শয়তান তাড়াবার উপায় কি?

        শয়তানের জন্য বড় দরজাসমূহের অন্যতম হল, মুসলমানদের সম্বন্ধে মন্দ ধারণা পোষণ করা। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, "ইয়া আইয়্যুহাল্লাযীনা আমানুজ তানিবু কাছীরাম মিনাজ জান্নি ইন্না বা'দ্বাজ জান্নি ইছমুন।” অর্থাৎ হে ঈমানদারগণ। অনেক ধারণাকে ত্যাগ কর। নিশ্চয়ই কোন কোন ধারণা অন্যায় বা পাপরূপে গণ্য।

        যে ব্যক্তি অন্যের উপর কুধারণা রাখে শয়তান তার রসনাকে পরনিন্দা চর্চার জন্য উৎসাহ দেয়। তাতে সে ধ্বংস হয়। এরূপ ক্ষেত্রে পরনিন্দাকারী যার নিন্দা করে তার হক নষ্ট করে, তাকে সম্মানের চোখে দেখে না; বরং তাকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখে এবং সে নিজেকে তার চেয়ে উত্তম মনে করে। এ সমস্তই তার ধ্বংসের কারণ। এজন্যই শরীয়ত এ অভ্যাসটিকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, তোমরা অপবাদের স্থান থেকে বেঁচে থাক। এমন কি তিনি নিজেও এ থেকে নিজেকে রক্ষা করতেন।

        হযরত হোসায়েন তনয় হযরত জয়নাল আবেদীন (রহঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, উম্মুল মু'মিনীন হযরত সুফিয়াহ (রাঃ) তাঁকে বলেছেন যে, হুযুরে পাক (দঃ) মসজিদে ই'তেকাফরত অবস্থায় তিনি তাঁর নিকট এসে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলে সন্ধ্যা বেলায় চলে গেলেন। হুযুরে পাক (দঃ) উঠে দাঁড়ালেন। এ সময় দুজন আনছার এসে তাঁকে সালাম দিয়ে চলে গেল। তিনি তাদেরকে ডেকে বললেন, ইনি আমার স্ত্রী হাই-এর কন্যা সুফিয়াহ। ছাহাবীদ্বয় বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার সম্বন্ধে আমাদের ধারণা উত্তম। তিনি বললেন, নিশ্চয়ই শয়তান আদম সন্তানের মনের মধ্যে রক্ত চলাচলের ন্যায় চলাচল করে। আমি ভয় করি যে, সে তোমাদের মধ্যেও প্রবেশ করতে পারে। লক্ষ্য করবার বিষয় হল, হুযুরে পাক (দঃ) তাঁর উম্মতগণকে রক্ষা করবার জন্য কত বেশী দয়ালু এবং সতর্ক ছিলেন। তিনি তাদেরকে অপরাধ থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কিভাবে তাদেরকে শিক্ষাদান করেছিলেন, অবশ্যই তা' লক্ষ্য করা দরকার। পক্ষান্তরে যে আলিম পরহেজগার, ধর্মে কর্মে পরিপক্ক এবং সে নিজেকে উত্তম ব্যক্তি মনে করে বলে যে, আমার ন্যায় লোকের প্রতি কারও মন্দ ধারণা হতে পারে না, তার মনে করা উচিত যে, যিনি সর্বাপেক্ষা পরহেজগার, খোদাভীরু এবং শ্রেষ্ঠ আলিম, তাকেও সবাই একভাবে দেখে না. একরূপ মনে করে না। কেউ তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকে আবার কেউ অসন্তুষ্ট থাকে। সুতরাং মানুষের মন্দ ধারণা এবং অপবাদ থেকে বেঁচে থাকার জন্য সতর্ক থাকা অবশ্য কর্তব্য। কেননা মন্দ লোকেরা যে কোন লোক সম্বন্ধেই কুধারণা করে। যখনই কোন লোক মানুষের দোষ-ত্রুটি অনুসন্ধান করে, কুধারণা পোষণ করে তখন মনে করবে যে, সে একটি গুপ্ত খবীছ বা কদর্য লোক। তার কাছ থেকে অশ্লীলতা প্রকাশ পাওয়া খুবই স্বাভাবিক। সে অন্য যে কোন লোককেই নিজের ন্যায় মনে করে। কিন্তু মু'মিন লোকগণ ওজর-আপত্তির বিষয় চিন্তা করে। যারা মু'দিন তারা প্রত্যেক লোকের যে কোন কাজকেই সহৃদয়তা ও সহানুভূতির স্যাথে বিচার করে।

        উল্লিখিত সোধাবলী হৃদয়ের দিকে শয়তানের দরজা বা প্রবেশ পথ। এগুলোর দ্বারা তার অন্যান্য সংবন পথ সম্পর্কে ধারণা করা যায়। আর স্মরণ রাখবে যে, মোটামুটিভাবে যত রকমের পাপ রয়েছে সবই তার অস্ত্র এবং প্রবেশ দ্বার।

         প্রশ্ন। শয়তান তাড়াবার উপায় কি? আল্লাহর যিকির এবং 'লা হাওলা ওয়ালা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ' বলাই কি যথেষ্ট?

