মৃত্যু কষ্ট কেমন

 

        প্রিয় পাঠক-পাঠিকা। জেনে রাখ যে, যদি কোন দরিদ্র ব্যক্তির সামনে মৃত্যুর যন্ত্রণা ব্যতীত অন্য কোন দুঃখ-কষ্ট ও শাস্তি না থাকত তবুও তার দুনিয়ায় সুখ ও স্বাদ-বিস্বাদ হয়ে যেত। তার আনন্দ নিরানন্দে পরিণত হত এবং তার গাফলতি ও ভুল দূর হয়ে যেত, তার সম্বন্ধে চিন্তা করতে করতে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করত। বিশেষতঃ প্রত্যেক মুহূর্তেই তার চিন্তা থাকত। কোন বুযর্গ বলেছেন, অন্যের হাত থেকে দুঃখ কখন আসবে তা' তুমি জান না। বিজ্ঞ লোকমান তার পুত্রকে উপদেশচ্ছলে বলেছিলেন, হে প্রিয় বৎস। মৃত্যু কখন তোমাকে আক্রমণ করবে তা' তুমি জান না। মৃত্যু তোমাকে হঠাৎ আক্রমণ করার পূর্বে তার জন্য প্রস্তুত হও। এটাই বড় আশ্চর্যের বিষয় যে, যদি মানুষ অত্যন্ত সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকে, আনন্দে কাটায়, উত্তম সঙ্গসুখে সময় অতিবাহিত করে ঠিক এমনি অবস্থায় একজন সিপাহী এসে তাকে হঠাৎ পর পর কয়েকবার বেত্রাঘাত করলে তার সমস্ত সুখ ও আনন্দ চলে যায় এবং তার জীবনের সমস্ত স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। সে আহার নিদ্রায় মনোযোগ দিতে পারে না। তদ্রূপ প্রত্যেক মুহূর্তেই যমদূত প্রাণ বের করে নেয়ার কষ্ট নিয়ে তার নিকট হাজির হয়ে যেতে পারে অথচ তার প্রতি অত্যন্ত অমনষ্কতা। এটা অজ্ঞতা ও ভ্রম ব্যতীত আর কি হতে পারে?

        প্রিয় পাঠক-পাঠিকা। জেনে রাখ যে, যে ব্যক্তি মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করেছে সে ব্যতীত আর কেউ- ই দৈহিক গ্রন্থি ছিঁড়ে যাবার ক্লেশ বুঝবে না। যে ব্যক্তি মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করেনি সে শুধু অনুমান দ্বারা তা' বুঝতে পারে। অথবা কোন মানুষের জীবনাবসানকালে সে যে কষ্ট ভোগ করে সে তা' দেখে তার মৃত্যুকষ্টের কিছুটা আন্দাজ করতে পারে। যে অঙ্গে কোন প্রাণ থাকে না সে অঙ্গ কোন যন্ত্রণা বোধ করে না। যখন ঐ অঙ্গের মধ্যে প্রাণের আবির্ভাব হয় তখন সে যন্ত্রণা অনুভব করে। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, প্রাণই যন্ত্রণা অনুভব করে। যখন কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আঘাতপ্রাপ্ত হয় বা অগ্নি দ্বারা দঞ্চিভূত হয় তার প্রভাব প্রাণের উপর পৌছে। যে পরিমাণ কষ্ট প্রাণের উপর পৌঁছে প্রাণ সেই পরিমাণ কষ্ট প্রাপ্ত হয়। তা' মাংসে, রক্তে ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রকাশ পায় বলে প্রাণের যন্ত্রণা কিছু কম হয়। যদি এই যন্ত্রণা এমন হয় যে, শুধু প্রাণই তা' ভোগ করে, অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তা' ভোগ করে না তখন সেই যন্ত্রণা অধিকতর ভীষণ ও কঠোর হয়।

        জীবন গ্রন্থি ছিঁড়ে যাবার অর্থ মৃত্যু যন্ত্রণা, যা শুধু প্রাণের উপর উপস্থিত হয়। সেই প্রাণ ছিঁড়ে বের করতে গেলে তার প্রভাব দেহের সর্বত্র প্রসারিত হয়ে পড়ে এবং সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তদপ্রভাবে অবশ হয়ে পড়ে। যদি দেহের কোন অঙ্গে একটি কাঁটা বেঁধে তার যন্ত্রণা প্রাণের একটি অংশে প্রবাহিত হয়ে যায়। যে স্থানে কাঁটা বিঁধে ঐ যন্ত্রণা সেই স্থানে অনুভূত হয়। অগ্নি দ্বারা শরীরের কোন অংশ দম্বিভূত হলে তার প্রভাব অধিক হয়। কেননা অগ্নির অংশ শরীরে "পরিব্যাপ্ত হয়। দম্বিভূত অঙ্গের এমন কোন প্রকাশ্য ও গুপ্ত অংশ বাকী থাকে না যার মধ্যে অগ্নির প্রভাব পতিত হয় না। শরীরের সব মাংসের অংশে অংশে এই প্রাণের অংশ ব্যাপৃত, সুতরাং তা' এই যন্ত্রণা অনুভব করে।

