকদের চিকিৎসা শাস্ত্রের বিষয়বস্তু। আমাদের আলোচ্য বিষয়ের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। হৃদপিন্ড পশু পাখী ও অন্যান্য ইতর প্রাণীর মধ্যেও রয়েছে। এমন কি তা' মৃত প্রাণীর মধ্যেও অবস্থান করে। আমরা যখন শব্দটি এ গ্রন্থে সাধারণভাবে ব্যবহার করব তা' এই প্রকার হৃদপিন্ডের উদ্দেশ্যে নিয়ে করব না। কেননা তা' একখন্ড মাংস মাত্র। তার কোনই মূল্য নেই। শুধু জড় জাতীয় একটি বৃদ্ধ মাত্র যা' শুধু মানব বরং সর্বশ্রেণীর জীবগণই বাহ্যিক চোখের দৃষ্টিতে দেখতে পারে।

        কলবের দ্বিতীয় অর্থঃ কলবের দ্বিতীয় অর্থ আত্মা। তা' আল্লাহ প্রদত্ত একটি আকারবিহীন লতীফা বা মৌলিক উপাদান অথবা একটি প্রাণবন্ত অতি সূক্ষ্ম অশরীরি বস্তু। তবে এর সঙ্গে আকার বিশিষ্ট হৃদপিন্ডের সম্পর্ক আছে। এই লতীফাই মানুষের মূল হাকীকাত বা আসল বস্তু। এটাই অনুভূতি সম্পন্ন, বুদ্ধিজ্ঞান বিশিষ্ট এবং তত্ত্বজ্ঞান অর্জনকারী। এটাই লক্ষ্যিত বস্তু। একেই সম্বোধন করা হয়, শাস্তি দেয়া হয়, তিরস্কার করা হয়, এবং একেই অনুসন্ধান করা হয়। সাকার হৃদপিন্ডের সাথে নিরাকার এই মৌলিক উপাদানের বিশেষ সম্পর্ক আছে। অধিকাংশ মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি এ সম্পর্কের কারণ অনুধাবন করতে গিয়ে হয়রান ও দিগভ্রান্ত হয়ে যায়। কেননা হৃদপিন্ডের সাথে আত্মার সম্পর্ক যেরূপ শারীরিক অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সাথে তাদের গুণাবলীর সম্পর্ক বা যেরূপ কারিগরের সাথে যন্ত্রের সম্পর্ক বা গৃহবাসীর সাথে গৃহের সম্পর্ক। এর সম্পর্ক দু' প্রকার। একপ্রকার হল, উলুমে মুকাশাফাহ বা আধ্যাত্মিক বিদ্যাসমূহের সাথে তার সম্পর্ক। অন্য প্রকার সম্পর্ক হল, উলুমে মুআমালাহ বা ব্যবহারিক বিদ্যাসমূহের সাথে সম্পর্ক। কিন্তু এ গ্রন্থে আমাদের উদ্দেশ্য শুধু উলুমে মুআমালাহ বা ব্যবহারিক বিদ্যাসমূহের বর্ণনা করা। দ্বিতীয় প্রকার সম্পর্ক বুঝতে গেলে প্রথমে রূহ বা আত্মার গুপ্ত তত্ত্ব বুঝে নিতে হবে। কিন্তু হুযুরে পাক (দঃ) এ বিষয়টির প্রতি আলোকপাত করেন নি। সুতরাং আমাদেরও সে বিষয় নিয়ে আলোচনা করা অনুচিত। আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, যখনই আমর। কলব শব্দটি সাধারণভাবে এ গ্রন্থে ব্যবহার করব তখনই তাকে আত্মা বা লতীফা বা সূক্ষ্ম অশরীরি বস্তু হিসেবেই ব্যবহার করব। এ মৌলিক উপাদানটির অবস্থা এবং গুণাবলী বর্ণনা করাই আমাদের লক্ষ্য। এর নিজস্ব সত্তার অবস্থা বর্ণনা করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। তার কারণ এই যে, ব্যবহারিক বিদ্যাসমূহে আত্মার প্রকৃতি ও গুণাবলীর পরিচয়ের উপরই নির্ভরশীল। তার সত্তার উপর নির্ভরশীল নয়।

