মালাকুল মওত বা মৃত্যুদূতের সাথে সাক্ষাতের সময় কি আক্ষেপ করে মানুষ

        হযরত আশআছ ইবনে আসলাম (রহঃ) বলেছেন, হযরত ইব্রাহীম (আঃ) মৃত্যুর ফিরেশতা আত্মাইলকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, হে মালাকুল মওত। যখন কোন লোক পূর্বদেশে থাকে এবং কোন লোক পশ্চিম দেশে থাকে এবং কোন মহামারী বা মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি কোন দেশে দেখা দেয় বা যখন দুই দলে ঘোরতর যুদ্ধ শুরু হয়, তখন তুমি কি কর? আজ্রাইল বলল, আমি তখন আল্লাহর আদেশে তাদের রূহদেরকে ডেকে থাকি এবং তারা আমার এই দু'ই অঙ্গুলীর মধ্যে অবস্থান করে। বর্ণনাকারী বলেন যে, যমিন তার সামনে একটি তত্তুরির ন্যায় এসে হাজির হয়। সে তা' থেকে যা ইচ্ছা গ্রহণ করে।

        হযরত সোলায়মান (আঃ) মুত্যুর ফিরেশতাকে বলেছিলেন, আমি তোমাকে মানুষের মধ্যে সুবিচার করতে কেন দেখতে পাচ্ছি না? তুমি একজনের প্রাণ হরণ কর আর একজনকে ছেড়ে দাও। ফিরেশতা বলল, আমি এ বিষয় তোমার চেয়ে অধিক জ্ঞাত নই। হযরত ওয়াহহাব ইবনে। মুনাব্বাহ (রহঃ) বলেছেন, একদা কোন প্রভাবশালী শাসক বিদেশ ভ্রমণের ইচ্ছা করে সে তার জন্য কিছু পোশাক-পরিচ্ছদ কিনে আনবার জন্য কাউকে নির্দেশ দিল। অচিরেই তার, জন্য যথাযোগ্য পোশাক-পরিচ্ছদ এনে পেশ করা হল। কিন্তু সে পোশাক তার পছন্দ হল না। সে পুনরায় তার জন্য পোশাক আনতে নির্দেশ করল। সাথে সাথে তার নির্দেশ পালন করা হল, কিন্তু এবারও তার সে পোশাক পছন্দ হল না। এভাবে কয়েকবার তার জন্য পোশাক আনীত হলে সর্বশেষে একটি বিচিত্র মূল্যবান পোশাক বেছে নিয়ে সে তা' পরিধান করল। তারপর সে তার বাহন জন্তু হিসেবে একটি উৎকৃষ্ট অশ্ব আনবার হুকুম দিল। তদনুযায়ী বেশ কতগুলো উত্তম অশ্ব তার সামনে নিয়ে আসা হল। তন্মধ্যে একটি সর্বোৎকৃষ্ট অশ্ব পছন্দ করে সে তদুপরি আরোহণ করল। ঠিক তন্মুহূর্তে ইবলীস উপস্থিত হয়ে তার নাসিকার ছিদ্রে একটি ফুৎকার দিল। সে তখন অহঙ্কারে স্ফীত হয়ে গেল। অতঃপর সে মহা ধুমধামের সাথে বিদেশে ভ্রমণে যাত্রা করল। এভাবে সে যখন রাজধানী থেকে বের হয়ে কিছুদূর অগ্রসর হল, তখন এক দরিদ্র ছিন্নবস্ত্র পরিহিত লোক তার সম্মুখে এসে তাকে সালাম করল। কিন্তু সে ঘৃণাভরে তার। সালামের জবাব দিল না। দরিদ্র লোকটি তখন তার অশ্বের লাগাম ধরে ফেলল। সে তাতে ক্রোধে অধীর হয়ে তাকে কলল, এ তোমার অমার্জনীয় অপরাধ ও মারাত্মক বেআদবী। এই মুহূর্তে অশ্বের লাগাম