যিকির করবার সময় শয়তানের কুমন্ত্রণা

 

        পাঠক-পাঠিকা। জেনে রাখ, যে সব আলিম আত্মার বিষয় চিন্তা করে এবং তার গুণাবলী ও অত্যাশ্চর্য কার্য-কলাপের প্রতি লক্ষ্য করে যিকির করবার সময় শয়তান কুমন্ত্রণা দেয় কিনা এই প্রশ্নে তারা পাঁচটি ব্যাপারে মতভেদ করে একদল আলিম বলে যে, আল্লাহর যিকির করলে শয়তানের কুমন্ত্রণা দূর হয়। কেননা হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, যখন সে আল্লাহর যিকির করে তখন শয়তান দমন থাকে। দমন থাকার অর্থ নীরব নিশ্চুপ থাকা। অর্থাৎ তখন শয়তান নীরব হয়ে যায়। অন্যদল বলে, আল্লাহর যিকির করবার কালে শয়তানের কুমন্ত্রণা মূলতঃ চলে যায় না; বরং তা' হৃদয়মধ্যে জারী থাকে। কিন্তু তার চিহ্ন বা প্রভাব থাকে না। কেননা হৃদয় যখন যিকির দ্বারা পূর্ণ হয়ে যায় তখন কুমন্ত্রণার উপর পর্দা পড়ে যায়। আর এক দল বলে যে, কুমন্ত্রণা এবং তার চিহ্ন দূর হয় না, কিন্তু হৃদয় থেকে তার প্রভাব চলে যায়। মনে হয় তখন শয়তান যেন দূর থেকে দুর্বলভাবে কুমন্ত্রণা দিতে থাকে। অন্য একদল বলে যে, যিকিরের সময় কিছুক্ষণ শয়তানের কুমন্ত্রণা বিলুপ্ত হয় এবং কিছুক্ষণ যিকির বিলুপ্ত হয়। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি করেই একটির পর আরেকটি আসে। এই দল প্রমাণ দেয় যে, হাদীস শরীফে শয়তানের কথা উল্লেখ আছে এবং আমরা যিকিরের সাথে কুমন্ত্রণা প্রত্যক্ষ করতেছি এর ব্যতিক্রম হবার কোন কারণ নেই। অন্যদল আলিম বলে, যিকির ও কুমন্ত্রণা পরস্পর পরস্পরকে হৃদয়ের উপর অনবরত এমনভাবে তাড়া করে যার বিরাম নেই। যে কোন ব্যক্তি একই সময় তাঁর দুটো চোখ দ্বারা দুটো জিনিস দেখতে পায়। তদ্রূপ মানবাত্মা একই সময় তার উপর দুটো জিনিসের চলাচল দেখতে পায়। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, এমন কোন মানুষ নেই যার চারটি চক্ষু নেই। দুটো চক্ষু তার মস্তকে তদ্বারা সে জড় জগতের ব্যাপার দেখে। আর অন্য দুটো চক্ষু তার অন্তরের মধ্যে। তদ্বারা সে তার ধর্মের বিষয় দেখে। হযরত মুহাসাবী (রহঃ) এ মতকে সমর্থন করেছেন।

        কিন্তু আমাদের মত হল, উপরোল্লিখিত প্রত্যেকটি মত বিশুদ্ধ হলেও কোন মতই বিভিন্ন প্রকারের কুমন্ত্রণার কথা উল্লেখ করে নি; বরং তারা প্রত্যেক কুমন্ত্রণাকেই সম্পূর্ণ ওয়াসওয়াসা বলে মনে করেছে। এ বিষয় নিম্নে বিশদভাবে আলোচনা করা গেল।

        কুমন্ত্রণা নানা প্রকার: ওয়াসওয়াসা বা শয়তানের কুমন্ত্রণা বিভিন্ন প্রকার রয়েছে।

