পাপ নিবারণকারীর গুণাবলী কী কী

 

        এতক্ষণ আমরা বিশদভাবে বিভিন্ন স্তরে পাপ নিবারণকারীর নিয়ম-কানুনগুলো বর্ণনা করেছি। এবার আমরা ঐ নিয়মের মূল বিষয়বস্তু বর্ণনা করব। উল্লেখ্য যে, পাপ নিবারণাকারীর মধ্যে তিনটি গুণ থাকা অত্যাবশ্যক। যথাঃ (১) জ্ঞান, (২) পরহেজগারী এবং (৩) সৎস্বভাব। জ্ঞান সম্বন্ধে পাপ নিবারণের স্থান, সীমা, আদেশ ও নিষেধ জেনে নেবে যেন তা' শরীয়তের সীমার মধ্যে সীমিত থাকে। এ জ্ঞান না থাকলে সৎ ও অসৎ কাজের মধ্যে তারমত্য করতে পারবে না।

        পরহেজগারী এইজন্য আবশ্যক যে, পাপ দমনকারীর কার্যাদি যেন ব্যক্তিগত স্বার্থশূন্য হয় এবং তার জানা বিষয়ের বিরোধিতা করা না হয়। কেননা প্রত্যেক আলিম তার ইলম অনুযায়ী আমল করে; বরং অনেক সময় সে পাপ বারণ করতে গিয়ে অতিরিক্ততার দোষে দোষী হয়ে পড়ে এবং সে বিষয়ে যা' শরীয়ত সম্মত তারও অতিরিক্ত করে। তখন সে অন্য উদ্দেশ্য কর্তৃক পরিচালিত হয়। পক্ষান্তরে তার মধ্যে পরহেজগারী থাকলে তখন এই আদেশ ও নিষেধে অতিরিক্ততার দোষ ঘটে না। যদি পাপী ব্যক্তি আদেশ ও নিষে। কার তখন মানুষ তাকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে এবং তজ্জন্য তাকে অপমান সহ্য করতে হয়।

        সৎস্বভাবঃ কোন ব্যক্তির সৎস্বভাব থাকলে সে উপদেশ দাতারূপে বিনম্র ও দয়ালু হয় এবং দয়া ও নম্রতাই এ বিষয়ের মূল ভিত্তি। জ্ঞান ও পরহেজগারী এ ব্যাপারে যথেষ্ট নয়। কেননা যখন ক্রোধের উৎপত্তি হয় তখন শুধু জ্ঞান ও পরহেজগারী তা' দমন করতে পারে না যখন পর্যন্ত না তার মধ্যে সৎস্বভাব থাকে। পাপাচারী তাকে কোন দুঃখ-কষ্ট দিলে সে ক্রোধে আল্লাহকে ভুলে যাবে এবং প্রতিশোধ গ্রহণে প্রস্তুত হয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে সৎ স্বভাব ব্যতীত এবং কাম ও ক্রোধ দমন ক্ষমতা ব্যতীত পরহেজগারী পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় না। পাপ নিবারণকারী আল্লাহর দ্বীনের বিষয়ে যে বিপদাপদ ভোগ করে উল্লিখিত গুণ থাকলে তার পক্ষে নিজ দায়িত্ব পালন করা সহজ হয়। তা' না হলে যদি তাকে তিরস্কার করা হয় বা প্রহার দ্বারা তার সম্মান ও ধনপ্রাণ নষ্ট করা হয় তখন সে আদেশ-নিষেধের কথা ভুলে যায়, আল্লাহর দ্বীনের প্রতি উদাসীন হয় এবং ব্যক্তিগত ব্যাপারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

