রসনার দ্বাদশ বিপদঃ গুপ্ত কথা প্রকাশ করা রসনার দ্বাদশ বিপদ। গোপনীয় বিষয় প্রকাশ করে দেয়া নিষিদ্ধ কাজ। কেননা তাতে অন্যের মনে কষ্ট হয় এবং বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিত লোকের কাছে তা' হেয়জনক। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, যখন কোন লোক গোপনে তোমার নিকট কোন কথা বলে, তা' গোপন রাখতে বলে, তা' তোমার নিকট আমানত তুল্য। হযরত হাসান বছরী (রহঃ) বলেছেন, তোমার ভ্রাতার গুপ্তকথা প্রকাশ করলে তা' বিশ্বাস ভঙ্গের কার্য হয়। বর্ণিত আছে যে, হযরত মুআবিয়া অলীদ ইবনে ওৎবার নিকট একটি গুপ্তকথা বলেছিলেন। অলীন তার পিতাকে বলল, হে পিতাঃ। আমীরুল মু'মিনীন আমার নিকট একটি গুপ্তকথা বলেছেন। আমি মনে করি সে কথাটি আপনার নিকট প্রকাশ করায় দোষ নেই। তার পিতা বলল, না, তা' তুমি আমার নিকটও প্রকাশ করো না। কেননা যে ব্যক্তি তার গুপ্তকথা গোপন রাখে সে তার অধীন থাকে। যখন সে তা' প্রকাশ করে দেয় তখন অন্যের অধীনে চা চলে যায়। অলীদ বলল, হে পিতঃ। কথাটি তো শুধু পিতা ও পুত্রের মধ্যেই থাকবে। পিতা বলল, আল্লাহর কসম হে বৎস। তা' নয়, আমি চাই যে, তোমার গুপ্তকথা প্রকাশ করে তোমার রসনাকে হীন করো না। তারপর অলীদ খলীফা মুআবিয়ার নিকট গিয়ে তাদের পিতাও পুত্রের মধ্যে যে কথা-বার্তা হল, তা' আদ্যপান্ত বর্ণনা করল। শুনে খলীফা মুআবিয়া বললেন, হে অলীদ। তোমার পিতা তোমাকে ভুলের গোলামী থেকে মুক্ত করেছে। মোটকথা গুপ্তকথা প্রকাশ করলে বিশ্বাস ভঙ্গ করা হয় এবং তা' হারাম। কেননা তার মধ্যে ক্ষতি ও অনিষ্ট রয়েছে।
রসনার ত্রয়োদশ বিপদঃ মিথ্যা অঙ্গীকার করা রসনার অন্যতম বিপদ। কেননা অনেক সময়ই তাড়াহুড়া করে ত্রস্ততার সাথে রসনা কোন বিষয় অঙ্গীকার করে ফেলে। কিন্তু তা' সব সময় পূর্ণ করা সম্ভব হয় না। যার ফলে অঙ্গীকার ভঙ্গ করতে হয়। এটা-ই মুনাফিকীর কুমন্ত্রণা। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, "আওফু বিল উদ্বুদ।" অর্থাৎ হে মু'মিনগণ। ওয়াদা পূর্ণ কর। হুযুরে পাক (সঃ) বলেছেন, অঙ্গীকার উপহার সদৃশ। তিনি আরও বলেছেন, ওয়াদা এক প্রকার ঋণ বা তার চেয়ে বড়। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে হযরত ইসমাইল (আঃ)কে ওয়াদার ব্যাপারে প্রশংসা করে বলেছেন, "নিশ্চয়ই তিনি অঙ্গীকার পালনে সত্যবাদী ছিলেন।" কোন কোন বর্ণনাকারী বলেছেন যে, হযরত ইসমাইল (আঃ) একদা এক ব্যক্তিকে কোন নির্দিষ্ট স্থানে সাক্ষাত করবার অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্তু লোকটি তার ওয়াদা অনুযায়ী সে স্থানে উপস্থিত হয়নি। লোকটি তার ওয়াদার কথা ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু হযরত ইসমাইল (আঃ) বাইশদিন পর্যন্ত সেই স্থানে তার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন।
