আল্লাহতায়ালা তিন ব্যক্তিকে ভালবাসেন ও তিন ব্যক্তিকে ভালবাসেন না

        হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, আল্লাহতায়ালা তিন ব্যক্তিকে ভালবাসেন, যথাঃ (১) যে ব্যক্তি জিহাদের সারিতে দন্ডায়মান থেকে শহীদ না হওয়া পর্যন্ত বা তার ও তার সঙ্গীদের বিজয় না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ করতে থাকে। (২) যে ব্যক্তির অসৎ প্রতিবেশী তাকে অনবরতঃ কষ্ট দেয় এবং যে তার অনিষ্টে ও কষ্টে ধৈর্য ধারণ করে থাকে, যে পর্যন্ত না মৃত্যু বা সফর তাদের উভয়ের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ঘটিয়ে দেয়। (৩) যে ব্যক্তি ভ্রমণে একটি কাফেলার বা সৈন্যদলের সাথে থাকে কিন্তু ঐ দল এতদূর পথ ভ্রমণ করে যে, তারা উত্তম স্থান দেখে তথায় অবতরণ করে বিশ্রাম করে ও নিদ্রা যায় কিন্তু ঐ ব্যক্তি এক কোণে আশ্রয় গ্রহণ করে তার সঙ্গীদের নিদ্রা থেকে জাগ্রত না হওয়া পর্যন্ত নামায পড়তে থাকে।

        আর আল্লাহতায়ালা যে তিন ব্যক্তিকে ভালবাসেন না অর্থাৎ ঘৃণা করেন, তারা হলঃ (১) মিথ্যা হলফকারী ব্যবসায়ী (২) অহংকারী দরিদ্র লোক এবং (৩) কৃপণ এবং কষ্টপ্রদানকারী ব্যক্তি। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি মানুষকে হাসাবার জন্য কথাবার্তা বলে ও তন্মধ্যে মিথ্যা কথা বলে, তার জন্য আক্ষেপ, তার জন্য আক্ষেপ, তার জন্য আক্ষেপ। তিনি আরও বলেছেন, আমি স্বপ্নে দেখলাম যে একজন লোক যেন আমার নিকট এসে আমাকে বলল, উঠ। আমি উঠলাম কিন্তু তখন আমি দু'জন লোকের মধ্যবর্তী পড়ে গেলাম। তাদের একজন দন্ডায়মান এবং অন্যজন উপবিষ্ট। দন্ডায়মান ব্যক্তির হস্তে লৌহ কন্টক। যে লোকটি উপবিষ্ট, সে লোকটির গন্ডে ঐ কষ্টক বিদ্ধ আর দন্ডায়মান ব্যক্তি ঐ কন্টক সজোরে টানতেছে। যখন তার মুখ স্কন্ধ পর্যন্ত নেমে এল, তখন সে ঐ কন্টক অন্য গন্ডে বিদ্ধ করে টানতে লাগল, যখন পর্যন্ত না তা' তার স্বন্ধ পর্যন্ত নেমে এল। যে ব্যক্তি আমাকে জাগ্রত করল, আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যপার কি? সে বলল, ঐ ব্যক্তি বড় মিথ্যাবাদী। রোজ কিয়ামত পর্যন্ত তার এভাবেই কবর আযাব হতে থাকবে।

        হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, আমি হুযুরে পাক (দঃ) কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল। মু'মিন ব্যক্তি কি ব্যভিচার করতে পারে? তিনি বললেন, তা' পারে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মু'মিন ব্যক্তি কি মিথ্যা বলতে পারে? তিনি বললেন, না, তা' পারে না। তারপর তিনি আল্লাহতায়ালার অত্র আয়াত উদ্ধৃত করলেন। "যারা আল্লাহর আয়াতে বিশ্বাস রাখে না, তারাই মিথ্যা তৈরী করতে পারে।" হযরত আবু সাইদ খুদরী (রাঃ) বলেন, আমি হুযুরে পাক (দঃ)কে দোয়া করতে দেখেছি এবং তিনি তাঁর দোয়ায় বলতেছিলেন, হে মাবুদ! মুনাফিকী থেকে আমার হৃদয়কে, ব্যভিচার থেকে আমার গুপ্তাঙ্গকে এবং মিথ্যা থেকে আমার রসনাকে পবিত্র কর। তিনি আরও বলেছেন, আল্লাহতায়ালা তিন ব্যক্তির সাথে কথা বলবেন না। এবং তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করবেন না। তাদেরকে পবিত্র করবেন না ও তাদের জন্য ভীষণ শান্তি আছে। বৃদ্ধ ব্যভিচারী, মিথ্যাবাদী নরপতি এবং অহঙ্কারী ভিক্ষুক।