        উত্তর। পাঠক-পাঠিকা। জেনে রাখ, শয়তান তাড়াবার একমাত্র উপায় হল উল্লিখিত নিন্দনীয় যোগগুলো থেকে আস্থাকে পরিশুদ্ধ করতঃ শয়তানের প্রবেশ দ্বারগুলো বন্ধ করে দেয়া। এ বিষয়ের বর্ণনা অতিপয় দীর্ঘ হবে। কিন্তু এক্ষেত্রেও আমাদের উদ্দেশ্য ধ্বংসকর দোষসমূহের বিষয় বর্ণনা করা। প্রত্যেক দোষ আমরা এক একটি পৃথক পৃথক অনুচ্ছেদে বর্ননা করব। একথা সত্য যে, যখন এ সমস্ত দোষের মূল হৃদয় থেকে কর্তন করে ফেলা হয় তখন শয়তান হৃদয়ের মধ্যে ঘুরা-ফিরা করে এবং অন্তরে মন্দ চিন্তার সৃষ্টি করে। তখন তার আর বিশ্রাম নেয়ার সময় থাকে না। তবে আল্লাহর যিকির এ সময় তাকে বাধা দেয়।

        শয়তান ক্ষুধার্ত কুকুরের ন্যায়, সে তোমার নিকট আগমন করবে। যদি তোমার নিকট মাংস বা রুটি না থাকে, তুমি তাকে তাড়িয়ে দাও। তাহলে সে চলে যাবে। কিন্তু যদি তোমার সামনে মাংস ও ত্রুটি থাকে তাহলে তাকে শতবার তাড়ালেও সে দূর হবে না; বরং ঐ মাংস ও রুটির উপর লাফিয়ে পড়বে। তদ্রুপ শয়তানের খাদ্য হতে যে হৃদয় শূন্য থাকে শুধু অনবরত যিকির দ্বারাই তার ফায়েদাহ হবে। কিন্তু যখন মোহ ও লালসা হৃদয়ের উপর প্রবল হবে তখন যিকিরের তত্ত্ব হৃদয়ের মধ্যে স্থির হয়ে না বসে তা' চতুর্দিকে ঘুরতে থাকবে। আর এ সুযোগে শয়তান হৃদয়ের অভ্যন্তরে প্রশান্ত মনে বসে থাকবে। বস্তুতঃ যেসব ধর্মভীরুদের হৃদয় মোহ ও নিন্দনীয় দোষ থেকে পবিত্র থাকে শয়তান লালসা নিয়ে তার মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না। কিন্তু হৃদয় যখন যিকির থেকে গাফেল থাকে তখন শয়তানের কুমন্ত্রণা যিকিরের নিকট ফিরে আসে। এর প্রমাণ আল্লাহতায়ালার এই বাণীঃ অর্থাৎ "বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।" যিকির সম্বন্ধে যত আয়াত ও হাদীস এসেছে তা' সবই এই কথা প্রমাণ করে। 

        হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, একবার মু'মিনের শয়তান এবং কাফিরের শয়তানের মধ্যে পরস্পর সাক্ষাত হয়েছিলো। কাফিরের শয়তান হৃষ্টপুষ্ট, মোটা-তাজা এবং উত্তম বস্তু পরিহিত ছিল। পক্ষান্তরে, মু'মিনের শয়তান জীর্ণ-শীর্ণ, কৃশ, আলু-খালু কেশবিশিষ্ট এবং নিকৃষ্ট পোশাক পরিহিত ছিল। কাফিরের শয়তান মু'মিনের শয়তানকে বলল, তোমার অবস্থা এরূপ কেন? তুমি এত কৃশ এবং জীর্ণ শীর্ণ হয়ে গেলে কেন? সে বলল, আমি এমন লোকের সঙ্গে আছি যখন সে ভক্ষণ করে এবং আল্লাহর নাম স্মরণ করে তখন আমি কৃশ হয়ে যাই। যখন সে পানীয় পান করে এবং আল্লাহর নাম স্মরণ করে তখন আমি তৃষ্ণার্ত হয়ে যাই। যখন সে বস্ত্র পরিধান করে এবং আল্লাহর নাম স্মরণ করে তখন আমি বস্ত্রহীন হয়ে যাই। যখন সে তেল ব্যবহার করে এবং আল্লাহর নাম স্মরণ করে তখন আমি আলুথালু কেশবিশিষ্ট হয়ে যাই। ওমান কাফিরের শয়তান বলল, আমি তোমার অবস্থা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আমি এমন এক ব্যক্তির সঙ্গে আছি, সে ঐ সমস্ত কোন কাজেই আল্লাহর নাম স্মরণ করে না। সুতরাং আমি তার খাদ্যে, পানীয় দ্রব্যে এবং পোশাক-পরিচ্ছদে শরীক হয়ে যাই। যার ফলে আমি অত্যন্ত সুখে-শান্তিতে আছি।

        হযরত মুহাম্মদ বিন ওয়াসে' ফজরের নামাযের বাদে প্রত্যেক দিন বলতেন, হে মাবুদ। তুমি আমাদের দোষ-ত্রুটি অবহিত এমন এক শত্রুকে আমাদের উপর প্রবল করে রেখেছ যে, সে এবং তার সঙ্গীগণ আমাদেরকে এমন স্থানে দেখে যেখানে আমরা তাদেরকে দেখতে পাই না। হে মাবুদ। তুমি আমাদের এ বিষয়ে তাকে বঞ্চিত কর। যেরূপ তুমি তাকে তোমার রহমত থেকে বঞ্চিত করেছ এবং আমাদের বিষয়ে তাকে অসন্তুষ্ট কর যেরূপ তুমি তাকে তোমার ক্ষমা থেকে বঞ্চিত করেছ। তার থেকে আমাদেরকে তুমি এত দূরে রাখ তোমার রহমত থেকে তাকে যত দূরে রেখেছ। নিশ্চয়ই তুমি সমস্ত বিষয়ে শক্তিশালী।

