রসনার অষ্টম বিপদঃ অপরকে অভিশাপ দেয়া রসনার অষ্টম বিপদ। চাই তা' কোন প্রাণী হোক বা নির্জীব পদার্থ হোক বা মানুষ হোক। এটা জঘন্য এবং নিন্দনীয় কার্য। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, মু'মিন কারও উপর অভিসম্পাত করে না। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, আল্লাহর লা'নত দ্বারা কাউকে অভিশাপ দিও না। তাঁর ক্রোধের দ্বারা বা জাহান্নামের দ্বারা অভিসম্পাত করো না। হযরত হোযায়ফাহ (রাঃ) বলেছেন, যে সম্প্রদায়ের মধ্যে একে অন্যকে অভিশাপ দেয়, তা' সেই সম্প্রদায়ের উপর বর্তে। হযরত ইমরান ইবনে হোসায়েন বলেছেন, হুযুরে পাক (দঃ)এর সফরে এক আনছার রমণী উদ্ভারোহণে হুযুরে পাক (দঃ)এর পার্শ্ব দিয়ে অতিক্রম করাকালে সে উষ্ট্রটিকে ধমকি দিয়ে অভিসম্পাত করল। তখন হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, উষ্ট্রের উপরকার বোঝাটি নামিয়ে লও এবং তাকে দল থেকে বের করে দাও। কেননা সে অভিশাপপ্রান্ত। তিনি আরও বলেছেন, আমি যেন সেই উষ্ট্রের দিকে লক্ষ্য করছি। উটটি ইতস্ততঃ লোকের মধ্যে চলাফিরা করতে লাগল। কেউই তার নিকট গেল না। হযরত আবু দারদা (রাঃ) বলেছেন, ভূমিকে অভিশাপ দিলে ভূমি বলতে থাকে, আমাদের মধ্যে যে অধিক পাপী, আল্লাহর জন্য তার উপর আল্লাহর অভিসম্পাত পড়ুক।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, হুযুরে পাক (দঃ) হযরত আবুবকর (রাঃ) কে তাঁর এক ক্রীতদাসীকে লা'নত দিতে শুনেছিলেন। হুযুরে পাক (দঃ) তাঁর প্রতি লক্ষ্য করে বললেন, হে আবুবকর। ছিদ্দীকগণ ও লা'নতকারীগণ একত্র হল। এ ত সম্ভবপর নয়। কা'বার শপথ, তিনি এ কথাটি দু' বার কি তিনবার বললেন। তারপর হযরত আবুবকর (রাঃ) ঐ দাসীকে মুক্ত করে দিলেন। অতঃপর তিনি হুযুরে পাক (দঃ) এর নিকট এসে বললেন, আমি আর কখনও এরূপ করব না। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, লা'নতকারীগণ রোজ কিয়ামতে শাফায়াতকারী বা সাক্ষ্য দানকারী হবে না। হযরত আনাস (রাঃ) বলেছেন, এক ব্যক্তি হুযুরে পাক (দঃ) এর সাথে একটি উষ্ট্রে আরোহণ করে চলাকালে সে উষ্ট্রকে লা'নত করল। তখন হুযুরে পাক (দঃ) তাকে বললেন, হে আল্লাহর বান্দা। লা'নতপ্রাপ্ত উষ্ট্রের পিঠে চড়ে তুমি আমাদের সাথে ভ্রমণ করো না। লা'নত তাঁর কাছে খারাপ লেগেছিল বলেই তিনি এরূপ বলেছিলেন।