        (খ) রূহঃ রূহ শব্দটিও তার সাথে সম্পর্কিত বস্তুর দিক থেকে দু'টো অর্থে ব্যবহৃত হয়। একটি অর্থ হল, সূক্ষ্ম শরীরি পদার্থ যার উৎপত্তিস্থল সাকার হৃদপিন্ডের অভ্যন্তরে, তা' থেকে রূহ বা প্রাণ প্রবাহ (বিদ্যুৎ প্রবাহের মত) বিভিন্ন শিরা-উপশিরার মাধ্যমে সমগ্র শরীরে ছড়িয়ে যায়। শরীরের মধ্যে এই বিদ্যুৎ প্রবাহের নামই প্রাণ। এর স্পর্শ শক্তি, দর্শন শক্তি, শ্রবণ শক্তি ঘ্রাণ শক্তি, এবং বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের চলৎশক্তি ও অনুভব শক্তি গৃহ কোণে প্রজ্জ্বলিত প্রদীপের আলো বিকিরণের ন্যায়। এ আলো গৃহের প্রত্যেক কোণেই গিয়ে গৃহকে আলোকিত করে। বস্তুত রূহ প্রাণ প্রবাহ ও তার আভ্যন্তরীণ প্রবাহ দেয়ালে লটকিয়ে রাখা প্রদীপের আলোর বিকিরণের ন্যায়ই বটে। চিকিৎসকগণ যখন সাধারণ প্রাণ বায়ুর কথা বলে তখন তারা তাকে এ অর্থেই গ্রহণ করে। এ প্রাণ সূক্ষ্ম গ্যাস, বাষ্প বা বিদ্যুৎ সদৃশ। যা' হৃদপিন্ডের উষ্ণতা সৃষ্টি করে। কিন্তু এ বিষয়ের বিশদ বিশ্লেষণ আমাদের উদ্দেশ্য নয়। এ বিষয়টি চিকিৎসকদের জন্য প্রয়োজনীয়। কেননা তারা মানুষের শরীরের চিকিৎসা করে। কিন্তু যারা দ্বীনের চিকিৎসক তারা কেবল আত্মার চিকিৎসা করে। সুতরাং উল্লিখিত রূপ প্রাণের ব্যাখ্যা করা ধর্মের বিষয়বস্তু নয়। রূহের দ্বিতীয় অর্থঃ কহ এমন এক অশরীরি সূক্ষ্ম লতীফা বা সূক্ষ্ম পদার্থ বা মৌলিক উপাদান যা' আমরা কলবের দ্বিতীয় অর্থে আত্মা বলে উল্লেখ করেছি। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা এই অর্থ করেই নিম্নোক্ত আয়াতে এরশাদ করেছেন, "জুলির রূহু মিন আমরি রাব্বী" অর্থাৎ বল, রূহ আমার প্রভুর নির্দেশ। সুতরাং এ অর্থে রূহের নাম আত্মা। তা' এমন এক অত্যাশ্চর্য খোদায়ী পদার্থ যার প্রকৃত তত্ত্ব অনুধাবন ও হৃদয়ঙ্গম করতে অধিকাংশ জ্ঞানবুদ্ধিকে দিশাহারা ও ব্যর্থ করে দেয়।