        যে স্থানে তরবারী আঘাত করেছে সেই স্থানই শুধু যন্ত্রণাভোগ করে। তজ্জন্য তরবারীত আঘাতের যন্ত্রণা অগ্নির দাহিকার যন্ত্রণা থেকে অনেক কম। জীবনগ্রন্থি বা প্রাণ ছিঁড়বারকালে যে কষ্ট হয় তার প্রভাব প্রাণের উপর পড়ে এবং তার সমস্ত অংশে ছড়িয়ে যায়। প্রত্যেক গ্রন্থি, প্রত্যেক অঙ্গ এবং প্রত্যেক সংযুক্ত স্থান থেকে প্রাণকে টেনে বের করা হয়। এমনকি প্রত্যেক লোমকূপের মূল থেকে পায়ের তালু পর্যন্ত প্রত্যেক স্থান থেকে তাকে টেনে ছিঁড়ে বের করা হয়; সুতরাং মৃত্যুর কষ্ট ও যন্ত্রণার বিষয় জিজ্ঞেস করো না। বিজ্ঞ বুযর্গগণ বলেছেন যে, মৃত্যুর কষ্ট তরবারী দ্বারা খণ্ডবিখণ্ড হবার কষ্টের চেয়ে বা করাত দ্বারা খণ্ডবিখণ্ড হবার কষ্টের চেয়ে বা কাঁডি দ্বারা টুকরা টুকরা হবার কষ্টের চেয়ে অধিক তীব্র এবং অত্যধিক যন্ত্রণাদায়ক ও কষ্টকর। অসি দ্বারা দেহকে খণ্ডবিখণ্ড করলে দেহ কষ্ট পায়। কেননা দেহের সাথে প্রাণের সম্পর্ক আছে। যখন আসল বস্তুটি ছিঁড়ে লওয়া হয় এবং প্রহৃত ব্যক্তি সাহায্য প্রার্থনা করে এবং তার হৃদয়ের ও রসনার শক্তি স্থায়ী হয়ে থাকার জন্য চীৎকার করে, তখন তার অবস্থা কিরূপ হয় তা' সহজেই অনুমেয়। মুমূর্ষু ব্যক্তির স্বর কর্তিত হয়ে যায় এবং তার অসীম যন্ত্রণার সাথে তার চীৎকারও কর্তিত হয়ে যায়। কেননা তার মধ্যে কষ্টের চরম সীমা পৌঁছে যায় এবং প্রাণে ও তার প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও তা' পৌঁছে যায়। তার সমস্ত শক্তি বিনষ্ট হয়। প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অতি দুর্বল ও অবশ হয়ে পড়ে। তার জন্য আর কোন শক্তি রাখা হয় না। শুধু সাহায্য প্রার্থনা করার কিছু শক্তি বাকী রাখা হয়। তার যন্ত্রণা তার বুদ্ধিকে সম্পূর্ণ আয়ত্ত করে ফেলে। তার রসনা মূক হয়ে যায় এবং তার সর্বাঙ্গ নিঃসাড় হয়ে আসে। সে তখন আকাঙ্ক্ষা করে যে, যদি সে কিছু সময় বিশ্রাম গ্রহণ করতে পারত, চীৎকার করতে পারত বা সাহায্য গ্রহণ করতে পারত, তাহলে উত্তম হত; কিন্তু সে কোন কিছুতেই সমর্থ হয় না। যদি তার মধ্যে কিছু শক্তিও থেকে যেত তবে তার প্রাণগ্রন্থি ছিড়বার সময় তার গণ্ডদেশ এবং বক্ষদেশ থেকে এমন চীৎকার ও গড়গড়ার শব্দ শোনা যেত যে তা' বর্ণনাতীত।

        এসময় তার বর্ণ পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং সে মনে করে যে, তার উপর মৃত্তিকা ছড়িয়ে দেয়া যেত তা' হলে উত্তম হত। কেননা মৃত্তিকার দ্বারাই তার সৃষ্টি হয়েছে। প্রত্যেক গ্রন্থি থেকে তার জীবন বের করা হয়; সুতরাং তার যন্ত্রণা তার মধ্যে ও বাইরে থাকে। তখন তার চক্ষুর পাতা উপর দিকে উঠে যায়। তার অধর যুগল শুষ্ক হয়ে যায়। রসনা মূল থেকে অবশ হয়ে যায়, অধর দুটি উপরের দিকে চলে যায়। অঙ্গুলিগুলি সবুজ বর্ণ হয়ে যায়। শরীরের প্রত্যেক গ্রন্থি থেকে