হযরত ওমর (রাঃ) এর পুত্র আবদুল্লাহর মৃত্যু সময় উপস্থিত হলে তিনি বললেন, জনৈক কুরায়েশ ব্যক্তি আমার কন্যার বিবাহপ্রার্থী হয়েছিল। আমি তাকে একপ্রকার ওয়াদা দিয়েছিলাম। আল্লাহর কসম আমি তিনটি মুনাফিকী নিয়ে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করব না। আমি তোমাদের নিকট সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমার কন্যাকে তার নিকট বিবাহ দেব। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে খামছাহ (রাঃ) বলেছেন; নবী হবার পূর্বে হুযুরে পাক (দঃ) এর সাথে আমার একটি দ্রব্য বিক্রি করবার চুক্তি হয়েছিল। সে জিনিসটি তাঁকে দেয়া বাকী ছিল। আমি অঙ্গীকার করলাম যে, তা' এক নির্দিষ্ট স্থানে তাঁকে পৌছে দেব। কিন্তু পরে তা' ভুলে গিয়েছিলাম। তার পরবর্তী দিন সে কথা আমার স্মরণ হলে, আমি সেখানে গিয়ে দেখলাম, হুযুরে পাক (দঃ) তথায় অবস্থান করছেন। তিনি আমাকে দেখে বললেন, হে যুবক! তুমি আমাকে বহু কষ্ট দিয়েছ। তোমার অপেক্ষায় আমি এখানে তিনদিন পর্যন্ত অবস্থান করছি।
হযরত ইব্রাহীম ইবনে আদহাম (রহঃ) বলেছেন, আমার নিকট এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, যদি কোন লোকের সাথে কেউ ওয়াদা করে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যদি তা' সে পূর্ণ না করে তাহলে কি করতে হবে? তিনি বললেন, যে পর্যন্ত নামাযের সময় না আসে সে পর্যন্ত তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। হযুরে পাক (দঃ) যখন ওয়াদা করতেন, তিনি 'সম্ভবতঃ' কথাটা ব্যবহার করতেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) 'ইনশাআল্লাহ' না বলে কোন ওয়াদা করতেন না। এ রীতি-ই উত্তম। এর সাথে দৃঢ়সঙ্কল্প থাকলে, কোন ওজর বা আপত্তি না থাকলে তা' পূর্ণ করতে হবে। যদি সেই ওয়াদা পূর্ণ করা হবে না বলে সংকল্প করা হয় তবে তা' মুনাফিকী হবে। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, যার মধ্যে এই তিনটি বিষয় আছে সে মুনাফিক। যদিও সে নামায পড়ে ও রোযা রাখে এবং মনে করে যে, সে মুসলমান। বিষয় তিনটি এইঃ (১) যখন সে কথা বলে, মিথ্যা কথা বলে। (২) যখন সে ওয়াদা করে, ভঙ্গ করে। (৩) যখন তাকে বিশ্বাস করা হয়, সে তা' ভঙ্গ করে।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলেছেন যে, হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, যার মধ্যে এ চারটি বিষয়ের একটিও থাকে সে মুনাফিক। যথাঃ (১) কথা বললে, মিথ্যা বলে। (২) ওয়াদা করলে তা' ভঙ্গ করে। (৩) তাকে বিশ্বাস করা হলে সে বিশ্বাসের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে (৪) বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ হলে তিরস্কার এবং কটুকথা বলে।