        (গ) নফসঃ নফস শব্দটিরও অনেক অর্থ আছে, তন্মধ্যে আমাদের প্রয়োজনের লক্ষ্যে তার দুটে। অর্থ ধরে নেব। তার প্রথম অর্থ প্রবৃত্তি। এটা এমন এক সামগ্রিক বস্তু যার মধ্যে ক্রোধ ও লোভের শক্তি আছে। এ বিষয়ের বর্ণনা শীঘ্রই করা হবে। সুফী-সাধকগণ নফসকে সাধারণতঃ এ অর্থেই ব্যবহার করে থাকেন। কেননা তারা নফস দ্বার। মানুষের নিন্দনীয় দোষাবলীর সমন্বয়ের মূল বস্তু বুঝে থাকেন। তারা বলেন যে, চেষ্টা-যত্ন করে প্রবৃত্তি দমন করা একান্ত প্রয়োজনীয়। তাদের এ কথার সমর্থনে হুযুরে পাক (দঃ) এর এ হাদীসটি রয়েছে। যথা "আ'দা আদুওয়্যাকা নাফসুকাল্লাযী বাইন। জাম্বাইকা" অর্থাৎ সর্বাপেক্ষা বড় শত্রু তোমার দু' পার্শ্বে অবস্থিত তোমার প্রবৃত্তি।

        নফসের দ্বিতীয় অর্থঃ এর দ্বিতীয় অর্থ হল, আত্মা বা সেই সূক্ষ্ম পদার্থ যা আমরা উপরে বর্ণনা করে এসেছি। আর একেই প্রকৃতপক্ষে মানুষ বলা যায়। এটাই মানুষের জাত বা অস্তিত্ব। নফসকে বিভিন্ন অবস্থানুযায়ী বিভিন্ন প্রকৃতি দ্বারা বর্ণনা করা হয়। যখন নফস শান্ত ভাব ধারণ করে তার পূর্বাবস্থা দূরীভূত হয়। কাম, মোহ ইত্যাদি বিরুদ্ধ ভাবগুলো চলে যায় তখন তা' নফসে মুত্বমায়িন্নাহ বা সন্তুষ্ট আত্মা বলে আখ্যায়িত হয়। এ অর্থেই আল্লাহ তায়ালা নিম্নোক্ত আয়াতে এরশাদ করেছেন, "ইয়া আইয়্যাতুহান নাফসুল মুতুমায়িন্নাতুরজিঈ ইলা রাব্বিকি রাদ্বিয়াতাম মারদ্বিইয়্যাহ" অর্থাৎ হে সন্তুষ্ট আত্মা! তোমার প্রভুর দিকে পরিতৃপ্ত হয়ে এবং সন্তুষ্ট ভাবে ফিরে যাও।

        প্রথম অর্থে নফস বা প্রবৃত্তি আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়ার রূপ ধারণ করে না। কেননা তখন তা' আল্লাহ হতে দূরে থেকে শয়তানের দলের অন্তর্গত হয়। আবার যখন নফসের শান্ত ভাব পূর্ণ হয় না কিন্তু তা' শুধু কাম প্রবৃত্তি দূর করে এবং তার বিরোধিতা করে তখন সে নফসকে নফসে লাওয়্যামাহ বা আত্মভৎসনাকারী আত্মা বলা হয়। কেননা এই প্রকার নফস তার মালিককে আল্লাহর ইবাদাতে ত্রুটির জন্য তিরস্কার করে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, "ওয়ালা উকুসিমু বিন্নাফসিল লাওয়্যামাহ" অর্থাৎ আমি ভর্ৎসনাকারী নফসের কসম করি। যদি নফস প্রতিবাদ ত্যাগ করে কাম প্রবৃত্তির আদেশানুযায়ী এবং ইচ্ছানুসারে চলে ও শয়তানের পায়রবী করে তখন তাকে নফসে আম্মারাহ বা মন্দ কাজে অনুরক্ত আত্মা বলা হয়। আল্লাহ তায়ালা - হযরত ইউসুফ (আঃ) এবং আযীযের স্ত্রী জুলায়খা প্রসঙ্গে বলেন যে, "হযরত ইউসুফ (আঃ) বলেছিলেন, "ওয়ামা উবাররিউ নাফসী ইন্নান নাফসা লাআম্মারাতুম বিসস্থ ইল্লায়ি মা রাহিমা রাব্বী" অর্থাৎ আমি নিজেকে মুক্ত দেখি না আমার প্রতিপালক যাকে অনুগ্রহ করেন সে ব্যতীত অসৎ বিষয়ে আদেশকারী, মন্দ বা নিন্দনীয় কার্যের আদেশকারী এই নফসকেও প্রথম অর্থে নফস বা প্রবৃত্তি বলা হয়। প্রথম অর্থে নফস বা প্রবৃত্তি মন্দ। দ্বিতীয় অর্থে নফস বা আত্মা উত্তম। কেননা তা' মানুষের মৌলিক উপাদান। তা-ই প্রকৃত বস্তু এবং তা' আল্লাহর এবং সমস্ত জ্ঞানের বস্তুর পরিচয় লাভ করে।