        মোটকথা উল্লিখিত তিনটি গুণের জন্যই পাপ নিবারণের ছওয়াব অর্জন করা যায় এবং তদ্বার। উত্তমরূপে অসৎ কার্য দূর করা যায়। পক্ষান্তরে যদি তার মধ্যে এসমস্ত গুণ না থাকে তবে তার পক্ষে মন্দ কার্য দূর করা সম্ভব হয় না; বরং কখনও কখনও তার থেকে আদেশ ও নিষেধ নিন্দনীয় কাজে পরিণত হয়। কেননা তাতে শরীয়তের সীমার দিকে লক্ষ্য রাখা হয় না। হযরত রাসূলে করীম (দঃ) এর নিম্নোক্ত হাদীসটি এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আদেশে বিনম্র এবং নিষেধেও বিনম্র, আদেশে ধৈর্যশীল এবং নিষেধেও ধৈর্যশীল, আদেশের বিষয়ে পরিজ্ঞাত এবং নিষেধের বিষয়েও পরিজ্ঞাত সে সৎকাজে আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজে নিষেধ করবে। অত্র হাদীস মর্মে বুঝা যাচ্ছে যে, যে ব্যক্তি শুধু ফকীহ হবে তার পক্ষেই আদেশ-নিষেধ করা সম্ভব নয়; বরং যে কাজে সে আদেশ দেবে এবং যে কাজে সে নিষেধ করবে সে ব্যাপারে তার পূর্ণ জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। তদ্রূপ ধৈর্য্য এবং দয়া আদেশ ও নিষেধের মধ্যে প্রয়োজনীয়। হযরত হাসান বছরী (রহঃ) বলেছেন, যদি তুমি সৎকাজে আদেশ দাতা হও তাহলে তুমি তা' প্রথম উত্তমরূপে পালন কর, নচেৎ তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা অবশ্য বলছি না যে, সৎকাজে উপদেশ দান গুনাহগারের জন্য নিষিদ্ধ। কিন্তু সত্য কথা এই যে, যখন মানুষের নিকট তার পাপ প্রকাশ পেয়ে যায় তখন তাদের মন থেকে তার উপদেশের প্রভাব দূর হয়ে যায়। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন যে, আমরা আরজ করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ (দঃ)! আমরা যে পর্যন্ত সদুপদেশ অনুযায়ী চলতে না পারি এবং মন্দ কার্য থেকে বিরত থাকতে না পারি সে পর্যন্ত কি আমরা অপরকে সৎকাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করা থেকে বিরত থাকব। রসুলে পাক (সঃ) বললেন, ববি সমুপদেশ অনুযায়ী সম্পূর্ণ আলে চলবে না তার তথাপি সৎকাজে আদেশ দেবে।

        একজন পূর্ণগুণের বুযগ, তার পুত্রদেরকে উপদেশ দিয়েছিলেন, যদি তোমাদের মধ্যে কেউ সদকাযে উপবেশ দিতে ইচ্ছা করে তবে প্রথমে সে নিজেকে সুন্দর বৈর্যগুণে বিস্তৃষিত করবে এবং আল্লার নিকট থেকে সওয়াব আশা করবে। যে বাক্তি আল্লাহর নিকট থেকে ছওয়াবের আশা  করে সে তার মধ্য কোন কষ্ট দেখতে পাই না। আদেশ-নিষেধ করবার একটি রীতি হল, ধৈর্য উপর নিজেকে সন্তুষ্ট রাখ। এজন্যই আল্লাহতায়ালা সৎকাজে আদেশের সঙ্গে ধৈর্যকে সংযুক্ত করেছেন। পবিত্র কুরানে আছে, হাকিম লোকমান তাঁর পুত্রকে উপদেশ দিয়েছিলেন। তথাঃ "ইয়া বুনাইয়া। আকিমুসসলাতা ওয়া'মুর বিল মা'রফি ওয়াহা আ'নিল মুনকারি ওয়াছবির আলা না আসহাবাকা। অর্থাৎ হে বৎসং নামাজ কায়েম কর, সৎকাজে আদেশ কর এবং অসৎ কাজে নিশেধ কর।  তোমার উপর যে বিপদ আসে তাতে ধৈর্য ধারণ কর।

