ক্রোধের বা রাগের পরিচয়

            পাঠক-পাঠিকা! জেনে রাখ, যখন মহান আল্লাহতায়ালা প্রাণীকে এমনভাবে সৃষ্টি করলেন যে, তার দেহের অভ্যন্তরস্থিত উপাদান এবং বাহ্যিক উপাদানসমূহের জন্য তার ধ্বংস অনিবার্য ছিল। তখন করুণাময় আল্লাহ ধ্বংসের হাত থেকে তাকে এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত রক্ষা করবার জন্য তার উপর এমন অস্ত্র প্রদান করলেন যদ্বারা সে আত্মরক্ষা করতে পারে। যে আভ্যন্তরীণ উপাদানের দ্বারা তার দেহ গঠিত তা' উষ্ণতা এবং আর্দ্রতা। এই উষ্ণতা ও আর্দ্রতার, মধ্যে তিনি আবার বিরোধিতা ও শত্রুতা স্থাপন করেছেন, তার ফলে উষ্ণতা সব সময়ই আর্দ্রতাকে শুভ ও দূর করতে থাকে এবং তাকে ধূম্র দ্বারা এমনভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলে যে দেহের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধুম্রাকার হয়ে যায় এবং তা' বহির্দেশে নির্গত হয়। যদি আর্দ্রতারূপ খাদ্যের সাহায্য দেহ না পেত এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হতে ধূম্ররাশি বিদূরীত না করত তাহলে প্রাণীসমূহ ধ্বংস হয়ে যেত; সুতরাং প্রাণীদেহ রক্ষার জন্য করুণাময় আল্লাহতায়ালা প্রয়োজনানুযায়ী তাকে আহার দিয়েছেন এবং তার মধ্যে এমন প্রবৃত্তি ও লালসা সৃষ্টি করেছেন যেন সে তার খাদ্য সংগ্রহে অনবরতঃ তৎপর থাকে। এই কারণই তাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে। 

        যেসব বাহ্যিক উপাদান মানুষকে প্রদান করা হয়েছে তা' তার অস্ত্রস্বরূপ। যেসব ধ্বংসকর উপাদান তাকে দেয়া হয়েছে তা' থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহতায়ালা তাকে ক্রোধরূপ মন্ত্র দিয়েছেন। তা' তার অভ্যন্তর হতে উত্থিত হয়ে তার ধ্বংসকর বস্তুসমূহকে দূর করে দেয়। আল্লাহতায়ালা তজ্জন্য ক্রোধ প্রবৃত্তিকে অগ্নি থেকে সৃষ্টি করে তা' মানবের মধ্যে অঙ্কুরিত করেছেন এবং মানব প্রকৃতির মধ্যে সুপ্তাবস্থায় রেখে দিয়েছেন। যখনই মানুষের নিকট তার প্রয়োজন মিটাবার পথে কোন বস্তু প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় এবং তার উদ্দেশ্য পূর্ণ করবার অন্তরায় হয় তখনই ক্রোধের অগ্নি এমনভাবে প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠে যে, তাতে হৃদয়ের শোনিত উত্তপ্ত হয়ে তার বিভিন্ন গ্রন্থিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং অগ্নি যেরূপ উর্ধগামী হয় অথবা পাত্রের মধ্যে পানি যেরূপ উত্তপ্ত হয়ে টগবগ করতে থাকে তদ্রূপ তা' দেহের উপরিভাগে উত্থিত হতে থাকে। তজ্জন্যই তা' চোখে ও মুখে প্রকাশ পায়, চোখ ও মুখমণ্ডল রক্তবর্ণ হয়ে যায়। যেরূপ কাচের জিনিসের মধ্যে কোন বস্তু রাখলে ঐ বস্তুর বর্ণ কাঁচের মধ্য দিয়ে ফুটে বের হয়। তদ্রূপ দেহাভ্যন্তরস্থিত রক্তও ফুটে উঠে চোখ ও মুখে প্রকাশ পায়। যে ব্যক্তি কিছুটা কম মর্যাদাসম্পন্ন লোক, ক্রোধের সময় তার প্রতি রক্ত এরূপে প্রভাবিত হয়। কেননা সে ক্রোধের কাবুর মধ্যে থাকে; কিন্তু যখন এমন ব্যক্তির উপর ক্রোধ আসে যে সম্মানে ও পদমর্যাদায় তদপেক্ষা উর্ধে তার ক্রোধ উপর দিকে উত্থিত হয়ে আবার হৃদয়ের দিকে নিম্নগামী হয়ে ফিরে যায়। তা' তখন দুঃখে পরিণত হয়। এজন্যই তখন তার মুখের বর্ণ পাংশুরূপ ধারণ করে। যখন কোন সতর্ককারীর উপর ক্রোধ হয় তখন শোনিত প্রবাহ প্রধাবিত হয় ও থেমে যায় এবং তার মুখবর্ণ লোহিত ও সবুজ হয়। মোটকথা ক্রোধের উৎপত্তিস্থল হৃদয়। ক্রোধের অর্থ প্রতিশোধ অন্বেষণের জন্য হৃদয়ের শোনিত উত্তপ্ত হওয়া। এর উত্তেজনার সময়ে এটা এমন শক্তি অর্জন করে যা' অনিষ্টকর বস্তু আবির্ভাবের পূর্বে একে দূরীভূত করে দেয় এবং এর আবির্ভাবের পর একে প্রতিশোধের দিকে নিয়ে যায়। প্রতিশোধ এবং লোভই ক্রোধ-শক্তির আহার। তন্মধ্যেই এর স্বাদ নিহিত।