        তিনি আরও বর্ণনা করেছেন যে, একদা ইবলীস মসজিদের পথে মানুষের রূপ ধরে উপবিষ্ট ছিল। এ সময় সে তাঁকে বলল, হে ইবনে ওয়াসে'। তুমি কি আমাকে চিন? তিনি বললেন, না, তুমি কে? শয়তান বলল, আমি ইবলীস। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার ইচ্ছা কি? শয়তান বলল, আমার ইচ্ছা এই যে. তুমি এ দোয়াটি আর কাউকে শিক্ষা দেবে না এবং আমিও আর তোমার নিকট উপস্থিত হব না। ইবনে ওয়াসে' বললেন, আল্লাহর কসম, যে ব্যক্তি এ দোয়া পেতে ইচ্ছে করে আমি তা' থেকে তাকে বিরত করব না। এখন তোমার যা' ইচ্ছে তাই করতে পার।

        হযরত আবদুর রহমান আবি লায়লা থেকে বর্ণিত আছে যে, একদা শয়তান অগ্নির মশাল হস্তে হুযুরে পাক (দঃ) এর নিকট উপস্থিত হল। তিনি তখন নামাযের মধ্যে কিরাত পড়তেছিলেন। শয়তান তার নিকট থেকে দূর না হওয়ায় ফিরেশতা জিব্রাইল তার নিকট উপস্থিত হয়ে তাকে নিম্নোক্ত দোয়াটি শিখিয়ে দিলেন এবং বললেন, আপনি এ দোয়াটি পাঠ করুন। দোয়াটি এইঃ "আউযু বিকালিমা তিত্তাম্মাতিল্লাতী লা ইউযাবিযুহুন্না বিররুন ওয়ালা ফাজিরুন মিন শাররি মা ইয়ালিজু ফিল আরদ্বি ওয়ামা ইয়াখরুজু মিনহা ওয়ামা ইয়ানযিলু মিনাসামায়ি ওয়ামা ইয়া'রুজু কীহা ওয়া মিন ফিতানিল লাইলি ওয়ান্নাহারি ইল্লা ওয়া মিন তাওয়ারিকিল লাইলি ওয়ান্নাহারি ইল্লা তারিক্বান ইয়াতরুকু বিখাইরিন ইয়া রাহমান" অর্থাৎ হে মাবুদ। পরিপূর্ণ কালেমার সাহায্যে তোমার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি যা' ধার্মিক ও অধার্মিক কেউই হারায়না ঐ মন্দ থেকে যা দুনিয়ায় প্রবেশ করে এবং যা তা' থেকে বের হয়। যা আসমান থেকে অবতরণ করে এবং যা তাতে বিচরণ করে। আর রাত্র ও দিবসের বিপদাপদ থেকে। রাত্র ও দিবসের মধ্যে যা কিছু যাতায়াত করে তা' থেকে। তবে যা মঙ্গল নিয়ে বিচরণ করে তা' থেকে নয়; হে রাহমান। হুযুরে পাক (দঃ) উক্ত দোয়া পাঠ করবার সাথে সাথে শয়তানের অগ্নির মশাল নিবে গিয়ে সেটা তার মুখের উপর পড়ল।

        হযরত হাসান বছরী (রহঃ) বলেছেন, আমি জানতে পেরেছি একদা হযরত জিব্রাইল (আঃ) হুযুরে পাক (দঃ) এর নিকট এসে তাঁকে বললেন, একদল জ্বিন আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। সুতরাং আপনি সন্ধ্যা বেলায় আয়াতুল কুরসী পাঠ করবেন। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, অতঃপর আমার নিকট শয়তান উপস্থিত হয়ে গোলমাল শুরু করে দিল। তখন আমি তার গ্রীবাদেশ ধারণ করলাম। যিনি আমাকে নবীরূপে প্রেরণ করেছেন তাঁর কসম, আমি তাকে ছাড়লাম না যে পর্যন্ত আমার হস্ত তার মুখের লালায় ভিজে গেল, এ সময় যদি আমার ভাতা হযরত সোলায়মান (আঃ) আমাকে আওয়াজ না দিতেন তবে শয়তানের মসজিদের মধ্যেই পড়ে থাকতে হত।

        হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, ওমর যে পথে গমন করে শয়তান সে পথে না গিয়ে অন্য পথ দিয়ে যাতায়াত করে। তার কারণ ওমরের হৃদয় শয়তান প্রদত্ত লালসা থেকে পবিত্র ছিল। সুতরাং তুমিও যদি আকাঙক্ষা কর যে, শয়তানকে তাড়িয়ে দেবে যেমন হযরত ওমর (রাঃ) তাড়িয়েছিলেন। তা' তোমার জন্য অসম্ভব হবে না। কিন্তু তুমি যদি ঐ ব্যক্তির মত হও, যে উদর পরিষ্কার হবার পূর্বে ওষুধ সেবন করতে চায়। অথচ তার উদর নানাবিধ অখাদ্য ও কুখাদ্য দ্বারা পরিপূর্ণ। তা' হলে তোমার দ্বারা তা' সম্ভব হবে না। কেননা উদরের উপকার করবার ইচ্ছা করলে উদর পরিষ্কার করবার পর এবং তা' শূন্য করবার পর ওষুধ সেবন করতে হবে। তদ্রূপ যিকির রূপ ওষুধ এবং আল্লাহর ভয়রূপ পরিষ্কার কারক কাম ও মোহ থেকে হৃদয়কে পরিষ্কার কর যখন যিকির এমন হৃদয়ের মধ্যে পতিত হয়ে যা অন্যান্য বিষয়ের চিন্তা হতে সম্পূর্ণ মুক্ত। তখন শয়তান হৃদয় হতে পালিয়ে যায়। যেরূপ খাদ্যশূন্য পরিষ্কার উদরে ওষুধ পতিত হলে রোগ দূর হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন, "শয়তানের জন্য এটা লিখে রাখা হয়েছে যে, যার উপর সে কর্তৃত্ব করবে তাকে সে গোমরাহ করবে এবং তাকে প্রজ্জ্বলিত নরককুন্ডের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাবে। যে ব্যক্তি তার কার্য দ্বারা শয়তানকে সাহায্য করে সে তার বন্ধু। যদিও সে তার রসনা দ্বারা আল্লাহকে স্মরণ করে। 

