নারীর 'গোটা দেহই পরম সুন্দর। তবে মুখমণ্ডল তার সৌন্দর্যের প্রতীক। বিবাহের পাত্রী দেখতে হলেও লোকে মুখমণ্ডল দেখে, অন্য কোন অঙ্গ দেখে না। নারীর মুখমণ্ডলই পুরুষের অদম্য চেতনাতে শিহরণ শিহ জাগায়। নারীর মুখমণ্ডলের এত গুরুত্ব রয়েছে বলেই এর রক্ষার জন্য নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ পাক সূরা আহযাবে বলেন-
بَايُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ بَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يديين عَلَيْهِنَّ مِن جَلَابِيبِهِنَّ ذَلِكَ أَدْنَى أَنْ يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ .
অর্থাৎ, "হে নবী। আপন বিবিদের, কন্যাদের ও মুসলিম নারীদেরকে বলে দিন, তারা যেন আপন চাদর দ্বারা নিজের ঘোমটা টেনে দেয়। এই ব্যবস্থার ছাত্র আশা করা যায় যে তাদেরকে চিনতে পারা যাবে, অতপর তাদেরকে উত্যক্ত করা যাবে না। (সূরা আহযাব: ৫৯)
বিশেষ করে মুখমন্ডল আবৃত করার জন্য আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। خلْبَابٌ শব্দের বহুবচন এর অর্থ চাঁদর جلباب শব্দের অর্থ লটকান। من نَ عَلَيْهِنَّ مِن جَلا يدنين এর শাব্দিক অর্থ নিজের উপরে চাদরের অংশ যেন লটকিয়ে দেয়। ঘোমটা দেয়ার অর্থও তা-ই। কিন্তু এ আয়াতের আসল উদ্দেশ্য সাধারণভাবে ঘোমটা নয়, বরং এর উদ্দেশ্য মুখমণ্ডলকে আবৃতকরণ। তা ঘোমটার দ্বারা হোক, অথবা অন্য যে কোন উপায়ে হোক। এর উপকারিতা বর্ণনা করা হয়েছে যে, যখন মুসলিম নারী এভাবে আবৃত অবস্থায় ঘর থেকে বের হবে, তখন মানুষ বুঝতে পারবে যে, তারা সম্ভ্রান্ত মহিলা। তারা নির্লজ্জ বাজে মহিলা নয়। এ কারণে কেউ তাদের শ্লীলতার প্রতিবন্ধক হবে না।
কুরআনের সকল ব্যাখ্যাকার এই আয়াতের এই মর্ম ব্যক্ত করেছেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) এর ব্যাখ্যায় বলেন: আল্লাহ তায়ালা মুসলমান নারীদেরকে নির্দেশ করেছেন যে, তারা যখন কোন প্রয়োজনে গৃহের বাইরে যাবে, তখন যেন তারা মাথার উপর হতে চাদর ঝুলিয়ে মুখমণ্ডল ঢেকে দেয়। (তাফসীরে ইবনে জারীর)
ইমাম মুহাম্মদ বিন সিরীন হযরত ওবায়দা বিন সুফিয়ান বিন আল হারিস আল-হাজরামীর নিকট জানতে চাইলেন, এই নির্দেশের কিভাবে আমল করা যায়। এর উত্তরে তিনি স্বয়ং চাদর জড়িয়ে দেখিয়ে দিলেন। কপাল, নাক ও একটি চোখ ঢেকে ফেললেন এবং একটি চোখ খুলে রাখলেন। (তাফসীরে ইবনে জারীর)
আল্লামা ইবনে জারীর তাবারী এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন: হে নবী। আপনার বিবিদের, কন্যাদের ও মুসলমান নারীদেরকে বলুন, যখন তারা কোন প্রয়োজনে আপন গৃহ হতে বাইরে যাবে, তখন যেন তারা ক্রীতদাসীদের পোশাক পরিধান না করে- যাতে মাথা ও মুখমণ্ডল অনাবৃত থাকে, বরং তারা যেন নিজের উপরে চাদরের ঘোমটা টেনে দেয় যাতে ফাসিক লোকেরা তাদের শ্লীলতার অন্তরায় না হয় এবং জানতে পারে এরা ভদ্র মহিলা। (তাফসীরে ইবেন জারীর)
আল্লামা আবু বকর জাসসাস বলেন-
এ আয়াতের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, যুবতী নারীকে পরপুরুষ হতে তার মুখমণ্ডল ঢেকে রাখার আদেশ করা হয়েছে এবং ঘর হতে বাইরে যাবার সময হিজাব পড়া উচিত, যাতে অসৎ অভিপ্রায় পোষণকারী তার প্রতি প্রলুদ্ধ হতেমা পারে। (আহকামুল কুরআন)
আল্লামা নায়শাপুরী তাঁর তাফসীর 'গারায়েবুল কুরআন-এ বলেন- ইসলা- মের প্রাথমিক যুগে মেয়েরা অজ্ঞতার যুগের মত কামিজ ও দোপাট্টা পরিধান করে বাইরে যেত। সম্ভ্রান্ত মহিলাদের পোশাকও নিচু শ্রেণীর মেয়েদের থেকে আ- লাদা ছিল না। অতপর নির্দেশ দেয়া হলো যে, তারা যেন চাদর জড়িয়ে মুখমণ্ডল ঢেকে ফেলে যাতে লোকে মনে করতে পারে যে তারা সম্ভ্রান্ত মহিলা। তারা শ্রীলতাবর্জিতা মহিলা নয়।
