অশ্লীল বাক্যের সীমা ও পরিচয়


         রসনার সপ্তম বিপদ: অশ্লীল বাক্য এবং কুবচন ইত্যাদি রসনার সপ্তম বিপদ। অশ্লীল বাক্য এবং কুবচন-কুকথা শরীয়তে নিষিদ্ধ। এগুলোর উৎস অপবিত্রতা। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, অশ্লীল বাক্য পরিত্যাগ করবে। কেননা আল্লাহতায়ালা অশ্লীলতা ও সীমাতিরিক্ততা ভালবাসেন না। হুযুরে পাক (দঃ) বদরের যুদ্ধে নিহত কাফিরদেরকে তিরস্কার করতে নিষেধ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এসব নিহত কাফিরদেরকে তিরস্কার করো না। কেননা তোমাদের এ তিরস্কার তাদের নিকট পৌঁছে না; বরং তাতে জীবিত লোকদের কষ্ট হয়। সতর্ক হও, মন্দকথা ঘৃণার্হ। তিনি বলেছেন, অতিরিক্ত নিন্দাকারী, অতিরিক্ত লা'নতকারী, অতিরিক্ত অভিসম্পাতকারী, অতিরিক্ত অশ্লীল ভাষী, অতিরিক্ত বাক্যব্যয়কারী মুমিন নয়। তিনি বলেছেন, চার ব্যক্তি দোযখবাসীদেরকে কষ্টের উপর কষ্ট দেবে। তারা তাদের উত্তপ্ত পানি ও অগ্নির মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করতে থাকবে। তন্মধ্যে এক ব্যক্তির অবস্থা এমন হবে যে, তার মুখ থেকে পুঁজ ও রক্ত বের হতে থাকবে। তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, তোমার অবস্থা এরূপ হয়েছে কেন? সে বলবে, আমি যে অশ্লীল ও কুকথা বলেছি এবং তা' বলে সঙ্গম সুখের ন্যায় সুখ লাভ করেছি। তজ্জন্যই আমার এরূপ শাস্তি হচ্ছে। হুযুরে পাক (দঃ) হযরত আয়েশা (রাঃ) কে বলেছিলেন, হে আয়েশা! যদি অশ্লীল বাক্য কোন মানুষের আকৃতি ধারণ করতে পারত, তাহলে তার আকৃতি অত্যন্ত কুৎসিত হত।

        হুযুরে পাক (দঃ) আরও বলেছেন, অশ্লীল বাক্য বলা এবং বর্ণনা করা মুনাফিকির দুটি শাখা। বর্ণনা করার কয়েকটি অর্থ আছে। প্রথম অর্থঃ যে গুপ্ততত্ত্বের বিষয় প্রকাশ করা নাজায়েয, তা' প্রকাশ করার ইচ্ছে করা। দ্বিতীয় অর্থঃ বর্ণনায় অতিরঞ্জন করা। এমনকি বর্ণনায় বানাউটির সীমা পর্যন্ত উপনীত হওয়া। তৃতীয় অর্থঃ ধর্ম বিষয় এবং আল্লাহর গুণাবলী বর্ণনা করা। কেননা এ ব্যাপার অতিরিক্ত বর্ণনার চেয়ে সংক্ষেপে কর্ণের মধ্যে ঢেলে দেয়া উত্তম। অতিরিক্ত বর্ণনায় সন্দেহ উপস্থিত হতে পারে এবং শয়তান কুমন্ত্রণা দিতে পারে। কিন্তু সংক্ষেপে বর্ণনা করলে হৃদয় তা' সত্তরই কবুল করতে পারে এবং তাতে সন্দেহ না থাকতে পারে। হাদীস শরীফে অশ্লীল বাক্যের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত বর্ণনার প্রসঙ্গ আনবার উদ্দেশ্য এই যে, মানুষ তা' বর্ণনা করতে লজ্জা প্রকাশ করবে। এটা মুনাফিকির একটি শাখা।

        একথা বলার কারণ এই যে, এসব ব্যাপার গোপন করা উত্তম, প্রকাশ করা অন্যায়। হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, আল্লাহতায়ালা অশ্লীল ভাষী, অতিরিক্ত বাক্য ব্যয়কারী এবং বাজারে চীৎকারকারীকে ভালবাসেন না।