        ক্রোধের শক্তিভেদে মানুষের তিনটি শ্রেণীঃ ক্রোধের শক্তির তারতম্যানুসারে মানুষ তিন শ্রেণীতে বিভক্ত। যথাঃ ক্রোধ না থাকা, অতিরিক্ত ক্রোধ থাকা এবং মধ্যম পরিমাণ ক্রোধ থাকা।

         ক্রোধ না থাকাঃ ক্রোধ না থাকা বা একেবারে নিস্তেজ হওয়া মন্দ। এজন্যই এরূপ লোককে বলা হয় পৌরুষহীন। ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি ক্রোধ উৎপাদনের কারণ ঘটলেও ক্রোধ হয় না, সে গর্দভ। যে ব্যক্তি মূলতঃই ক্রোধের শক্তি হারিয়ে ফেলেছে সে অতিশয় খর্ববুদ্ধিবিশিষ্ট লোক। আল্লাহতায়ালা হুযুরে পাক (দঃ) এর ছাহাবাদের প্রশংসা করে বলেছেন, তারা কাফিরদের প্রতি কঠোর কিন্তু তাদের পরস্পরের মধ্যে দয়ালু। যেমন কুরআনে পাকে উক্ত হয়েছে, "আশিদ্দাউ আ'লাল কুফফারি ওয়া রুহামাউ বাইনাহুম।" আল্লাহতায়ালা তাঁর নবীকে লক্ষ্য করে বলেছেন, "জাহিদিল কুফফারা ওয়াল মুনাফিক্বীনা ওয়াগলুজ আ'লাইহিম"। অর্থাৎ কাফির ও মুনাফিকদের সাথে যুদ্ধ কর এবং তাদের প্রতি কঠোর হও। এই কঠিন ব্যবহারই ক্রোধের উত্তেজনা শক্তির ফল।

         অতিরিক্ত ক্রোধ থাকাঃ অতিরিক্ত ক্রোধ থাকাও অনিষ্টকর। কেননা তা' উপরোক্ত গুণসমূহের উপর প্রবল হয়। এমন কি সে বুদ্ধি, ধর্ম ও ইবাদাতের বহির্ভূত হয়ে যায়। তখন তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। সে তখন দর্শন শক্তি ও চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলে। তখন তার কোন স্বাধীনতা থাকে না; বরং সে তখন বিপদগ্রস্ত লোকের ন্যায় হয়ে যায়। ক্রোধ প্রবল হওয়ার কারণ জন্মগত প্রবৃত্তি বা অভ্যাসগত ব্যাপার। অনেক লোক আছে যারা স্বাভাবিকভাবেই সত্বর ক্রোধের জন্য প্রস্তুত থাকে। এমন কি তাদের জন্মগত প্রকৃতিতেই ক্রোধের ভাব থাকে এবং তার সাথে উত্তেজনা মিলিত হয়ে তাকে সাহায্য করে। কেননা ক্রোধ অগ্নি থেকে উৎপত্তি হয়। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, স্বভাবের শীতলতাই ক্রোধকে দমন করে এবং তার প্রকৃতি ভেঙ্গে দেয়।