        প্রাণটাকে টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়। যদি তা' একটি গ্রন্থি হত, তার যন্ত্রণা তত জীষণ হত না। যখন প্রাণ টানা হয় একটি থেকে তা' টানা হয় না, সমস্ত গ্রন্থি থেকে তা' টানা হয়। তারপর আস্তে আস্তে প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মৃত্যু হয়। প্রথমে তার পদদ্বয় বরফের ন্যায় শীতল হয়ে যায়। তারপর তার উরুদ্বয়। তারপর তাব কোমর। প্রত্যেক অঙ্গে তন্ময়তার পর তন্ময়তা এবং কষ্টের পর কষ্ট হয়। এভাবে যখন সর্বশেষ অস্থির নিকট পৌঁছে। এসময় তার সৃষ্টি সুনিয়া ও তার পরিবারবর্গ থেকে চলে যায়। তাওবাহর দরজা তার নিকট থেকে বন্ধ হয়ে যায় এবং অনুতাপ ও বিক্ষোভ তাকে আক্রমণ করে।

        হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, যে পর্যন্ত গড়গড়া না হয় সে পর্যন্ত মানুষের তাওবাহ কবুল হয়। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, "ওয়ালাইসাতিত্তাওবাতু লিল্লাযীনা ইয়া'মালুনাস সাইয়্যিয়াতি হাত্তা ইযা হাজারা আহাদা হুমুল মাওতু জ্বালা ইন্নী তুবতুল আন। অর্থাৎ তাওবাহ ঐ ব্যক্তিদের জন্য নয়, যারা পাপকার্য সদা-সর্বদা করার পর যখন তাদের মধ্যে কারও মৃত্যু এসে পড়ে তখন সে বলে, আমি এখন তাওবাহ করলাম। মুজাহিদ (রহঃ) এই আয়াতের অর্থে বলেছেন যে, যখন সে মৃত্যুদূত দেখতে পায়, তখন সে মৃত্যুদূতের মুখের প্রশস্ততা দেখে; সুতরাং মৃত্যুর কঠিন যন্ত্রণা ও ভয়াবহতার কষ্ট সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করো না। এজন্য হুযুরে পাক (দঃ) বলতেন, হে মাবুদ! মুহাম্মদের মৃত্যু যন্ত্রণা সহজ কর। মানুষ তা' থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে না এবং তাদের অজ্ঞতার দরুন তাকে তেমন বড় কিছু মনে করে না। কোন ঘটনা ঘটবার পূর্বে নবুয়ত এবং বেলায়েতের নূরের মাধ্যমে তা' জানতে বা ধরতে পারা যায় অর্থাৎ আল্লাহর অলীগণ অলৌকিক জানের প্রভাবে তা' উপলব্ধি করে। এজন্যই নবীগণ এবং অলীগণের মৃত্যুভয় অতান্ত অধিক ছিল। এমন কি হযরত ঈসা (আঃ) বলেছেন, হে আমার শিষ্যগণ। তোমরা আল্লাহর নিকট প্রার্থনা কর, তিনি যেন আমার উপর মৃত্যু যন্ত্রণা হালকা করেন। মৃত্যুযন্ত্রণা কিরূপ তা' বুঝতে পেরেই আমি ঐ ভয়ে জীবনমৃত হয়ে আছি।

        বর্ণিত আছে যে, ইস্রাইল বংশীয় একদল লোক এক কবরস্থানের পার্শ্ব দিয়ে কোথাও যাচ্ছিল। তারা তখন পরস্পর বলাবলি করতেছিল, যদি আমরা আল্লাহর দরবারে এই কবরস্থান থেকে একটি লোক উঠে আসবার জন্য প্রার্থনা করি, আর সে উঠে আসে এবং আমরা তার নিকট কবরের অবস্থা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে তা' জানতে পারি, তবে বড়ই উত্তম হয়। শেষপর্যন্ত এ ব্যাপারে তারা একমত হয়ে সবে মিলে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করল। আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা মঞ্জুর হয়ে গেল। কবরস্থানের একটি কবর থেকে সহসা একজন লোক উঠে পড়ে তাদের সম্মুখে এসে দাঁড়াল। তার চক্ষুদ্বয়ের মধ্যস্থলে সিজদাহর চিহ্ন ছিল। সে বলল, হে লোকগণ! তোমরা আমার নিকট থেকে কি জানতে চাও? আমি দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পূর্বে মৃত্যুবরণ করেছি কিন্তু এখনও আমি সেই মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করছি, তা' উপশম হয়নি।

        হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন যে, মৃত্যুযন্ত্রণা কারও জন্য কিছু হ্রাস হতে পারে বলে আমি মনে করি না, কেননা হুযুরে পাক (দঃ) এর মৃত্যুর সময় আমি তাঁর যন্ত্রণা স্বচক্ষে দেখেছি। বর্ণিত আছে যে, হুযুরে পাক (দঃ) তাঁর মৃত্যুকালে বলতেছিলেন, হে মাবুদ। গ্রন্থি, অস্থিখণ্ড এবং অঙ্গুলির অগ্রভাগের মধ্য থেকেও তুমি জীবনী শক্তি টেনে বের করছ? হে মাবুদ! তুমি আমার 