লা'নতের অর্থ আল্লাহর নিকট থেকে তাড়িয়ে দেয়া এবং আল্লাহ থেকে দূরবর্তী করা। এটা জায়েয নয়। এ শব্দ ঐসব বস্তুর উপরই প্রযোজ্য যা আল্লাহ থেকে দূরবর্তী হয়ে রয়েছে। যেমন কুফরী, জুলুম ইত্যাদি। জালিম এবং কাফিরদের উপর লা'নত করা জায়েয আছে। কিন্তু তাতেও এমন শব্দ ব্যবহার করতে হবে যা' শরীয়ত মতে ব্যবহার করা যায়। কেননা লা'নতের মধ্যে দোষ-ত্রুটি আছে। লা'নতকে আল্লাহর হুকুমের উপর ছেড়ে দেয়া হয় এবং লা'নতপ্রাপ্ত বস্তু বা প্রাণীকে আল্লাহ থেকে দূরবর্তী করে দেয়া হয়। এটা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও করার অধিকার নেই। আল্লাহ যখন বলতেন, হুযুরে পাক (দঃ) তখন ব্যবহার করতেন।
অভিশাপের যোগ্যস্থলঃ অভিশাপের যোগ্যস্থল তিনটি। যথাঃ (১) কুফরী (২) বেদআত এবং (৩) বড় গুনাহ। এ তিনটি বিষয়ের প্রত্যেকটির মধ্যে লা'নতের তিনটি সোপান আছে। প্রথম সোপান হল সাধারণভাবে লা'নত করা জায়েয। যেমন, কাফিরদের উপর লানত। বেদআতীদের উপর লা'নত, বড় গুনাহগারদের উপর লা'নত। দ্বিতীয় সোপান হল, বিশেষ করে কোন সম্প্রদায়ের উপর লা'নত করা জায়েয। যথাঃ ইয়াহুদীদের উপর লা'নত, খৃষ্টানদের উপর লা'নত, কাদরিয়া সম্প্রদায়ের উপর লা'নত। খারেজী, বারাকেজী, সুদখোর জিনাকার এবং অত্যাচারীদের উপর লানত। অবশ্য বেদআত পন্থীদেরকে লা'নত করায় সন্দেহ আছে। কেননা বেদাতের পরিচয় লাভ করা খুবই সূদ্ধ এবং কঠিন ব্যাপার। হাদীস শরীফে তাদের পরিচয় ঙ্গপক কোন বর্ণনা নেই। সুতরাং সাধারণ লোকদেরকে বেদআতীদের প্রতি লা'নত করা থেকে বারণ করা উচিত। নতুবা সমাজে ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি হয়ে যাবে। তৃতীয় সোপান হল, কোন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে লা'নত করা সাধারণতঃ আয়েয নয়। যেমন, যায়েদ কাফির, ফাসেক বা বেদআতী হলে তার উপর আল্লাহর অভিসম্পাত, তার প্রতি এরূপ লা'নত করা উচিত নয়। তবে শরীয়ত যাকে লানত করেছে তার উপর লানত করা জায়েয। যথা ফিরাউনের উপর আল্লাহর লা'নত, আবুজেহেলের উপর আল্লাহর লা'নত। কেননা এটা সপ্রমাণিত ও সত্য সাব্যস্ত হয়ে গেছে যে, এরা কুফরী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে। কিন্তু বর্তমানে ব্যক্তিগতভাবে কোন কাফিরকে আল্লাহর লা'নত দেয়া উচিত হবে না। কেননা সে হয়ত মৃত্যুর পূর্বেই মুসলমান হয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারে। সুতরাং আল্লাহর করুণা হতে তাকে কিভাবে দূরে রাখা যায়? এক্ষেত্রে এরূপ একটি প্রশ্নের উদয় হতে পারে যে, কাফির ব্যক্তি যেভাবে মৃত্যুর পূর্বে মুসলমান হয়ে মুত্যুবরণ করতে পারে, তদ্রূপ মুসলমানও ঈমান হারিয়ে কাফির হয়ে মারা যেতে পারে। সুতরাং একজন মুসলমানকে যেরূপ "তোমাকে আল্লাহ রহম করুন" বলা যেতে পারে, তদ্রূপ একজন কাফিরকে অভিশাপ দেয়া যাবে না কেন?