        অন্য গুণ হল লোভহীনতা। পাপ নিবারক বা পাপ শাসনকারীর এ গুণটি থাকতে হবে যে, তার সিলোভ হতে হবে। এজন্যই যে সাংসারিক সংস্রবে থাকবে না, সে ভয়শূন্য হবে এবং সে মানুষের নিকট থেকে কোন কিছুর আশা বা লিঙ্কা করবার প্রবৃত্তি কর্তন করে ফেলবে। এমন কি তার নিকট থেকে অন্য লোকের খোশামোদ করবার স্বভাব দূর করে দিতে হবে। এক বৃষর্গের একটি পোষা বিড়াল ছিল। তিনি তাঁর এক প্রতিবেশী কসাইর নিকট থেকে তার বিড়ালের জন্য অকেজো মাংসের পর্দা এবং মানুষের অখাদ্য ফাফরা ইত্যাদি প্রতিদিন কুড়িয়ে আসতেন। একদিন তিনি উক্ত কসাইকে একটি মন্দ কাজ করতে দেখে প্রথমে নিজ গৃহে। ঢুকলেন, তারপর গৃহ থেকে বিড়ালটিকে বের করে দিয়ে উক্ত কসাইর নিকট এসে তাকে উপদেশ দিলেন। কসাই তাকে বলল, তোমার বিড়ালের জন্য আমি এরপর আর কিছু দেব না। তার কথ্য গুনে তিনি বললেন, আমি বিড়ালটিকে ত্যাগ না করে এবং নিজের লোভ দমন না করে তোমাকে উপদেশ দিতে আসি নি। তিনি বাস্তবিকই যা বলতেন, তাই করতেন।

        যে ব্যক্তি মানুষের নিকট লোভের প্রত্যাশী, মানুষের কোন মালের প্রতি যার লিন্দা বিদ্যমান থাকে, সে কখনও পাপ নিবারণ করতে সক্ষম হয় না। তা' ছাড়া যে ব্যক্তি আশ্য করে যে, মানুষের মন তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকুক, মানুষ তার প্রশংসা করুক, তার পক্ষেও পাপ নিবারণ করা সহজ হয় না। হযরত কা'ব ইবনে আহবার (রহঃ) হযরত আবু মুসলিম খাওলানী (রহঃ) এর নিকট বলেছিলেন, মানুষের নিকট আপনার সম্মান কিরূপ? তিনি বললেন, উত্তম। হযরত কা'ব ইবনে আহবার (রহঃ) বললেন, নিশ্চয়ই তাওরাতে আছে, যে ব্যক্তি সৎকাজে আদেশ দেয় এবং অসৎকাজে নিষেধ করে সে ব্যক্তি স্বীয় সম্প্রদায়ের নিকট হেয় এবং হীন হয়ে থাকে। হযরত আবু মুসলিম (রহঃ) বললেন, তাওরাত ঠিকই বলেছে এবং আবু মুসলিম যা বলেছে তা' মিথ্যা।

        একদা জনৈক বক্তা খলীফা মামুনকে উপদেশ দিতে গিয়ে তার প্রতি কর্কশ বাক্য প্রয়োগ করেছিল। তখন খলীফা মানুন বললেন, হে ব্যক্তি। বিনম্ন হউন। কেননা আপনার চেয়েও যে ব্যক্তি উত্তম তাঁকে আল্লাহতায়ালা আমার চেয়েও অসৎলোকদের নিকট নবীরূপে পাঠিয়ে বিনম্রভাবে উপদেশ দেয়ার জন্য বলেছেন। যেমন পবিত্র কুরআনে উল্লেখ রয়েছে "ফাকুলা-লাহ কাওলা স্লাইয়্যিনা লাআল্লাহু ইয়া তাযাক্কা আও ইয়াখশা"। অর্থাৎ তোমরা উভয়ে (মুসা ও হারুন) তার সাথে (ফিরাউনের সাথে) নম্রভাবে কথা বলো। তাতে সম্ভবতঃ ফিরাউন আল্লাহকে স্মরণ করতে পারে অথবা তাঁকে ভয় করতে পারে; সুতরাং পাপ নিবারণকারীর নবীদের বিনম্রব্যবহারের অনুসরণ করা উচিত।