        প্রথম প্রকার কুমন্ত্রণা: প্রথম প্রকার কুমন্ত্রণা সত্যের সাথে মিশ্রিত হয়। কেননা শয়তান তার কুমন্ত্রণা সত্যের সাথে মিশ্রিত করে মানুষকে বলে, তুমি সুখ, সমৃদ্ধি, ধন-সম্পদ, ত্যাগ করে চলেছ জীবন ত দীর্ঘ এবং সে জীবন ভর কাম ও মোহ থেকে ধৈর্য ধারণ করে থাকা বড়ই কষ্টকর। এসময় যদি ঐ ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি তার অসীম কর্তব্য, আল্লাহর অপার করুণা এবং ভীষণ শাস্তির কথা স্মরণ করে আর যদি মনে মনে বলে যে, লোভ, মোহ, কাম থেকে ধৈর্য ধারণ করা কষ্টকর বটে, কিন্তু দোযখের অগ্নিতে চিরকাল থাকা আরও বেশী কষ্টকর। এখন এ দুটোর মধ্যে কোনটি গ্রহণীয়? এ কথা বলামাত্র শয়তানের কুমন্ত্রণা দূরে চলে যায়। যখন বান্দা আল্লাহর ওয়াদাহ ও সতর্কবানীর কথা স্মরণ করে এবং সে ঈমান ও একীনের নব বলে বলীয়ান হয় তখন শয়তান চুপ করে পালিয়ে যায়। তখন বান্দাকে এরূপ কথা বলা যায় না যে, দোযখের অগ্নি পাপ থেকে ধৈর্যের চেয়ে অধিক সহজ। তাছাড়া তাকে এ কথা বলা ত সম্ভব নয় যে, পাপ দোযখে বৃদ্ধি হবে না। কেননা কুরআনের প্রতি তাঁর ঈমান তা' বারণ করবে। তখন কুমন্ত্রণা আপনা থেকেই কর্তিত হয়ে যাবে। তদ্রূপ বান্দার মনে আত্মম্ভরিতার কুমন্ত্রণা এলে তাকে শয়তান বলে, কোন ব্যক্তি তোমার চেয়ে মারেফাতে অধিক জ্ঞানী? কোন ব্যক্তি তোমার চেয়ে অধিক ধর্মভীরু? আল্লাহর নিকট তোমার পদমর্যাদা অনেক উচ্চে। এ সময় যদি সে ব্যক্তি মনে মনে ভাবে যে, তার মারেফাত, তার হৃদয় এবং তার নেক কার্যসমূহে সাহায্যকারী অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ ও তার বিদ্যা-বুদ্ধি সবই আল্লাহর সৃষ্টি তাহলে শয়তান কর্তৃক তার প্রশংসায় সে মোটেই তুপ্তি লাভ করবে না। এমতাবস্থায় শয়তান নিশ্চয়ই তার কাছে পরাজয় স্বীকার করবে। কেননা শয়তানও একথা অস্বীকার করতে পারে না যে, এগুলো সবই আল্লাহর সৃষ্টি। তখন বাধ্য হয়ে শয়তান তার নিকট থেকে দূর হয়ে যায়। এ

        দ্বিতীয় প্রকার কুমন্ত্রণা: যিকিরের মধ্যে কাম ও মোহের কুমন্ত্রণা। শয়তান এটাকে জাগ্রত করে দেয়। এ কুমন্ত্রণা দু' প্রকার এমন কার্যে কুমন্ত্রণা যা সে নিশ্চয়ই জানে যে, এটা পাপকার্য এবং এমন কার্যে কুমন্ত্রণা যা' সে ধারণা করে যে, এটা পাপ কার্য। যদি পাপকার্য বলে তার নিশ্চিত জ্ঞান থাকে তখন শয়তান তার মনে কাম ও মোহ উদ্রেক করবার ব্যাপারে নিরাশ হয়। আর যদি পাপকার্য বলে তার মনে প্রবল ধারণা হয় তখন অনেক সময় তা' হৃদয়ের উপর থেকে যায় এবং তা' দূর করবার জন্য পরিশ্রমের প্রয়োজন হয়। তবে যদি কুমন্ত্রণা প্রবল না হয় তবে তা' দূর করা সম্ভব হয়।