        (ঘ) আকলঃ (বুদ্ধি বা জ্ঞান) আকল বা বুদ্ধির অনেক অর্থ আছে। তা' আমরা ইলমের অধ্যায়ে বর্ণনা করেছি। আমাদের প্রয়োজনে এখানে এর মাত্র দুটো অর্থের বিষয় আলোচনা করব। বুদ্ধির প্রথম অর্থ জড় জগতের ঘটনাপুঞ্জের প্রকৃত তত্ত্ব জানার নামই বুদ্ধি। এই অর্থে জ্ঞানের একটি গুণের নামই বুদ্ধি এবং এর অবস্থান আত্মার মধ্যে। বুদ্ধির দ্বিতীয় অর্থ হল, বিভিন্ন গুপ্ত বিদ্যা আয়ত্ত করার শক্তি। শেষাবস্থায় বুদ্ধি একটি লতীফা বা সূক্ষ্ম পদার্থ। তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা এই যে, আমরা জানি যে, প্রত্যেক আলম বা জগতেরই স্বভাবতঃ অস্তিত্ব আছে। তাই তার জীবন ধারণের মূল। জ্ঞান এর মধ্যে একটি অবস্থা বা গুণ, গুণের আধার ও গুণ দুটো পৃথক বস্তু। কখনও বুদ্ধি দ্বারা সাধারণভাবে জ্ঞানীর গুণ বুঝা যায়। আবার কখনও বুঝবার বন্ধু অথবা জ্ঞানাধারকেও বুঝায়। হুযুরে পাক (দঃ) এর নিম্নোক্ত হাদীস তারই সমর্থন করে। যথা "আউয়‍্যালু মা খালাক্কা লাহুল আকুলা" অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম বুদ্ধিকেই সৃষ্টি করেছেন। বুদ্ধিগুণ একটি অশরীরি বস্তু। তা' নিজে নিজে দাঁড়াতে পারে না। সর্বপ্রথম সৃষ্টি হয়েছে বুদ্ধি। একথা কিরূপে বুঝে আসতে পারে? তজ্জন্যই বুদ্ধিগুণটির আধার বুদ্ধির পূর্বে বা বুদ্ধির সাথে একই সঙ্গে সৃষ্টি হওয়া আবশ্যক। অন্যথায় শুধু বুদ্ধিকে সম্বোধন করা নিম্নোক্ত হাদীসে কিরূপে সম্ভব হয়? হাদীস শরীফে আছে, আল্লাহ তায়ালা বুদ্ধিকে সামনে আস বলার পর তা' সামনে এল। তারপর তিনি তাকে পিছনে যাওয়ার কথা বললে তা' পিছনে চলে গেল। এতে বুঝা যাচ্ছে যে, অত্র হাদীসে বুদ্ধি দ্বারা বুদ্ধির আধার বিদ্যাকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। উল্লিখিত বর্ণনার মাধ্যমে এখন পরিষ্কার হয়ে গেল যে, কলব, নফস, রূহ এবং আকলের আধার ভিন্ন ভিন্ন। শরীরি কলব বা হৃদপিন্ড শরীর রূহ বা প্রাণ রিপুজনিত নফস বা কুপ্রবৃত্তি এবং আকল বা বিদ্য। এ চারটি অর্থে চারটি শব্দ সাধারণতঃ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ চারটি শব্দের অন্য অর্থ লতীফা বা সূক্ষ্ম অশরীরি