        হযরত আবু উমামাহ থেকে বর্ণিত আছে যে, একটি গোলাম হুযুরে পাক (দঃ) এর নিকট উপস্থিত হয়ে অনুরোধ জানাল যে, ইয়া রাসূলাল্লাহ (দঃ)! আমাকে ব্যভিচার করবার জন্য অনুমতি প্রদান করুন। ছাহাবীগণ লোকটির কথা শুনে চীৎকার করে উঠলেন। তখন হুযুরে পাক (দঃ) তাঁদেরকে বললেন, তোমরা এভাবে ডাক চীৎকার না করে তাকে আমার সাথে কথা বলতে দাও। লোকটি হুযুরে পাক (দঃ) এর সামনে এসে বসলে তিনি তাকে লক্ষ্য করে বললেন, আচ্ছা, তোমার মাতার সাথে কেউ ব্যভিচার করলে তুমি কি তা' ভালবাসবে? সে বলল, কখনই নয়। আল্লাহ আমাকে আপনার প্রতি কুরবান করুন। তিনি বললেন, তদ্রূপ কোন ব্যক্তির মাতার সাথে কেউ ব্যভিচার করুক তা' সে ব্যক্তি পছন্দ করে না। আচ্ছা, তোমার কন্যার সাথে কেউ ব্যভিচার করুক তা' কি তুমি ভালবাসবে? সে বলল, কখনই নয়। আল্লাহ আমাকে আপনার প্রতি কুরবান করুন। তিনি বললেন, তদ্রূপ কোন ব্যক্তির কন্যার সাথে কেউ ব্যভিচার করুক তা' সে ব্যক্তি পছন্দ করে না। আচ্ছা, তুমি কি তোমার ভগ্নির সাথে কেউ ব্যভিচার করুক তা' কি তুমি পছন্দ করবে? (এমন কি চাচি, খালা ইত্যাদির কথাও তিনি উল্লেখ করলেন এবং সে লোকটি প্রত্যেকবারই বলল), কখনই নয়। আল্লাহ আমাকে আপনার প্রতি কুরবান করুন। তখন হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, এভাবেই কোন লোক তা' পছন্দ করে না। তখন হুযুরে পাক (দঃ) উক্ত লোকটির বুকের উপর হাত রেখে দোয়া করলেন, হে মাবুদ! এর হৃদয়কে পবিত্র কর। এর পাপ ক্ষমা কর। এর গুপ্ত অংগকে নিরাপদ রাখ। বলা বাহুল্য, সেদিন থেকেই লোকটির নিকট ব্যভিচারের চেয়ে অধিকতর নিকৃষ্ট আর কোন কাজই রইল না।

        হযরত ফোজায়ল ইবনে ইয়াজ (রহঃ) কে জিজ্ঞেস করা হল, হযরত সুফিয়ান বিন উয়াইনিয়া (রহঃ) রাজা-বাদশাহদের উপঢৌকন গ্রহণ করে থাকেন। তখন হযরত ফোজায়ল (রহঃ) বললেন, তিনি তাঁর হক ব্যতীত তাদের নিকট থেকে কিছু গ্রহণ করেন না। তারপর তাঁকে নির্জনে নিয়ে গিয়ে তজ্জন্য ভর্ৎসনা করলে হযরত সুফিয়ান বিন উয়াইনিয়া (রহঃ) বললেন, হে আবু আলী (ফোজায়ল)। আমি যদিও নেককার নই তবুও আমি নেককারদেরকে ভালবাসি। হযরত হাম্মাদ বিন সালমাহ (রহঃ) বলেছেন যে, হযরত ছালাত বিন আছিম (রহঃ) একদা স্বীয় শিষ্যমন্ডলী পরিবেষ্টিত হয়ে উপবিষ্ট ছিলেন। তখন এক ব্যক্তি তাঁর নিকট দিয়ে পথ অতিক্রম করতেছিল। তার পরিহিত পাজামাটি অত্যন্ত দীর্ঘ ছিল। তখন তার শিষ্যগণ লোকটির প্রতি কঠোর ব্যাবহার করতে উদ্যত হলে, হযরত ছালাত (রহঃ) বললেন, তোমরা তাকে আমার নিকট ছোপর্দ কর। আমি তাকে উপদেশ দের। অতঃপর তিনি সে লোকটিকে লক্ষ্য করে বললেন, হে ভ্রাতৃপুত্র। তোমার নিকট আমার একটু প্রয়োজন আছে। লোকটি বলল, হে চাচাজান। বলুন আপনার কি প্রয়োজন? তিনি বললেন, তুমি তোমার পাজামাটি একটু উপারে উঠিয়ে পরিধান কর। লোকটি বলল, আপনার কথা আমি মেনে নিলাম। এ কথা বলে সে তার পাজমাটি উপরে তুলে পরিধান করল। তখন হযরত ছালাত (রহঃ) তাঁর শিষ্যমন্ডলীকে বললেন, যদি তোমরা তার সাথে রুক্ষ ব্যবহার করতে, সে নিশ্চয়ই বলত, কখনই নয়। তোমাদের কথামত আমি আমার পাজামা উঠিয়ে পরিধান করব না; বরং তোমাদেরকে আরও সে তিরস্কার করত।