এ প্রশ্নের উত্তর এই যে, "তোমাকে আল্লাহ রহম করুন।" এর অর্থ হল, তোমাকে আল্লাহ ঈমানের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন বা তোমার ঈমান অটল থাকুক। ঈমান অটল থাকাই আল্লাহর রহমতের ফল। এ কথার উপর ভিত্তি করে ঐ কথা বলা যায় না যে, কাফিরের উপর আল্লাহর লা'নত। কেননা এই অভিশাপের অর্থ হয় যে, কাফিরকে আল্লাহ কুফরীতে অটল রাখুন। এটা কুফরীর জন্য প্রার্থনাস্বরূপ হয়। আর এরূপ প্রার্থনা করাও কুফরী। তবে এভাবে বলা জায়েয হবে যে, তোমার উপর আল্লাহর লানত যদি তোমার কুফরীর সাথে মৃত্যু হয়। আর যদি ঈমানের সাথে মৃত্যু হয়, তবে লা'নত নেই। এ ব্যাপার ভবিষ্যতের উপর নিহিত। সুতরাং এর মধ্যে সন্দেহ থাকে। তারপর যখন কাফিরদের সম্পর্কে এই কথা, তখন ফাসেক এবং বেদআত-পন্থীদের প্রতিও লা'নত করা অনুচিত। কেননা মানুষের অবস্থা সব সময় একই রূপ বাকে না। হুযুরে পাক (দঃ) যাদের অন্তিম অবস্থা সম্বন্ধে জেনেছেন, তিনি অনেক সময়ে তাদের সম্বন্ধে লা'নত করেছেন। তিনি তাঁর প্রার্থনায় কুরায়েশদের সম্বন্ধে বলতেন, হে মাবুদ। আবু জেহেল এবং ওৎবাহকে গ্রেফতার কর। যারা কুফরীর উপর বদর যুদ্ধে নিহত হয়েছিল, তাদের নাম তিনি উল্লেখ করেছেন, কিন্তু যার অন্তিম অবস্থা তাঁর জানা ছিল না, তিনি তাকে লা'নত করতে নিষেধ করেছেন। বর্ণিত আছে যে, বীরে মাউনাতে ছাহাবীগণকে যেসব কাফির হত্যা করেছিল, তিনি একমাস ধরে দোয়াকুনুতের মধ্যে তাদেরকে লানত করেছিলেন। তখন আল্লাহতায়ালা অত্র আয়াত নাযিল করেন। যথাঃ কোন ব্যাপার তোমার আয়ত্তাধীন নয়। তিনি তাদের তাওবাহ কবুল করতে পারেন বা তাদেরকে শাস্তি দিতে পারেন। নিশ্চয়ই তারা অত্যাচারী, হয়ত তারা মুসলমান হতে পারে। সুতরাং তুমি কোথা হতে অবগত হলে যে, তারা অত্যাচারীদের উপর লা'নত। অবশ্য বেদাআত পত্নীদেরকে লা'নত করার সাবর প্রছে। কেননা বেদআতের পরিচয় লাভ করা খুবই সৃদ্ধ এবং কঠিন ব্যাপার। হাদীস শরীফে তাদের বরিজন আপক কোন বর্ণনা নেই। সুতরাং সাধারণ লোকদেরকে বেদজাতীদের প্রতি পানিত করা রোকে বারণ করা উচিত। নতুবা সমাজে ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি হয়ে যাবে। তৃতীয় দোলান হল, কোন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে লা'নত করা সাধারণতঃ জায়েয নয়। যেমন, বারেদ কাফির, কলবের বা বেদআতী হলে তার উপর আল্লাহর অভিসম্পাত, তার প্রতি এরূণ লা'নত করা উচিত নয়। তবে শরীয়ত যাকে লানত করেছে তার উপর লানত করা জায়েল। গণ্য ফিরাউনের উপর আল্লাহর লা'নত, আবুজেহেলের উপর আল্লাহর লা'নত। কেননা এটা সরমাণিত ও বরল বাধাক হয়ে গেছে যে, এরা কুফরী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে। কিন্তু বর্তমানে ব্যক্তিগতভাবে কেনে কাফিরকে আল্লাহর লা'নত দেয়া উচিত হবে না। কেননা সে হয়ত নৃত্যক পূর্বেই তুললমান এতে মৃত্যুবরণ করতে পারে। সুতরাং আল্লাহর করুণা হতে তাকে কিভাবে দূরে রাণা বায়ণ এক্ষেত্রে এরূপ একটি প্রশ্নের উদয় হতে পারে যে, কাফির ব্যাক্তি যেভাবে বৃত্যুর পূর্বে যুদলমান হয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারে, অদ্রূপ মুসলমানও ঈমান হারিয়ে কাকির হয়ে দাবা থেতে পারে। সুতরাং একজন মুসলমানকে যেরূপ "তোমাকে আল্লাহ রহম করুন" বলা যেতে পারে, অরূপ একজন কাফিরকে অভিশাপ দেয়া যাবে না কেন?