        প্রাণবিয়োগের কষ্ট সহজ কর। হুযুরে পাক (দঃ) তাঁর মৃত্যুকালে বলেছিলেন, ক্রমাগত তিন শ' অসির আঘাতের যন্ত্রণা যেন অনুভূত হচ্ছে। একনা হুযুরে পাক (দঃ)কে মৃত্যু যন্ত্রণার কথা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন, যে মৃত্যু সর্বাপেক্ষা সহজ তা' গোক্ষুর কাঁটার ন্যায় তিন কাঁটা বিশিষ্ট লৌহ শলাকা চক্ষুর মধ্যে গভীরভাবে ফুটিয়ে টানাটানি করার কষ্টের সমান। একদা হুযুরে পাক (দঃ) এক মুমূর্ষু রোগীর নিকট গিয়ে বললেন, সে কি কষ্ট পেতেছে তা আমি জানি। তার এমন কোন গ্রন্থি নেই যা' মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করছে না। হযরত আলী (রাঃ) জিহাদে যোগদান করতে উৎসাহ দিয়ে বলতেন, যদি তোমরা জিহাদে যোগদান না কর, তবে তোমরা প্রাণত্যাগ কর। যাঁর হাতে আমার প্রাণ, তাঁর কসম, শয্যার উপরে মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করা অপেক্ষা এক হাজার তরবারীর আঘাতজনিত মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করা আমার পক্ষে অধিক সহজ। হযরত আওযায়ী (রহঃ) বলেছেন, আমরা শুনেছি যে, মৃত ব্যক্তিকে কবর থেকে না উঠানো পর্যন্ত তার মৃত্যু যন্ত্রণা দূর হবে না। হযরত শাদ্দাদ ইবনে আওস (রহঃ) বলেছেন, মৃত্যু মুমিনের উপর ইহকাল ও পরকালের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় কঠিন বিপদ। তা' করাতের দ্বারা খণ্ডিত-বিখণ্ডিত হওয়া অপেক্ষা বা কাঁচি দ্বারা টুকরা টুকরা হওয়া অপেক্ষা বা উত্তপ্ত কড়াইতে ভাজা অপেক্ষা অধিক কষ্টকর। যদি মৃতব্যক্তি পুনরায় উত্থিত হয়ে মৃত্যুর ব্যাপার দুনিয়াবাসীকে জানাতে পারত, তবে দুনিয়াবাসীরা বেঁচে থাকায় কোন উপকার পেত না এবং তারা তাদের ঘুম-নিদ্রা থেকে বঞ্চিত হয়ে যেত। হযরত যায়েদ ইবনে আসলাম (রহঃ) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, কোন মুমিন ব্যক্তি তার কার্যের কল্যাণে যে ফায়দাহ হাছিল করতে পারেনি এবং তার জন্য যা' বাকী রয়েছে আল্লাহতায়ালা তার উপর মৃত্যুযন্ত্রণা কঠিন করে তদপ্রভাবে তাকে বেহেশতে টেনে নিবেন। পক্ষান্তরে কোন কাফির ব্যক্তি যদি কোন সৎ-কার্য করে থাকে এবং তাঁর পুরস্কার সে না পেয়ে থাকে, আল্লাহতায়ালা মৃত্যুকালে তার প্রতি মৃত্যু-যন্ত্রণা লঘু করে দেন এবং এর দ্বারা তার সৎকার্যের প্রতিফল দুনিয়ায় শেষ হয়ে যায়; এবং পরকালে তাকে দোযখে টেনে নেয়া হয়।

        জনৈক বুযর্গ বর্ণনা করেছেন যে, তিনি অনেক মৃত্যুপথযাত্রীর নিকট জিজ্ঞেস করতেন, তোমরা মৃত্যুকে কিরূপ দেখছ? যখন তিনি নিজে পীড়িত হলেন এবং তার প্রাণহরণ কার্য শুরু হয়ে গেল, তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হল, আপনি মৃত্যুকে কিরূপ দেখছেন? তিনি বললেন, আসমান যেন দুনিয়ার পৃষ্ঠে পতিত হল এবং আমার প্রাণ যেন একটি সূচের ছিদ্র-পথে টেনে বের করা হচ্ছে। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, হঠাৎ মৃত্যু মুমিনের পক্ষে আরামদায়ক এবং মহাপাপীর পক্ষে পরিতাপের বিষয়।

        হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন। যদি মৃতব্যক্তির একটি কেশ দুনিয়া ও আসমানবাসীর উপর স্থাপন করা হত, তবে তারা আল্লাহর আদেশে সবাই-ই প্রাণ ত্যাগ করত। কেননা প্রত্যেক কেশের মৃত্যু আছে এবং মৃত্যু কোন কিছুর উপর পতিত হলে তারও মৃত্যু হয়ে যায়। বর্ণিত আছে যে, যদি মৃত্যুযন্ত্রণার একবিন্দু পরিমাণ যন্ত্রণাও দুনিয়ার পর্বতের উপর স্থাপন করা যেত, তবে তা' সাথে সাথে বিগলিত হয়ে যেত। এরূপ বর্ণিত আছে যে, যখন হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর মৃত্যু ঘটনা শুরু হয়ে গেল, তখন তাঁকে লক্ষ্য করে আল্লাহতায়ালা বললেন, হে আমার বন্ধু ইব্রাহীম। মৃত্যুকে তুমি কিরূপ মনে করছ? তিনি বললেন, আর্দ্রচর্ম ও পশামের মধ্যে উত্তপ্ত লৌহ শলাকা বার বার টানার ন্যায়। তখন আল্লাহতায়ালা বললেন, আমি তোমার উপর মৃত্যুকে অত্যন্ত সহজ করেছি। বর্ণিত আছে যে, হযরত মুসা (আঃ)এর আত্মা আল্লাহর নিকট উপস্থিত করা হলে, আল্লাহতায়ালা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, হে মুসা। তুমি মৃত্যুযাতনা কেমন অনুভব করলে? হযরত মুসা (আঃ) জবাবে বললেন, আমি আমার প্রাণটিকে ক্ষুদ্র একটি চড়ুই পাখীর ন্যায় দেখতে পেলাম। জীবিত পাখীকে তপ্ত কড়াইয়ে ভাজতে শুরু করলে তা' উড়ে পালাতে পারে না বা মরেও যন্ত্রণা থেকে অব্যাহিত পায় না। ঐ পাখীর তখন যেরূপ যন্ত্রণা সহ্যা করতে হয়, মৃত্যুযন্ত্রণাও তদ্রুপ, তা' বুঝতে পেরেছি। হযরত মূসা (আঃ) থেকে আর একটি বর্ণনা এরূপ আছে যে, তিনি বলেছিলেন, আমি আমাকে একটি জীবিত বকরীর ন্যায় দেখতে পেলাম, যার চর্ম কসাই টেনে খুলে নিচ্ছে।

        বর্ণিত আছে যে, হুযুরে পাক (দঃ) এর জান কবজের সময় তাঁর নিকট পানির পাত্র ছিল। তিনি তাঁর হস্ত পানির মধ্যে ডুবিয়ে স্বীয় মুখমন্ডল মুছতে মুছতে বলতে লাগলেন, হে মাবুদ। তুমি আমার মৃত্যু-যন্ত্রণা সহজ কর। তাঁর প্রাণের পুত্তলী হযরত ফাতেমা (রাঃ) তখন তাঁর নিকটেই উপবিষ্ট ছিলেন। তিনি বার বার বলতে লাগলেন, হে পিতঃ। আপনার উপর কি ভীষণ যন্ত্রণা! তখন হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, মা ফাতেমা! আজকার এদিনের পর তোমার পিতার উপর আর কোন দিনই এ যাতনা আসবে না।

        হযরত ওমর (রাঃ) হযরত কা'ব আহবার (রাঃ) কে বলেছিলেন, হে কা'ব; মৃত্যু সম্বেেন্ধ আমাকে কিছু বলুন। তিনি বললেন, হে আমীরুল মু'মিনীন! মৃত্যু অসংখ্য কন্টকপূর্ণ শলাকার ন্যায়, যা' কোন লোকের উদরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করানো হয় এবং প্রত্যেকটি কন্টক দেহাভ্যন্তরস্থ প্রত্যেক শিরায় বিদ্ধ হয়ে যায়, তারপর এক ব্যক্তি তার শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে তা' টেনে বের করে আনে। কন্টকগুলোর সাথে যা চলে আসে তা' সে গ্রহণ করে এবং যা আসে না তা' সে ত্যাগ করে।

        হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, মানুষ মৃত্যুযাতনাও মৃত্যুর তন্ময়তা ভোগ করতে থাকলে তার এক অঙ্গ অন্য অঙ্গকে বলে, তোমার প্রতি সালাম, আমি তোমার নিকট থেকে এবং তুমি আমার নিকট থেকে কিয়ামত পর্যন্ত পৃথক হয়ে যাচ্ছ। এটাই আল্লাহর বন্ধুদের ও প্রিয়জনদের উপর মৃত্যু যাতনা। তোমরা ভেবে দেখ, তাঁদের উপর এরূপ অবস্থা হলে আমাদের ন্যায় হতভাগ্যদের অবস্থা কিরূপ হতে পারে?

