হযরত ইব্রাহীম (আ) জাতিকে ইসলামের প্রতি আহ্বান ও তার প্রতিক্রিয়া

 

        ইব্রাহীম (আ)এর পিতা যখন তাঁর হেদায়ত ও নসীহত কবুল করল না, তখন হযরত ইব্রাহীম তাঁর পিতা আষর হতে পৃথক হয়ে গেলেন এবং নিজের সত্যের দাওয়াত ও দ্বীন প্রচারকে আরো ব্যাপক করে দিলেন। এখন শুধু আযরই সম্বোধনের লক্ষ্যস্থল রইল না; বরং গোটা জাতিকে সম্বোধনের লক্ষ্যস্থল করে নিলেন। কিন্তু তাঁর জাতির লোকেরা নিজেদের পূর্বপুরুষের ধর্ম ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিল না। তারা ইব্রাহীম (আ) এর কোন কথাই শুনল না এবং সত্যের দাওয়াতের সম্মুখে নিজেদের দেবদেবীদের মতই তারা বোবা, অন্ধ এবং বধির হয়ে গিয়েছিল।

        তাদের কান ছিল, কিন্তু সত্যের আওয়ায় শ্রবণে বধির ছিল। তাদের চক্ষু ছিল, কিন্তু সত্য দর্শনে অপ্রস্তুত ছিল, তাদের বাকশক্তি ছিল, কিন্তু সত্য কথা উচ্চারণে বোবা ছিল। এ মর্মে সূরা আ'রাফে আল্লাহ্ বলেন:

لهم قلوبٌ لا يَفْقَهُونَ بِهَا وَلَهُمْ أَعْيُنٌ لَا يَبْصُرُونَ بِهَا وَلَهُمْ أَذَانَ لا يَسْمَعُونَ بِهَا . أولَئِكُمْ كَالأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ أُولَئِكَ هُمُ الْعَمَلُونَ - (الْأَعْرَافُ)

            অর্থাৎ: "তাদের অন্তর আছে, কিন্তু তা দ্বারা তারা উপলব্ধি করতে পারে না, তাদের চক্ষু আছে, কিন্তু তা দ্বারা দেখে না এবং তাদের কান আছে, কিন্তু তা দ্বারা শ্রবণ করে না, তারা পশুর ন্যায়; বরং তাদের চেয়েও অধিক পথভ্রষ্ট। তারাই গাফিল। -(সূরা আ'রাফ: ১৭৯)

        আর যখন ইব্রাহীম (আ) তাদেরকে বলিষ্ঠভাবে জিজ্ঞেস করলেনঃ বল তো, তোমরা যাদের পূজা করছ, তারা কি তোমাদের কোন উপকার বা ক্ষতি করতে পারে? তারা বলল, আমরা এ সব বিষয়ে বিতর্কে লিপ্ত হতে চাই না। আমরা কেবল এটাই জানি যে, আমাদের পূর্বপুরুষ এসবের পূজা করে আসছেন। আমরাও তাই করেছি। তখন হযরত ইব্রাহীম (আ) এক বিশেষ পদ্ধতিতে এক আল্লাহর অস্তিত্বের প্রতি তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে বলতে লাগলেন, আমি তো তোমাদের এসব মূর্তিকে আমার শত্রু মনে করেছি। অর্থাৎ তাদের থেকে নির্ভীক হয়ে তাদের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করছি। তারা যদি আমার কোন ক্ষতি করতে সক্ষম হয়, তবে নিজেদের সখ মিটিয়ে বা আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করে নিক।

         অবশ্য আমি শুধু সেই সত্তাকে আমার মালিক মনে করছি, যিনি সারা জাহানের প্রতিপালক। যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং সত্য ও সরল পথ দেখিয়েছেন। যিনি আমাকে খাদ্য ও পানীয় দান করেন। আর যখন আমি রুগ্ন হয়ে পড়ি তখন আমাকে সুস্থতা দান করেন, যিনি আমার জীবন ও মৃত্যুর মালিক। আর আমি কোন অপরাধ বা ত্রুটি করে ফেললে যাঁর দরবারে আশা রাখি যে, তিনি আমাকে কিয়ামতের দিন ক্ষমা করে দেবেন। আর আমি তাঁর দরবারে এ প্রার্থনাই করছি যে, হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমাকে সঠিক মীমাংসার শক্তি দান করুন। আর আমাকে মুখের সত্যতা দান করুন। আর আমাকে জান্নাতুন নাঈমের উত্তরাধিকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন। হযরত ইব্রাহীম (আ) যে নসীহত ও উপদেশাবলি নিজের পিতা ও সম্প্রদায়ের সম্মুখে পেশ করলেন, তা সূরা শু'আরায় বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে।

         "আর তাদেরকে ইব্রাহীমের সংবাদ পাঠ করে শুনিয়ে দিন, যখন তিনি তাঁর পিতা ও তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন, তোমরা কিসের পূজা করছ? তারা বলল, প্রতিমার পূজা করছি এবং নিষ্ঠারসাথে তাদের পূজায় নিরত থাকব। তিনি (ইব্রাহীম আ) বললেন, যখন তোমরা তাদেরকে ডাক, তখন তারা তোমাদের কথা কি কিছু শুনে? তোমাদের কি কোন উপকার কিংবা কোন ক্ষতি করতে পারে? তারা বলল না, তবে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে এরূপই করতে দেখেছি। তিনি বললেন, তোমরা কি তাদের সম্বন্ধে চিন্তা করে দেখেছ যাদের পূজা করছ। তোমরা এবং তোমাদের পূর্বপুরুষরা? তারা আমার শত্রু কিন্তু রব্বুল আলামীন আল্লাহ্ যিনি আমাকে সৃষ্টি করেন, অনন্তর তিনি আমাকে সৎপথ প্রদর্শন করেন, আমাকে খাদ্য দান করছেন, পানীয় দান করছেন। আর যখন আমি পীড়িত হয়ে পড়ি, তখন তিনিই আমাকে সুস্থতা দান করেন। আর তিনিই আমাকে মৃত্যু দান করবেন অতঃপর আবার জীবিত করবেন এবং আশা রাখি যে, আমার ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো তিনি কিয়ামতের দিন ক্ষমা করবেন। হে আমার প্রতিপালক! আমাকে জ্ঞান দান করুন। আর আমাকে সৎকর্ম পরায়ণদের শামিল করুন। আর পরবর্তী লোকদের মধ্যে আমাকে যশস্বী করুন। আর আমাকে সুখময় জান্নাতের অধিকারীদের দলভুক্ত করুন। আর আমার পিতাকে ক্ষমা করুন, তিনি পথভ্রষ্টদের মধ্যে শামীল ছিলেন। আর যে দিন সকলে পুনরায় জীবিত হয়ে উঠবে সেদিন আমাকে লজ্জিত করবেন না। যে দিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন কাজে আসবে না। সে দিন উপকৃত হবে কেবল সে, যে আল্লাহর নিকট বিশুদ্ধ অন্তকরণ নিয়ে আসবে। (সূরা শু'আরা: ৬৯-৮৯)