এ প্রশ্নের উত্তর এই যে, "তোমাকে আল্লাহ রহম করুন।" এর অর্থ হল, তোমাকে সাতান ঈমানের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন বা তোমার ঈমান অটল থাকুক। ঈমান অটল থাকাই সল্লাহর রহমতের ফল। এ কথার উপর ভিত্তি করে ঐ কথা বলা যায় না যে, কাফিরের উপর আল্লাহর লা'নত। কেননা এই অভিশাপের অর্থ হয় যে, কাফিরকে আল্লাহ কুফরীতে আটলা রাপুন। এটা কুফরীর জন্য প্রার্থনাস্বরূপ হয়। আর এরূপ প্রার্থনা করাও কুফরী। তবে এভাবে বলা জায়েদ। হবে যে, তোমার উপর আল্লাহর লানত যদি তোমার কুফরীর সাথে মৃত্যু হয়। আর বদি ঈমানের সাথে মৃত্যু হয়, তবে লা'নত নেই। এ ব্যাপার ভবিষ্যতের উপর নিহিত। সুতরাং এক মধ্যে সন্দেহ থাকে। তারপর যখন কাফিরদের সম্পর্কে এই কথা, তবন কাসেক এবং বেদআত-পন্থীদের প্রতিও লা'নত করা অনুচিত। কেননা মানুষের অবস্থা সব সময় একই রূপ থাকে না। হুযুরে পাক (দঃ) যাদের অন্তিম অবস্থা সম্বন্ধে জেনেছেন, তিনি অনেক সময়ে অদের সম্বন্ধে লা'নত করেছেন। তিনি তাঁর প্রার্থনায় কুরায়েশদের সম্বন্ধে বলতেন, হে মাবুদ। আবু জেহেল এবং ওৎবাহকে গ্রেফতার কর। যারা কুফরীর উপর বদর যুদ্ধে নিহত হয়েছিল, তাদের নাম তিনি উল্লেখ করেছেন, কিন্তু যার অন্তিম অবস্থা তাঁর জানা ছিল না, তিনি তাকে লাদিত করতে নিষেধ করেছেন। বর্ণিত আছে যে, বীরে মাউনাতে ছাহাবীগণকে যেসব কাফির হত্যা। করেছিল, তিনি একমাস ধরে দোয়াকুনুতের মধ্যে তাদেরকে লানত করেছিলেন। তখন আল্লাহতায়ালা অত্র আয়াত নাযিল করেন। যথাঃ কোন ব্যাপার তোমার আয়ত্তাধীন নয়। তিনি তাদের তাওবাহ কবুল করতে পারেন বা তাদেরকে শাস্তি দিতে পারেন। নিশ্চয়ই তারা অত্যাচারী, হয়ত তারা মুসলমান হতে পারে। সুতরাং তুমি কোথা হতে অবগত হলে যে, তারা অভিশাণপ্রাপ্ত। তদ্রূপ স্পষ্ট কুফরীর মধ্যে যার মৃত্যু হয়েছে, তাকে লা'নত করা বা তাকে তিরস্কার করা জায়েয, কেননা তাতে মুসলমানদেরকে কষ্ট দেয়া হয় না। হুযুরে পাক (দঃ) তায়েফ যাবার কালে হযরত আবুবকর (রাঃ)কে একটি কবর সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলে হযরত আবুবকর (রাঃ) বললেন, এ কবরটি এমন এক ব্যক্তির, যে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের বিরোধী ছিল।
তার নাম সাইদ ইবনে আস। তখন সাইদের পুত্র আমর তাঁর উপর ক্রোধান্বিত হয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (দঃ)। এই কবর ঐ ব্যক্তির যিনি আবুবকর (রাঃ)এর পিতা আবু কাহাফ থেকে অধিক খাদ্যদান করতেন এবং তার থেকে অধিক বীর পুরুষ ছিলেন। তখন হযরত আবুবকর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (দঃ)। এ লোকটির ব্যবহার দেখুন। তখন হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, হে আবুবকর। যখন তোমরা কাফিরদের কথা আলোচনা কর, তখন তা' সাধারণভাবে আলোচনা করো। নিশ্চয়ই তাদের সন্তানগণ তাদের পিতামাতার জন্য ক্রোধ করবে। সুতরাং লোকদেরকে তা' আলোচনা করতে বারণ করো।