যে ব্যক্তি ওয়াদা পূর্ণ করবার দৃঢ়সংকল্প করে কিন্তু কোন কারণে তা' পূর্ণ করতে পারে না। সে মুনাফিক হবে না। স্মরণ রাখতে হবে যে, যেভাবে নিজেকে মুনাফিকী থেকে রক্ষা করতে হয় তদ্রূপ মুনাফিকীর নিদর্শন থেকেও আত্মাকে রক্ষা করতে হয়। এক্ষেত্রে বিশেষ প্রয়োজন ব্যতীত সাধারণ ওজর-আপত্তি পেশ করা উচিত নয়।
বর্ণিত আছে যে, হুযুরে পাক (দঃ) একদা আবুল হাইছ্যমকে তিনজন গোলাম দেবার ওয়াদা করেছিলেন। তিনি তিনজন যুদ্ধবন্দীকে পেয়ে দু'জন ঐ ব্যক্তিকে দিয়ে একজন গোলাম তার নিজের নিকট রেখে দিলেন। তখন তাঁর কন্যা হযরত ফাতেমা (রাঃ) এসে একটি গোলামের জন্য তাঁর কাছে আবেদন করে বললেন, আপনি কি আমার হাতে আটা পেষার চিহ্ন দেখতে পাচ্ছেন না? তখন হুযুরে পাক (দঃ) আবুল হাইছামের নিকট তাঁর ওয়াদার কথা স্মরণ করে তিনি বললেন, তা' হলে আবুল হাইছামের সাথে আমার ওয়াদার কি হবে? মোটকথা তিনি কন্যা ফাতেমা (রাঃ)কে গোলামটিকে না দিয়ে আবুল হাইছামকে দিয়ে দিলেন। কেননা তিনি আবুল হাইছামের সাথে পূর্বেই তিনটি গোলাম দেবার ওয়াদায় আবদ্ধ ছিলেন। হযরত রাসূলে করীম (দঃ) ওয়াদা রক্ষার প্রতি কত বেশী গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন, এ ঘটনাটির মধ্য দিয়ে তা' অনুধাবন করা যায়।
একদা হুযুরে পাক (দঃ) হোনায়নের যুদ্ধলব্ধ ধন বিতরণ করতেছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি তথায় উপস্থিত হয়ে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ (দঃ)! আপনার ওয়াদাহ অনুযায়ী একটি জিনিস আমি পাওনা আছি। তিনি বললেন, তোমার কথা সত্য। যা' ইচ্ছে চাইতে পার। সে ব্যক্তি তখন আশিটি বকরী এবং একটি রাখাল চাইল। হুযুরে পাক (দঃ) তা-ই তাকে দিয়ে দিলেন এবং বললেন, তুমি খুব সামান্যই চেয়েছ। দেখ, যে স্ত্রীলোকের সন্ধানক্রমে হযরত ইউসুফ (আঃ) এর অস্থিখন্ড পাওয়া গিয়েছিল, হযরত মুসা (আঃ) সেই স্ত্রীলোকটিকে বলেছিলেন, তুমি যা' চাইবে, তা-ই পাবে। তখন সেই স্ত্রীলোকটি নিবেদন করেছিল আমি যেন আমার যৌবন ফিরে পাই এবং পরকালে আপনার সাথে যেন বেহেশতে থাকতে পারি। এই বকরী প্রার্থী পরবর্তীকালে আরবের মধ্যে একটি উপমাস্থলে পরিণত হয়েছিল। মানুষ বলত, অমুক ব্যক্তি আশিটি বকরী একটি রাখাল পেয়েও তুষ্ট নয়।
হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, যদি ওয়াদা পূর্ণ করবার নিয়ত থাকে, তা'হলে এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তিকে ওয়াদা দিলে ভঙ্গ হবে না। অন্য বর্ণনায় আছে, যখন কোন লোক তার ভ্রাতার সাথে কোন ওয়াদা করে এবং তা' পূর্ণ করবার তার নিয়ত থাকে, কিন্তু পরে তা' ভঙ্গ হয়ে যায়, তাতে তার পাপ হবে না।
0 Comments