        হযরত আবুল ইবনে আমের বলেছেন, একদা হুযুরে পাক (দঃ) আমাদের গৃহে তাশরীফ আনলেন, তখন আমি কচি বালক ছিলাম। আমি খেলতে গেলে আমার মাতা আমাকে বলতেন, হে আবদুল্লাহ। এস, আমি তোমাকে কিছু দেব। হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, তুমি তাকে কি দেবে? তিনি বললেন, খুরমা দেব। হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, সতর্ক হও, যদি তুমি তাকে কিছু না দিতে, তোমার নামে একটি মিথ্যা লিপিবদ্ধ হত।

        হুযুরে পাক (দঃ) আরও বলেছেন, যদি আল্লাহতায়ালা এই প্রস্তর খন্ডগুলোর ন্যায় অসংখ্য ধনরাশি দান করতেন, নিশ্চয়ই আমি তা' তোমাদের মধ্যে দান করে দিতাম। আমাকে তোমরা নিশ্চয়ই কৃপণ পেতে না, মিথ্যাবাদী এবং কাপুরুষ পেতে না। তিনি তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বলতেছিলেন, আমি কি তোমাদেরকে মহাপাপের বিষয়ে সংবাদ দেব না? আল্লাহর সাথে শরীক করা এবং পিতামাতার অবাধ্য হওয়া (তারপর তিনি উপবেশন করে বললেন) সতর্ক হও, মিথ্যা কথা বলা। হুযুরে পাক বললেন, তার সঙ্গীয় ফিরেশতা তার দুর্গন্ধে এক মাইল দূরে চলে যায়। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, তোমরা ছয়টি বিষয় গ্রহণ করলে আমি তোমাদের জন্য বেহেশত সাব্যস্ত করব। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করল, তা কি? তিনি বললেন, তা' হল, (১) তোমাদের মধ্যে কেউ কথা বললে সে যেন মিথ্যা না বলে। (২) কেউ কোন ওয়াদা করলে সে যেন তা' ভঙ্গ না করে। (৩) কেউ কোন আমানত গ্রহণ করলে সে যেন তার খেয়ানত না করে। (৪) তোমাদের দৃষ্টিকে যেন সংযত করা হয়। (৫) তোমদের গুপ্তাঙ্গকে যেন রক্ষা করা হয়। (৬) তোমাদের হস্তকে যেন নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, শয়তানের জন্য সুর্মা, সুগন্ধি এবং সুস্বাদ আছে। তার সুগন্ধির অর্থ মিথ্যা কথা বলা, সুস্বাদের অর্থ ক্রোধ, সুর্মার অর্থ নিদ্রা।

        একদা হযরত ওমর (রাঃ) খুৎবার মধ্যে বললেন, হুযুরে পাক (দঃ) তোমাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে যেরূপ খুৎবা দিতেন তদ্রূপ একদা আমাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে খুৎবা দান কালে তিনি বললেন, আমার ছাহাবীদের প্রতি তোমরা উত্তম ব্যবহার করবে এবং তার পরবর্তী পর্যায়ের লোকদের প্রতিও উত্তম ব্যবহার করবে। এরপরই তোমাদের মধ্যে মিথ্যার প্রসার হবে। এমনকি কোন কোন লোক শপথ করার পর শপথ করে বলবে যে, আমি শপথ করি নি এবং সাক্ষ্য দেয়ার পর সাক্ষ্য দেবে যে, আমি সাক্ষ্য দেই নি। তিনি আরও বললেন, যে ব্যক্তি কোন হাদীসকে মিথ্যা জেনেও তা' আমার সাথে সম্পৃক্ত করে, সে মিথ্যাবাদীদের অন্তর্গত। তিনি আরও বলেছেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা শপথ করে অন্য মুসলমানের ধন অন্যায়ভাবে গ্রহণ করে, আল্লাহতায়ালা অসন্তুষ্ট থাকাবস্থায় তার আল্লাহর সাথে সাক্ষাত হবে।