 প্রশ্ন: হাদীস শরীফে এসেছে, আল্লাহর যিকির শয়তানকে দূর করে, কিন্তু তুমি যে কথা বলতেছ তা' হাদীস এবং আলিমগণের কথার বিপরীত; সুতরাং তোমার কথা বোধগম্য নয়। উত্তর: জেনে রাখ, শ্রবণ কখনও প্রত্যক্ষ দেখার ন্যায় নয়। তুমি তোমার নিজের অবস্থা দেখেই বিষয়টির মীমাংসা করতে পারবে। নামায তোমার সব ইবাদাত ও যিকিরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। যখন তুমি সেই নামাযের মধ্যে থাক তখন নিজের হৃদয়ের দিকে লক্ষ্য কর কিভাবে শয়তান তোমার হৃদয়কে হাট-বাজার ও সমস্ত দুনিয়ার হিসাব-নিকাশের দিকে নিয়ে যায়? কিরূপে সে তোমার প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হবার পরামর্শ যোগায়? কিরূপে সে তোমাকে নিয়ে কত দূরবর্তী এলাকায় ঘুরা-ফিরা করে? এমন কি তখন দুনিয়ার যে সব ব্যাপার তুমি ভুলে গিয়েছিলে সেগুলোকেও তোমার হৃদয়মধ্যে এনে হাজির করে দেয়। এসব ব্যাপার শয়তান তোমার নামাযের মধ্যেই বেশী করে ঘটিয়ে থাকে।

         আল্লাহর ভয় ও স্বরণে শয়তান দূর হয়ঃ নামায় হৃদয়কে নির্মল করে। নামাযের আরাই হৃদয়ের গুণাবলী ও দোযাবলী প্রকাশ পার হয়ে সময় পার্থিব কাম, মোহ ইত্যাদি দ্বারা পরিপূর্ণ তা' থেকে নামায কবুল হয় রাকাত। এটা সন্দেহাতীত যে, এমতাবস্থায় শয়তান তোমার নিকট থেকে দূর হবে না: বরং অনেক সময় তোমার প্রতি তার কুমন্ত্রণা বৃদ্ধি পাবে। যেমুক্ত জোলাপের পূর্বে ওষুধ সেবনে অনেক সময়ই অনিষ্ট বৃদ্ধি হয়। অতএব যদি শয়তান থেকে মুক্ত হতে চাও তাহলে সবার আগে আল্লাহর ভয় বা তাকওয়া দ্বারা হৃদয় পরীক্ষা করে নাও। তারপর যিকিরের ওষুধ তাতে প্রয়োগ কর। তবেই শয়তান তোমার নিকট থেকে পলায়ন করবে। যেরূপ ওমর থেকে পলায়ন করেছিল। এজনাই হযরত ওয়াহহাব বিন মুনাত্মাহ (রহঃ) বলেছেন, আল্লাহকে ভয় কর। শয়তানকে প্রকাশ্যে তিরষ্কার করে কি হবে যখন তুমি তার গোপন বন্ধু এবং অনুসরণকারী? জনৈক বিজ্ঞ বুযর্গ বলেছেন, যে ব্যক্তি নেক কাজের পরিচয় জেনেও তা' পালন করতে অবহেলা করে এবং অভিশপ্ত শয়তানের নাফরমানীর পরিচয় জেনেও তাকে অনুসরণ করে তার প্রতি বিস্ময় প্রকাশ না করে আর কি করা যায়? আল্লাহতায়ালা বলেছেন, "আমাকে ডাক আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব।" অথচ তুমি তাঁকে ডাকতেছ, কিন্তু তিনি তোমার ডাকে সাড়া দিচ্ছেন না। তদ্রূপ তুমি আল্লাহর যিকির করছ, কিন্তু শয়তান তোমার নিকট থেকে পালাচ্ছে না। এর কারণ তুমি যিকিরের ও দোয়ার শর্তসমূহ হারিয়ে ফেলেছ।