        কিন্তু আযর ও তার সম্প্রদায়ের অন্তর কোনক্রমেই সত্যকে কবুল করার জন্য নরম হল না এবং তাদের অবিশ্বাস ও অস্বীকৃতি সীমা ছাড়িয়ে যেতে লাগল।

        ইতিপূর্বে একথা উল্লেখ করা হয়েছে যে, হযরত ইব্রাহীম (আ) এর জাতি মূর্তিপূজার সাথে সাথে নক্ষত্রেরও পূজা করত এবং তাদের এই আক্বীদা ছিল যে, মানুষের মৃত্যু ও জীবন, তাদের রিযিক, তাদের লাভ-লোকসান, অজন্ম ও দুর্ভিক্ষ, জয়-পরাজয় মোটকথা, জগতের যাবতীয় কার্যের শৃঙ্খলা নক্ষত্রসমূহ এবং তাদের গতিবিধির প্রভাবেই চলছে এবং এ প্রভাব তাদের নিজস্ব গুণাবলির অন্তর্গত। সুতরাং তাদেরকে সন্তুষ্ট রাখা অবশ্য কর্তব্য। আর তা তাদেরকে পূজা করা ছাড়া সম্ভব নয়। অতএব, হযরত ইব্রাহীম (আ) যেভাবে তাদের নিম্নজগতের বাতেল মা'বুদগুলোর স্বরূপ উদঘাটিত করে দিয়ে তাদেরকে সত্য পথের দিকে আহ্বান করলেন, তাদের উর্ধ্বজগতের আদিজেলার স্বরূপ মা'বুদগুলোরও স্বরূপ উদঘাটন করে তাদেরকে সত্যপথের দিকে আহব্বান করলেন। কিন্তু এ বাতিলের পূজকিরা নিজেদের স্বহস্তে নির্মিত মূর্তিকে এত ভয় করত যে, তাদের নিন্দাকারীদের জন্য কল্পনা করতঃ তারা এদের জতোলে বিশাল হয়ে যাবে। তখন তাই কল্পনার পূজারীদের অন্তরে ঊর্ধ্ব জগতের সেই নক্ষত্র পূজার বিরুদ্ধে বিপরীত প্রেরণা সৃষ্টি করা কোন সহজ কাজ ছিল না, সুতরাং মুজাদ্দিদে আম্বিয়া হযরত ইব্রাহীম (আ) তাদের  মস্তিষ্কের উপযোগী এক বিচিত্র ও চিত্তাকর্ষক বর্ণনা পদ্ধতি অবলম্বন করলেন।

        রাত ছিল নক্ষত্রপূর্ণ, তন্মধ্যে একটি ছিল অত্যন্ত দীপ্তিমান। হযরত ইব্রাহীম (আ) তাকে দেখে বললেন, এটিই কি আমার খোদা? কিন্তু যখন তা নির্ধারিত সময়ে অদৃশ্য হয়ে গেল তখন হযরত ইব্রাহীম (আ) বললেন, আমি আত্মগোপনকারীদেরকে পছন্দ করি না। আবার দৃষ্টি করে দেখতে পেলেন, চন্দ্র অতিশয় দীপ্তি ও আলোর সাথে সম্মুখে বিদ্যমান। তিনি চন্দ্রকে দেখে বললেন, এটা কি আমার খোদা?

        ভোর ঘনিয়ে আসল, ক্রমে ক্রমে চন্দ্রের আলোও নিষ্প্রভ হয়ে আসতে লাগল, তারও আত্মগোপন করার সময় এসে পৌঁছল। আর যতই সূর্যোদয়ের সময় ঘনিয়ে আসতে লাগল ততই চাঁদের অস্তিত্ব দর্শকদের দৃষ্টিপথ থেকে অদৃশ্য হতে লাগল, তা দেখে ইব্রাহীম বললেন, "আমার প্রকৃত পরওয়ারদেগার যদি আমাকে পথ প্রদর্শন না করেন, তবে আমিও অবশ্যই পথভ্রষ্ট সম্প্রদায়েরই অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ব।" এতটুকু বলেই নীরব হয়ে গেলেন।

        নক্ষত্রপূর্ণ রাত অবসান হল, নক্ষত্র, চন্দ্র সবকিছুই দৃষ্টি পথ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল কেন? এজন্য যে, বিশ্ব উজ্জ্বলকারী সূর্যের দীপ্তিমান চেহারা এখন সম্মুখে আসছে। দিবা উদ্ভাসিত হল এবং সূর্য আলো ও দীপ্তির সাথে দীপ্তিমান হতে লাগল।