           তৃতীয় প্রকার কুমন্ত্রণা: যিকিরের সময় মনের মধ্যে হঠাৎ অন্য চিন্তা এবং অদৃশ্য বস্তুর খেয়াল জাগ্রত হওয়া। যখন সে যিকির করতে আরম্ভ করে, কুমন্ত্রণা কিছু সময়ের জন্য দূর হয়ে যায়। তারপর তা' ফিরে আসে। তারপর আবার চলে যায়। তারপর আবার ফিরে আসে। এভাবে যিকির ও ওয়াসওয়াসা একটির পর আর একটি আসতে থাকে। এসময় মনের মধ্যে কিরাতের অর্থ আসে এবং শয়তানের কুমন্ত্রণাও আসে। যেন উভয়ই হৃদয়ের দুটি স্থানে অবস্থিত। এটা সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত করা খুবই কষ্টকর। কিন্তু অসম্ভব নয়। কেননা হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি দু' রাকাত নামায পড়ে এবং তার মধ্যে পার্থিব বিষয়ের কোন কিছু তার মনের মধ্যে উদয় না হয়, তবে তার অতীত পাপ ক্ষমা করা হয়। যদি একথা অসম্ভব হত, তবে হুযুরে পাক (দঃ) তা' এ হাদীসে উল্লেখ করতেন না। কিন্তু এই অসম্ভব এমন হৃদয়ে সম্ভব হয়, যা আল্লাহর প্রেমে নিমজ্জিত রয়েছে। কেননা যে বিষয় নিয়ে মন সদাসর্বদা ব্যস্ত থাকে, তা' ব্যতীত অন্য কিছুই তার মনে উদিত হয় না। যার মনে কোন শত্রুর শত্রুতার খেয়াল আসে, তখন তার সাথে তর্কযুদ্ধে প্রায় দু' রাকাত বা তদুর্ধ রাকাত নামায পরিমাণ সময় সে মনে মনে কাটিয়ে দেয় এবং শত্রুর কথা ছাড়া তার হৃদয়ে অন্য কিছুই উদিত হয় না।

        যে মন ভালবাসায় নিমজ্জিত থাকে, তার অবস্থাও তদ্রূপ হয়। প্রেমাস্পদের চিন্তা তার সম্পূর্ণ মন অধিকার করে বসে। ঐ চিন্তা ব্যতীত অন্য কিছুই তার হৃদয় মধ্যে স্থান পায় না। এই অবস্থায় যদি অন্য কেউ তার সাথে কথা বলে, তবে সে তা' শ্রবণ করে না। যদি কেউ তার সামনে এসে দাঁড়ায় সে তাকে দেখতেও পায় না। এভাবে যদি শত্রুর ভয় মনে জাগ্রত হয় বা যশঃ খ্যাতি ও সুখ-শান্তির লোভ মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, তবে দোযখের ভয় এবং বেহেশতের সুখ-সমৃদ্ধির লোভ আরও বেশী মনে স্থান লাভ করা উচিত কিন্তু তা' হয় না। কেননা আল্লাহর প্রতি ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসের জোর নেই।