ছেড়ে দাও। লোকটি বলল, তোমার নিকট আমার বিশেষ প্রয়োজন আছে। বাদশাহ বলল, অপেক্ষা কর, আমি অশ্ব থেকে অবতরণ করে নেই। লোকটি বলল, না তোমার অবতরণ করার প্রয়োজন নেই। একথা বলে সে অশ্বের লাগাম ধরে সজোরে আকর্ষণ করতে লাগল, তখন বাদশাহ বলল, তোমার যদি কিছু বলার থাকে তা' আমাকে বল। তা' না বলে এরূপ অশালীন ব্যবহার করছ কেন? লোকটি বলল, অবশ্যই তোমার নিকট আমার বলবার কথা আছে, তবে তা'একটি অত্যন্ত গুপ্ত কথা। তখন বাদশাহ তার কর্ণ লোকটির দিকে এগিয়ে দিলে লোকটি বলল, আমাকে তুমি চিনতে পারনি, আমি যমদূত। একথা শুনামাত্র বাদশাহর মুখমন্ডলের রূপ পরিবর্তিত হল, রসনার সিক্ততা শুষ্ক হয়ে গেল। আড়ষ্ট কণ্ঠে সে বলল, তবে তুমিআমাকে আমার পরিজনবর্গের নিকট প্রত্যার্বতন এবং প্রয়োজনীয় কাজ- কর্মগুলো সেরে নেয়ার অবসর দাও। যমদূত বলল, আল্লাহর কসম, তা' দিতে পারব না। তুমি তোমার পরিজনবর্গ ও ধন-সম্পদ, মাল-দৌলত কিছুই আর দেখবার সুযোগ পাবে না; বরং এই মূহূর্তেই আমাকে তোমার প্রাণ হরণ করতে হবে। একথা বলেই যমদূত বাদশাহর দেহ-পিঞ্জর থেকে রূহ বের করে নিয়ে চলে গেল। বাদশাহ সাথে সাথে একখন্ড কাষ্ঠের ন্যায় অশ্বপৃষ্ঠ থেকে ভূতলে লুটিয়ে পড়ল। 

        এই ঘটনার পর যমদূত কিছুদূর অগ্রসর হয়ে জনৈক মুমিন ব্যক্তির সাথে সাক্ষাত করল। সে তাকে সালাম করল এবং মুমিন ব্যক্তিও তার সালামের জবাব দিল। অতঃপর যমদূত মুমিন- ব্যক্তিকে বলল, তোমার নিকট একটি বিশেষ প্রয়োজনে আমি আগমন করেছি। প্রয়োজনটি আমি তোমার কানে কানে বলব। মুমিন লোকটি বলল, এস, আমার নিকটে এসে তোমার কথা বল। তখন যমদূত নিম্নস্বরে তাকে বলল যে, আমি মালাকুল মওত বা মৃত্যুদূত। তার কথা শুনে মু'মিন ব্যক্তি বলল, আমার পক্ষ থেকে সাদর অভ্যর্থনা। বহুদিন থেকেই আমি অধীর আগ্রহে তোমার অপেক্ষা করছি। আল্লাহর কসম, দুনিয়ায় 'তোমার সাথে সাক্ষাত করার চেয়ে আমার আর কোন অধিক প্রিয় বস্তু নেই। যমদূত বলল, তোমার প্রয়োজনীয় কোন কাজ বাকী থাকলে তা' সেরে নাও। মু'মিন ব্যক্তি বলল, আমার নিকট আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের চেয়ে অধিক প্রয়োজনীয় কাজ আর কিছুই নেই; সুতরাং তুমি যে অবস্থায় আমার প্রাণ হরণ করা উত্তম মনে কর, তাই করে নাও। মৃত্যুদূত বলল, তুমি তোমার প্রয়োজন পূর্ণ করতে পার এবং তজ্জন্য তোমাকে সময় দিতে আমি আদিষ্ট হয়েছি। তখন মু'মিন ব্যক্তি বলল, তাহলে আমি অজু করে নামাযে দাঁড়িয়ে যাই। নামাযের সিজদাহর মধ্যে তুমি আমার প্রাণ হরণ করো। তারপর সে অজু করে নামাযের মধ্যে যখন সিজদায় চলে গেল মৃত্যুদূত তখন তার রূহ নিয়ে বিদায় হল।