একদা নো'মান নামক এক মুসলমান মদ পান করেছিল, ঐ দোষের জন্য হুযুরে পাক (দঃ) এর দরবারে তাকে কয়েকবার বেত্রাঘাত করা হয়েছিল। তখন একজন ছাহাবী বললেন, তার উপর আল্লাহর লা'নত। তখন হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, তোমার ভ্রাতার বিরুদ্ধে শয়তানের সাহায্যকারী হয়ো না। কোন কোন বর্ণনায় আছে যে, হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, এরূপ বলোনা কেননা সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসে, তিনি তাকে এরূপ বলতে বারণ করতেন। এতে দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তিগতভাবে কোন পাপীকে অভিশাপ দেয়া জায়েয নয়। মোটকথা ব্যক্তিগতভাবে যে কোন ব্যক্তিকে লা'নত করলে তার মধ্যে যে দোষ আছে, তা' প্রথমে পরিত্যাগ করবে।
প্রশ্নঃ ইয়াযিদকে লা'নত করা জায়েয কিনা? সে হযরত ইমাম হোসায়েন (রাঃ) কে হত্যা করেছে বা হত্যা করার আদেশ করেছে।
উত্তরঃ এ প্রশ্নের উত্তর এই যে, ইয়াযিদ যে হযরত ইমাম হোসায়েন (রাঃ) কে হত্যা করেছে, তার মূলতঃ কোন প্রমাণ নেই। তাছাড়া সে যে ইমাম হোসায়েন (রাঃ) কে হত্যা করার হুকুম দিয়েছে, তাও কোন প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত বলা যায় না। সুতরাং তাকে কি প্রকারে লা'নত করা যায়। সত্যাসত্য প্রমাণ না করে কোন মুসলমানের উপর কোন বড় পাপ আরোপ করা নাজায়েয। এ কথা সত্য বটে যে, হযরত আলী (রাঃ) ইবনে মূলজেম কর্তৃক এবং হযরত ওমর (রাঃ) আবু লুলু কর্তৃক শাহাদাত প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং তা' লোক পরম্পরায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। সুতরাং তাদের উপর লা'নত করা যায়। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, কোন লোক অন্য লোককে কাফির বা মহাপাপী বলবে না যদি সে তদ্রূপ না হয়। তবে সে ধর্মদ্রোহী হলে তাকে তা' বলা যেতে পারে। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, একব্যক্তি অন্য ব্যক্তিকে কাফির বলে সাক্ষ্য দিলে দুজনের মধ্যে একজনের উপর তা' প্রযুক্ত হবে। যদি সে কাফির হয়, তবে সে যেরূপ বলেছে তদ্রূপই হয়, আর যদি সে প্রকৃতপক্ষে কাফির না হয়, তবে যে ব্যক্তি কাফির বলেছে, সে-ই কাফির হয়। যদি মুসলমান জেনে কাউকে কাফির বলা হয়, তবে তা নাজায়েস হবে। যদি তাকে শুধু বেদআত পন্থী বলে কাফির বলা হয়, তা' তার জন্য ভুল হবে। কেননা সে কাফির নয়। হযরত মুআয (রাঃ) বলেছেন, হুযুরে পাক (দঃ) আমাকে বললেন, আমি তোমাকে কোন মুসলমানকে গালি দিতে বা কোন ন্যায় বিচারক ইমামের অবাধ্য হতে নিবেদ করছি এবং মৃত ব্যক্তির প্রতিবাদ করা জঘন্য।
হযরত মাসরুক (রহঃ) বলেছেন, আমি হযরত আয়েশা (রাঃ) এর নিকট গেলে তিনি বললেন, অমুক ব্যক্তি কি কি করেছে? তার উপর আল্লাহর লা'নত। আমি বললাম, তার মৃত্যু হয়ে গেছে। তখন হযরত আয়েশা (রাঃ) বললেন, তার উপর আল্লাহর করুণা। আমি বললাম, তা' কিরূপে হয়। তখন হযরত আয়েশা (রাঃ) বললেন, হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, সূত ব্যক্তিদেরকে গালি দিও না। কেননা তারা যা' অগ্রে পাঠিয়েছে, তা' তাদের নিকট পৌঁছেছে। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, মৃত ব্যক্তিদেরকে গালি দিও না। তদ্বারা জীবিত লোকদেরকে কাউ দেয়া হয়। তিনি বলেছেন, হে লোকগণ! আমার ছাহাবীগণ, আমার ভ্রাতৃবৃন্দ এবং আমার মাতাপিতার বিষয়ে আমাকে রক্ষা করবে। তাদেরকে গালি দিও না। হে মানবগণ। যখন কোন লোকের মৃত্যু হয়, তার সৎকার্যের কথা উল্লেখ করো।
প্রশ্ন: হযরত হোসায়েন (রাঃ) এর হত্যার আদেশকারীকে বা তাঁর হত্যাকারীকে তোমার উপর আল্লাহর লা'নত একথা বলা যাবে কিনা?