        ইব্রাহীম (আ) তা দেখে বললেন, এটাই আমার খোদা। কেননা, গ্রহাদির মধ্যে তা সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সৌরজগতে তার চেয়ে বড় গ্রহ আমাদের সামনে দ্বিতীয়টি নেই। কিন্তু সারাদিন দীপ্তিমান ও আলোময় থাকার এবং সমগ্র বিশ্বকে আলোকিত করার পর নির্ধারিত সময়ে তাও ইরাকের ভূখণ্ড থেকে সরে পড়তে লাগল। অন্ধকার রাত ক্রমে ক্রমে সামনে আসতে লাগল এবং অবশেষে সূর্যও দৃষ্টিপথ হতে অদৃশ্য হয়ে গেল। এখন সময় এসে পৌছল যে, ইব্রাহিম (আ) প্রকৃত তথ্য ঘোষণা করে দিয়ে কাওমকে নিরুত্তর করে দেন, তারা যেন ভাবতে বাধ্য হয় যে, তাদের আক্বীদা অনুযায়ী যদি এসব গ্রহ-নক্ষত্রাদি মা'বুদ হওয়ার অধিকারী হয়, তবে কি কারণে তাদের মধ্যে আমাদের চেয়েও অধিক পরিবর্তন ও অস্থায়িত্ব দেখা যায়? এবং কেন তারা অতি তাড়াতাড়ি পরিবর্তনের ও অস্থায়িত্বের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে যায়। তারা ইলাহ হয়ে থাকলে তারা অস্তমিত হয় কেন? যেরূপ ভাবে দীপ্তিমান ও উজ্জ্বল দৃষ্ট হচ্ছিল তদ্রূপ উজ্জ্বল ও দীপ্তিমান থাকে না কেন? ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরকাগুলোর আলোকে চাঁদের আলো অনুজ্জ্বল কেন করে দিল? চন্দ্রের উজ্জ্বল চেহারাকে সূর্যের আলো কেন আলো বিহীন করে দিল?

        অতএব, হে আমার জাতির লোকেরা। আমি এসব শিরকমূলক আক্বীদা হতে পবিত্র এবং শিরকের বন্দেগীর প্রতি অসন্তুষ্ট। নিঃসন্দেহে আমি আমার মনোযোগকে শুধু এক আল্লাহ দিকে ফিরিয়ে দিয়েছি। যিনি আকাশমণ্ডল ও ভূ-মণ্ডল সৃষ্টি করেছেন। আমি সত্যের প্রতি আকৃষ্ট, মুশরিক নই।

        এখন তাঁর সম্প্রদায় বুঝতে পারল। ইব্রাহীম (আ) আমাদের সকল অস্ত্র অকেজো করে দিলেন এবং আমাদের সমুদয় প্রমাণকে পদদলিত করে দিলেন। এখন আমরা ইব্রাহীম (আ) এর এ মযবুত ও কঠিন প্রমাণকে কেমন করে খণ্ডন করি এবং তার এ স্পষ্ট প্রমাণের কি উত্তর দেই? তারা এর জন্য সম্পূর্ণ অক্ষম ও অপারগ ছিল। যখন কোন উপায়ই খুঁজে পেল না, তখন কিছু বলা এবং সত্যের আওয়াজকে কবুল করার পরিবর্তে ইব্রাহীম (আ)এর সাথে তারা বিতর্কে লিপ্ত হল এবং তাদের বাতিল খোদাদের ভয় দেখাতে আরম্ভ করল যে, তারা তোমরা এই অপমানের প্রতিশোধ অবশ্যই তোমা হতে গ্রহণ করবে এবং তোমাকে তার দণ্ড অবশ্যই ভুগতে হবে।

        হযরত ইব্রাহীম (আ) বললেন, তোমরা আমার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছ এবং আমাকে তোমাদের দেব দেবীর ভয় দেখাচ্ছ, অথচ আল্লাহ্ তা'আলা আমাকে সঠিক পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। আর তোমাদের কাছে গোমরাহী ছাড়া আর কিছুই নেই। আমি তোমাদের মূর্তিসমূহের কোনই পরোয়া করি না, আমার প্রতিপালক যা চাইবেন তাই হবে। তোমাদের মূর্তিগুলো কিছুই করতে পারবে না। এসব কথা থেকে তোমাদের কি কিছুই উপদেশ লাভ হয় না? তোমরা তো আল্লাহর নাফরমানী করতে এবং তাঁর সাথে শরীক সাব্যস্ত করতে ভয় কর না। অথচ এ' শরীক সাব্যস্ত করার পক্ষে তোমাদের নিকট কোন দলিলও নেই। আর আমা হতে আশা কর যে, এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী হয়ে আমি তোমাদের মূর্তিসমূহকে ভয় করব। আহা! কতই না ভাল হত যদি তোমরা বুঝতে পারতে যে, কে ফাসাদ বিস্তারকারী আর কে সংশোধনকারী? সঠিক নিরাপত্তার জীবন সেই ব্যক্তিই লাভ করেছে যে ব্যক্তি এক আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে এবং শিরক হতে পবিত্র থাকে।

