
রসনার চতুর্থ বিপদঃ ঝগড়া ও বিবাদ-বিসম্বাদ করা রসনার চতুর্থ বিপদ ওই গুলো পরিস্কার হারাম। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, তোমার ভায়ের সাথে ঝগড়া বিবান করো না। তাদেরকে ঠাট্টা বিদ্রূপ করো না। তাদের সাথে প্রতিজ্ঞা করে তা' ভঙ্গ করো না তিনি আরও বলেন প্রতিবাদ করা ত্যাগ কর। কেলল সেক্ষেত্রে ভূমি নিরূপন বাজতে নজর হবে না। তিনি পরন বলেছেন, ন্যায়ের উপর থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি প্রতিবদন কার না, তার জন্য সর্বোচ্চ বেহে একখানি গৃহ নির্মিত হবে। আর যে ব্যক্তি অসত্য বিষয়ে প্রতিবানে বিরত থাকে, সবার বেহেশতে তার জন্য একটি গৃহ নির্মিত হবে। হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, আমার প্রশ্ন সর্বপ্রথম আমার নিকট যে ওয়াদা করেছেন এবং যা' থেকে আমাকে নিবের করেবেন তা এল মূর্তিপূজা ও মদ পানের পর মানুষের সাথে বাক-বিতন্ডা করা। তিনি আরও বলেরেন আল্লাহতায়ালা কোন সম্প্রদায়কে হেদায়েত করবার পর বিধান-বিশাল ব্যতীত পররাষ্ট করেল না। তিনি আরও বলেছেন, তর্কস্থলে নিজের মতকে অত্তান্ত সত্য জেনেও যে ব্যক্তি বাদ-প্রতিবাদ ত্যাগ না করে, তার ঈমানের পূর্ণ পরিচয় হয় না। তিনি আরও বলেছেন, যে ব্যক্তির মধ্যে ছয়টি গুণ আছে সে ঈমানের প্রকৃত পরিচয় পায়। উক্ত জয়টি ওণ এইর (9) গ্রীষ্মকালে রোযা রাখা। (২) আল্লাহর শত্রুগণকে অসির আঘাত করা। (৩) বড়-বৃত্তানের দিনে নামায দ্রুত আদায় করে নেয়া। (৪) বিপদাপদে ধৈর্য ধারণ করা। (৫) ইচ্ছে না হলেও অজু পূর্ণ করা এবং সত্য জেনেও বাদ-প্রতিবাদ পরিত্যাগ করা।
হযরত জোবায়ের ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) একদা তাঁর পুত্রকে বলেছিলেন, কৃরসাব নিয়ে মানুষের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করো না। কেননা তুমি তাদেরকে বুঝাতে সমর্থ হবে না বরং তর্ক। বিতর্ক না করে তোমার উচিত হবে নিজে সুন্নতকে মজবুতভাবে ধারণ করে রাখা। ইসরত ওমর ইবনে আবদুল আযীয বলেছেন, যে ব্যক্তি তর্ক-বিতর্ক করবার উদ্দেশ্যে তার ধর্মকে উপস্থিত করে সে অধিকাংশ সময় মত পরিবর্তন করে। হযরত মুসলিম ইবনে ইয়াসার বলেছেন, তোমরা তর্ক-বিতর্ক ত্যাগ করবে। কেননা সেটা আলিমের অজ্ঞতার সময় এবং সে সময় শয়তান তার পদস্খলনের চেষ্টা করে। কোন বিজ্ঞ লোক বলেছেন, আল্লাহতায়ালা কোন জাতিকে ধর্মপথে আনার পর বিবাদ-বিসম্বাদ করা ব্যতীত পথভ্রষ্ট করেন সা। ইমাম সালেক (রহঃ) বলেছেন, ধর্মমত নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করা ধর্মের বিধান নয়। তিনি আরও বলেছেন, তর্ক। বিতর্ক হৃদয়কে কঠিন করে এবং হিংসা-বিদ্বেষ জন্মায়। হাকীম লোকমান তার পুত্রকে বলেছিলেন, বৎস! তুমি কখনও আলিমদের সাথে তর্ক-বিতর্ক করো না। কেননা তাতে তোমাকে তারা ঘৃণা করবে।