        হযরত আবুবকর ইবনে হামদুল্লাহ (রহঃ) কিছু ধন-সম্পদ সঞ্চয় করেছিলেন। যখন তার মৃত্যু উপস্থিত হল, তিনি তাঁর পুত্রগণকে বললেন, আমি যে বিভিন্ন প্রকার ধন-দৌলত ও মাল-সামান সঞ্চয় করেছি, তোমরা আমাকে তা' একবার দেখাও। তখন তাঁর সামনে ধন-দৌলত, স্বর্ণ- রৌপ্য, চতুষ্পদ জীব-জন্তু যথাঃ ছাগ ও মেষ, অশ্ব ও উট এবং দাস-দাসী ইত্যাদি মালামাল তাঁর সম্মুখে এনে হাজির করা হল। তিনি তা' দেখে রোদন করতে লাগলেন। মৃত্যুদূত তা' দেখে তাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি এভাবে রোদন করছ কেন? যিনি তোমাকে এই ধন-দৌলত ও মাল-সামান দিয়েছেন, তাঁর শপথ করে বলছি, তোমার দেহ পিঞ্জর থেকে প্রাণ হরণ না করা পর্যন্ত আমি তোমার গৃহ ত্যাগ করব না। তিনি মৃত্যুদূতের কথা শুনে বললেন, তবে তুমি আমাকে এগুলোর কাছ থেকে বিদায় গ্রহণ করার জন্য আমাকে একটু সময় দাও। মৃত্যুদূত বলল, তা' হবে না। একটি পলকের সময়ও আমি তোমাকে দিতে পারব না। একথা বলেই সে তাঁর প্রাণ হরণ করে নিল।

        কথিত আছে যে, এক ব্যক্তি বহু ধন-সম্পদ উপার্জন করে তা' সঞ্চয় করে রেখেছিল। এমন কোন সম্পদ নেই যা' সে অর্জন করেনি। বিরাট বিরাট বহু সৌধ নির্মাণ করে তার সদর তোরণগুলো সুসজ্জিত করে রেখেছিলো। অগণিত দাস-দাসী সর্বদা মোতায়েন থাকত এবং তরে হুকুম তামীল করত। লোকটির বহু বেগম ও বাঁদী ছিল। একদা সে তার মূল রাজপ্রাসাদে সমস্ত বেগমকে একত্র করে ও অমাত্যগণকে নিমন্ত্রণ করে এক প্রীতিভোজের আয়োজন করল। ধুম-ধামের সাথে ব্যবস্থাপনা চলতেছিল। একদল লোক ভোজ শেষ করে অন্য দল এসে ভোজক্রিয়ায় বসে যেতে ছিল আর ঐ ধনবান লোকটি মূল্যবান আসনে উপবিষ্ট হয়ে গর্বে ও আনন্দে পার্থিব স্বাদের পরাকাষ্ঠা উপভোগ করতেছিল। আনন্দোৎসব শেষে লোকটি নিজেকে নিজে সম্বোধন করে বলল, তোমার দুনিয়ায় আর কোনরূপ অশান্তি ও দুঃখের বালাই নেই। এভাবেই তুমি পার্থিব আনন্দ ভোগ করতে থাক। মনে মনে তার এই কথা বলামাত্র যমদূত একটি লোকের আকৃতিতে তাঁর নিকট হাজির হয়ে গেল। লোকটির কাঁধে দু'খণ্ড ছিন্নবস্তু ঝুলতেছিল। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যে, লোকটি অনাহারক্লিষ্ট অত্যন্ত দরিদ্র লোক। লোকটি প্রাসাদের সদর তোরণে এসে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে এমনভাবে দরজায় খড়খড়ি দিল যে, তাতে মানুষের মনে ত্রাসের সঞ্চার হয়। লোকটির এই আচরণে দাস-দাসীগণ প্রায় প্রত্যেকেই অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে আগন্তুক লোকটিকে ধমকের সুরে বলে উঠল, বাইরে কে তুমি? কি প্রয়োজন তোমার? সে বলল, তোমাদের মনিবের কাছেই আমার বিশেষ প্রয়োজন। তাকে এখানেই ডেকে নিয়ে এস। তারা বলল, এ তুমি মূর্খের ন্যায় কথা বলছ? আমাদের মনিব তোমার মত এক মুসাফিরের নিকট কথা শুনতে আসবে কেন? আগন্তুক বলল, যদি সে আমার নিকট না আসে তবে তোমরা তার নিকট গিয়ে আমার আগমনের কথা বল। কিন্তু তারা কেউই তাতে রাজী হল না; বরং তার সাথে অসদাচরণ প্রদর্শন করল। আগন্তুক যখন বুঝতে পারল যে, এরা কেউই তার আগমনের কথা এদের মনিবের নিকট জানাবে না, তখন সে দরজায় এমন জোরে ধাক্কা দিতে লাগল যে, তা' অত্যন্ত বিরক্তিকর মনে হল। দ্বাররক্ষকগণ লোকটির উপরে লাফিয়ে পড়ল তাকে শাস্তি দেয়ার জন্য। তখন সে বলল, তোমরা আমাকে চিনতে পারনি। আমি স্বয়ং মৃত্যুদূত। একথা শুনে দ্বাররক্ষীগণ ও নিকটে উপস্থিত অন্যান্য লোকগণ সবারই মনে ত্রাসের সঞ্চার হল। তারা প্রত্যেকেই বিব্রত হয়ে পড়ল। শীঘ্রই একথা তাদের মনিবের কর্ণগোচর। হল তখন তার লোকদেরকে বলল, তোমরা ঐ ব্যক্তির সাথে সে তার বল এবং তাকে জিজ্ঞে জ্ঞেস কর যে, সে কারও প্রাণ হরণ বিনম্রভাবে কথাবার্তা বল আগমন করেছে কি? যমদু মদূতের। সাথে অতঃপর দেয়া হল। সে এবার অন্ত পের সদাচরণ প্রদর্শন করা হল এবং করার জন্য গৃহদ্বার খুলে অন্তঃপুরে প্রবেশ করে করে গৃহকর্তাকে বলল, তুমি তোমার ধন-সম্পদ দ্বারা যা' ইচ্ছা তাই কর। আমার তাতে কিছু বলার নেই, কিন্তু এখন আমি তোমার প্রাণ। করা পর্যন্ত এখান থেকে বিদায় হব না। গৃহকর্তার বহু ধন-সম্পদ ত পড়ে থেকেছিল। মৃত্যুদূত তাকে জিজ্ঞেস করল, এই ধন-সম্পদ তার এসেছ। গৃহকর্তা তার কথার জবাব দেয়ার পূর্বেই আল্লাহতায়ালা ধন চারপাশে স্তূপাকা কারে দ্বারা এতদিন তুমি কি করে ধন-সম্পদের জবান খুলে দিতোনা। সে বলতে লাগল, ওহে ব্যক্তি। তুমি আমাকে নিয়ে বহু রাজা-বাদশা যাতায়াত করেছ, আমার দ্বারা বহু অসৎকার্য সাধন করেছ, অনেক ধর্মভীরু দরিদ্র ব্যক্তি সাহায্যের জন্য তোমার দরজায় এসেছে; কিন্তু তুমি তাদেরকে এক এক কপর্দকও র দরবারে সাহা করাত হায্য দূরের কথা; বরং তাদেরকে তাড়িয়ে দিয়েছ। তুমি আমারই সাহায্যে কত সুন্দরী পরস্ত্রীকে উপভোগ করেছ। মোটকথা যত রকমের মন্দ কাজ আছে সব কাজই তুমি আমার দ্বারা সাধন করেছ। যদি তুমি আমাকে মঙ্গল পথে ব্যয় করতে তাহলে এখন তা' তোমার উপকারে আসত; কিন্তু তা' তুমি করনি; সুতরাং এখন তোমার কাজের যথাযোগ্য ফল ভোগ কর। কথাগুলো বলে ধন-সম্পদের জবান বন্ধ হওয়ার সাথে সাথেই মৃত্যুদূত লোকটির জান কবজ করে চলে গেল। 