        অভ্যাসগত কারণ সমূহঃ যখন কোন লোক এমন লোকের সাথে মেলামেশা করে যারা ক্রোধ উৎপাদনের দাওয়াই গ্রহণ করে এবং তার অনুগত হয়। তারা তাকে বীরত্ব ও পুরুষত্ব গুণে আখ্যা দেয়। তাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি বলে, আমি কোন প্রকার প্রবঞ্চনা সহ্য করব না। কোন ব্যক্তি কোন রুক্ষ কথা বললে আমি সহ্য করব না। আমার কোন বুদ্ধি বা ধৈর্য নেই। সেরূপ গৌরব ও অহঙ্কারের প্রতারণায় এবং অজ্ঞতাবশতঃ বলে থাকে, যে ব্যক্তি তা' শুনে সেও তা' তার হৃদয়ের মধ্যে বদ্ধমূল করে নেয় এবং ঐ লোকের অনুকরণ করে। তখন তার সাহায্যে ক্রোধ আরও শক্তিশালী হয়। এরূপে যখন ক্রোধাগ্নি প্রবল হয় তখন ক্রুদ্ধ ব্যক্তি অন্ধ হয়ে যায় এবং যে কোন উপদেশের ক্ষেত্রেই সে বধির হয়। তখন কেউ তাকে উপদেশ দিলে সে তা' শ্রবণ করে না; বরং উপদেশে তার ক্রোধ আরও বৃদ্ধি পায়। যখন তার বুদ্ধির আলো উঁকি দেয় এবং সে নিজের প্রবৃত্তিকে শীতল করতে চায় সে ক্রোধ দমন করতে সক্ষম হয় না। কেনন্য তখন বুদ্ধির আলো নির্বাপিত হয়ে ক্রোধের ধুম্রজালে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

        চিন্তার খনি মস্তিষ্কঃ অতিরিক্ত ক্রোধের সময় হৃদয়ের শোনিত উত্তপ্ত হওয়ার জন্য অন্ধকারপূর্ণ ঘুম মস্তিস্কের দিকে উর্ধগামী হয় এবং চিন্তার খনিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। কখনও কখনও তা' দর্শনের খনিকেও আচ্ছন্ন করে ফেলে। যার ফলে তার চক্ষু অন্ধকার হয়ে যায়। এমন কি সে তখন তার চক্ষু দ্বারা দেখতে পায় না। তার নিকট তখন সংসার ঘোর অন্ধকারময় হয়ে যায় এবং তার মস্তিষ্ক একটি গুহার ন্যায় অন্ধকারপূর্ণ হয়ে যায়। তার মধ্যে শুধু আগুন জ্বলতে থাকে। তার অভান্তর সম্পূর্ণ কৃষ্ণময় হয়ে গিয়ে তার চতুষ্পার্শ্ব ধূমে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। তার মধ্যে বৃদ্ধিরূপ ক্ষীণ প্রদীপ থাকে বটে, কিন্তু তার আলো নির্বাপিত হয়ে যায়। তখন তার মধ্যে পদদ্বয় ঠিক থাকে না, কথাও শুনা যায় না। কোন আকৃতিও ভিতর থেকে বা বহির্ভাগ হতে দেখা যায় না। বরং যা' দগ্ধ হবার উপযুক্ত তা' দগ্ধ না হওয়া পর্যন্ত সে ধৈর্য ধারণ করে থাকে। ক্রোধ হৃদয়ে ও মস্তিষ্কের মধ্যে এরূপ কার্য করে। কখনও কখনও ক্রোধাগ্নি প্রবল হলে হৃদয়ের প্রাণস্বরূপ আর্দ্রতাকে তা' শেষ করে ফেলে। তখন ক্রোধভরে সে লোক মৃত্যুবরণ করে। যেরূপ অগ্নি গুহার মধ্যে বর্ধিত হয়ে তাকে খন্ড-বিখন্ড করে ফেলে। তার ফলে উর্ধ দিক নিচের দিকে বসে যায় অর্থাৎ গুহার দেয়াল এবং চতুষ্পার্শ্বে যে শক্তি থাকে তা' উত্তপ্ততার কারণে গলে গিয়ে ঋধ্বসে পড়ে। তদ্রূপ ক্রোধাগ্নির ফলে হৃদয়ের আর্দ্রতা দূর হয়ে ক্রোধান্বিত ব্যক্তির সম্মুখীন হয়। যদি প্রকৃতপক্ষে জিজ্ঞেস কর, তাহলে দেখবে যে, সমূদ্রের তরঙ্গমালার মধ্যে ঝড়-তুফানের সময় নৌকার অবস্থা যেরূপ হয় তা' থেকেও ক্রুদ্ধ ব্যক্তির হৃদয়ের অবস্থা নিকৃষ্ট হয়। নৌকা রক্ষা করা সম্ভব হতে পারে, কেননা নৌকায় যেসব আরোহী থাকে তারা নৌকা শান্ত এবং স্থির থাকার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু হৃদয় নৌকা তার মালিকের কারনেই পড়ে যায়। কেননা ক্রোধই তাকে অন্ধ ও বধির করে ফেলে।