হয়রত বেলাল ইবনে সা'দ বলেছেন, যখন কোন লোককে তর্ক-বিতর্কে রত এবং তার নিজের মতেই তাকে সন্তুষ্ট দেখতে পাও, মনে করবে সেটা তার অনিষ্টের কারণ। হযরত সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেছেন। আমার বন্ধু যদি একটি আনার সম্বন্ধে মতভেদ করে অর্থাৎ বলে যে এ আনারটি মিষ্টি আর আমি যদি বলি, এটি টক তবে আমাকে সে বিচারকের নিকট নেয়ার চেষ্টা করবে। তিনি আরও বলেছেন, তুমি ইচ্ছে করলে যে কোন লোকের মনোভাব তোমার পক্ষে আনতে পার। আবার তাদের সাথে তর্ক-বিতর্ক করে তোমার প্রতি তাদের ক্রোধও জন্মাতে পার। আর এ অবস্থায় যদি তুমি তাকে হেদায়েত করতে চাও তবে তাতে তুমি নিশ্চয়ই ব্যর্থ হবে। ইবনে আবি লায়লা বলেছেন, আমার বন্ধুর সঙ্গে আমি বাদানুবাদ করব না। কেননা তাতে হয় আমি তার উপর মিথ্যা দোষারোপ করব নতুবা তার ক্রোধ উৎপাদন করব। হযরত আবু দারদা (রাঃ) বলেছেন, যদি তুমি তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত থাক তবে তা-ই তোমার পাপের জন্য যথেষ্ট। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, কারও সাথে ঝগড়া-বিবাদ হলে দু'রাকাত নামাযই তার কাফফারার জন্য যথেষ্ট। হযরত ওমর (রাঃ) বলেছেন, তোমরা তিনটি উদ্দেশ্যে বিদ্যার্জন করো না। যথাঃ (১) বিদ্যার দ্বারা তর্ক-বিতর্ক করা, (২) বিদ্যার দ্বারা গৌরব করা, এবং (৩) মানুষকে বিদ্যা প্রদর্শন করা। তিনি আরও বলেছেন, তোমরা তিনটি কারণে বিদ্যার্জন থেকে বিরত থেকো না। যথাঃ (১) বিদান্বেষণে লজ্জা করা, (২) সংসার বৈরাগ্যের জন্য অবসর পাওয়া, এবং (৩) অজ্ঞতায় সন্তুষ্ট থাকা।
হযরত ঈসা (আঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলে তার সৌন্দর্য ক্রমশঃ হ্রাস পেতে থাকে। যে ব্যক্তি মানুষের সাথে ঝগড়া-বিবাদ করে তার মনুষ্যত্ব লোপ পেতে থাকে। যে ব্যক্তির চিন্তা-ভাবনা অধিক তার দেহ রোগাক্রান্ত হতে থাকে। যার স্বভাব মন্দ সে নিজের আত্মাকে শাস্তি দেয়। মায়মুন ইবনে মেহরান (রহঃ) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি কোন বন্ধুর প্রতি হিংসা পোষণ করেন না এর কারণ কি? তিনি বললেন, এর কারণ হল, আমি কারো সাথে মন দিয়ে বন্ধুত্ব করি না এবং কারও সাথে শত্রুতাও করি না।
বিবাদের চিহ্ন: যে কথাই অন্য লোকের নিকট থেকে শ্রবণ করা হয় তার দোষ-ত্রুটি বের করে প্রতিবাদ করা বিবাহের চিহ্ন। যে বাক্যের অর্থ সম্বন্ধে তর্ক-বিতর্ক করা হয় তার প্রতিবাদ যদি সত্য হয় তবে তা' সমর্থন করবে। আর যদি তা' মিথ্যা হয় বা বাতিল হয় এবং ধর্ম সম্বন্ধীয় কোন ব্যাপারের সাথে তার সংস্রব না থাকে তবে সে ক্ষেত্রে নীরব থাকবে। অন্যের কথার প্রতিবাদ করতে গেলে কখনও বা তার দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করতে হয় যেমন বলতে হয় যে, তোমার ভাষা অমার্জিত। তোমার আরবী ভাষায় জ্ঞান নেই। তোমার কথায় পূর্বাপর কোন মিল নেই ইত্যাদি। যে ব্যক্তির জ্ঞান অল্প সে উত্তম কথা বলতে পারে না; বরং তার রসনা থেকে অপ্রীতিকর শব্দ বের হয়ে যায়। যার মানুষের কথার প্রতিবাদ করবার অভ্যাস সে সহসা মানুষের কথায় দোষ ধরে ফেলে। অথচ এরূপ দোষ ধরার কোন কারণই থাকে না।