        হযরত ওয়াহহাব ইবনে মুনাব্বাহ (রহঃ) বলেছেন, একদা মালাকুল মওত এক প্রবল পরাক্রমশালী অত্যাচারী বাদশাহর প্রাণ হরণ করে আকাশে উত্থিত হলে আসমানের ফিরেশতাগণ তাকে জিজ্ঞেস করল, হে মৃত্যুদূত। তুমি দুনিয়ায় অগণিত মানুষের প্রাণ হরণ করেছ, তবে তোমার এই কার্যকালে কখনও কোন ব্যক্তির ক্ষেত্রে কি এতটুকু মমতার উদয় হয়নি? মৃত্যুদূত জবাবে বলল, হ্যাঁ, একবার আমার মনে দয়ার সঞ্চার হয়েছিল। একদা এক গভীর নির্জন অরণ্যে একটি গর্ভবতী রমণী একান্ত অসহায় অবস্থায় পতিত ছিল। হঠাৎ তার সন্তান ভূমিষ্ঠ হল। ঠিক তন্মুহূর্তে আমার প্রতি ঐ মহিলার প্রাণ হরণ করার আদেশ হল। তার তখনকার অসহায় অবস্থা দেখে বিশেষতঃ তার সদ্য প্রসূত সন্তানের অবস্থা চিন্তা করে আমার প্রাণে সেদিন দয়ার সঞ্চার হয়েছিল। তখন ফিরেশতাগণ তাকে বলল, তুমি এইমাত্র যে প্রবল পরাক্রান্ত বাদশাহর প্রাণ হরণ করে এনেছ সে ঐ মহিলারই সেই সন্তান যে সন্তানটি সেদিন গভীর অরণ্যে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল। তখন মালাকুল মণ্ডত বলল, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, তিনি যা' ইচ্ছা তাই করেন। 

        হযরত আতা ইবনে ইয়াসীর (রহঃ) বলেছেন, শাবান চাঁদের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত্রে মৃত্যুদূত একটি তালিকা প্রাপ্ত হন। তাঁকে বলা হয় এই তালিকায় যাদের নাম রয়েছে এই বছরের মধ্যে তাদের প্রাণ হরণ করবে। আতা ইবনে ইয়াসীর (রহঃ) বলেন, কেউ হয়ত বৃক্ষ রোপণে ব্যস্ত, কেউ হয়ত বিবাহ-শাদীর কাজে লিপ্ত, কেউ বা দালান-কোঠা নির্মাণ কাজে নিয়োজিত, তাদের এতে যে, নাম রয়েছে তা' কেউই তারা অবগত নয়। হযরত হাসান বছরী (রহঃ) বলেছেন, এমন কোনদিন অতীত হয় না, যেদিন মৃত্যুদূত দুনিয়ার প্রত্যেক গৃহে গিয়ে তার খবর লয় না। সে যদি কোথাও গিয়ে দেখতে পায় যে, কারও দুনিয়ার জীবিকা পূর্ণ হয়েছে, তার পার্থিব জীবনকাল শেষ হয়ে গেছে, মৃত্যুদূত তখন তার প্রাণ হরণ করে আনে। যখন সে তার প্রাণ হরণ করে তার পরিবারবর্গ বিলাপ সহকারে রোদন করতে