        হযরত মুহাম্মদ ইবনে যাকারিয়া (রহঃ) বলেছেন,, এক রাত্রে আমি আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মদ বিন আয়েশাকে মাগরিবের নামাযের পর মসজিদ থেকে বের হয়ে নিজ গৃহের দিকে রওয়ানা হতে দেখলাম। তার পথে কুরায়েশ বংশীয় একটি গোলামকে মদের নেশায় মত্ত থাকা অবস্থায়ও দেখতে পেলাম। সে একটি স্ত্রীলোককে ধরে তার দিকে আকর্ষণ করছিল। স্ত্রীলোকটি চীৎকার করে লোকজনের সাহায্য প্রার্থী হলে, বহুলোক সেখানে ছুটে এসে লোকটিকে প্রহার করতে লাগল। হযরত ইবনে আয়েশা (রহঃ) তার প্রতি লক্ষ্য করে তাকে চিনতে পেরে সমবেত লোকদেরকে তিনি বললেন, এ আমার ভ্রাতুপুত্র। তোমরা একে ছেড়ে দাও। অতঃপর তিনি তাকে বললেন, হে ভ্রাতুষ্পুত্র! তুমি আমার নিকট এস। লোকটি অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে তাঁর নিকট এলে, তিনি তার সাথে আলিঙ্গন করে বললেন, তুমি আমার সঙ্গে চল। অতঃপর তিনি লোকটিকে তাঁর গৃহে নিয়ে গেলেন। গৃহে নিয়ে তিনি তাঁর কোন এক চাকরকে বললেন, তুমি রাত্রে এর নিকট অবস্থান করবে। যখন তার মদের নেশা ছুটে যাবে, তখন তাকে তার বেহুঁশ অবস্থায় কি কি ঘটনা হয়েছিল, তা' জানিয়ে দেবে এবং তাকে আমার নিকট উপস্থিত না করা পর্যন্ত যেতে দেবে না। তারপর যখন লোকটির মদের নেশা দূর হয়ে গেল তখন চাকরটি যা যা ঘটেছিল তা' সবই তার নিকট বর্ণনা করল। তাতে সে লজ্জিত হয়ে ক্রন্দন করতে লাগল এবং সেখান থেকে বিদায় হতে উদ্যত হল। তখন চাকরটি তাকে বলল, যিনি তোমাকে এখানে এনেছেন, তিনি তাঁর নিকট তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। তখন লোকটি হযরত ইবনে আয়েশা (রহঃ) এর নিকট উপস্থিত হলে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি লজ্জার বালাই নেই? তোমার কি মান সম্মান বলতে কিছু নেই? তুমি কার সন্তান তা কি তুমি একটিবারের জন্যও চিন্তা কর না? ওহে! আল্লাহকে ভয় কর। তুমি যে সমস্ত কাজে লিপ্ত আছ তা' পরিত্যাগ কর। লোকটি তখন মস্তক অবনত করে অঝোরে কেঁদে দিল। কিছুক্ষণ পর মস্তক উত্তোলন করে বলতে লাগল, আমি আপনার সামনে আল্লাহর নিকট এই প্রতিজ্ঞা করছি, জীবনে আর কোনদিন আমি মদ স্পর্শ করব না এবং যে সমস্ত গুনায় আমি লিপ্ত আছি, কস্মিনকালে আর তাতে লিপ্ত হব না। আমি খাঁটি তাওবাহ করছি। তখন হযরত ইবনে আয়েশা (রহঃ) তাকে বললেন, তুমি আমার নিকটে আস। লোকটি তাঁর একান্ত নিকটবর্তী হলে, তিমি তার মস্তক চুম্বন করে বললেন, হে বৎস। আজ তুমি বড় উত্তম কাজ করেছ। কথিত আছে যে এরপর থেকে ঐ লোকটি হযরত ইবনে আয়েশা (রহঃ) এর নছীহতসমূহ লিপিবদ্ধ করবার কাজে আত্মনিয়োগ করল। বলা বাহুল্য যে, হযরত ইবনে আয়েশা (রহঃ) এর এরূপ বিনম্ন স্বভাবের কারণেই ঐ লোকটির এভাবে মন পরিবর্তন হয়েছিল। হযরত ইবনে আয়েশা (রহঃ) বলেছিলেন, অনেকেই সৎকাজে আদেশ দেয় এবং অসৎকাজে নিষেধ করে। কিন্তু তাদের অসতর্কতায় এ সৎকাজটি অসৎকাজে পরিণত হয়। সুতরাং প্রত্যেকেরই একাজে বিনম্র এবং দয়ালু হওয়া চাই। তাহলে তাদের যে উদ্দেশ্য থাকে, নিশ্চয়ই তা' সফল হবে।