           বর্ণিত আছে যে, হুযুরে পাক (দঃ) জনৈক মিথ্যাবাদী মুসলমানের সাক্ষ্য সরাসরি অগ্রাহ্য করেছিলেন। তিনি বলেছেন, মুসলমান বিভিন্ন দোষের কার্য করতে পারে, কিন্তু তার মধ্যে খেয়ানত অর্থাৎ প্রতারণা এবং মিথ্যা কথা থাকতে পারে না। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, হুযুরে পাক (দঃ)এর ছাহাবীগণ মিথ্যা ব্যতীত অন্য কোন স্বভাবকে এত বেশী ঘৃণা করতেন না। হুযুরে পাক (দঃ) তাঁর ছাহাবীদের কারও মধ্যে মিথ্যার দোষ দেখতে পেলে তিনি তা' মন থেকে মুছে ফেলতে পারতেন না , যখন পর্যন্ত না তিনি শুনতে পেতেন যে, সে ব্যক্তি তাওবাহ করেছে। হসরত মুসা (আঃ) বলেছিলেন, যে প্রস্তু। তোষার নিকট কোন বান্দা ইবাদাতে শ্রেষ্ঠ? আল্লাহতায়ালা বললেন, যার  রসনা মিথ্যা কথা বলে না। যার হৃদয় কোন পাপ করে না; এবং যার গুপ্তাঙ্গ ব্যভিচার করে না। হাকীম  লোকমান তার পুত্রকে উপদেশ দিয়েছিলেন, হে পুত্র। মিথ্যা বলার ক্ষেত্রে সাবধান থাকবে। কেননা মিথ্যা কথা বলা চড়ুই পাখির মাংসের ন্যায় বৃথা কিন্তু বিখ্যাবানীর বিখ্যা কথাও যদ ফল অনতিবিলম্বেই প্রকাশ পাবে।

         হুজুরে পাক (দঃ) সত্য কথার প্রশংসা করতে দিয়ে বলেছেন, চারটি গুণ তোমার মধ্যে থাকলে  পাথিব কোন বস্তু তুমি না পেলেও তোমার কোন অনিষ্টের ভয় নেই। বস্তু চারটি এই। যথাঃ (১) সত্য কথা বলা। (২) আমানত রক্ষা করা। (৩) সৎ স্বভাব বিশিষ্ট হওয়া এবং (৪) হালাল খাদ্য গ্রহণ করা। হযরত আবুবকর (রাঃ) হুযুরে পাক (দঃ)এর ইন্তেকালের পর একদা খুৎবা দান কালে বলেছিলেন, হুযুরে পাক (দঃ) আজ আমি যেখানে দাঁড়িয়েছি সেখানে দাঁড়িয়েই বলেছিলেন, তোমরা সত্য বাক্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। কেননা সত্য ধর্মের সালে জড়িত এবং উভয়ই বেহেশতে অবস্থিত। একথা বলে তিনি ক্রন্দন করতেছিলেন। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, তোমরা আল্লাহকে ভয় করবে। সত্য কথা বলবে, আমানত বহাল রাখবে, প্রতিজ্ঞা রক্ষা করবে, পরস্পর পরস্পরকে সালাম দেবে এবং নম্রতা অবলম্বন করবে।