       এ প্রসঙ্গে কোরআনুল কারীমে আল্লাহ বলেন- "আর এরূপে আমি ইব্রাহীমকে আকাশমণ্ডলী পৃথিবীর পরিচালনা ব্যবস্থা দেখাই। যাতে সে নিশ্চিত বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। অতঃপর যখন তাঁর উপর রাতের অন্ধকার ছেয়ে গেল, তখন তিনি একটি নক্ষত্র দেখিয়ে বললেন, এটা আমার প্রতিপালক কিন্তু যখন তা ডুবে গেল, তখন বললেন না, আমি অস্তাচলে গমনকারীদেরকে পছন্দ করি না। অতঃপর যখন চন্দ্রকে সমুজ্জ্বলরূপে উদিত হতে দেখলেন তখন তিনি বললেন, এটাই আমার প্রতিপালক, কিন্তু যখন তাও অস্তমিত হলো তখন বললেন, আমার প্রতিপালক আমাকে সঠিক পথ প্রদর্শন না করলে আমি অবশ্যই সেই দলেরই অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ব, যারা সত্যপথ হতে ভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছে। অতঃপর যখন প্রভাত হল এবং সূর্য প্রদীপ্ত হয়ে উদিত হতে দেখলেন তখন বললেন, এতো আমার প্রতিপালক, কেননা, এটা সকলের চেয়ে বড়। কিন্তু যখন তাও অস্তমিত হয়ে গেল, তখন তিনি বললেন, (হে আমার কাওম!) তোমরা যে সবকে আল্লাহর শরীক সাব্যস্ত করছ, তৎসমুদয়ের সাথে আমার কোণ সম্পর্ক নেই। আমি সবকিছু হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সেই সত্তার দিকে আমার মুখ করেছি যিনি আকাশ মণ্ডল ও ভূ-মণ্ডল সৃষ্টি করেছেন আর আমি তাদের দলভুক্ত নই, যারা আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করে। এবং তাঁর জাতি তাঁর সাথে বিতর্কে লিপ্ত হল। বললেন, তোমরা কি আমার সাথে আল্লাহ সম্বন্ধে ঝগড়া করছ? অথচ তিনি আমাকে সত্যপথ দেখিয়েছেন। যাদেরকে তোমরা আল্লাহ তা'আলার শরীক সাব্যস্ত করছ, আমি তাদেরকে ভয় করি না। আমি জানি যে, তারা আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তবে হ্যাঁ, যদি আমার প্রতিপালকই আমার কোন ক্ষতি করতে ইচ্ছা করেন, তবে সবকিছু তাঁরই জ্ঞানায়ত্তে। তবুও কি তোমরা অণুধাবন করবে না। তোমরা যাকে আল্লাহর সাথে শরীক কর আমি তাকে কিরূপে ভয় করব। যখন তোমরা আল্লাহর সাথে অন্যান্য বস্তুকে শরীক সাব্যস্ত করতে ভয় কর না? যার জন্য তিনি কোন সনদ এবং দলিল তোমাদের উপর নাযিল করেন নি? এখন বল, আমাদের উভয়ের মধ্যে কার পথ নিরাপত্তার পথ? যদি তোমাদের জ্ঞান ও অন্তর-চক্ষু থাকে। যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে এবং নিজের ঈমানকে যুলুমের সাথে মিশ্রিত করে নি, তাদেরই জন্য নিরাপত্তা আর তারাই হক পথের উপর রয়েছে। আর এটা আমার যুক্তি প্রমাণ যা আমি ইব্রাহীমকে দিয়েছিলাম তার সম্প্রদায়ের মোকাবিলায়। আমি যার মর্যাদাকে উচ্চ করতে ইচ্ছা করি, তারে ইলম ও দলীল প্রমাণের পরিচয় জ্ঞান দিয়ে উচ্চ মর্যাদাশালী করে দেই আর নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক প্রজ্ঞাময়, জ্ঞানময়। (সূরা আন'আমঃ৭৫-৮৩)

        ইব্রাহীম (আ) এর এ কথাগুলো ছিল তাঁর জাতির নক্ষত্র পূজা খণ্ডন সম্বন্ধে, তাদেরকে নিরুত্তর করে দেয়ার জন্য। কেননা, দুটি দল যখন কোন বিষয়ে মতভেদ করে বসে, তখন সত্যকে প্রমাণিত করার জন্য বিতর্কসুলভ দলিলসমূহের এক প্রকারের দলিল এরূপও আছে যে, নিজেদের দাবী প্রমাণে শুধু থিওরীসমূহ পেশ না করে চাক্ষুষ দর্শনের এমন একটি পথ অবলম্বন করা হয় যে, বিপক্ষ তার দাবীর মোকাবেলায় সম্পূর্ণ নিরুত্তর হয়ে যায়। প্রথম পক্ষের প্রমাণ খগুনের সকল পথ তার সম্মুখে বন্ধ হয়ে যায়। এখন যদি বিপক্ষের মধ্যে হঠকারিতা না থাকে বরং ন্যায়ের পথ অবলম্বনের স্পৃহা তার মধ্যে অবশিষ্ট থাকে, তবে সে তা কবুল করে নেয় অন্যথায় বিনা প্রমাণে লড়াই ঝগড়া ফাসাদ করতে প্রস্তুত হয়ে যায়। তখন এরূপে হক বাতিলের মধ্যে পার্থক্য ফুটে উঠে এবং মূল ও প্রকৃত বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়।

         হযরত ইব্রাহীম (আ) আল্লাহর নবী। সুতরাং তাঁর মিশন তর্কশাস্ত্রের নিয়ম-কানুনের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না বরং প্রকৃত তথ্যকে প্রাকৃতিক প্রমাণসমূহের সরলতা দিয়ে প্রকাশ করে দেয়াই ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য। সুতরাং তিনি এ পথই অবলম্বন করলেন, এবং সম্প্রায়ের সামনে পরিষ্কার করে দিলেন যে, গ্রহাদি- চন্দ্র, সূর্য, তারকা যাই হোক না কেন, এরা রব ও ইলাহ্ হওয়ার যোগ্য নয় বরং রব হওয়া তাঁরই জন্য শোভনীয় হয়, যিনি রব্বুল আলামীন যেহেতু সম্প্রদায়ের কাছে এ উৎকৃষ্ট প্রমাণের কোন জবাব ছিল না, সুতরাং তারা বিরক্ত হয়ে সত্য কবুল না করে লড়াই ও ঝগড়া করতে প্রস্তুত হয়ে গেল। কিন্তু তাদের অন্তর একথা মানতে বাধ্য হল যে, ইব্রাহীম (আ) যা কিছু বলেছেন তা সত্য। আমাদের নিকট তার কোন সঠিক জবাব নেই। আর হযরত ইব্রাহীম (আ) এরও উদ্দেশ্য ছিল তাই।

