নমরূদকে ইসলামের দা'ওয়াত প্রদান
হযরত ইব্রাহী (আ) এর সাথে তাঁর পিতা আযর ও জনগণের এ দ্বন্দ ও তাদের দেবদেবী রূপী প্রতিমাসমূহ ভেঙ্গে ফেলার ঘটনা শেষ পর্যন্ত সে দেশের বাদশাহ নমরূদের দরবার পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে। নমরূদ তা জানতে পেরে ক্রোধে অধীর হয়ে পড়ল এবং চিন্তা করতে লাগল, এ ব্যক্তির পয়গম্বর সুলভ তাবলীগ ও দাওয়াত যদি এ ভাবেই চলতে থাকে, তবে এ ব্যক্তি আমার খোদায়িত্ব, রাজত্ব এবং দেবত্ব থেকেও সব প্রজাকে বিগড়িয়ে দেবে, এভাবে পূর্বপুরুষের ধর্মের সাথে সাথে আমার এ রাজত্বেরও অবসান ঘটবে। সুতরাং অঙ্কুরেই এ ব্যাপারটি খতম করে দেয়ার সংকল্প গ্রহণ করল। সে ইব্রাহীমকে তার দরবারে হাজির করার আদেশ জারি করল। ইব্রাহীম (আ) নমরূদের দরবারে পৌঁছলে নমরূদ ইব্রাহীম (আ) কে জিজ্ঞেস করল, "তুমি পূর্বপুরুষের ধর্মের বিরোধিতা কেন করছ? আর করছি। তাঁকে ছাড়া তাঁর সাথে আর কাউকেও শরীক মানি না। সমুদয় সৃষ্টি এবং সমগ্র জগৎ তাঁরই সৃষ্ট। তিনিই সকলের আর কেমন করে এ বোবা, বধির ও অন্ধ কাষ্ঠ মূর্তিগুলি খোদা হতে পারে? আমি সঠিক পথের উপর আছি। আর তোমরা সকলে ভুল পথে রয়েছ। কাজেই আমি সত্যের প্রচার কেমন করে ত্যাগ করতে পারি? তোমাদের পূর্বপুরুষের মনগড়া ধর্মকে কেমন করে গ্রহণ করতে পারি?
নমরূদ ইব্রাহীম (আ)কে বলল, আমি ছাড়া তুমি যাকে তোমার রব বলে মান, তার এমন গুণ বর্ণনা কর, যে শুণ আমার মধ্যে নেই। তখন ইব্রাহীম (আ) বললেন, আমার রব সেই মহান সত্তা যার করায়ত্বে জীবন ও মৃত্যু, তিনিই এরূপে মৃত্যু ও জীবন তো আমার আয়ত্বেও রয়েছে। এই বলে সে একজন নির্দোষ ব্যক্তিকে এনে জাল্লাদকে আদেশ করল একে হত্যা করে ফেল। জাল্লাদ তৎক্ষণাৎ আদেশ পালন করল। আর জনৈক মৃত্যু দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত অপরাধীকে জেলখানা হতে ডেকে এনে আদেশ করল যাও, আমি তোমার জীবন দান করলাম। অতঃপর ইব্রাহীম (আ) কে লক্ষ্য করে বলল, দেখলে আমিও কিভাবে জীবন ও মৃত্যু দান করে থাকি, তবে আর তোমার রবের বিশেষত্ব কি রইল?