থাকে। তখন মৃত্যুদূত গৃহের দরজায় দাঁড়িয়ে বলে, আল্লাহর কসম, আমি তার জীবিকা ভক্ষণ করিনি, আমি তার জীবনকাল শেষ করিনি, আমি তার মৃত্যুর সময় নির্দিষ্ট করে দেই নি। তোমাদের মধ্যে আমার আবার ফিরে আসতে হবে। কাউকেই আমি বাকী রাখব না। হযরত হাসান বছরী (রহঃ) বলেছেন, আল্লাহর কসম, যদি দুনিয়ার লোকেরা নিজ নিজ স্থান দেখতে পেত বা নিজেদের স্থানের কথা শুনতে পেত, তবে নিশ্চয়ই তারা অন্যের মৃত্যুর কথা নিয়ে চিন্তা না করে নিজেদের ব্যাপারেই ক্রন্দন শুরু করে দিত।

        হযরত ইয়াযিদ রাক্কাশী (রহঃ) বলেছেন, একদা বনু ইস্রাইল সম্প্রদায়ের এক অত্যাচারী, পরাক্রমশালী অসৎ ব্যক্তি তার গৃহাভ্যন্তরে জনৈক পরস্ত্রীকে নিয়ে অবাঞ্ছিত আমোদ-স্ফূর্তিত রত ছিল। ঠিক এই মুহূর্তে সে দেখতে পেল যে, তার গৃহের দরজা দিয়ে এক অপরিচিত ব্যক্তি প্রবেশ করছে। তখন ক্রোধভরে সে তার প্রতি অকথ্য ভাষা প্রয়োগ করে বলল, কে তুমি? আমার গৃহে প্রবেশ করতে কে তোমাকে অনুমতি দিয়েছে? লোকটি বলল, যিনি এই গৃহের মালিক তিনিই আমাকে গৃহে প্রবেশের অনুমতি দান করেছেন। আমি এক এমন সত্তা, যাকে কেউ বাধা দিতে পারে না। আমি আমার কাজে কোন রাজা-বাদশাহর অনুমতি গ্রহণ করি না। আমি কোন পরাক্রমশালী ব্যক্তির পরাক্রমকে ভয় করি না। কোন অত্যাচারীর অত্যাচারকে পরোয়া করি না। কোন অবাধ্যগত শয়তানও আমার কার্যে বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। উক্ত পরাক্রমশালী অসৎ ব্যক্তি মহাপরাক্রমশালী মৃত্যুদূতের পাল্লায় পড়ে সহসা বিনম্র হয়ে গেল। তার কণ্ঠস্বর স্তিমিত হয়ে গেল। করুণকণ্ঠে সে বলল, তবে তুমি কি যমদূত। আগন্তুক বলল, হাঁ আমি যমদূত বৈ কি। লোকটি বলল, তবে তুমি আমাকে একটি কথা বলার সময় দিবে? সে বলল, না তা' হবে না। তোমার সময় সম্পূর্ণ শেষ হয়ে গেছে। তোমাকে এতটুকু সময় দেয়ার আমার সাধ্য নেই। তার কথা শুনে লোকটি বলল, তবে তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে? মৃত্যুদূত বলল, তোমার অগ্রে প্রেরিত আমলের নিকট এবং তোমার জন্য অগ্রে প্রস্তুত গৃহে। লোকটি বলল, আমিত অগ্রে কোন সৎকাজ পাঠাইনি এবং আমার জন্য কোন সুন্দর গৃহ তৈরি করে রাখারও ব্যবস্থা করিনি। মৃত্যুদূত বলল, তোমার জন্য সব কিছুরই ব্যবস্থা আছে এবং নিশ্চয়ই তা' প্রজ্জ্বলিত অগ্নিরাশি, যা' তোমার পা থেকে মস্তক পর্যন্ত একই সাথে আক্রমণ করবে। একথা বলেই সে লোকটির প্রাণ হরণ করল। লোকটির গৃহে হা-হুতাশ ও কান্না-কাটির রোল পড়ে গেল। তবে যদি তার পরিবারবর্গ তার মন্দ স্থানের কথা জানতে পারত তাহলে তাদের হা-হুতাশ ও কান্নাকাটির অবস্থা আরও অধিক ও মারাত্মক হত।

