আত্মার পরিচয় জ্ঞানের আবশ্যকতা

        মানবকুলের সম্মান এবং মর্যাদা সমগ্র সৃষ্টির উপরে অবস্থিত। কেননা মানুষ মহান প্রভুর পরিচয় জ্ঞান লাভের জন্য সর্বরকম চেষ্টায় নিয়োজিত। সেই পরিচয় জ্ঞানই তার ইহলোকে সৌন্দর্য, গৌরব সর্ববিষয়ে পূর্ণত্ব এবং পারলৌকিক অমূল্য ও পরম ধনে পরিণত হয়। মানুষ তার একমাত্র আত্মার দ্বারাই আল্লাহর সেই পরিচয় জ্ঞানলাভে সক্ষম হয়। তা' তার অন্য কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা নয়। কেবলমাত্র আত্মাই আল্লাহর তত্ত্বজ্ঞান অর্জন, তাঁর নৈকট্য লাভ এবং 'তাঁর উদ্দেশ্যে আমলসমূহ সাধন করতে পারে। আত্মার মাধ্যমেই আল্লাহর নিকট যে সৌভাগ্য রয়েছে, তা' অবগত হতে পারে। বস্তুতঃ আত্মাই হল দেহরাজ্যের রাজা। আর দেহ এবং দৈহিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হল তার অধীনস্থ সেবক, হাতিয়ার এবং আজ্ঞাবহ। আত্মা তারই কাজকর্মে তাদেরকে নিযুক্ত করে, যেরূপ রাজা তার প্রজাকে এবং মনিব তার দাসকে কার্যে নিযুক্ত করে। আত্মা আল্লাহর নিকট গৃহীত হয় তখন, যখন তা' আল্লাহ ব্যতীত অন্য সবকিছু হতে মুক্ত থাকে। কিন্তু যখন আত্মা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের প্রতি আসক্ত বা আকৃষ্ট হয়, তখন তা' আল্লাহ থেকে দূরে সরে যায়। অনুসন্ধান করা হবে শুধু আত্মাকে। জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে আত্মাকে এবং তিরস্কৃতও হবে একমাত্র আত্মা, আর এই আত্মাই আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে সৌভাগ্যবান হয়। আত্মাকে নির্মল ও পবিত্র করলে সে মুক্তিলাভ করে আর অপবিত্র ও কলুষিত হলে সে দুর্ভাগ্যের কবলিত হয়। প্রকৃতপক্ষে আত্মাই আল্লাহর অনুগত হয় এবং আনুগত্য ও ইবাদাতের ফলে তার সর্বাঙ্গে তার নূর বিকশিত হয়। পক্ষান্তরে এই আত্মাই আবার আল্লাহর অবাধ্য হয় এবং তজ্জন্য তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহে অপবিত্রতা ও কদর্য্যতার নিদর্শন প্রতিফলিত হয়। আত্মারই আলোকে এবং অন্ধকারের কারণে তার যত গুণাবলী ও দোষাবলী প্রকাশ্যে প্রকাশ পায়।

         তত্ত্ব জ্ঞানলাভে আত্মজ্ঞান লাভ চাইঃ মানুষ আত্মার পরিচয়ে জ্ঞানলাভের মাধ্যমে আত্মাকে বা নিজকে চিনতে পারে। আত্মার পরিচয় জ্ঞান অর্জিত না হলে মানুষ নিজকে চিনতে পারে না। নিজকে চিনতে না পারলে মানুষ আল্লাহকেও চিনতে পারে না। যে নিজ আত্মাকে চিনতে পারে না, সে অন্যের ব্যাপারে আরও অজ্ঞাত থাকে। অধিকাংশ মানুষই নিজ আত্মা এবং নফসের বিষয় অবগত নয়। তাদের আত্মা ও নফসের মধ্যে পর্দা পড়ে যায়। আল্লাহতায়ালা বলেছেনঃ "ইন্নাল্লাহা ইয়াহুলু বাইনাল মারয়ি ওয়া ক্বালবিহী।" অর্থাৎ আল্লাহতায়ালা বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা মানুষের ও তার আত্মার মধ্যে চলাফিরা করেন। আল্লাহ আত্মাকে এরূপ সংযত করেন যে, আত্মার দর্শন, চিন্তাকরণ এবং আল্লাহর গুণাবলীর পরিচয় জ্ঞানকে আবদ্ধ করে রাখেন।