উত্তরঃ এ প্রশ্নের উত্তর এই যে, হযরত হোসায়েন (রাঃ) এর হত্যাকারী যদি তাওবাহ না করে মারা যায় তবে তার উপর আল্লাহর লানত একথা বলা সঙ্গত হবে। তবে সাধারণতঃ সে তাওবাহ করেই মৃত্যুবরণ করেছে ধরতে হবে। যদি অহশী হুযুরে পাক (সঃ)এর পিতৃব্য হযরত হামযাহ (রা)কে হত্যা করে থাকে তাহলে সে কুফরী অবস্থায় তাঁকে হত্যা করেছিল। তারপর সে তাওবাহ করে ইসলাম গ্রহণ করেছিল এবং এ হত্যার জন্যও তাওবাহ করেছিল। সুতরাং তাকে লা'নত করা জায়েয হবে না। তাঁর হত্যাকান্ডের ব্যাপার সত্য বটে কিন্তু তা' কুফরীর স্তর পর্যন্ত পৌঁছে না। এজন্য লা'নতে যদি তাওবাহর শর্ত না লাগাও তবে লা'নতের মধ্যে দোক থেকে যাবে। কিন্তু নীরবতার মধ্যে কোন দোষ নেই। সুতরাং নীরব থাকাই উত্তম।
আমরা ইয়াযিদ সম্পর্কে যা এখানে উল্লেখ করেছি তার কারণ হল, মানুষ ভালভাবে না বুঝে- শুনেই লানতের রসনা খুলে দেয়, অথচ হাদীস শরীফে এসেছে যে মু'মিন লা'নতকারী হয় না। সুতরাং লা'নতের রসনা খুলে দেয়া অনুচিত বৈ কি। তবে যে কুফরী অবস্থায় ও সুবিদিত ধর্মোদ্রোহীদের মতামত অবলম্বনের অবস্থায় মারা গিয়েছে, তাকে লা'নত করায় দোষ নেই। লা'নত করলে নির্দিষ্ট লোককে লা'নত করবে না। তার চেয়ে বরং আল্লাহর যিকিরে লিপ্ত হওয়া উত্তম। তা' না হলেও অন্ততঃ নীরবতা অবলম্বন করবে। কেননা এতে নিরাপত্তা রয়েছে।
হযরত মক্কী ইবনে ইব্রাহীম (রহঃ) বলেছেন, একদা আমরা হযরত ইবনে আওন (রাঃ) এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। লোকগণ বেলাল ইবনে আবি বোরদার বিষয় উল্লেখ করে তাকে লা'নত করে নিন্দা করতে লাগল। হযরত ইবনে আওন (রহঃ) তখন নীরব ছিলেন। লোকগণ বলল, যে ইবনে আওনা আপনার সালে সে হ্যা' করেছে, কজন্য পানরা তাকে এখানে বিল করব। তিনি বললেন, তোমাদের এই দুটি শব্দ রোজ কিয়ামতে জলসার বাদলবদল থেকে লাইলাহা ইল্লাল্লাহ শব্দ বের করে দেবে না আল্লাহর লা'নত বের করে দেবে তা আমি জানি না। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বের হওয়া অবুকের প্রতি সা'দত বের হওয়া অপেক্ষা লাফি লিব প্রদে করি।
এক ব্যক্তি হুযুরে পাক (দঃ)কে বলল, আমাকে উপদেশ দিদ। তিনি বললেন, আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি, লা'নতকারী হয়ো না। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলেছেন, পঞ্জাবর সর্বাপেক্ষা অপ্রিয় ঐ ব্যক্তি, যে মানুষকে অভিশাপ দেয় এবং পরনিন্দা করে। জনৈক বিজ্ঞ ব্যাক্তি বলেছেন, কোন মুমিনকে লা'নত করা তাকে হত্যা করার তুল্য। হরকত সাবু কাতাদাহ বলেছেন, মু'মিনকে লা'নত করলে তাকে হত্যা করার ন্যায় হয়। কোন লোককে বদদোয়া কর লা'নতের নিকটবর্তী। এমনকি অত্যাচারীকে বদদোয়া করলেও তা-ই হয়। যেমন তার পরীর আল্লাহ সুস্থ না রাখুন। তাকে আল্লাহ নিরাপদে না রাখুন ইত্যাদি। এরূপ বদদোয়া করা নিন্দনীয়।
হাদীস শরীফে এসেছে মজলুম বা নির্যাতিত ব্যক্তি জালিম বা অত্যাচারীকে বদদোয়া করলে তাতে তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়ে যায়। তারপর তার যে পুণ্য বাকী থাকে,, ত্যা রোজ কিয়ামতে অত্যাচারীর আমলনামায় চলে যাবে।
0 Comments