        এই ক্রোধের ফলে তার প্রকাশ্য রূপ পরিবর্তিত হয়ে যায়। তার হস্তপদ কাঁপতে থাকে এবং সে কার্য-কলাপের নিয়ম-কানুন থেকে বের হয়ে যায়। এমন কি ক্রোধের ফলে তার দু' অধরের মধ্য থেকে ফেনা নির্গত হতে থাকে, চক্ষু রক্তবর্ণ হয়ে যায়, নাসিকারন্ধ্রের অবস্থা পরিবর্তিত হয় এবং মুখাকৃতির বিকৃতি ঘটে। যদি ক্রুদ্ধ ব্যক্তি তখন নিজের প্রকৃত অবস্থা দেখতে পেত এবং নিজের বিকৃত আকৃতির প্রতি তার নজর পড়ত তাহলে সে লজ্জায় ক্রোধকে দমন করতে পারত। তার এ সময়কার বাহ্যিক কুৎসিত আকৃতি থেকে আন্তরিক কুৎসিত আকৃতি আরও জঘন্য হয়। মূলতঃ বাহ্যিক প্রকাশই তার আন্তরিক অবস্থার নিদর্শন। এ সময় প্রথমে অন্তরের রূপ বিশ্রী হয়ে যায়। পরে তা' বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে প্রকাশ পায়; সুতরাং প্রকাশ্য রূপের পরিবর্তন আভ্যন্তরীণ রূপ পরিবর্তনেরই ফল। ফলের দ্বারাই বৃক্ষের পরিচয়। দেহের উপর এসব চিহ্ন থেকে অন্তরের বিকৃতি অনুভব করা যায়। এ সময় রসনার উপরও ক্রোধের নিদর্শন প্রতিফলিত হয়। তিরস্কার ও অশ্লীল বাক্য ব্যবহার করা থেকে বুদ্ধিমান লোক লজ্জিত না হয়ে পারে না। এমন কি ক্রোধ চলে গেলে ক্রুদ্ধ ব্যক্তিও তাতে লজ্জিত হয়। ক্রোধের ফলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপর যে প্রভাব পতিত হয় তার চিহ্ন আক্রমণ, মারপিট, নর্তন কুর্দন এবং খুন- খারাপি ইত্যাদি। এ সময় যে লোকই সামনে থাকে তাকেই সে আক্রমণে বৃষ্ঠিত হয় না। যদি প্রতিপক্ষ তার নিকট থেকে পালিয়ে যায় তাহলে ক্রুদ্ধ ব্যক্তি রোষানিক্যে নিজেও সন্তু ছিন্ন করে, নিজের মুখেই চপেটাঘাত করে, মাঁটির উপর হস্তপদ মারতে থাকে এবং সুরাপায়ী বিকারগ্রস্ত ব্যক্তির ন্যায় দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে। কখনও বা হঠাৎ মাটির উপর পড়ে যায়, এমন কি উঠবার ও দৌড়াবার শক্তি থাকে না। কখনও কখনও ক্রোধভরে নির্জীব ও সজীব প্রাণীকে প্রহার করতে থাকে। যেমন বর্তন ও তৈজসাদি ভেঙ্গে ফেলে, দস্তরখানা ছিঁড়ে ফেলে, গরু- ঘোড়া, মেষ-ভেড়াকে গালি-গালাজ করে এবং তাদের সাথে এমনভাবে কথা বলে যেন সে মানুষের সাথে কথা বলছে। যদি কোন প্রাণী তাকে পদ্যঘাত করে সে নিজেও তাকে পদাঘাত করে। তাকে ভর্ৎসনা করে এবং বিকারগ্রস্ত লোকের ন্যায় আরও নানারূপ অসংলগ্ন কাজে ব্যাপৃত হয়।