        মৃত্যুযাতনা ব্যতীত মৃত্যুকালীন বিভীষিকাত্রয়ঃ প্রথম বিভীষিকা হল, প্রাণত্যাগের সময় ভীষণ যন্ত্রণা। তার বিস্তারিত বিবরণ আমরা উপরে উল্লেখ করেছি। দ্বিতীয় বিভীষিকা হল, মালাকুল মওত বা মৃত্যুদূতের মূর্তি দর্শন এবং মনের মধ্যে ভয় ও ত্রাস সৃষ্টি হওয়া। পাপী ব্যক্তির প্রাণ টেনে বের করার সময় যদি মৃত্যুদূতের মূর্তি দেখা যায়, তবে পরম সাহসী ও অত্যধিক বলবান ব্যক্তিও সে রূপ দেখে তার তীব্র প্রভাব সহ্য করতে পারবে না। বর্ণিত আছে যে, হযরত ইব্রাহীম (আঃ) মৃত্যুর ফিরেশতাকে বলেছিলেন, ওহে! তুমি পাপীর প্রাণ হরণকালে যে মূর্তি ধারণ কর, তা' কি আমাকে একবার দেখাতে পার? মৃত্যুদূত বললেন, আপনি তা'দেখে প্রক্তিস্ত থাকতে পারবেন না। তিনি বললেন, হ্যাঁ অবশ্যই পারব। মৃতুল্যুত বললেন, তবে দেখে প্রকৃতিস্থ আপনি আমার সম্মুখ থেকে ক্ষণিকের জন্য মুখ এক পলকের জন্য তার দিক থেকে অন অন্য দিকে এরিয়ে নিন। তখন হযরত ইব্রাহীম। দিকে মুখ ফিরালেন। পর মুহূর্তে তিনি তার দিকে দৃষ্টিপাত করে দেখতে পেলেন যে, মৃত্যুদূতের দেহ ভীষণ কৃষ্ণ বর্ণবিশিষ্ট, মন্ত্রক রুক্ষকেশ বিশিষ্ট, ভীষণ দুর্গন্ধময় কৃষ্ণবর্ণ পরিচ্ছদে দেহ আবৃত, তার মুখ গহবরও নাসিকা রঙ থেকে অগ্নিশিখা উত্থিত হচ্ছে ও ঝলকে ঝলকে তা' বের হয়ে আসছে। তার এ ভীষণ ও বিকট মূর্তি দর্শন করে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) অচৈতন্য হয়ে পড়ে গেলেন। কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর তাঁর সংজ্ঞা ফিরে এলে মৃত্যুদূত তার স্বাভাবিক অর্থাৎ প্রাথমিক মূর্তি ধারণ করে তার সম্মুখে উপস্থিত হয়ে বললেন, আমি ত প্রথমেই আপনাকে বলেছিলাম যে, আপনি আমার প্রকৃত মূর্তি দেখে সহ্য করতে পারবেন না। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তাকে বললেন, হে মৃত্যুদূত। যদি পাপী লোকগণ মৃত্যুর সময় শুধু তোমার এ মূর্তি দেখে, তাদের অন্য কোনরূপ ক্লেশ ও যন্ত্রণা না হয় বা তারা অন্য কোন কিছুই না দেখে তবু তাদের যে অবস্থা হয়, চরম শাস্তির জন্য তা-ই যথেষ্ট।

        হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, হযরত দাউদ (আঃ) অত্যন্ত ভীত ব্যক্তি ছিলেন। যখন তিনি গৃহ থেকে বের হয়ে যেতেন, তখন গৃহের সমস্ত দরজা বন্ধ করে দিতেন। একদা এভাবে তিনি গৃহের সব দুয়ার বন্ধ করে বাইরে চলে গেলেন। তারপর তার স্ত্রী দেখলেন যে, এক ব্যক্তি গৃহের মধ্যে রয়ে গেছে। তিনি ঐ ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি গৃহের মধ্যে কিভাবে প্রবেশ করলে? যদি আমার স্বামী গৃহে এসে তোমাকে দেখতে পান, তবে আমাকে তিনি ভীষণ শাস্তি দেবেন। ইতোমধ্যে হযরত দাউদ (আঃ) প্রত্যাবর্তন করলেন এবং গৃহমধ্যে ঐ ব্যক্তিকে দেখতে পেলেন। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন। তুমি কে? সে বলল, আমি ঐ জন, যাকে রাজ-রাজন্য ও বাদশাহগণ ভয় করে থাকে; এবং কোন ব্যক্তিই তাকে বাধা দিতে পারে না। তখন হযরত দাউদ (আঃ) বললেন, আল্লাহর কসম, তাহলে নিশ্চয়ই তুমি মৃত্যুদূত। এই কথা বলেই তিনি নিজেকে একটি কম্বলাবৃত করে শুয়ে পড়লেন।

         বর্ণিত আছে যে, একদা হযরত ঈসা (আঃ) একটি কঙ্কালের নিকট দিয়ে যেতেছিলেন। তিনি তাকে স্বীয় পদ দ্বারা আঘাত করে বললেন, আল্লাহর আদেশে তুমি আমার সাথে কথা বল। তখন কঙ্কাল বলে উঠল, হে রূহুল্লাহ! আমি অমুক অমুক স্থানের বাদশাহ ছিলাম। এক সময় আমি সিংহাসনে উপবিষ্ট হতাম, আমার মস্তকে রাজমুকুট শোভা পেত, আমার চতুষ্পার্শ্বে ছিল অগণিত সৈন্যসামন্ত, আমার রাজ দরবার ছিল অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্ণ। এমন অবস্থায় হঠাৎ একদা যমদূত এসে আমার সম্মুখে হাজির হল। তার ভীষণ মূর্তি দেখেই আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শিথিল হয়ে গেল। সে আমার প্রাণ হরণ করে চলে গেল।