        দোয়া কবুল না হবার কারণঃ হযরত ইব্রাহীম ইবনে আদহাম (রহঃ) কে জিজ্ঞেস করা হল, হুযুর। আমাদের কি হল যে, আমরা দোয়া করি অথচ আমাদের দোয়া কবুল হয় না? কিন্তু আল্লাহতায়ালা বলেন যে, "উদউনী আসতাজিবলাকুম"। অর্থাৎ আমার নিকট প্রার্থনা কর আমি তোমাদের প্রার্থনা কবুল করব। হযরত ইব্রাহীম ইবনে আদহাম (রহঃ) বললেন, এর কারণ তোমাদের দিল মরে গেছে। তাকে জিজ্ঞেস করা হল, কোন বস্তু আমাদের দিলকে মেরে ফেলেছে? তিনি বললেন, আটটি বস্তু দিলের মৃত্যু ডেকে আনে। তা' হলঃ (১) তোমরা আল্লাহর প্রতি কর্তব্যের বিষয় অবগত আছ কিন্তু তোমরা তা' প্রতিপালন করছ না। (২) তোমরা কুরআন মজীদ তিলওয়াত কর কিন্তু তার শাস্তির বর্ণনার বিষয় লক্ষ্য কর না। (৩) তোমরা মুখে বল যে, আমরা হযরত রাসূলে করীম (দঃ) কে ভালবাসি কিন্তু তোমরা তাঁর তরীকা ও কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে কিছুই জান না। (৪) তোমরা মুখে বল আমরা মৃত্যুকে ভয় করি কিন্তু তোমরা সেভাবে মোটেই প্রস্তুত হও না। (৫) আল্লাহ তায়ালা বলেন, নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের শত্রু তাকে শত্রুরূপেই গ্রহণ কর। কিন্তু তোমরা তার বিপরীত কাজ কর অর্থাৎ গুনাহর কার্য দ্বারা তার সাহায্য গ্রহণ কর। (৬) তোমরা মুখে বল যে, আমরা দোযখের আগুনকে ভয় করি। কিন্তু তোমরা সেই দোযখের অগ্নির মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে আছ। (৭) তোমরা মুখে বল যে, আমরা বেহেশতকে ভালবাসি। কিন্তু তোমরা তোমাদের কার্য দ্বারা তদ্রূপ পরিচয় দাও না। (৮) যখন তোমরা তোমাদের শয্যা থেকে উঠ, তখন তোমাদের নিজেদের দোষ-ত্রুটি পিছনে ফেলে রেখে অন্যের দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনা শুরু করে দাও। এর দ্বারা তোমরা শুধু আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণ ঘটিয়ে থাক। এখন তোমরাই বদ এমতাবস্থায় কিরূপে আল্লাহতায়ালা তোমাদের দোয়া কবুল করবেন?


        প্রশ্নঃ যে মানুষকে নানাবিধ পাপের দিকে আহ্বান করে সে কি একটি শয়তান না বহু শয়তান। উত্তরঃ হে প্রশ্নকারী। জেনে রাখ যে, কাজকর্মে তার পরিচয় জানা তোমার জন্য প্রয়োজনীয় নয়। তুমি শত্রুকে বিতাড়িত করবার জন্য তৎপর হও। তরি-তরকারী খাবার বস্তু। তা' খেয়ে নাও। তা' যেখান থেকে আসে আসুক, তা' জিজ্ঞেস করে তোমার কোন ফায়েদাহ নেই; বরং তুমি অন্তর্দৃষ্টির নূর দ্বারা হাদীসের সাক্ষ্যের মাধ্যমে পরিষ্কারভাবে বুঝে নাও যে, শয়তান একটি সুসজ্জিত সৈন্যদল সদৃশ। প্রত্যেক প্রকার পাপের জন্য এক একটি শয়তান নির্দিষ্ট আছে এবং সে সেই পাপের দিকে আহ্বান করে। অন্তর্দৃষ্টির বিষয় বর্ণনা অতি দীর্ঘ। সুতরাং যতটুকু যা' বর্ণনা করেছি তা-ই তোমার জন্য যথেষ্ট। সুতরাং উক্ত বিষয় অধিক বর্ণনা করবার প্রয়োজন করে না। তাছাড়া আমি পুণ্যের আলো এবং পাপের অন্ধকার সম্বন্ধেও বর্ণনা করেছি। তার মধ্য থেকেও এ বিষয় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় বিষয় অবহিত হয়েছ।

        হাদীস শরীফে এসেছে, হযরত মুজাহিদ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, ইবলীসের পাঁচটি পুত্র আছে। সে তার প্রত্যেক পুত্রকে এক এক বিষয়ের ভার দিয়েছে। তাদের নাম যথাক্রমে ছবর, আওয়ার, মাবদ্ভুত, দাছেম, জলম্বর। ছবর শয়তানের নিকট বিপদাপদ ঘটানোর ভার। সে মানুষের মুখমন্ডলে চপেটাঘাত করবার এবং অন্ধকার যুগের বীভৎস অন্যায়-অত্যাচার করবার আদেশ দেয় ও প্রেরণা যোগায়। আওয়ার শয়তানের উপর ব্যভিচারের ভার। সে ব্যভিচারের আদেশ দেয় এবং তা' মানুষের মনে আনন্দদায়ক করে তোলে। মাবদ্ভুত শয়তানের উপর মিথ্যার ভার। সে মানুষের দ্বারা মিথ্যা বলায়। দাছেম শয়তান কোন লোকের সাথে গিয়ে তার দ্বারা মানুষের অপবাদ এবং দুর্নাম রটায়। জলম্বর শয়তানের উপর বাজারের ভার। সে বাজারের ক্রেতা-বিক্রেতার নিকট অবস্থান করে তাদের দ্বারা প্রবঞ্চনা ও প্রতারণামূলক কার্য ঘটায়। এছাড়া আরও কতিপয় কুখ্যাত শয়তান আছে। যেমন হাদীস শরীফে এসেছে, নামাযের মধ্যে যে শয়তান আসে তার নাম খানজাব এবং অজুর মধ্যে যে শয়তান আসে তার নাম ওয়ালহান। শয়তানের পরিচয় সম্বন্ধে বহু সংখ্যক হাদীস আছে এবং তাতে বহু শয়তানের পরিচয় পাওয়া যায়।

        ফিরেশতার সংখ্যাঃ শয়তানের যেরূপ সংখ্যা বহুত, তদ্রূপ ফিরেশতাদের সংখ্যাও অসংখ্য। এ বিষয় শোকর বা কৃতজ্ঞতার অনুচ্ছেদে বর্ণনা করা হয়েছে। এদের প্রত্যেক ফিরেশতার উপর এক একটি কাজের ভার ন্যস্ত রয়েছে। হযরত আবু উমামা বাহেলী (রাঃ) বলেছেন, হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন যে, প্রত্যেক মু'মিনের উপর একশ' ষাট জন করে ফিরেশতা নিযুক্ত আছে। চক্ষুর জন্য সাতজন ফিরেশতা মোতায়েন রয়েছে। গ্রীষ্মকালে মধুর পাত্রের উপর থেকে যেরূপ মশা-মাছি বিতাড়িত করা হয় তদ্রূপ তারা চক্ষু থেকে অনিষ্টকর বস্তু তাড়িয়ে দেয়। 