বস্তু বা মৌলিক উপাদান যা মানুষ পরিশ্রম করে উপার্জন করতে পারে। চারটি শব্দের মধ্যে লতীফার স্থান আছে এবং তাতে সে শরীক হয়; সুতরাং শব্দ চারটি হলেও তাদের অর্থ পাঁচটি এবং প্রত্যেক শব্দেরই সাধারণতঃ দুটো অর্থ আছে। অধিকাংশ আলিম এসকল শব্দ ব্যবহারে মতভেদ করে সন্দেহে নিপতিত হয়ে সেগুলোর ভিন্ন অর্থ করেছে। তোমরা তাদেরকে খাতের বা গুপ্ত প্রেরণা শব্দ দ্বারা কথা বলতে দেখবে। তারা বলে থাকে যে, এটা খাতেরুল আকুল অর্থাৎ বুদ্ধির গুপ্ত প্রেরণা, এটা রূহের গুপ্ত প্রেরণা, এটা আত্মার গুপ্ত প্রেরণা এবং এটা নফসের গুপ্ত প্রেরণা। কিন্তু যারা এমন শব্দ শ্রবণ করে, তারা এসব শব্দের অর্থের মধ্যে কোন পার্থক্য লক্ষ্য করে না। এ জন্যই এ বিষয়টিকে পরিষ্কাররূপে উদঘাটন করার জন্য এসব শব্দের যথাযথ অর্থ বর্ণনা করলাম। যেখানে কলব শব্দ কুরআনে পাকে ও হাদীস শরীফে এসেছে সেখানে মানুষ যা' বুঝতে পারে এবং সব জিনিসের প্রকৃত তত্ত্ব উপলব্ধি করতে পারে তা-ই উদ্দেশ্য করা হয়েছে। তজ্জন্য যে কলব বুকের মধ্যে আছে তা' দ্বারা ঐ উভয় বস্তুকে অর্থাৎ হৃদপিন্ড এবং আত্মাকে সম্বোধন করা হয়েছে। কেননা এ দুটোর মধ্যে একটি বিশেষ গুপ্ত সম্পর্ক আছে। কলবের সাথে সমস্ত শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সম্পর্ক আছে এবং তা' সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে কাজ আদায় করে নেয়। অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাথে শরীরের সম্পর্ক কলবের মাধ্যমেই রক্ষিত হয়। শরীরি কলবের সাথে অশরীরি আত্মার বা লতীফার প্রথমতঃ বিশেষ সম্পর্ক আছে। শরীরি কলব বা হৃদপিন্ডই আত্মার স্থান ও আত্মার রাজা, আত্মার জগত বা আত্মার বাহন। এ কারণেই হযরত ছহল তশতরী (রহঃ) আত্মাকে আরশের সাথে এবং বক্ষকে কুরসীর সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন, কলবই আরশ, এবং বক্ষই কুরসী। কিন্তু একথা দ্বারা কেউ যেন এরূপ না বুঝে যে, কলবই আল্লাহর আরশ বক্ষই আল্লাহর কুরসী। কেননা তা' সম্পূর্ণ অসম্ভব; বরং তিনি এ কথার দ্বারা বুঝাতে চেয়েছেন যে, হৃদপিন্ড আত্মার সাম্রাজ্য ও সিংহাসন এবং আত্মার জন্যই হৃদপিন্ডের অবস্থিতি। হৃদপিন্ড ও বক্ষের সাথে যেরূপ আত্মার সম্পর্ক আরশ ও কুরসীর সাথে তদ্রূপ আল্লাহর সম্পর্ক। এই উদ্দেশ্য ব্যতীত উল্লিখিত তুলনাটি টিকতে পারে না। তবে সে যাই হোক আমাদের প্রয়োজনে তার বিশদ আলোচনা অনাবশ্যক।

Post a Comment

0 Comments