আল্লাহ বলেন-

إِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ لِأَبِيْهِ أَذَرَ أَتَتَّخِذُ أَصْنَامًا آلِهَةً إِنِّي أَرَاكَ وَقَوْمَكَ فِي ضَلِيلٍ مُّبِينِ وكذلك تُرِى إِبْرَاهِيمَ مَلكوت السمواتِ وَالْأَرْضِ وَلِيَكُونَ مِنَ الْمُوْقِنِينَ - (الْأَنْعَامُ)

        অর্থাৎঃ "স্মরণ করুণ, যখন ইব্রাহীম (আ) তাঁর পিতা আযরকে বললেন, আপনি কি মূর্তিগুলোকে ইলাহরূপে গ্রহণ করছেন? আমি আপনাকে ও আপনার সম্প্রদায়কে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতার মধ্যে দেখছি। আর এরূপে আমি ইব্রাহীমকে আকাশ ও পৃথিবীর পরিচালন ব্যবস্থা দেখাই, যাতে তিনি নিশ্চিত বিশ্বাসীদের দলভুক্ত হয়ে যান।" -(সূরা আন'আম : ৭৪-৭৫)

        এ আয়াত দুটি হতে নিম্নরূপ ফল প্রকাশ পাচ্ছে:

    ১। গ্রহাদি দর্শন ব্যাপারটি হযরত ইব্রাহীম (আ) এর সাথে এরূপ সময়ে ঘটেছিল যখন তিনি আপন পিতা ও স্বীয় সম্প্রদায়ের সাথে সত্য প্রচার সম্বন্ধীয় বিতর্কে লিপ্ত ছিলেন।

    ২। আল্লাহ্ তা'আলা ইব্রাহীম (আ)কে যেভাবে প্রতিমা পূজার বিরুদ্ধে উজ্জ্বল প্রমাণ দান করেছিলেন, যেন তিনি আষর এবং তাঁর জাতিকে নিরুত্তর করে দিতে পারেন এবং হেদায়াতের পথ দেখাতে পারেন। এরূপে গ্রহাদি পূজার বিরুদ্ধেও তিনি (ইব্রাহীম আ) কে আকাশ ও পৃথিবীর পরিচালন ব্যবস্থা দেখিয়ে দিয়েছেন যেন তিনি সমুদয় সৃষ্টির গৃঢ়তত্ত্ব সম্বন্ধে অবহিত হতে পারে এবং তিনি দিব্য স্তরের জ্ঞান লাভ করেন। অতঃপর তিনি গ্রহাদির পূজার বিরুদ্ধেও উৎকৃষ্ট প্রমাণ পেশ করতে পারেন। এ বিষয়েও সম্প্রদায়কে সত্যপথ দেখাতে এবং তাদের এ ভুলপন্থা সম্বন্ধে তাদেরকে নিরুত্তর করে দিতে পারেন। এসব "দেখিয়ে দেয়ার আয়াতটি ছিল পূর্বের আয়াত, এবার শেষের আয়াতটির প্রতি লক্ষ করুন: যখন ইব্রাহীম (আ) সূর্যের দিকে তাকালেন এবং তাও যখন দৃষ্টিপথ হতে অদৃশ্য হতে শুরু করল, তখন এ আয়াতেই এ বাক্যটি দেখা যায়।

قال يقوم التي يرى مِمَّا تُشْرِكُونَ .

        অর্থাৎ: "(ইব্রাহীম) বললেন, হে আমার সম্প্রদায়। আমি অংশীবাদীদের থেকে সম্পূর্ণ নিঃসম্পর্ক। আর তারই সঙ্গে এ আয়াতটি উল্লেখিত রয়েছে।

إنِّي وَجَهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَوتِ وَالْأَرْضَ حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ. (الانعام)

        অর্থাৎঃ "নিশ্চয়ই, আমি একনিষ্টভাবে তাঁর দিকে মুখ ফিরাচ্ছি যিনি আসমান ও যমিন সৃষ্টি করেছেন, আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।" (সূরা আন'আম ৭৯)

وحاجة قومه ، قَالَ أَتَحَاجُّونِي فِي اللهِ .

        অর্থাৎ: "আর ইব্রাহীমের সম্প্রদায় তাঁর সাথে বিতর্কে লিপ্ত হল, তিনি বললেন, তোমরা কি আল্লাহ সম্বন্ধে আমার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হচ্ছ?"

        আর সর্বশেষ আয়াতে বলা হয়েছে:

وَتِلْكَ حُجَّتُنَا أَتَيْنَهَا ابْرَاهِيمَ عَلَى قَوْمِهِ تَرْفَعُ دَرَجَتٍ مِّنْ نَشَاءُ إِنَّ رَبَّكَ حَكِيمٌ عَلِيمٌ (الانعام)

        অর্থাৎঃ "আর এটা আমার যুক্তি প্রমাণ যা আমি ইব্রাহীমকে তার সম্প্রদায়ের মোকাবেলায় দান করেছি। অমি যার মর্যাদা উন্নত করতে ইচ্ছ্য করি, উন্নত করে দেই। নিঃসন্দেহ, আপনার রব প্রজ্ঞাময়, জ্ঞানী।" (সূরা আন‌আম: ৮৩)

        এ আয়াতগুলো হতে নিম্নোক্ত ফলসমূহ লাভ হয়:

     ১। গ্রহাদি দেখার ব্যাপারটি সম্প্রদায়ের সাথে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট ছিল। সুতরাং তৃতীয় দফায় ইব্রাহীম (আ) নিজেকে সম্বোধন করার পরিবর্তে তৎক্ষণাৎ সম্প্রদায়কে সম্বোধন আরম্ভ করে দেন।

    ২। আর তাঁর সম্প্রদায়ও সবকিছু শুনে প্রমাণের উত্তর প্রমাণ দ্বারা দেয়ার পরিবর্তে ইব্রাহীম (আ)এর সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়।