        হৃদয়ের উপর ক্রোধের যে প্রভাব পড়ে তার নিদর্শন হিংসা ও বিদ্বেষ। তাছাড়া বিপক্ষের উপর মন্দ ধারণা করা, তার দুঃখে সুখী হওয়া এবং তার সুখে দুঃখী হওয়া, তার গুপ্ত বিষয় প্রকাশ করবার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা ইত্যাদি কার্যসমূহ। এটাই অতিরিক্ত ক্রোধের ফল। ক্রোধের ফলে অত্যধিক দুর্বল উত্তেজনাও উত্তম নয়। যথাঃ মাতা, ভগ্নি, স্ত্রী, কন্যা ও অন্যান্যের উপর জুলুম, অত্যাচারীদের উপর ক্রোধ না করা বা দুষ্কর্মকারীদের দ্বারা অপমান সহ্য করা এবং এভাবে নিজেকে হেয় করা ইত্যাদি কার্য-নিন্দনীয়। কেননা হারাম কার্যের উপর ক্রোধ না করলে তা' অন্যায় কার্যের শামিল হয়। হুযুরে পাক (দঃ) একদা বলেছিলেন, নিশ্চয়ই সা'দের ক্রোধ আছে। সা'দ অপেক্ষা আমার ক্রোধ অধিক। আমার অপেক্ষা আল্লাহর ক্রোধ আরও অধিক। বংশ রক্ষার জন্য ক্রোধ সৃষ্টি করা হয়েছে। যদি লোক ক্রোধমুক্ত হয়ে পড়ে তবে নানাপ্রকার বংশ রক্ত মিশ্রিত হবে। এজন্যই বলা হয়েছে, প্রত্যেক উম্মতের লোকের মধ্যে ক্রোধ এবং স্ত্রীলোকের মধ্যে সতীত্ব স্থাপন করা হয়েছে। মন্দ কার্য করতে দেখে তাতে নীরব থাকা ক্রোধশূন্যতার চিহ্ন। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তি ধর্মে দৃঢ় সেই উত্তম। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, আল্লাহর ধর্ম পালনে যেন তাদের প্রতি তোমাদের দয়া না হয়।

        যার ক্রোধ নেই সে নিজের আত্মার রিয়াজাত বা আত্মোন্নতির জন্য পরিশ্রমে অক্ষম। কেননা রিয়াজাত পূর্ণ হয় না যে পর্যন্ত ক্রোধ, লোভ ও লালসার প্রাধান্য লাভ না করা যায় এবং প্রবৃত্তি ঘৃণিত লোভের দিকে অনুরক্ত হলে যে পর্যন্ত তার উপর ক্রোধ না হয়। তখন ক্রোধ না, করা অন্যায়। বুদ্ধি ও ধর্মের ইশারায় যে ক্রোধ জন্যে তা-ই উত্তম। যেখানে ক্রোধ অপরিহার্য সেখানে তা' ক্রোধকে উত্তেজিত করে এবং যেখানে ধৈর্য ধারণ ওয়াজিব সেখানে তা' ক্রোধকে নির্বাপিত করে। সাম্যের সীমায় ক্রোধকে রক্ষা করাই সঠিক পন্থা। আল্লাহতায়ালা মানুষকে তার উপরই থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, সব জিনিসের মধ্যে মধ্যম পন্থাই উত্তম। যার ক্রোধ নির্বাপিত প্রায় এবং যে ক্রোধের বহ্নি দেখতে পায় না তার চিকিৎসা করা উচিত, যে পর্যন্ত না তার ক্রোধ প্রবল হয়। যার ক্রোধ অত্যধিক এবং তা' তাকে ঔদ্ধত্য এবং অশ্লীল কার্যের দিকে উৎসাহ দেয় তারও চিকিৎসা করা উচিত, যাতে ক্রোধের পরিমাণ হ্রাস পায় এবং দু' সীমার মধ্যবর্তী মধ্যপর্যায় নেমে আসে এবং এটাই ছিরাতুল মুস্তাকীম বা সরল পথ। এ পথ কেশ থেকে সূক্ষ্ম এবং অসি থেকে তীক্ষ্ণ। যদি তাতে সে সমর্থ না হয় তবে তার নিকটবর্তী হওয়ার চেষ্টা করবে। আল্লাতায়ালা বলেছেন, "তোমরা পত্নীদের মধ্যে সমব্যবহার করতে কিছুতেই পারবে না যদিও তোমরা তার আকাঙক্ষা কর; সুতরাং একদিকে ঝুঁকে পড়ো না এবং তাকে শূন্যে লটকানোর ন্যায় রেখো না। যেমন কুরআনে পাকে উক্ত হয়েছে, "অলান তাসতাত্বীউ আন তা'দ্বিলু বাইনা গ্লিসায়ি অ লাও হারাছতুম ফালা তামীলু কুল্লাল মাইলি তাতাযারূহা কাল মুআল্লাবাতি"।

        যে ব্যক্তি সম্পূর্ণ মঙ্গল করতে সম্পূর্ণ সক্ষম না হয়, তার পক্ষে সম্পূর্ণ অমঙ্গল কার্য করা উচিত নয়। কতক মন্দ কার্য কতক মন্দ কার্য হতে অধিক সহজ এবং কতক উত্তম কার্য কতক উত্তম কার্য হতে অধিক উত্তম।

Post a Comment

0 Comments