        হযরত ফাতেহ বিন সাখরাফ (রহঃ) বলেছেন, একব্যক্তি ছোড়া হস্তে জনৈকা স্ত্রীলোককে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, প্রাণের ভয়ে কেউই তার নিকট থেকে স্ত্রীলোকটিকে উদ্ধার করতে সাহস পেল না। বিশেষতঃ লোকটি শক্তিশালীও ছিল। স্ত্রীলোকটি চীৎকার করতেছিল। এমতাবস্থায় হযরত বাশার হাফী (রহঃ) ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি লোকটির নিকট গিয়ে তার স্কন্ধ ঐ লোকটির স্কন্ধের সাথে লাগিয়ে দিলেন। অমনি লোকটি সংজ্ঞাহীন হয়ে ভূতলে পড়ে গেল। অতঃপর হযরত বাশার হাফী (রহঃ) সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। তখন উপস্থিত লোকগণ ঐ ব্যক্তির নিকট এসে দেখল যে, লোকটির সর্বাঙ্গ ঘর্মসিক্ত হয়ে গেছে। স্ত্রীলোকটি ইতিমধ্যে সেখান থেকে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে লোকটির জ্ঞান ফিরে এলে লোকগণ তাকে জিজ্ঞেস করল, তোমার কি হয়েছে? সে বলল, আমি কিছুই বলতে পারি না। তবে আমার এতটুকু স্মরণ হচ্ছে যে, জনৈক বুযর্গ আমার নিকট এসে আমার শরীর স্পর্শ করে বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাকে দেখছেন এবং তোমার কার্যকলাপও পর্যবেক্ষণ করছেন। তাঁর একথা শুনামাত্র আমার মনে এক অপূর্ব অবস্থার সৃষ্টি হল। অন্তরে দারুণ ভীতির সঞ্চার হল। সঙ্গে সঙ্গে আমার পদদ্বয় অবশ হয়ে এল। তারপর কি হল আমি বলতে পারছি না। আমি বলতে পারছিনা যে, ঐ বুযর্গ কে ছিলেন? লোকগণ বলল, তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং হযরত বাশার হাফী (রহঃ) ছিলেন। তখন লোকটি বলল, হায়! তাহলে তিনি আমাকে কি মনে করেছেন এবং সামনেই বা কি করে আমি তাঁর সাথে সাক্ষাত করব? কথিত আছে যে, ঐ লোকটি সেদিনই জ্বরাক্রান্ত হয়ে পড়ল এবং তার সাতদিন পর প্রাণত্যাগ করল।

Post a Comment

0 Comments