    ৩। সম্প্রদায়ের সাথে ইব্রাহীম (আ) এর প্রমাণ প্রদানকে আল্লাহ্ নিজের পক্ষ থেকে প্রমাণ প্রদান সাব্যস্ত করেছেন। আল্লাহ ইব্রাহীম (আ) সম্বন্ধে এটাও বলেছেনঃ

ولَقَدْ أَتَيْنَا إِبْرَاهِيمَ رُشْدَهُ مِنْ قَبْلُ وَكُنَّا بِهِ عَالِمِينَ - (أَنْبِيَاءُ)

        অর্থাৎঃ "আর নিঃসন্দেহে, আমি এর পূর্বে ইব্রাহীমকে সৎপথের জ্ঞান দিয়েছিলাম। আর আমি তার সম্বন্ধে অবহিত ছিলাম।" -(সূরা আম্বিয়া: ৫১)

        সুতরাং এই ব্যাপারটি হযরত ইব্রাহীমের বাল্যকালের ঘটনাও হতে পারে না এবং তার নিজের আক্বীদা এবং ঈমানের ব্যাপারও হতে পারে না। এই বিস্তারিত বর্ণনা থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, আমার বর্ণিত তাফসীরই আয়াতগুলোর বিশুদ্ধ তফসীর। আর নিঃসন্দেহে তা ইব্রাহীম (আ) এর পক্ষ হতে কাওমের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রমাণ ছিল। এ বিষয়ে যে, সম্প্রদায়ের লোকদের গ্রহাদারি পূজা করা, তাদের জন্য মন্দির নির্মাণ করা, নিজেদের নিম্নজগতের দেবতাসমূহের নাম উক্ত গ্রহাদির নামানুযায়ী রাখা। মোটকথা, তাদেরকে ইলাহ্ ও রব মনে করা নিশ্চিতরূপে বাতিল এবং পথভ্রষ্টতা। কেননা, এ সমুদয় গ্রহ নক্ষত্রাদি সকলেই এক বিশেষ শৃঙ্খলে জড়িত এবং দিবা ও রাতের পরিবর্তনের সাথে নানা প্রকার পরিবর্তন কবুল করে। এই পূর্ণ শৃঙ্খলার মালিক এবং স্রষ্টা শুধু সেই মহা শক্তিমান সত্তাই যাঁর কুদরতের হস্ত এ সমুদয়কে বশীভূত করে রেখেছে এবং তিনি "আল্লাহ্”। আল্লাহর বশীভূত থাকার ফলেঃ

  لا الشَّمْسُ يَنْبَغِي لها أن تدرك القَمَرُ وَلَا الَّيْلُ سَابِقُ النَّهَارِ .

        অর্থাৎ: "সূর্যের পক্ষে সম্ভব নয় যে, সে চন্দ্রকে ধরতে পারে এবং রাতের পক্ষে সম্ভব নয় যে, সে দিনকে পেছনে হটিয়ে দিয়ে তার স্থান নিজে গ্রহণ করে। (সূরা ইয়াসীনঃ ৪০)

        সোটকথা, এসব উজ্জ্বল প্রমাণ ও অকাটা দলিলের পরেও যখন সম্প্রদায় ইসলামের দা'ওয়াত কবুল করল না, মূর্তিপূজা ও নক্ষত্রাদি পূজাতেই পূর্ববৎ বহাল রইল, তখন হযরত ইব্রাহীম (আ) একদিন সর্ব সাধারণের সামনে ঘোষণা করে দিলেন যে, আমি তোমাদের এ মূর্তিগুলো সম্বন্ধে এমন এক ব্যবস্থা গ্রহন করব যা তোমাদেরকে উত্ত্যক্ত করেই ছাড়বেঃ

وَتَاللهِ لَاكِيدَنَّ أَصْنَامِكُمْ إِن تَوَلُّوا مُدْبِرِينَ - (أَنْبِيَاء )

        অর্থাৎঃ "আর আল্লাহর কসম! তোমরা চলে গেলে আমি তোমাদের মূর্তিগুলো সম্বন্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহন করব।" -(সূরা আম্বিয়া: ৫৭)

        কাওমের লোকেরা হযরত ইব্রাহীম (আ) এর এ ঘোষণার দিকে কোন মনোযোগই দিল না। অল্প কিছু দিন পরেই কাওমের এক ধর্মীয় মেলা আসল। সকলেই উক্ত মেলায় যেতে লাগল, ইব্রাহীম (আ) কেও মেলায় যোগদানের জন্য পীড়িপীড়ি করতে লাগল। হযরত ইব্রাহীম (আ) প্রথমে অস্বীকার করলেন। অতপর যখন তাদের পক্ষ থেকে খুব বেশী চাপ দিতে লাগল, তখন তিনি নক্ষত্রসমূহের দিকে তাকিয়ে বললেন, "আমি আজ অসুস্থ বোধ করছি।" ইব্রাহীম (আ) এর সম্প্রদায় নক্ষত্র পূজক হওয়ায় নক্ষত্রসমূহের কামালিয়তে বিশ্বাসী ছিল। সুতরাং তারা মনে করল, ইব্রাহীম (আ) আজ কোন অশুভ নক্ষত্রের অশুভ ক্রিয়ার মধ্যে লিপ্ত রয়েছেন। তাই তারা আর কিছু জিজ্ঞেস না করেই ইব্রাহীম (আ) কে শহরে রেখেই মেলায় চলে গেল। কোর আনুল কারীমে এ ঘটনাটি নিম্নরূপে বর্ণিত হয়েছে:

فَنَظَرَ نَظْرَةً فِي النُّجُومِ - فَقَالَ إِنِّي سَقِيمَ - فَتَوَلَّوا عَنْهُ مُدْبِرِينَ - (الصَّافات)

           অর্থাৎঃ "অতঃপর তিনি (ইব্রাহীম (আ)) নক্ষত্রসমূহের প্রতি একবার তাকালেন এবং বললেন, 'আমি অসুস্থ।' সুতারাং তারা তাঁকে পেছনে রেখে চলে গেল। (সূরা ছফ্ফাত: ৮৮-৯০)