        হযরত আ'মাশ (রহঃ) হযরত খায়ছামা (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, একদা মৃত্যুদূত হযরত সোলায়মান (আঃ) এর দরবারে উপস্থিত হয়ে তার এক সভাসদের প্রতি বার বার তাকাচ্ছিল। অনেকক্ষণ পর্যন্তই এই অবস্থা চলছিল। অতঃপর যখন মৃত্যুদূত দরবার থেকে চলে গেল উক্ত সভাসদ হযরত সোলায়মান (আঃ) এর নিকট জিজ্ঞেস করল, যে লোকটি এইমাত্র চলে গেল সে কে? হযরত সোলায়মান (আঃ) বললেন, সে মালাকুল মওত। সভাসদ বলল, আমি লক্ষ্য করেছি যে, সে বার বার আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে দেখছিল। এখন আমার মনে হচ্ছে যে, সে নিশ্চয়ই আমার প্রাণ হরণ করতে চায়। হযরত সোলায়মান (আঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, যদি তা-ই হয়ে থাকে তবে সে ব্যাপারে তোমার ইচ্ছা কি? সভাসদ বলল, আমার ইচ্ছা এই যে, জাহাঁপনা। আপনি মার্কে যমদুতের হাত থেকে রক্ষা করুন। তখন হযরত সোলায়মান (আঃ) বায়ুকে নির্দেশ দিলেন যে, তুমি এই মুহূর্তে এই ব্যক্তিকে সুদূর হিন্দুস্থানে রেখে আস। সাথে সাথে বায়ু তার নির্দেশ পালন করল। অতঃপর মালাকুল মওত দ্বিতীয়বার হযরত সোলায়মান (আঃ) এর দরবারে উপস্থিত হলে তিনি তাকে বললেন, ইতোপূর্বে আমি লক্ষ্য করেছি যে, তুমি আমার এক সভাসদের প্রতি বার বার তীব্র দৃষ্টিপাত করছ, তার কারণ কি শুনি? মৃত্যুদূত বলল, হাঁ হিন্দুস্থানের কোন একস্থানে তোমার উক্ত সভাসদের প্রাণ হরণ করার জন্য আমার প্রতি আদেশ ছিল, অথচ সে ব্যক্তিকে তখনও তোমার দরবারে দেখতে পেলাম। তাতে আমি অবাক হয়ে মনে মনে ভাবলাম যে, মুহূর্তকাল মধ্যে এ ব্যক্তি কেমন করে হিন্দুস্তানে পৌছবে এবং আমি তথায় তার প্রাণ হরণ করব? কিন্তু তার পরে আমি ততোধিক আশ্চর্য হলাম যে, কেমন করে সে এই সামান্য সময়ের মধ্যে হিন্দুস্থানে পৌঁছে গেল এবং আমি সেখানেই তার প্রাণ হরণ করলাম? তার কথা শুনে হযরত সোলায়মান (আঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এ কি বলছ তুমি? তুমি কি সত্যিই তার প্রাণ হরণ করে এসেছ? মৃত্যুদূত বলল, কেন তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করছ না? এইত এখনই আমি তোমার সে সভাসদের প্রাণ হরণ করে নিয়ে এলাম।

Post a Comment

0 Comments