অর্থ সম্বন্ধে তর্ক বিতর্ক করাঃ এটা এইরূপ হয়ে থাকে। যেমন কেউ বলে, তুমি এর বা অর্থ কর তা' অর্থ নয়, তুমি এতে ভুল করেছ। কথার অর্থ নিয়ে এ ধরনের বক্ত বিতর্ক ঘটে যায়। এভাবে উদ্দেশ্যের জন্যও তর্ক-বিতর্ক ঘটে। এগুলো অত্যন্ত গর্হিত কার্য। তাই এসব ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে নীরব থাকা কর্তব্য। অবশ্য যদি কেউ উপকার লাভের জন্য কোন প্রশ্ন করে এবং তার মনে কোনরূপ কপটতা বা হিংসা-বিদ্বেষ না থাকে আর যাকে প্রশ্ন করা হয় সেও বদি অতি নম্রতার সাথে তার জবাব বলে দেয় তাহলে এরূপ প্রশ্ন ও উত্তরে কোন দোষ নেই।
আরবী ভাষায় মুজাদিলা বলে একটি শব্দ আছে। এর অর্থ অন্যের কথার প্রতিবাদ করে তাকে জব্দ করা এবং তার দোষ ত্রুটি প্রকাশ করা। তার নিদর্শন এই যে, শ্রোতাকে অন্যরূপ বুঝিয়ে • দেয়া হয় এবং তার দোষ বের করে নিজের গৌরব প্রকাশ করা হয়। এথেকে রক্ষা পাবার উপায় এই যে, যে কথায় কোন পাপ নেই তা' থেকেও নীরব থাকতে হবে। কেননা নিজের গৌরব ও সম্মান প্রকাশ করা এবং অন্যের দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করে তার সম্মান নষ্ট করা এদুটোই বিশেষ দোষের কারণ। প্রবৃত্তির পক্ষে এ দুটো বিষয় প্রবল লোভ। নিজের সম্মান প্রকাশ করা অহঙ্কার এবং অহমিকাজনিত কারণে হয়ে থাকে, যে অহংকার একমাত্র আল্লাহরই দাবী এবং একমাত্র তাঁর জন্যই শোভনীয়। ঐ ব্যক্তি এই খোদায়ী গুণে গুনান্বিত বলে দাবী করো সে আল্লাহর নাফরমান হয়ে থাকে। প্রবৃত্তির দ্বিতীয় লোভ অন্যকে ছোট মনে করা। এটা হিসে প্রাণীর স্বভাব। কেননা হিংস্র প্রাণী তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে বিপদে ফেলে তার অনিষ্ট করতে এবং তাকে খন্ড-বিখন্ড করতে চায়। এ দুটো মানুষের জন্য ধ্বংসকর দোষ। যে ব্যক্তি অনবরত। ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত এসব ধ্বংসকর দোষ তার মধ্যে সৃষ্টি হয়ে পাপের সৃষ্টি করে। এতে বিনা কারণে অন্যকে কষ্ট দেয়া হয়। যে ব্যক্তি ঝগড়া- বিবাদে লিপ্ত হয় অন্যকে কষ্ট দেয়া এবং অন্যের ক্রোধ সঞ্চার করা থেকে সে কিছুতেই মুক্ত থাকতে পারে না। অন্যের প্রতিবাদ করতে করতে মানুষের স্বভাব ক্রমান্বয়ে এমন হয়ে যায় যে, কুকুরের ন্যায় তারা পরস্পর হাতাহাতি ও কাটাকাটিতে লিপ্ত হয়। এক্ষেত্রে তাদের প্রত্যেকের উদ্দেশ্য নিজের প্রতিবাদীকে জব্দ বরং ধ্বংস করে নিজের গৌরব প্রতিষ্ঠা করা।
এ ঝগড়া-বিবাদের একমাত্র প্রতিকার তার বিরুস্কাচরণ করা। অর্থাৎ নিজের অহংকার ও দর্পকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়া এবং প্রতিবাদীর ফজীলত ও মহত্ত্ব প্রকাশ করা। রোগের কারণ দূরীভূত করাই প্রত্যেক রোগের প্রকৃত প্রতিকার। সুতরাং বিবাদ-বিসম্বাদের কারণ দূর করতে হয় এবং এই নীতির উপরই সর্বদা দৃঢ় থাকতে হয়। এরূপ করতে করতে যখন ধৈর্য ধারণ করা অভ্যাসে পরিণত হয় তখন আপনা থেকেই হৃদয় শান্ত ভাব ধারণ করে।