        অনন্তর গোটা জাতি যখন মেলার আনন্দে মত্ত এবং শরাবে ও কাবাবে মশগুল, তখন হযরত ইব্রাহীম (আ) উঠলেন এবং সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতার মন্দিরে প্রবেশ করে দেখলেন, সেখানে দেবতাদের সম্মুখে নানা রকমের মিষ্টি, ফল, মেওয়া এবং হালুয়া উৎসর্গ করে রাখা হয়েছে। ইব্রাহীম (আ) বিদ্রূপের সূরে চুপিচুপি সেই মূর্তিসমূহকে সম্বোধন করে বললেন: এসব সুস্বাদু খাদ্য তোমাদের সম্মুখে, অথচ তোমরা এগুলো খাচ্ছ না, কেন খাচ্ছনা? অতঃপর বললেন, কি হল, তোমরা আমার কথার জবাব দিচ্ছ না কেন? অনন্তর সবগুলো মূর্তিকে ভেঙ্গে ফেললেন এবং হাতের কুঠারখানি সকলের বড় মূর্তিটির স্কন্ধে ঝুলিয়ে রেখে চলে গেলেন। এই ঘটনাটি কোরআনে এরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। 

فراغ إلى الهَتِهِمْ فَقَالَ اَلَا تَأْكُلُونَ - مَا لَكُمْ لَا تَنْطِقُونَ - فَرَاغَ عَلَيْهِمْ ضَرْبًا.بِالْيَمِينِ - (الصَّافَّاتُ)

        অর্থাৎঃ "অনন্তর ইব্রাহীম (আ) সতর্কতার সাথে তাদের দেবদেবীদের নিকটে গেল এবং বলল, (তোমাদের সম্মুখে স্তরে স্তরে সাজান এসব সুস্বাদু খাদ্যদ্রব্যসমূহ) তোমরা খাচ্ছ না কেন? তোমাদের কি হল, কথা বলছ না কেন? অতঃপর তিনি সেগুলোর উপর সবলে আঘাত হানলেন।" -(সূরা ছফাত: ৯১-৯৩)

فجعلهم جدَادًا الا كبيرا لهم لَعَلَّهُمُ اللَيْهِ يَرْجِعُونَ - (أَنْبِيَا)

        অর্থাৎ : "অতঃপর সেগুলোকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেললেন তাদের বড় দেবতাটি ব্যতীত, যেন তারা সেটার দিকে ফিরে আসে। (এবং জিজ্ঞেসা করে যে, তাদেরকে কে এমন করেছে)" -(সূরা আম্বিয়া : ৫৮)

        লোকেরা মেলা হতে প্রত্যাবর্তন করে মন্দিরে দেবতাদের এ হাল দেখে অত্যন্ত রাগান্বিত হল এবং পরস্পর বলাবলি করতে লাগল- কি হল, এমন কাজ কে করল? তাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিও ছিল। যার সম্মুখে হযরত ইব্রাহীম (আ) "আল্লাহর কসম আমি তোমাদের মৃতিগুলোর সম্বন্ধে অবশ্যইব্যবস্থা গ্রহণ করব।" কথাটি বলেছিলেন, সে তৎক্ষণাৎ বলে উঠল, এ সেই ইব্রাহীম নামক যুবকের কাজ। সেই আমাদের দেবতাদের শত্রু। কোরআনুল কারীমে এই কথাটি নিম্নরূপে ব্যক্ত হয়েছে: 

         "তারা বলতে লাগল, আমাদের দেবতাদের সাথে এরূপ ব্যবহার কে করল? নিঃসন্দেহ, সে যালিম, কেউ কেউ বলল, আমি যুবককে ওগুলোর সমালোচনা করতে শুনেছি। তাকে ইব্রাহীম বলা হয়। (অর্থাৎ, এ কাজ তারই।) -(সূরা আম্বিয়া: ৫৯-৬০)

        নেতৃবৃন্দ একথা শুনে দুঃখে ও ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে বলতে লাগল, তাকে জন সম্মুখে নিয়ে আস, সকলে দেখুক অপরাধী কোন ব্যক্তি। ইব্রাহীম (আ) কে সামনে আনয়ন করা হল। বড়ই ভীতিপ্রদ প্রভাবের সাথে জিজ্ঞেস করল, হে ইব্রাহীম। তুমি কি আমাদের দেবতাদের সাথে এরূপ করেছ? এ মর্মে কুরআন মাজীদের বর্ণনা নিম্নরূপ-

قَالُوا فَأَتُوا بِهِ عَلَى اعْيُنِ النَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَشْهَدُونَ - قَالُوا وَأَنتَ فَعَلْتَ هذا بالهَتِنَا بِإِبْرَاهِيمُ - (أَنْبِيَاء)

        অর্থাৎঃ "তারা বলল, তাঁকে জনতার সম্মুখে নিয়ে আস, যেন তারা সাক্ষী দিতে পারে, হিব্রাহীম (আ) জনসমক্ষে উপস্থিত হওয়ার পর তারা বলল, হে ইব্রাহীম "তুমিই কি আমাদের দেবতাদের সাথে এরূপ আচরণ করেছ?" (সূরা আম্বিয়া: ৬১-৬২)

        ইব্রাহীম (আ) দেখলেন, এখন সেই সুবর্ণ সুযোগ এসে পড়ছে যার জন্য আমি এ পথ অবলম্বন করেছি। জনসমাবেশ বিদ্যমান, সর্বসাধারণ লোকেরা দেখছে যে, তাদের দেবতাদের কি দুর্দশা ঘটেছে। অতএব, নেতৃবৃন্দকে সর্বসাধারণের সমক্ষে তাদের ভ্রান্ত আক্বীদার জন্য সর্মিন্দা করার সময় এটাই যাতে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে যে, আজ পর্যন্ত দেবতাদের সম্বন্ধে নেতৃবৃন্দ আমাদেরকে যা কিছু বলেছে, সবকিছুই তাদের ধোঁকা ও প্রতারণাই ছিল। হযরত ইব্রাহীম (আ) উত্তর করলেন:

قَالَ بَلْ فَعَلَهُ كَثِيرُهُمْ هَذَا فَسْتَلُوهُمْ إِنْ كَانُوا يَنْطِقُونَ - (أَنْبِيَاهُ) 

        অর্থাৎঃ তিনি "ইব্রাহীম (আ) বললেন, বরং তাদের মধ্যে ঐ বড় মূর্তিটি এ কাজ করেছে। সুতরাং তোমরা তাদেরকে জিজ্ঞেস কর যদি তারা বলতে পারে।" -(সূরা আম্বিয়া: ৬৩)

        ইব্রাহীম (আ) এর সুনিশ্চিত প্রমাণের বিরুদ্ধে পূজারীদের আর কি জবাব হতে পারত। তারা লজ্জায় নিমজ্জিত ছিল। মনে মনে হীন ও অপমানিত হয়ে পড়েছিল এবং ভাবছিল কি জবাব দেবে? জনসাধারণও আজ সবকিছু বুঝে গেল এবং তারা স্বচক্ষে সেই দৃশ্য দেখে নিল, যার জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না এবং পরিশেষে ছোট বড় সকলেই মনে মনে স্বীকার করতে হল যে, ইব্রাহীম অন্যায়চারী নয় বরং অন্যায়চারী আমরা। কারণ, এমন প্রমাণবিহীন বাতিল আক্বীদার উপর আমরা বিশ্বাস রেখেছি, তখন তারা অত্যন্ত সর্মিন্দ হয় অবনত মস্তকে বলতে লাগল, ইব্রাহীম। তুমি তো ভাল করেই জান যে, এসব দেবতার মধ্যে বাকশক্তি নেই। এরা তো নিষ্প্রাণ মূর্তি মাত্র। এ ঘটনাটিকে পবিত্র কোরআন এরূপে ব্যক্তি করেছে-

مرجعوا إلى انفُسِهِمْ فَقَالُوا إِنَّكُمْ أَنْتُمُ الظَّلِمُونَ ثُمَّ تَكْسُوا عَلَى رُءُوسِهِمْ لَقَدْ علمت ما هُوَلَا يَنْطِفُونَ - (أَنْبِيَاء)

        অর্থাৎঃ "অতঃপর তারা মনে মনে চিন্তা করে পরস্পরকে বলতে লাগল, নিঃসন্দেহ, তোমরাই (অর্থাৎ, আমরাই) অন্যায়চারী। অতঃপর (লজ্জায়) নিজেদের মন্তক অবনত করে বলতে লাগল, (হে ইব্রাহীমা) তুমি খুব ভাল করেই জান যে, এ এগুলোর বাকশক্তি নেই।" (সূরা আম্বিয়া: ৬৪-৬৫)

        এভাবে হযরত ইব্রাহীম (আ) এর দলিল ও প্রমাণ সফলকাম হল এবং শত্রুরা স্বীকার করতে বাধ্য হল যে, "অন্যায়কারী আমরাই" এবং তাদেরকে জনসাধারণের সম্মুখে নিজেদের মুখে স্বীকার করতে হল যে, আমাদের এ দেবতাসমূহের জবাব দেবার ও কথা বলবার শক্তি নেই। উপকার ও ক্ষতি করার শক্তি থাকা তো দূরেরই কথা। এমর্মে কোরআনুল কারীমে উল্লেখ করা হয়েছে-

التعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللهِ مَا لا يَنْفَعُكُمْ شَيْئًا وَلا يَضُرِكُمْ أَن لَّكُمْ وَلَمَّا تَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّهِ - أَفَلَا تَعْقِلُونَ - (انبياء)

        অর্থাৎঃ ইব্রাহীম বললেন, "তোমরা কি আল্লাহকে ছেড়ে এমন কিছুর ইবাদত করছ যারা তোমাদের না কোন উপকার করতে পারে আর না পারে কোন ক্ষতি করতে? ধিক তোমাদেরকে এবং তোমাদের সেই বাতিল ইলাহগুলোর উপরও যাদের ইবাদত করছ আল্লাহকে বাদ দিয়ে। তবে কি তোমরা বুঝবে না।" -(সূরা আম্বিয়া: ৬৬-৬৭)

فَأَقْبَلُوا إِلَيْهِ يَرْقُونَ - قَالَ أَتَعْبُدُونَ مَا تَنْحِتُونَ - وَاللَّهُ خَلَقَكُمْ وَمَا تَعْمَلُونَ -( الصَّافات)

        অর্থাৎ: "অতঃপর সকলে তাঁরই ইব্রাহীম (আ) এর দিকে ছুটে এল। ইব্রাহীম (আ) বললেন, তোমরা কি তোমাদের হাতে গড়া মূর্তিসমূহের পূজা করছ? প্রকৃত পক্ষে, আল্লাহই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমরা যা তৈরি করছ তাও?" -(সূরা ছফফাত: ৯৪-৯৫)

        হযরত ইব্রাহীম (আ) এর উপদেশের ফল এ হওয়া উচিত ছিল যে, সম্প্রদায়ের সব লোক নিজেদের বাতেল আক্বীদা হতে তওবা করে হানাফী ধর্ম গ্রহণ করে নেয়া। কিন্তু তা না করে তারা সকলে ইব্রাহীম (আ) এর সাথে শত্রুতা ও দুশমনীর আওয়াজ তুলল। একে অন্যকে বলল, যদি দেবতাদের সন্তোষ কামনা কর, তবে এই ব্যক্তিকে এ ধৃষ্টতা ও অপরাধমূলক কার্যের জন্য কঠোর শাস্তি প্রদান কর এবং জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে ফেল। যাতে তার এ তাবলীগ ও দা'ওয়াতের ব্যাপারই ধরা পৃষ্ঠ থেকে শেষ হয়ে যায়।

Post a Comment

0 Comments