        হযরত জাবের ইবনে ছামুরাহ (রাঃ) বলেছেন, আমি একদা হযরত রাসূলে কারীম (সঃ)এর সামনে উপবিষ্ট ছিলাম। তখন আমার পিতা আমার সামনে ছিলেন। হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, অশ্লীল কথা বা অতিরিক্ত কথার কোন বিষয় ইসলামের অন্তর্গত নয়। যে ব্যক্তি স্বভাব চরিত্রে সর্বাপেক্ষা সুন্দর, সে ইসলামে সর্বাপেক্ষা উত্তম। হযরত ইব্রাহীম ইবনে মাইসারাহ বলেছেন, যে ব্যক্তি পরিষ্কার করে অশ্লীল কথা বলে, রোজ কিয়ামতে তার আকৃতি কুকুরের ন্যায় হবে বা তার আকৃতি কুকুরের উদরের ন্যায় হবে। হযরত আহনাফ ইবনে কায়েস (রহঃ) বলেন, আমি কি তোমাদেরকে মারাত্মক রোগের বিষয় সংবাদ দেব না? তা'হল অশ্লীল এবং অসৎ স্বভাব। অশ্লীল বাক্য সম্বন্ধে এরূপ তিরস্কারসমূহ উক্ত হয়েছে।

অশ্লীল বাক্যের সীমা ও পরিচয়

        প্রকাশ্য শব্দের দ্বারা অশ্লীল বিষয় উচ্চারণ করা হয় এবং অধিকাংশ সময়ে তা' সঙ্গমের শব্দগুলো বা তৎসম্পর্কিত শব্দ দ্বারা অশ্লীল বিষয় প্রকাশ করা হয়। অশান্তি সৃষ্টিকারীগণ অশ্লীল কার্য করে বলে স্পষ্টভাবে অশ্লীল কথাও বলে বেড়ায়। আর ধার্মিক লোকগণ তা' বলতে লজ্জা বোধ করে এবং তারা তা' গোপন করে রাখে এবং ইশারা ইঙ্গিতে তা' প্রকাশ করে। তারা অশ্লীল বাক্যের যা' নিকটবর্তী বা তদসম্পর্কিত হয়, তা-ই বলে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, আল্লাহতায়ালা লজ্জাশীল, সম্মানিত, ক্ষমাকারী। তিনি সঙ্গমের কথা স্পর্শ শব্দ দ্বারা বর্ণনা করেছেন। সুতরাং স্পর্শ, প্রবেশ, ছোহবত শব্দগুলি সঙ্গমের অর্থেই ব্যবহৃত হয়। এই শব্দগুলি প্রয়োগ দ্বারা অশ্লীল কথা বলা হয় না। অনেক অশ্লীল কথা আছে, যা পরিষ্কারভাবে বলা অনুচিত। সে শব্দগুলো অনেক সময়ে তিরস্কার এবং বকাবকির কালে বলা হয় বা ব্যবহার করা হয়। এগুলোর মধ্যে কোন শব্দ অন্য শব্দ হতে অধিক অশ্লীল। অনেক সময়ে স্থান ভেদেও শব্দগুলোর তারতম্য হয়। এসব অশ্লীল বাক্যের প্রথম ধাপ মাকরূহ বা নিন্দনীয় এবং শেষধাপ হারাম বা নিষিদ্ধ। মধ্যবর্তী ধাপের মধ্যে মানুষ সাধারণতঃ কতগুলো শব্দ ব্যবহার করে। তন্মধ্যে সঙ্গম সম্পর্কিত অশ্লীল কথা নেই। মলমূত্র ত্যাগের পরিবর্তে হাজত বা প্রয়োজন পূর্ণ করা শব্দ ব্যবহার করাই উত্তম। এটা গুপ্ত বস্তু এবং গুপ্ত বস্তু পরিষ্কার করে না বংল গুরুভাবেই বলা উচিত। এভাবেই অশ্লীল কথা গুপ্তভাবে বা অস্পষ্টভাবে বলতে হয়। এরূপ স্ত্রীলোক সম্পর্কিত কোন কল্য বলতে হলে সুন্দর শব্দ ব্যবহার করা উচিত। এইরূপ দলা উচিত নয়, যেমন তোমার স্ত্রী এই কথা বলেছে, বরং এইরূপ বলা উচিত যে, তোমার গৃহ থেকে এই কথা বলা হয়েছে। মোটকল্য মার্জিত এবং শালীন বাক্য ব্যবহার করতে হবে, যেন সত্য সমাজের রুটী অনুযায়ী হয়। সচেত পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে তা' অশ্লীল কথার নিকটবর্তী হয়। তন্ত্রপ দোষের কথা বা কোন রোগ-ব্যাধির কথা উল্লেখ করতে গেলেও তা' মার্জিত ভাগায় বলতে হয়। যেমন তার কঠিন রোগ হয়েছে।