        বিজ্ঞ দের বাণীঃ মিথ্যা কথার দোষ সম্বন্ধে বিজ্ঞ বুযর্গদের অসংখ্য বাণী রয়েছে। হযরত জালী (রাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তায়ালার নিকট সর্বপ্রধান দোষ মিথ্যাবাদীর রসনার দোষ এবং সর্বপ্রধান অনুতাপ বিচারের দিনের অনুতাপ। খলীফা ওমর ইবনে আবদুল আযীয বলেছেন, জাষি যে সময় থেকে পায়জামা পরিধান করতে শিখেছি সেই সময় থেকে কখনও মিথ্যা কথা বলি নি। হযরত ওমর (রাঃ) বলেছেন, তোমাদেরকে না দেখা পর্যন্ত তোমাদের উত্তম নামই আমাদের নিকট প্রিয়। কিন্তু যখন আমরা তোমাদেরকে দেখি তখন তোমাদের মধ্যে যে স্বভাব-চরিত্রে উত্তম সে-ই আমাদের নিকট প্রিয়। আর যখন আমরা তোমাদের সাথে কোন কারবার করি তখন তোমাদের মধ্যে যে কথা-বার্তায় সত্যবাদী এবং আমানত রক্ষায় দৃঢ়, সে-ই আমাদের নিকট অধিক প্রিয়।

        হযরত মাইমুন ইবনে আবি শাবীব (রহঃ) বলেছেন, আমি একদা একখানা পত্র লিখতে বলেছিলাম। লিখতে শুরু করে এমন একটি বাক্যের নিকট গিয়ে পৌঁছলাম যে, বাক্যটি লিখলে কথা সুন্দর হয় বটে, কিন্তু তা' মিথ্যা হয়। আমি তা' পরিত্যাগ করবার মনস্থ করলে আমার গৃহের এক পার্শ্ব থেকে কে যেন অদৃশ্য আওয়াজে বলতে লাগল, যারা প্রকৃত ঈমান এনেছে তাদেরকে আল্লাহতায়ালা ইহ-পরলোকে সুপ্রতিষ্ঠিত কালেমা দ্বারা দৃঢ় করবেন। হযরত শো'বী বলেছেন, আমি জানি না মিথ্যাবাদী এবং কৃপণের মধ্যে কে দোযখের নিম্নতম গহ্বরে থাকবে। হযরত ইবনে সাম্মাক (রহঃ) বলেছেন, আমার ধরণা এই যে, মিথ্যা কথা ত্যাগ করায় আমার কোনই পুণ্য হবে না। কেননা তা' আমি দুনিয়ার উপকারের জন্য ত্যাগ করি। হযরত খালেদ (রহঃ)কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, একটি মিথ্যা কথা বলায় কি কাউকে মিথ্যাবাদী বলে অভিহিত করা যায়? তিনি বললেন, হাঁ যায়। হযরত মালেক ইবনে দীনার (রহঃ) বলেছেন, আমি কোন এক কিতাবে পড়েছি যে, কোন বক্তার বক্তৃতা তার আমল দ্বারা যাচাই করা হবে। যদি তার আমল বক্তৃতানুযায়ী হয় তবে ত উত্তম। আর যদি তা' না হয় তবে দোযখের কাঁচি দ্বারা ওষ্ঠাধর কর্তন করা হবে। যখনই তা' কর্তন করা হবে আবার তা' ঠিক হয়ে যাবে। পুনরায় তা' কর্তন করা হবে। হযরত মালেক ইবনে দীনার (রহঃ) বলেছেন, মানবের মনে সত্য এবং মিথ্যায় অবিরাম লড়াই হতে থাকে যে পর্যন্ত না একটি অপরটিকে পরাভূত করে।

        একদা খলীফা ওমর ইবনে আবদুল আযীয অলীদ ইবনে আবদুল মালেককে কিছু কথা বলেছিলেন। তখন তিনি বললেন, আপনি মিথ্যা বলেছেন। একথা শুনে ওমর ইবনে আবদুল আযীয বললেন, আল্লাহর কসম! যে দিন আমি জানতে পেরেছি যে, মিথ্যা কথা লোককে হেয় ও অপমানিত করে সেদিন থেকে আমি কখনই মিথ্যা কথা বলি নি।

Post a Comment

0 Comments