ইব্রাহীম (আ) বুঝলেন, নমরূদ হয়ত মৃত্যু ও জীবনের প্রকৃত তত্ত্ব অবগত নয়। নতুবা সাধারণকে ভুল বুঝাতে চাচ্ছে। যেন তারা এ পার্থক্যটুকু বুঝতে না পারে যে, জীবন দান করা এর নাম নয়; বরং অনস্তিত্ব হতে অস্তিত্বে আনয়ন করার নাম জীবন দান করা। ইব্রাহীম (আ) ভাবলেন, আমি যদি এখন জীবন মৃত্যুর সূক্ষ্ম দার্শনিক তত্ত্ব আলোচনা করি, তবে নমরূদের উদ্দেশ্য সফল হয়ে যাবে। সে সর্বসাধারণকে ভুলে ফেলে আসল ব্যাপারটিকে গড়বড় করে দেবে এবং এরূপে আমার সৎ উদ্দেশ্যটি সফল হতে পারবে না। আর সত্যের প্রচার প্রসঙ্গে জনতার সম্মুখে নমরূদকে নিরুত্তর করে দেয়ার সুযোগ নষ্ট হয়ে যাবে। যেহেতু অন্তরে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য, তাই তিনি তাকে বুঝানোর জন্য অন্য পন্থা অবলম্বন করলেন। তিনি এমন প্রমাণ উপস্থিত করলেন যা প্রত্যেকটি মানুষই চাক্ষুষ দর্শন করে থাকে।
ইব্রাহীম (আ) বললেন, আমি সেই মহান সত্তাকে আল্লাহ বলে মানি যিনি প্রতিদিন সূর্যকে পূর্ব দিক থেকে উদিত করেন এবং পশ্চিম দিকে নিয়ে যান। তুমিও যদি নিজেকে সেই শক্তির অধিকারী বলে দাবী কর, তবে তার বিপরীত সূর্যকে পশ্চিম দিক থেকে উদিত কর এবং পূর্বদিকে অস্তমিত কর। তা শুনে নমরূদ হতবাক ও নিরুত্তর হয়ে গেল। আর এরূপে ইব্রাহীম (আ) এর মুখে আল্লাহ্ তা'আলার প্রমাণ পূর্ণ হয়ে গেল।
নমরূদের সাথে হযরত ইব্রাহীম (আ) এর বিতর্কটির কথা সূরা বাক্বারায় বর্ণনা করা হয়েছে-
المْ تَرَ إِلَى الَّذِي حَاجَ إِبْرَهِم فِي رَبِّهِ أن أنهُ اللهُ الْمُلْكَ - إِذْ قَالَ إِبْرَهُمُ رَبِّيَ الَّذِي - يُحْيِي وَيُمِيتُ - قَالَ أَنَا أَحَى وَأُمِيتُ - قَالَ إِبْرَاهِيمُ فَإِنَّ اللهَ يَأْتِي بِالشَّمْسِ مِنَ الْمَشْرِقِ فَأَنَّ بِهَا مِنَ الْمَغْرِبِ فَيُهَت الَّذِي كَفَرَ - وَاللهُ لَا يَهْدِى الْقَوْمَ الظَّلِمِينَ - (بَقَرَة)
অর্থাৎ: "আপনি কি ঐ ব্যক্তিকে দেখেননি, যে ইব্রাহীম (আ) এর সাথে তার প্রতিপালক সম্বন্ধে বিতরর্কে লিপ্ত হয়েছিল। যেহেতু আল্লাহ্ তাকে কর্তৃত্ব দিয়েছিলেন? যখন ইব্রাহীম বললেন, তিনি আমার রব যিনি জীবিতর্কে লিপ্ত ■ ভাবেই দশা এবং মৃত্যু ঘটান, তখন সে বলল, আমি ও জীবন দান করি এবং মৃত্যু ঘটাই। ইব্রাহীম বললেন নিজীবনে দান করেন দেবে, এভাবে ত'আলা সর্ষকে পর্বদিক থেকে উদিত করান, তমি তাকে পশ্চিম দিক থেকে উদিত করে দেখাও। অতঃপর যে ত্রুটি খতম এটা কফরী করেছিল সে হতবুদ্ধি হয়ে গেল। আর আল্লাহ জামিলদেরকে হেদায়াত দেন না। (সূরা বাক্কারাহ: ২৫৮)