        এ বিষয়গুলো রসনার বিপদের অন্তর্গত। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে হারুন (রহঃ) বলেছেন, খলীফা ওমর ইবনে আবদুল আযীযের পলদেশে একবার ফোঁড়া হয়েছিল। রসনা সংযত করা তাঁর অভ্যাস ছিল। আমরা তাঁকে দেখতে গিয়ে তাঁকে বললাম, আপনার কোন স্থানে ফোঁড়া হয়েছে? তিনি বললেন, হন্তের অনুস্পর্শিত অঙ্গে।

        অশ্লীল কথার উদ্দেশ্য কষ্ট দেয়া, যারা গুনাহগার, দুষ্কৃতিপরায়ণ এবং দুশ্চরিত্র, তাদের সাথে সংমিশ্রণের ফলে অশ্লীল কথার অভ্যাস হয়। একজন গ্রাম্য আরববাসী হুযুরে পাক (দঃ) কে বলল, আমাকে উপদেশ দিন। তিনি বললেন, আল্লাহকে ভয় করবে। যদি কেউ কোন ব্যাপারে তোমাকে তিরস্কার করে এবং তা' যদি তোমার মধ্যে আছে বলে সে জানে, তুমি তার মধ্যে তোমার জানা মতে এমন কোন ব্যাপার নিয়ে তাকে তিরষ্কার করো না। তার শাস্তি তার উপর যাবে এবং তোমার পুণ্য হবে। কোন বস্তুকে তিরস্কার করো না, গ্রাম্য আরববাসী বলল, আমি এরপর আর কাউকে তিরস্কার করি নি।

        হযরত ইয়াজ ইবনে হেমার (রাঃ) বলেছেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ (দঃ)। আমার কাওমের মধ্যে একটি লোক আমাকে তিরস্কার করে অথচ সে আমা থেকে হেয়। তার থেকে প্রতিশোধ গ্রহণে আমার কি কোন বাঁধা আছে? তিনি বললেন, পরস্পর তিরস্কারকারী উভয়ই শয়তান। তারা পরস্পরকে মিথ্যাবাদী বলে এবং পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপ করে। তিনি আরও বলেছেন, মু'মিনকে তিরস্কার করলে পাপ হয় এবং তাকে হত্যা করলে কুফরী হয়। তিনি বলেছেন, দুজন তিরস্কারকারী তাদের তিরস্কারের উপর থাকলে তন্মধ্যে যে প্রথম তিরস্কার করে, তার উপর পাপ বর্তে। এমন কি তিরষ্কৃত ব্যক্তি সীমা অতিক্রম করলেও প্রথম তিরস্কারকারীর উপর তা' বর্তে। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি তার পিতা-মাতাকে গালি দেয়, সে অভিশপ্ত। অন্য বর্ণনায় আছে, পিতামাতাকে গালি দেয়া মহাপাপগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ পাপ। ছাহাবীগণ আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (দঃ)। এমন কোন নরাধম আছে, যে নিজ পিতামাতাকে গালি দেয়? তিনি বললেন, সে অপরের পিতামাতাকে গালি দেয় এবং অপরে তার পিতাকে গালি দেয় এতেই তার নিজের পিতামাতাকে গালি দেয়া হয়।


Post a Comment

0 Comments