        পাপীদের এই যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়, কিন্তু ধার্মিকগণ এ অবস্থা থেকে রক্ষা পেয়ে থাকে। নবী-রাসূলগণ মৃত্যু যন্ত্রণার বিষয় বর্ণনা করেছেন, কিন্তু যমদূতকে দেখে যে ভয় ও ত্রাসের সঞ্চার হয় তা' তারা কেউই বর্ণনা করেননি। মূলতঃ যমদূতকে আল্লাহতায়ালা যে বিকট চেহারা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, তার সেই জন্মগত মূর্তি যদি কোন লোক স্বপ্নযোগেও অবলোকন চেহারা করে তাহলে তার অবশিষ্ট জীবনে আর কোন সুখ ও স্বাদ থাকবে না। ধার্মিক লোকগণ তাদের একে তাদের সময়ে যমদূতদে ধর্ম ও নেক আমালের স্তর। ভেদে সুন্দর মূর্তিতে দেখতে পায়।

        হযরত ইবনে আব্বাস। (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, দুল্লাহ ইন হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এঃ)এর একটি একটি ইবাদাতখানা ছিল। যখন তিনি তাঁর ইবাদাতখানা থেকে বের হয়ে যেতেন তিনি ঐ গৃহের সমস্ত দরজা বন্ধ করে যেতেন। একদিন তিনি বাইরে থেকে ইবাদাতখানায় ফিরে এসে দেখলেন যে, একদিন এক ব্যক্তি তার মধ্যে বসে আছে। তিনি তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, বল, কে তোমাকে আমার এ গৃহের মধ্যে প্রবেশ করিয়েছে। এ ঘরের মালিক আমি। ঐ ব্যক্তি বলল, তুমি মালিক নও। যিনি তোমার ও আমার সবার মালিক তিনিই এ ঘরেরও মালিক। উক্ত মালিকই আমাকে এ গৃহে প্রবেশ করার অনুমতি দিয়েছেন। তার কথা শুনে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) বললেন, তবে নিশ্চয়ই তুমি কোন ফিরেশতা হবে? সে বলল, হ্যাঁ, আমি মালাকুল মওত অর্থাৎ মৃত্যুদূত। তখন হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তাকে বললেন, তবে তুমি কি আমাকে তোমার সেই মূর্তি দেখাবে যা' দেখিয়ে তুমি মুমিন লোকদের প্রাণ হরণ কর? মৃত্যুদূত বলল, হাঁ দেখাচ্ছি, তবে একটু সময়ের জন্য তুমি আমার দিক থেকে তোমার মুখ ফিরিয়ে নাও। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এক মুহূর্তের জন্য অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আবার তার দিকে দৃষ্টিপাত করলেন, কিন্তু কি আশ্চর্য তিনি দেখতে পেলেন যে, একজন অত্যন্ত সুশ্রী সৌম্য দর্শন যুবক তার সামনে দণ্ডায়মান। তার পরিধানে পরিচ্ছন্ন শুভ্র বস্ত্র এবং তার অবয়ব সুঘ্রাণে পরিপূর্ণ। তখন হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তাকে বললেন, হে যমদূত। যদি মু'মিন ব্যক্তি তোমার মূর্তি ব্যতীত অন্য কিছুই না দেখে, তবে তা-ই তার পুরস্কারের জন্য যথেষ্ট। অবশ্য ঐ সময় প্রত্যেকই অন্য দু'জন ফিরেশতা দেখতে পায়, যারা তাদের আমলনামা লিপিবদ্ধ করে।

        হযরত ওয়াহহাব (রহঃ) বলেছেন, আমি শুনেছি যে, এমন কোন মুমূর্ষু ব্যক্তি নেই, যার সামনে দু'জন ফিরেশতা তার কার্য তাকে না দেখায়। যদি লোকটি ধার্মিক হয়, তবে তাঁকে তারা বলে, আল্লাহ তোমাকে আমাদের পক্ষ থেকে নেকীর পুরস্কার দিন। বহু ধর্মীয় মজলিসে তুমি আমাদেরকে বসিয়েছিলে এবং বহু নেক কাজে আমাদেরকে উপস্থিত করিয়েছিলে। আর যদি লোকটি পাপী হয়, তখন তারা তাকে বলে, আল্লাহ আমাদের পক্ষ থেকে তোমাকে যেন কোন মঙ্গল দান না করেন। তুমি বহু মন্দ মজলিসে আমাদেরকে বসিয়েছিলে, বহু মন্দ কার্যে আমাদেরকে উপস্থিত করিয়েছিলে এবং বহু মন্দ কথা শুনিয়েছিলে। আল্লাহতায়ালা যেন তোমাকে কোন মঙ্গলজনক পুরস্কার না দেন। মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তি তাদের মুখে এইরূপ কথা শুনে দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে যায়।