        হযরত দাউদ (রহঃ) বলেছেন, আমরা বলেছি মানুষের সন্তানের সঙ্গে জ্বিনেরও সন্তান জন্মরাহণ করে। কারা মানুষের সন্ধাদের সাথে একইভাবে বর্ণিত হয়। হাসরত জাবের ইবনে আবদুর্যাধ (রাঃ) থেকে গর্বিত আছে, যখন হয়রত আদম (আঃ)কে মুদিয়ায় পাঠিয়ে দেয়া হল, তখন তিনি বললেন, যে সত্ত্ব। তুমি শয়তানের সাথে আমার শত্রুতা সৃষ্টি করেছ। তার বিরুদ্ধে যদি তুমি আমাকে সাহায্য না কর তবে তার সাথে আমার সংগ্রাম করবার শক্তি থাকবে না। আল্লাহতায়ালা বললেন, তোমার এমন কোন সন্তান জন্মগ্রহণ করবে না যার সাথে অন্ততঃ একজন ফিরেশতা থাকবে না। হযরত আদম (আঃ) বললেন, যে মানুষ। তুমি আমাকে আরও কিছু আশার কথা শ্রবণ করাও। তখন আল্লাহতায়ালা বললেন, আমি তোমার এবং তোমার সন্তানদের একটি পাশের জন্য একটি শান্তি দেব কিন্তু একটি পুণ্যের বদলে আমি সশটি পুণ্য বা আমার ইচ্ছানুসারে ততোধিক শূণ্য দান করব। হযরত আদম (আঃ) বললেন, হে মাবুদ! আমাকে আরও আশ্বস্ত কর। আল্লাহতায়ালা বললেন, তোমার এবং তোমার সন্তানদের যে পর্যন্ত দেহে প্রাণ থাকবে সে পর্যন্ত তাওবাহর দরজা উন্মুক্ত রাখা হবে।

        ইবলীস আল্লাহকে সম্বোধন করে বলল, হে প্রভু! তুমি তোমার এ বান্দাকে সম্মানিত করেছ। যদি তুমি আমাকে তার বিরুদ্ধে সাহায্য না কর তবে তার সাথে আমার সংগ্রাম করবার শক্তি থাকবে না। তখন আল্লাহতায়ালা বললেন, হে ইবলীস। জেনে রাখ, তার কোন সন্তান হবার সাথে সাথে তোমারও একটি সন্তান হবে। ইবলীস বলল, হে প্রভু। আমার জন্য আরও বেশী পক্তি ও সামর্থ্যের ব্যবস্থা কর। আল্লাহ বললেন, তুমি তাদের মধ্যে রক্ত চলাচলের ন্যায় চলাচল করবে এবং তাদের বক্ষকে নিজের আবাসরূপে বানিয়ে নেবে। ইবলীস বলল, প্রভু! তুমি আমাকে আরও ক্ষমতা দাও। আল্লাহ বললেন, তোমার অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্যবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে একত্র হবে এবং ধন-সম্পদে এবং সন্তান-সন্ততিতে তাদের সঙ্গে শরীক হবে আর তাদেরকে ওয়াদা দেবে। কিন্তু তোমার সে ওয়াদা প্রবঞ্চনা ব্যতীত আর কিছু
নয়।

জ্বিন তিন প্রকারঃ হযরত আবু দারদা (রাঃ) বলেন, হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন যে. আল্লাহতায়ালা তিন প্রকার জ্বিন সৃষ্টি করেছেন। এক প্রকার জ্বিন সর্প, বিচ্ছু এবং মাটির কীট ইত্যাদি। দ্বিতীয় প্রকার জ্বিন শূন্যের উপর বায়ুর ন্যায় চলাচল করে এবং তৃতীয় প্রকার জ্বিনের হিসাব-নিকাশ হবে। তাদের জন্য পুরস্কার এবং শান্তি আছে।