        দয়াময় আল্লাহর দু' অঙ্গুলির মধ্যে আত্মার পরিবর্তন হচ্ছে। আত্মা কখনও চরম অধোগতির সর্বনিম্ন স্তরে গমনের মনোভাব নিয়ে শয়তানের দলের শেষ সীমা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। আবার কখনও বা আগ্রহান্বিত হয়ে পরম প্রভুর দরবারে উপনীত হয় এবং মুকাররব ফিরেশতা অর্থাৎ নিকটবর্তী ফিরেশতাদের সমীপে পর্যন্ত পৌছে যায়। কিন্তু এর তাৎপর্য অনুধাবন করা বা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা মানুষের সাধ্যায়ও নয়।

        যে ব্যক্তি স্বীয় আত্মার ব্যাপারে ওয়াকিফ নয় এবং যে তার তত্ত্বাবধান করে তাকে দুরস্ত রাখে না ও তদ্বারা অনন্ত পারলৌকিক জগতের মহারত্নরাজির সন্ধানের আকাঙ্খা করে না, সে ঐ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, "নাসুল্লাহা ফানসাহুম আনফুসাহুম উলায়িকা হুমুল ফাসিকুন"। অর্থাৎ তারা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছিল সুতরাং তিনিও তাদেরকে তাদের আত্মা থেকে ভুলিয়ে রেখেছিলেন। তারাই প্রকৃত পাপী। এতে বুঝা যাচ্ছে যে, আত্মার পরিচয় জানা এবং তার প্রকৃত গুণাবলী অবহিত হওয়া ধর্মের মূল এবং ধর্মপথের পথিকদের আসল ভিত্তি।

        এই গ্রন্থের প্রথম চার খন্ডে ইবাদাত ও ব্যবহারিক বিদ্যা এবং তার শাখা-প্রশাখা সম্বন্ধে বর্ণনা করা হয়েছে। তা প্রত্যক্ষ বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাথে জড়িত। এখন আমরা অবশিষ্ট খন্ডসমূহের মধ্যে আত্মার ধ্বংসকর দোষসমূহ এবং তা' থেকে পরিত্রাণের গুণাবলী সম্বন্ধে বর্ণনা করব। আত্মার এই দোষাবলী ও গুণাবলীর পরিচয় জ্ঞানের নামই ইলমুল বাতিন বা গুপ্ত বিদ্যা। এর এক খন্ডে আমরা আত্মার আবশ্যকীয় গুণাবলী ও স্বভাব-চরিত্র সম্বন্ধে আলোচনা করব এবং অন্য খন্ডে আত্মর সংশোধনের জন্য বিয়াজাত এবং পরিশ্রমের নিয়মাবলী ও তার স্বভাব-চরিত্র গঠনের রীতিনীতি আলোচনা করব। সবশেষে ধ্বংসকর দোষগুলো এবং পরিত্রাণকারী গুণগুলোর বিশদ বর্ণনা পেশ করব। এখন আমরা আত্মার অত্যাশ্চর্য গুণাবলী দৃষ্টান্ত সহকারে বর্ণনা করব। যাতে করে লোকজন তা' সহজে অনুধাবন করতে পারে। কেননা আত্মার গুপ্ত-সূক্ষ্ম এবং অত্যাশ্চর্য গুণাবলী গভীর আধ্যাত্মিক বিষয়ের অন্তর্গত। সাধারণ জ্ঞান- সম্পন্ন লোকদের বুদ্ধির মাধ্যমে এগুলো হৃদয়ঙ্গম করা খুবই কষ্টকর।

Post a Comment

0 Comments