রসনার দশম বিপদ : সঙ্গীত ও কবিতা হল রসনার দশম বিপদ। সঙ্গীত ও কবিতা সন্ধীত বিষয় আমরা ইতঃপূর্বে আলোচনা করেছি, তা' এখানে পুনরাবৃত্তি করব না। ঐ বিষয়ের সারমর্ম এই যে, উত্তম সঙ্গীত ও কবিতা উত্তম এবং মন্দ সঙ্গীত ও কবিতা মন্দ। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, কারও উদর কবিতা দ্বারা পূর্ণ করা অপেক্ষা তা' পুঁজ দ্বারা পূর্ণ করা উত্তম। হযরত মাসরুক (রহঃ) কে কবিতা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি তা' নাপছন্দ করেছেন। তার কারণ সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছেন, আমার কিতাবে কবিতা থাকা। আমি পছন্দ করি না। কোন এক বুযর্গকে কবিতা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, কবিতার স্থান যিকির দ্বারা পূর্ণ কর। কবিতা থেকে আল্লাহর যিকির উত্তম। সার কথা এই যে, কবিতা রচনা বা আবৃত্তি করা নিষিদ্ধ নয়, যদি তাতে অসৎ বাক্য না থাকে। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, "ইন্না মিনাশ শি'রিলাহিকমাতুন।" অর্থাৎ কবিতার মধ্যে হেকমত আছে। সত্য বটে যে. কবিতার উদ্দেশ্য থাকে প্রশংসা, নিন্দা, স্ত্রীলোকের রূপ গুণ বর্ণনা এবং তার মধ্যে অসত্য কথাও থাকে। হুযুরে পাক (দঃ) কবি হাসসান ইবনে ছাবেতকে কাফিরদেরকে আক্রমণমূলক এবং ইসলামের প্রশংসাজ্ঞাপক কবিতা আবৃত্তির জন্য নিযুক্ত করেছিলেন। যদিও কবিতার মধ্যে কিছু অতিরঞ্জন থাকে, তা' হারাম হয় না। কেননা সেটাই কবিতার প্রাণ।
যদি কবি দানবীর না হয়, সে মিথ্যাবাদী হয়, আর যদি সে দানবীর হয়, কবিতার দ্বারা সে দানকে অতিরঞ্জিত করে। দানকারীর মূর্তি মানুষ অবিকল বিশ্বাস করে নেবে বলে কবির উদ্দেশ্য থাকে না। ঐরূপ উপমাজ্ঞাপক কবিতা হুযুরে পাক (দঃ)এর সামনে আবৃত্তি করা হয়েছিল। কিন্তু হুযুরে পাক (সঃ) তা' নিষেধ করেন নি। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, হুযুতে পাক (সঃ) একদিন নিজের জুতা সেলাই করতেছিলেন এবং আমি তার পাশে বসে সূতা কাটতেছিলাম। আমি তাঁর দিকে লক্ষ্য করে দেখলাম যে, তার কপোলদেশ থেকে ধর্ম নির্গত হচ্ছে এবং যুক্তন বিন্দুর ন্যায় ঝকমক করছে। তিনি পরিশ্রান্ত হয়ে আমার দিকে লক্ষ্য করে বললেন, তুমি ও পরিশ্রান্ত হয়েছ। আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ (দঃ)। আমি আপনার দিকে লক্ষ্য করে দেখলাম, আপনার কপোলদেশ থেকে ধর্ম নির্গত হচ্ছে এবং তা' মুক্তার ন্যায় ঝকমক করছে। যদি কবি আবুকবির হাজলী আপনাকে এই অবস্থায় দেখত, সে আপনাকে তার কবিতার এক উপযুক্ত বিষয়বস্তু হিসাবে ধরে নিত। তখন হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, সে কিরূপ কবিতা বলে। তখন আমি তার রচিত দুটি পংক্তি আবৃত্তি করে তাঁকে শুনালাম। তিনি তখন আমার দু' নয়নের মধ্যবর্তী স্থানে চুম্বন করে বললেন, আল্লাহর মঙ্গল তোমার উপর বর্ষিত হোক। আমি তোমার উপর যত সন্তুষ্ট হয়েছি, তুমি আমার উপর তত সন্তুষ্ট হওনি।