বর্ণিত আছে যে, ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) হযরত দাউদ তাঈ (রহঃ) কে জিঙ্গেস করেছিলেন, আপনি নির্জনতা কেন অবলম্বন করেছেন? তিনি বলেছিলেন, তর্ক-বিতর্ক ত্যাগ করে নিজেকে রক্ষা করে চলছি। তার কথা শুনে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) বললেন, তর্ক-বিতর্কের সভায় যোগদান করুন তাতে যা' কিছু বলা হয় শুনুন। কিন্তু নিজে কিছু বলবেন না। তিনি বললেন, আমি তা-ই করছি। কিন্তু এ কাজ থেকে অধিক কঠিন কাজ আমি আর দেখি নি। তার কথার মর্ম এই যে, যে ব্যক্তি অন্যের ভুল কথা শুনে তা' সংশোধন করবার সামর্থ রাখে, তখন তার পক্ষে কিছু না বলে ধৈর্য ধারণ করে থাকা অত্যন্ত কষ্টকর। এজন্যই হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি সত্য উপলব্ধি করেও বিবাদ-বিসম্বাদ থেকে বিরত থাকে আল্লাহ তায়ালা তার জন্য বেহেশতের সর্বোচ্চ স্থানে একটি গৃহ নির্মাণ করে দেন। কেননা এ কাজটি তার আত্মার উপর বড়ই কঠিন। বলা বাহুল্য যে, অনেক সময় বিভিন্ন মাযহাবের মতামত এবং বিভিন্ন ধর্মমত নিয়েও এরূপ তর্ক-বিতর্ক হয়ে থাকে এবং এটা মানব প্রকৃতির অন্তর্গত। বিশেষতঃ যখন সে মনে করে যে, তর্ক-বিতর্কে পুণ্য রয়েছে তখন তার তর্ক-বিতর্ক করবার লোভ আরও বৃদ্ধি পায়।
মূলতঃ এটা ভ্রান্ত মত, বরং মানুষের উচিত তার রসনাকে আহলে ক্লিবলা অর্থাৎ মক্কাবাসীদের উপর থেকে বিরত রাখা। যখন কেউ কোন বেদআতপন্থীকে দেখতে পায় তাকে সে নির্জনে নম্রভাবে উপদেশ দেবে। তর্ক-বিতর্কের পন্থায় নয়। কেননা তর্ক-বিতর্ক করলে সে মনে করবে যে, তার সাথে প্রবঞ্চনা করা হচ্ছে। আর তারা এরূপ করেও থাকে এবং অন্যকে নীরব করে রাখে। এরূপ ধারণা হলে তার হৃদয়ে বেদআত আরও দৃঢ় হবে। সুতরাং বিনম্র বচনে এবং তার মঙ্গল সাধন কল্পে তাকে নির্জনে বুঝাবে। আর যখন জানতে পারা যাবে উপদেশ কোন উপকারে আসবে না। তখন নিজের কাজে ব্যস্ত থাকবে এবং তার ব্যাপার ত্যাগ করবে।
হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, আল্লাহ ঐ ব্যক্তির উপর দয়া প্রদর্শন করেন, যে মক্কাবাসী বা আহলে কিবলাদের থেকে রসনা সংযত রাখে। তবে সামর্থ থাকলে উপদেশ দেবে। হযরত হেশাম ইবনে ওরওয়াহ (রাঃ) বলেছেন যে, হুযুরে পাক (দঃ) এই বাক্যটি সাতবার বলেছেন, যে ব্যক্তির বিবাদ-বিসম্বাদ করা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে যে, তজ্জন্য মানুষের প্রশংসা এবং সম্মান পায়, তার হৃদয়ে ধ্বংসকর দোষগুলো বদ্ধমূল এবং প্রবল হয়। তা' লে প্রত্যাখ্যান করতে পারে না। সুতরাং তার উপর ক্রোধ, অহংকার, রিয়া বা সাধুতা প্রদর্শনেচ্ছা, নামের লালসা এবং সম্মানের লোভ প্রবল হয় এবং তার হৃদয়ে তা' একত্রীভূত হয়। যখন একটি দোষই দূর করা কষ্টকর তখন এসব দোষ একত্র হলে তা' দূর করা কিরূপ কষ্টকর, তা' সহজেই অনুমান করা যায়।
0 Comments