        শয়তান থেকে মুক্ত থাকা অসম্ভবঃ শয়তান থেকে রক্ষা পাওয়া বা মুক্ত থাকা কিছু সময়ের জন্য তত কষ্টকর না হলেও তার থেকে স্থায়ীভাবে সারা জীবনের জন্য মুক্ত থাকা খুবই কষ্টকর বরং অসম্ভব। কেন না যদি তা' সম্ভব হত, তাহলে হুযুরে পাক (দঃ) এর নিকট কোনরূপ কুমন্ত্রণা আসত না। অথচ দেখা যায়, তা' এসেছে। হাদীস শরীফে আছে, হুযুরে পাক (দঃ) একদা নামাযের মধ্যে তাঁর পরিহিত বস্ত্রের নকশা তাঁর দৃষ্টিগোচর হলে তিনি নামাযের বাদে সে বস্তু খুলে ফেললেন এবং বললেন, এই বস্ত্র আমাকে নামাযের মধ্যে অন্যমনষ্ক করছে। এটা আমাকে যে দিয়েছে তার নিকট ফিরিয়ে দাও এবং আমার জন্য মামুলি বস্ত্র নিয়ে এস। আর একদিন খুৎবাহ পাঠ করবার কালে (যখন পর্যন্ত ইসলামে পুরুষের জন্য স্বর্ণ ব্যবহার করা হারাম হয়নি) তাঁর হাতে একটি স্বর্ণের আংটির উপর দৃষ্টি পতিত হলে, তিনি তা' ফেলে দিয়ে বললেন, আমি একবার এ আংটির দিকে তাকাই আর একবার তোমাদের দিকে তাকাই এটা ওয়াসওয়াসার কারণে হয়েছিল। কেননা তিনি হাতের আংটিটি দেখে একটু আনন্দিত হয়েছিলেন।

        পার্থিব ধন-সম্পদ ও মাল-সামান বর্জন ব্যতীত এই ওয়াসওয়াসা দূর হয় না। যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত এক দিনার মূল্যেরও কোন জিনিস থাকে শয়তান নামাযের মধ্যে তার চিন্তা হৃদয় মধ্যে এনে দেয় যে, কিরূপে তা' সংরক্ষণ করব এবং কিভাবে তা' নিরাপদ থাকবে ইত্যাদি। যে ব্যক্তি দুনিয়ায় শয়তান থেকে রক্ষা পেয়েছে বলে গর্ব করে সে ঐ ব্যক্তির ন্যায়, যে মধুর মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে ধারণা করে যে, তার দেহে মৌমাছি পতিত হবে না। এটা সম্পূর্ণ অবান্তর। দুনিয়া শয়তানের কুমন্ত্রণার জন্য একটি কেন্দ্রস্বরূপ।

        জনৈক বিজ্ঞ বুযর্গ বলেছেন, শয়তান প্রথমে মানুষের নিকট পাপের আকৃতিতেই আগমন করে, কিন্তু তাতে বাধাপ্রাপ্ত হলে উপদেশ নিয়ে আসে, এমনকি তখন সে তাকে হেদায়েতের মধ্যে ফেলে তার উদ্দেশ্য সিদ্ধি করতে চায়। যদি সে অ' গ্রহণ না করে তখন সে তাকে কষ্ট ও পরিশ্রম করতে আদেশ দেয়। এমন কি যা হারাম নয় তাও তাকে হারাম মনে করতে বলে। যদি সে তা' গ্রহণ না করে তখন সে তার অজু ও নামাযের মধ্যে সন্দেহ উপস্থিত করে। যদি সে তা' গ্রহণ না করে তখন সে তাকে অন্যদিক থেকে পথভ্রষ্ট করবার চেষ্টা করে। সে তখন তার উপর সৎকার্যকে সহজ করে দেয়। যেন তাতে লোকগণ তাকে ধৈর্যশীল ও সংযমশীল বলে জানে। তখন তাদের মন তার দিকে অনুরক্ত হয় এবং এর ফলে সে আত্মম্ভরিতা ও আত্মগৌরবের ফাসাদে পড়ে যায় এবং তদ্বারা শয়তান তাকে ধ্বংস করে। এ সময় শয়তান থেকে সতর্ক থাকা অধিক প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কেননা এটাই তার শেষ স্তর। শয়তান জানে যে. সে যদি এই স্তরটি অতিক্রম করতে পারে তবে সে সোজা বেহেশতের দিকে চলে যাবে।

Post a Comment

0 Comments