কিন্তু তা সত্ত্বেও বাদশাহ, আযর এবং দেশের আপামর জনসাধারণ হযরত ইব্রাহীম (আ) এর দলিল প্রমাণাদির সাথে নিরুত্তর ছিল। মনে মনে তাঁর সত্যতায় স্বীকারকারী; এমনকি মূর্তিসমূহের ব্যাপারে তো মুখেও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে, ইব্রাহীম যা বলছে তাই সত্য এবং সঠিক। তথাপি তাদের মধ্যে থেকে কেউ সরল পথ গ্রহণ করল না। শুধু এতটুকুই নয়, বরং তার বিপরীত নিজেদের লজ্জা ও অপমানের প্রতিক্রিয়ায় প্রভাবিত হয়ে অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে গেল। রাজা হতে প্রজাবৃন্দ পর্যন্ত সকলে ঐক্যমতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর যে, দেবতাদের অপমান করা এবং বেকার জবাব কোরআনুল কার পূর্বপূরুষের ধর্মের বিরোধিতা করার প্রতিফল স্বরূপ ইব্রাহীমকে প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করাই কর্তব্য। কেননা, এমন ভীষণ অপরাধীর শান্তি তাই হতে পারে, আর দেবতাদের অপমান করার প্রতিশোধ এরূপেই নেয়া যেতে পারে।
ইব্রাহীম (আ) কে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ
কিন্তু হযরত ইব্রাহীম (আ) এর অন্তরে তার বিন্দুমাত্র পরোয়াও ছিল না, তার জন্য কোন ভয়ও ছিল না। তিমি পূর্বের মতই নির্ভীক। ঘটনা এই ঘটেছিল যে, নমরূদ এবং তার জাতি ইব্রাহীম (আ)কে শান্তি প্রদানের জন্য একটি স্থান নির্দিষ্ট করে নিল এবং এতে কয়েক দিন পর্যন্ত অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করল। এমন কি তার জ্বলন্ত শিখায় চতুর্দিকের সব বস্তু ঝলসিয়ে উঠতে লাগল, যখন এরূপে বাদশাহ ও তার জাতি পূর্ণ নিশ্চিন্ত হয়ে গেল যে, এখন এ অগ্নি হতে ইব্রাহীমের জীবিত বের হয়ে আসার কোন পথ নেই, তখন এক চড়কের উপর ইব্রাহীম (আ) কে বসিয়ে উত্ত প্রজ্বলিত অগ্নির মধ্যে নিক্ষেপ করল।
তৎক্ষণাৎ আল্লাহ তা'আলা আগুনকে আদেশ করলেন, হে অগ্নি ইব্রাহীমের প্রতি শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও। আগুন তৎক্ষণাৎ ইব্রাহীম (আ) এর উপর স্নিগ্ধ ও শান্তিময় হয়ে গেল। শত্রুরা তাঁর কোনই ক্ষতি করতে পারল না। ইব্রাহীম (আ) জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড হতে নিরাপদ ও সংরক্ষিত অবস্থায় শত্রুদের ভিড় থেকে বের হয়ে গেলেন। কবি বলেন।
"শত্রু যদিও শক্তিশালী, কিন্তু রক্ষাকারী তদপেক্ষা শক্তিশালী।"
কোরআনুল কারীমে ইব্রাহীম (আ) এর এ ঘটনাটির উল্লেখ এভাবে করা হয়েছে।
"তারা সকলে বলতে লাগল, ইব্রাহীম (আ) কে পুড়িয়ে ফেল এবং তোমাদের দেবতাদের সাহায্য কর। যদি তোমরা কিছু করতে চাও। আমি আদেশ করলাম, হে অগ্নি। তুই ইব্রাহীমের পক্ষে শীতল এবং নিরাপদ হয়ে যা, আর তারা তাঁর ক্ষতি সাধনের ইচ্ছা করল, আমি তাদেরকে করে দিলাম সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত"। -(সূরা আম্বিয়া: ৬৮-৭০)
قَالُوا ابْنُوا لَهُ بُنْيَانًا فَالْقُوهُ فِي الْجَحِيم - فَأَرَادُوا بِهِ كَيْدًا فَجَعَلْتَهُمُ الأسْفَلِينَ - وَقَالَ إِنِّي ذَاهِبٌ إِلى رَبِّي سَيَهْدِينَ - (الصَّافات)
অর্থাৎঃ "তারা বলল, এর জন্য একটি স্থান তৈরি কর অতঃপর তাকে প্রজ্বলিত অগ্নিতে নিক্ষেপ কর। তার তার বিরুদ্ধে চক্রান্তের সঙ্কল্প করেছিলে; কিন্তু আমি তাদেরকে অত্যন্ত হে করে দিলাম। ইব্রাহীম (আ) বললেন, আমি আমার প্রতিপালকের দিকে চললাম তিনি অবশ্যই আমাকে সৎপথে পরিচালিত করবেন। (সূরা আছছাফাত: ৯৭-৯৯)
0 Comments