তৃতীয় বিভীষিকা হল, মৃত্যুকালে পাপীগণ দোযখের অভ্যন্তরে তাদের জন্য নির্দিষ্ট স্থান দেখতে পায় এবং তখন তাদের অত্যন্ত ভয় হয়, কেননা তখন তারা এমনিতেই মৃত্যুযাতনা ও মৃত্যুর তন্ময়তার মধ্যে থাকে, দেহ অবশ হয়ে আসে, তাদের প্রাণ দেহ খাঁচা থেকে বের হয়ে যেতে থাকে। তবে তাদের মৃত্যু হয় না, যে পর্যন্ত না মৃত্যুর ফিরেশতার দুটি সংবাদের মধ্যে একটি সংবাদের ঘোষণা না পায়। হয়ত সে বলে, হে আল্লাহর শত্রু। দোযখে চলে যাও, অথবা বলে, হে আল্লাহর বন্ধু। বেহেশতে চলে যাও। এখানেই বুদ্ধিমানদের জন্য ভয় রয়েছে। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তিই দুনিয়া থেকে বের হবে না, যে পর্যন্ত না সে তার গন্তব্য স্থান জানতে পারে এবং যে পর্যন্ত না সে দোযখে বা বেহেশতে তার জন্য নির্দিষ্ট স্থান দেখতে পারে।

        হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করতে ভালবাসে, আল্লাহও তার সাথে সাক্ষাত করতে ভালবাসেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে সাক্ষাত কামনা করে না, আল্লাহও তার সাথে সাক্ষাত কামনা করেন না। ছাহাবীগণ আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (দঃ)! আমরা মৃত্যুকে চাই না। (কেননা মৃত্যু যে বড় কঠিন ব্যাপার) হুযুরে পাক (সঃ) বললেন, না, ব্যাপার তা' নয়, বরং মুমিন ব্যক্তির উপর যা আসে, তাকে অতি সহজ করে দেয়া হয়। কেননা সে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত ভালবাসে এবং আল্লাহও তার সাথে সাক্ষাত ভালবাসেন।

         বর্ণিত আছে যে, হযরত হোযায়ফাহ (রাঃ) শেষ রাত্রে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) এর শয্যায় গমন করে তাঁকে ডেকে বললেন, ওঠ এবং এখন কোন সময় তা' দেখ। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) উঠে বসে বললেন, আমি প্রত্যুষে দোযখে যাওয়া থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি। একদা মারওয়ান রোগাক্রান্ত হযরত আবু হোযায়ফাহ (রাঃ) এর নিকট গিয়ে বলল, হে মাবুদ। তাঁর উপর মৃত্যু সহজ কর। হযরত আবু হোযায়ফাহ (রাঃ) বললেন, হে মাবুদ। কঠিন কর। তারপর হযরত আবু হোযায়ফা (রাঃ) রোদন করতে করতে বললেন, আল্লাহর কসম, দুনিয়া ত্যাগের জন্য দুঃখিত বলে আমি রোদন করি না বা তোমাদেরকে ছেড়ে যাই বলে রোদন করি না; বরং আমার প্রভু থেকে দুটি সংবাদের দিকে আমি লক্ষ্য করছি, তা' হল, দোযখ বা বেহেশত।

        হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, আল্লাহ যখন কোন বান্দার উপর সন্তুষ্ট হন, তখন তিনি বলেন, হে মৃত্যুর ফিরেশতা! অমুক ব্যক্তির নিকট গিয়ে তার আত্মাকে আমার নিকট নিয়ে এস, যেন আমি সুঘ্রাণ গ্রহণ করতে পারি। তার সৎকার্য আমার নিকট যথেষ্ট। তাকে আমি পরীক্ষা করেছি এবং যা ভালবাসি, তাকে আমি তথায় দেখেছি। তখন মৃত্যুর ফিরেশতা পাঁচশ ফিরেশতা সাথে নিয়ে সেই ব্যক্তির নিকট চলে আসে এবং তার হাতে দুটি বেহেশতের যষ্ঠি এবং জাফরানের সুগন্ধি থাকে। মৃত্যুর ফিরেশতা তাকে তখন নূতন সুসংবাদ দেয় এবং তার আত্মা গ্রহণ করার জন্য উল্লিখিত ফিরেশতাগণ দু'সারিতে দণ্ডায়মান হয়ে যায়। তাদের প্রত্যেকের হাতে সুগন্ধিযুক্ত দ্রব্য থাকে। যখন শয়তান তাদের দিকে দৃষ্টিপাত করে তখন সে তার হস্ত তার মাথায় স্থাপন করে চীৎকার করে উঠে। তাতে তার উপস্থিত সৈন্যদল তাকে বলে, হে আমাদের মালিক! তুমি চীৎকার দিলে কেন, তোমার কি হয়েছে? শয়তান বলে, তোমরা কি দেখছ না যে এই আদম সন্তানকে কি সম্মান দেয়া হয়েছে? তোমরা এই ব্যক্তি থেকে কোথায় ছিলে? শয়তানের সৈন্যগণ বলে, আমরা এর ব্যাপারে অনেক চেষ্টা করেছি, সে নিষ্পাপ ছিল। কিন্তু কোন প্রকারেই তাকে আমাদের পথে আনতে পারিনি। হযরত হাসান বছরী (রহঃ) বলেছেন, আল্লাহর সাথে সাক্ষাত ব্যতীত মুমিন ব্যক্তির আর কোন সুখ নেই। আল্লাহর সাথে সাক্ষাতে যার সুখ, মৃত্যুর দিনই তার সুখের দিন, আনন্দের দিন, নিরাপত্তার দিন সম্মানের দিন।

Post a Comment

0 Comments