হুযুরে পাক (দঃ) জঙ্গে হোনায়নের গনিমতসমূহ মুসলিম মুজাহিদগণের মধ্যে বন্টনকালে আব্বাস ইবনে মেরদাসকে চারটি উষ্ট্র দিলেন। কিন্তু তিনি তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে বরং এ বণ্টনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে চলে গেলেন এবং ঐ অভিযোগ একটি কবিতার মাধ্যমে পেশ করে গেল। যার মর্ম এই ছিল, বদর এবং খন্দকের যুদ্ধে আমাকে যা দেয়া হয়েছিল, তা' আমার জন্য সন্তোষজনকই ছিল। কিন্তু আজ হোনায়েন যুদ্ধ শেষে তাকে বঞ্চনার ব্যথা নিয়ে চলে যেতে হল। এটা আমার জন্য বড়ই দুঃখের কথা।
হুযুরে পাক (দঃ) তার এ কবিতা শুনে বললেন, তোমরা আমার পক্ষ থেকে তাকে খুশী করে দাও। তখন হযরত আবুবকর (রাঃ) নিজে পছন্দ করে তাকে একশ উষ্ট্র দিয়ে দিলেন। তিনি তখন সর্বাপেক্ষা বেশী খুশী হলেন। তখন হুযুরে পাক (দঃ) তাকে লক্ষ্য করে বললেন, ও হে। তুমি কি কবিতার দ্বারাই সব কথাবার্তা বল না কি? তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (দঃ)! আমার পিতামাতা আপনার উপর কুরবান হোক। আমি কবিতার মধ্যে পিপীলিকার ন্যায় চলাচল করি এবং তা' আমাকে পিপীলিকার ন্যায় দংশন করে। কবিতা না বলে আমি সুস্থির থাকতে পারি না। তখন হুযুরে পাক (দঃ) মৃদু হেসে বললেন, এ মরুবাসী হোনায়নের উষ্ট্র ত্যাগ করতে পারে, তবু মনে হয় কবিতা ত্যাগ করতে পারে না।
রসনার একাদশ বিপদঃ উপহাস এবং ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা রসনার একাদশ বিপদ। উপহাস এবং ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হারাম। কেননা তা' অপরের অন্তরে ব্যথা জনিন্ময়ে দেয় এবং তাতে তার মনঃকষ্ট হয়। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, হে মু'মিনগণ তোমাদের কোন একদল লোক যেন অন্য একদল লোককে উপহাস না করে। কেননা বিচিত্র নয় যে, যাদেরকে উপহাস করা হয় তারা উপহাসকারীদের অপেক্ষা উৎকৃষ্ট হবে। একদল স্ত্রীলোক যেন অন্য একদল স্ত্রীলোককে উপহাস না করে। কেননা হয়ত উপহাসিত স্ত্রীলোকগণ উপহাসকারিনী স্ত্রীলোকদের অপেক্ষা উৎকৃষ্ট হতে পারে। যেমন পবিত্র কুরআনে উক্ত হয়েছে, "ইয়া আইয়্যুহাল্লাযীনা আমানু লা-ইয়াসরু ক্বাওমুম্ মিন কাওমিন আসা আইয়্যাকুন্ খাইরাম মিনহুম অলা নিসায়ুম মিন নিসায়িন আসা আইয়াকুন্না খাইরাম মিনহুন্না।"