মানুষ তিন প্রকারঃ আল্লাহতায়ালা তিন প্রকার মানুষ সৃষ্টি করেছেন। এক প্রকার মানুষ পশু সদৃশ। আল্লাহতায়ালা বলেন, তাদের হৃদয় আছে, কিন্তু তদ্বারা তারা কিছু বুঝে না। তাদের চক্ষু আছে; কিন্তু তদ্বারা তারা দেখে না। তাদের কর্ণ আছে; কিন্তু তদ্বারা তারা শুনে না। তারা পশুর ন্যায় বরং আরও বেশী ভ্রষ্ট। যেমন কুরআনে মজীদে উক্ত হয়েছেঃ "লাহুম কুলুবুল্লা ইয়াফাতুন। বিহা অ লাহুম আ'ইয়ুনু প্লাইয়ুবছিরুনা বিহা অ লাহুম আযানু ল্লাইয়াসমাউন। বিহা-উলায়িকা কাল আনআমি বাল হুম আদ্বাল্ল"। দ্বিতীয় প্রকার মানুষের আদম সন্তানের যার দেহ র‍ইয়েছে কিন্তু তাদের হৃদয় রয়েছে শয়তানের হৃদয়  সদৃশ। তৃতীয় প্রকার মানুষ। যেদিন আল্লাহর ছায়াতলে থাকবে, সেদিন আল্লাহর ছায়া ব্যতীত অন্যকোন ছায়া থাকবে না। পরতার ও হরত ইয়াহইয়া (লাঃ)। হযরত ওয়াহহাব ইবনে ওয়ারদ (রহঃ) বলেছেন যে, আমরা ওদেছি, শয়তান একসা হযরত ইয়াহইয়া (আঃ) এর নিকট একজন মানুষের রূপ ধরে এসে বলল, আমি তোমাকে কিন্তু উপদেশ দিতে চাই। তিনি বললেন, তোমার উপদেশে আমার ভোর ভাস্থ্যজর দেই। তবে আদম সন্তানদের সম্পর্কে কিছু বলতে পার। শয়তান বলল, আমাদের দৃষ্টিংও আদম সন্তান তিন প্রকার। এক প্রকার আমাদের নিকট খুবই কঠোর। তাদের নিকট আমরা গন্ধন করে তাদেরকে বিপদলিপ্ত করে নিয়ে আমরা নিশ্চিন্তে বসে থাকি। ওদিকে তারা তাওগার ও ক্ষমার আশ্রয় গ্রহণ করে তাদের নিকট থেকে আমরা যা' অর্জন করি, তা' সম্বলে বিনাশ করে দেয়। তারপর আবার আমরা তাদের নিকট যাই এবং তারাও আবার ক্ষমা প্রার্থনা করে। এভাবে আমরা তাদের সম্বন্ধে নিরাশ হয়ে যাই এবং তাদের দ্বারা আমাদের কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধি হয় না। তাদের ব্যাপারে আমাদের বহু কষ্ট, ক্লেশ ও অশান্তির মধ্যে কাটাতে হয়।

        দ্বিতীয় প্রকার মানুষ আমাদের হস্তে বালকদের হস্তের পুতুলের ন্যায়। তাদেরকে আমরা যখন যেরূপ ইচ্ছে করে নেই, তারাই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট।

        আর তৃতীয় প্রকার মানুষ তোমাদের ন্যায় সম্পূর্ণ নিখুঁত এবং নিষ্পাপ। তাদের উপর আমরা কখনও আমাদের কর্তৃত্ব খাটাতে পারি না।

        প্রশ্ন। শয়তান কোন কোন লোকের নিকট আকৃতি ধারণ করে আসে, আবার কোন লোকের নিকট অন্ত্রণ আসে না, যদি কখনও তার আকৃতি দেখা যায় তা-ই কি তার প্রকৃত আকৃতি বা আকৃতির অনুতপ? যদি তা-ই তার প্রকৃত আকৃতি হয় তাহলে আবার কখনও কখনও তাকে বিভিন্ন আকৃতিতে দেখা যায় কেন? আবার কিরূপেই বা তাকে একই সময় দুটি স্থানে দুটি আকৃতিতে দেখা যায়? দু' ব্যক্তি তাকে একই সময় দুটি বিভিন্ন আকৃতিতে কি করে দেখতে

        উত্তরঃ হে প্রশ্নকারী। তোমার প্রশ্নের উত্তর এই যে, জেনে রাখ, ফিরেশতার আকৃতি আছে এবং শয়তানেরও আকৃতি আছে, নবুয়তের নূর ব্যতীত তাদের প্রকৃত আকৃতি দেখা যায় না। হুযুরে পাক (দঃ) ফিরেশতা জিব্রাইলকে তার প্রকৃত আকৃতিতে মাত্র দু'বার দেখেছিলেন, তাও সম্ভব হয়েছিল এই কারণে যে, তিনি তা' দেখতে চেয়েছিলেন এবং ফিরেশতা জিব্রাইল তাঁকে তা' দেখাবার ওয়াদা করেছিলেন। একবার হেরা পর্বতের গুহায় তিনি ফিরেশতা জিব্রাইলকে তার প্রকৃত আকৃতিতে দেখেছিলেন। তখন জিব্রাইল সারা জগতের পূর্ব সীমান্ত থেকে পশ্চিম সীমান্ত পর্যন্ত জুড়ে ছিলেন। দ্বিতীয়বার ছাদরাতুল মুস্তাহার নিকট মে'রাজের রাত্রে তিনি তাঁর প্রকৃত রূপ দেখেছিলেন। এ ছাড়া সবসময় তিনি সাধারণতঃ জিব্রাইলকে কোন না কোন মানবাকৃতিতে দেখেছেন। একবার তিনি তাঁকে হযরত দাহিয়াতুল কালবীর আকৃতিতে দেখেছিলেন। অধিকাংশ সময়ই তিনি কাশফওয়ালা সুফীদের নিকট দাহিয়াতুল কালবীর আকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করতেন।

        এভাবে হুযুরে পাক (দঃ) শয়তানকেও বিভিন্ন আকৃতিতে দেখেছেন। জাগ্রত অবস্থায় হুযুরে পাক (দঃ) এর সামনে শয়তান তাঁর আকৃতি ধারণ করে আসত। তখন তিনি তাকে নিজের চোখ দ্বারা দেখতেন এবং কর্ণদ্বারা তার কথা শুনতেন। তখন সে তার প্রকৃত আকৃতির প্রায় অনুরূপ আকৃতি ধরে আসত। যেমন সে অধিকাংশ ধার্মিক লোকের নিকট আত্মপ্রকাশ করে থাকে। কোন লোক শয়তানকে জাগ্রত অবস্থায় দেখতে চাইলে আধ্যাত্মিক জগতে তার এতদূর পৌঁছা আবশ্যক যে পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও সংসারের ব্যস্ততা থাকলেও স্বপ্নে তা' প্রকাশ পেতে বাধাপ্রাপ্ত হয় না। এরূপ লোকগণ স্বপ্নে যা দেখে জাগ্রত অবস্থায়ও তা' দেখে।

        হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আযীয বলেছেন যে, আদম সন্তানের হৃদয়ের কোন স্থানে শয়তান বসবাস করে তা' তাকে দেখাবার জন্য তিনি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করলেন, তখন স্বপ্নে তিনি কাঁচের ন্যায় একটি লোকের আকৃতি দেখতে পেলেন। তার বাইরে থেকে ভিতরের সব জিনিস দেখা যেতে লাগল। তিনি শয়তানকে ব্যাংএর ন্যায় তার বামকাঁধের উপর উপবিষ্ট দেখতে পেলেন। এর কর্ণ ও কাঁধের মধ্যবর্তী স্থানে একটি অতি সূক্ষ্ম শুঁড় দেখতে পেলেন। সে গুঁড় তার বাম কাঁধ থেকে তার হৃদয়ের দিকে প্রবেশ করানো রয়েছে এবং সে তাকে তার সাহায্যে কুমন্ত্রণা দিচ্ছে। যখন তিনি আল্লাহর যিকির করেন, ঐ শুড় সঙ্কুচিত হয়ে যায়।

        জাগ্রত অবস্থায়ও চক্ষুদ্বারা তদ্রূপ শয়তানকে দেখতে পাওয়া যায়। কোন কোন আল্লাহওয়ালা লোক তাকে মৃত প্রাণীর উপর দংশনকারী কুকুরের ন্যায় আত্মপ্রকাশ করতে দেখেছেন। সে লোকদেরকে ঐ মৃত প্রাণীর দিকে ডাকতেছেন। সংসার মৃত প্রাণীসদৃশ। প্রকৃত মৃত প্রাণীর আকৃতি যেরূপ দেখা যায় শয়তানের আকৃতিও তদ্রূপ দেখা যায়। আত্মার মুখ যদি আধ্যাত্মিক জগতের সম্মুখীন করে রাখা যায় তার চিহ্নের জ্যোতি ঐ মুখের উপর পতিত হয়, তা' আবার এই প্রত্যক্ষ জড় জগতের দিকের সম্মুখীন হয়। কেননা এর একটি অন্যটির সাথে জড়িত।

        আমরা উল্লেখ করেছি যে, হৃদয়ের দুটি দরজা আছে। একটি অদৃশ্য জগতের দিকে এবং তা' এলহাম ও অহীর প্রবেশপথ। অন্য দরজাটি জড়জগতের দিকে। যে দরজা প্রকাশ্য জড়জগতের দিকে তদ্বারা কল্পনাজনিত আকৃতি হৃদয়ের উপর প্রকাশ হয়। কেননা প্রকাশ্য জগতের সব জিনিসই কল্পনামূলক। তবে সেই ধারণা কখনও পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বাহ্যিক জড়জগতে পাওয়া যায়। তখন এই ধারণা অনুযায়ী প্রকাশ্য জগতের প্রকৃত আকৃতি তদ্রূপ নাও হতে পারে। এমনকি যদি কোন সুন্দর আকৃতি বিশিষ্ট লোককে দেখতে পাওয়া যায়, তার হৃদয় হয়ত কুৎসিত ও কদর্য হয়। কেননা প্রকাশ্য জগত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রবঞ্চনাপূর্ণ। অদৃশ্য জগতের নূর যে কল্পনা হৃদয়ের অন্তঃস্থলে থেকে যে আকৃতি গঠন করে তার গুণের আকৃতি ব্যতীত হয় না। কেননা অদৃশ্য জগতের সেই গুণানুযায়ী আকৃতি গঠিত হওয়াই রীতি। সুতরাং এটা সন্দেহাতীত যে. কুৎসিত দোষ কুৎসিত আকারই ধারণ করে। এভাবে শয়তানকে কুকুর, ব্যাঙ, শূকর ইত্যাদি আকৃতিতে দেখা যায়। আর ফিরেশতাকে সুন্দর আকৃতিতে দেখা যায়। তখন সেই আকৃতি গুণের আধার হয় এবং সত্যের সাথে তার সামঞ্জস্য থাকে এবং এজন্যই স্বপ্নে বানর ও শূকর ইত্যাদি দেখলে তা' মন্দলোক মনে করবে এবং বকরী দেখলে তা' সৎলোক মনে করবে। এরূপে স্বপ্নের মর্ম বুঝে নেবে। এটা অত্যন্ত আশ্চর্যজনক গুপ্তকথা এবং তা' আত্মার অত্যাশ্চর্য গুপ্ত গুণ, যা ব্যবহারিক জ্ঞান দ্বারা বর্ণনা করা যায় না। শয়তান যে সময় সময় কলবের লোকদের নিকট দৃষ্টান্তের আকৃতি নিয়ে উপস্থিত হয় তা' সমর্থন করাই আমাদের উদ্দেশ্য। তদ্রূপ ফিরেশতাও দৃষ্টান্তরূপে মানুষের নিকট আবির্ভূত হয় যেরূপ স্বপ্নে আকৃতি দেখা যায়। কখনও কখনও ফিরেশতা প্রকৃত রূপেই মানুষের নিকট আবির্ভূত হয়; কিন্তু অধিকাংশ সময় গুণের দৃষ্টান্তের আকারে আবির্ভূত হয়। সেটা গুণের দৃষ্টান্ত বা উপমা, প্রকৃত আকৃতি নয়। তবে চক্ষুর দৃষ্টি, প্রকৃত দৃষ্টি এবং অদৃশ্য জিনিসের প্রতি দৃষ্টি স্বপ্নের মধ্যে দৃষ্টান্তের রূপে আত্মপ্রকাশ করে

Post a Comment

0 Comments