উপহাস করবার অর্থ অন্যকে অবজ্ঞা ও হেয় করা এবং তার দোষত্রুটি দেখিয়ে দেয়া। কথা ও কার্যের দৃষ্টান্ত দ্বারা তা' প্রকাশ পায়। আকার ইঙ্গিত দ্বারাও উপহাস করা যায়। যাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করা হয় তার উপস্থিতিতে তা' করা হলে তা' পরনিন্দায় গণ্য হয় না।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, আমি এক ব্যক্তিকে উপলক্ষ্য করে উপহাস করেছিলাম। হুযুরে পাক (দঃ) তখন আমাকে বললেন, আল্লাহর কসম আমি চাই না যে, কোন লোককে উপলক্ষ্য করে আমি উপহাস করি এবং আমার এরূপ পাপ হয়। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, "মালি হাযাল কিতাবি লাইয়ুগাদিরু ছাগীরাতান অলা কাবীরাতান ইল্লা আ'ছাহা"। অর্থাৎ এ আমলনামা কি? ক্ষুদ্র-বৃহৎ কিছুই যে এ গণনা থেকে বাদ যায় নি। সবই লিপিবদ্ধ হয়েছে। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেছেন, ক্ষুদ্র শব্দের অর্থ এখানে মু'মিনের উপহাসরূপ মৃদু হাসি। এতে দেখা যাচ্ছে যে, অট্টহাসি বড় পাপের অন্তর্গত।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জামআ (রাঃ) বলেছেন, আমি হুযুরে পাক (দঃ) কে বলতে শুনেছি, কারও উদরস্থ বায়ু সশব্দে নির্গত হলে তা' নিয়ে উপহাস করো না। যে কাজ মানুষকে প্রকৃতির নিয়মানুসারে করতে হয় তা' নিয়ে অপরকে উপহাস কেন করবে? হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, যারা লোকের সাথে উপহাস করে তাদের কারও কারও বেহেশতের দরজা খুলে দিয়ে বলা হবে আস, আস! তখন সে তার দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি লাভের জন্য বেহেশতের দরজায় আসবে কিন্তু তার আসামাত্রই বেহেশতের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। তার সাথে বার বার এরূপ করা হতে থাকবে। যখনই তাকে বলা হবে যে আস, প্রবেশ কর। কিন্তু প্রবেশ করতে উদ্যত হলেই বেহেশতের দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। এভাবে বার বার করা হলে সে ব্যক্তি আর বেহেশতের দরজায় উপস্থিত হবে না। হুযুরে পাক (দঃ) আরও বলেছেন, যে ব্যক্তি তার ভ্রাতাকে তাওবাহকৃত পাপের জন্য দোরী করে সে নিজে ঐ পাপ না করা পর্যন্ত তার মৃত্যু হবে না। এসব কথা সয়ন্তই অন্যকে উপহাস করা সম্বন্ধে বলা হয়েছে। উপরোল্লিখিত আয়াত অনুযায়ী বৃথা যায় যে, অন্যকে উপহাস করলে উপহাসকারী হয়ত এমন ব্যক্তিকে উপহাস করে যে, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। উপহাস করবার কারণে যাকে উপহাস করা হয় সে যদি মনঃকষ্ট পায় তাহলে সেক্ষেত্রে উপহাস করা হারাম। যে ব্যক্তি নিজেকে উপহাসযোগ্য করে তোলে এবং যে ব্যক্তি অনেক সময় উপহাস দ্বারা আনন্দ পায় তার ক্ষেত্রে, উপহাস কৌতুকের অনুরূপ হয়। এক্ষেত্রে উপহাস করা হারাম নয়, হারাম ঐ ক্ষেত্রে যখন উপহাস দ্বারা অপরের মনে কষ্ট দেয়া হয়। যদি কোন ব্যক্তির রসনা থেকে কোন ত্রুটিমূলক কিছু বের হয়ে যায় তবে তার উপর হাস্য করা উপহাসের অন্তর্গত। তন্ত্রণ কারও লিখা, কার্য, আকৃতি, প্রকৃতি, দৈর্ঘ্য ইত্যাদির উপর হাস্য করলে তা' উপহাসে গণ্য হয় এবং তা' হারাম বা নিষিদ্ধরূপে বিবেচিত হয়।
0 Comments