ইমাম রাজী বলেন: জাহেলিয়াতের যুগে সম্ভ্রান্ত মহিলারা ও ক্রীতদাসী, সকলেই বেপর্দায় ঘুরে বেড়াত এবং অসৎ লোকে তাদের পিছু নিত। আল্লাহ তা'আলা সম্ভ্রান্ত নারীদের প্রতি নির্দেশ করেন যেন তারা চাদর দ্বারা নিজেদেরকে 77 - ذلك أدنى أن يعرفن فلا يؤذين : দু প্রকার মর্ম হতে পারে। প্রথমত, এই পোশাক হতে চিনতে পারা যাবে যে, এরা সম্ভ্রান্ত মহিলা দ্বিতীয়ত, এর দ্বারা বুঝতে পারা যাবে যে, এরা চরিত্রহীনা নয়। কারণ যে নারী তার মুখমণ্ডল আবৃত করে রাখে তার কাছে কেউ এ আশা পোষণ করতে পারে না যে, সে আওরাত অনাবৃত করতে সম্মত হবে। অতএব এ পোশাক এটিই প্রমাণ করে যে, সে একজন পর্দানশীন নারী এবং তার দ্বারা কোন অসৎ কর্মের আশা করা বৃথা হবে। (তাফসীরে কবীর)
কাযী বায়যাবী বলেনঃ يدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِن ن من جلابيبهن এর অর্থ হলো, যখন তারা আপন প্রয়োজনে বাইরে যাবে তখন চাঁদর দ্বারা শরীর ও মুখমণ্ডল A ঢেকে নিবে। এখানে من শব্দটি تبعیض এর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে অর্থাৎ চাদরের একাংশ দিয়ে মুখমণ্ডল ঢাকতে হবে এবং একাংশ শরীরের ওপর জড়িয়ে নিতে হবে। يعرفن ذَالِكَ أَدْنَى أَنْ يُعرفن এট দ্বারা সম্ভ্রান্ত নারী, ক্রীতদাসী এবং গায়িকাদের মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে। يؤذين ও অর্থাৎ সন্দেহভাজন ব্যক্তি তাদের শ্লীলতাহানীর সাহস করবে না। (তাফসীরে বায়যারী)
এ সকল উক্তি থেকে প্রমাণিত হয় যে, সাহাবায়ে কিরাম (রা)-এর পবিত্র যুগ থেকে শুরু করে অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত প্রতি যুগে উক্ত আয়াতের একই মর্ম করা হয়েছে যা আমরা এতক্ষণ এর শব্দগুলো হতে বুঝতে পেরেছি। এরপর হাদীসগুলোর প্রতি লক্ষ্য করলে তা হতে স্পষ্ট হয় যে, এই আয়াত নাযিল হওয়ার পর থেকে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে সাধারণভাদে মুসলমান নারীরা মুখমণ্ডলের উপর আবরণ দেয়া শুরু করেছিলেন-আবু দাউদ, বিতমিরী ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থগুলোতে আছে যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আল এইহি ওয়াসাল্লাম ইহরাম অবস্থায় মহিলাদের মুখে আবরণ ও হাতে দস্তানা। পরিধান নিষিদ্ধ করেছিলেন। এতে প্রমাণিত হয় যে সেই পবিত্র যুগেই মুখমণ্ডল আবৃতের জন্য আবরণ ও হস্তদ্বয় ঢাকার জন্য দস্তানা ব্যবহারের প্রচলন হয়েছিল। শুধু ইহরামের অবস্থায় তা ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু হজ্জের সময় নারীর মুখমণ্ডল জনসাধারণের দৃষ্টিগোচর করা এর উদ্দেশ্য ছিল না, বরং এর উদ্দেশ্য ছিল যে, ইহরামের দীনবেশে মুখের আবরণ যেন নারীদের পোশাকের কোন অংশবিশেষ না হতে পারে, যা অন্য সময়ে সাধারণভাবে হয়ে থাকে। অন্যান্য হাদীসে বলা হয়েছে, ইহরাম অবস্থায়ও নবী-পত্নীগণ ও অন্যান্য মুসলমান মহিলারা আবরণহীন মুখমণ্ডল অপরিচিত লোকের দৃষ্টি হতে লুকিয়ে রাখতেন।
হযরত আয়েশা (রা) বলেন যানবাহন আমাদের নিকট দিয়ে যাচ্ছিল এবং আমরা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ইহরাম অবস্থায় থাকতাম। যখন মানুষ আমাদের কাছ দিয়ে অতিক্রম করত, তখন আমাদের চাদর মাথার উপর হতে মুখের উপর টেনে দিতাম। তারা চলে গেলে আবার মুখ খুলে দিতাম। (আবু দাউদ)
ت كنا نخمر عن فَاطِمَةَ بِنْتِ الْمُنْذِرِ قَالَتْ خمر وجوهنا مُحْرِمَاتٌ وَنَحْنُ مَعَ أَسْمَاءَ بِنْتِ أَبِي بَكْرِ الصِّدِيقِ فَلَا ونحن محرمتذكره علينا -
অর্থাৎ, ফাতিমা বিনতে মানযার বলেন, "আমরা ইহ্রাম অবস্থায় কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে রাখতাম। আমাদের সাথে হযরত আবু বকরের কন্যা হযরত আসমা (রা) ছিলেন। তিনি আমাদেরকে নিষেধ করেননি।" (মুয়াত্তা ইমাম মালিক)
ফতহুল বারীর, কিতাবুল হজ্জে হযরত আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত আছে।
تَسْوَلُ الْعِرَأَةُ جَلْبَابَهَا مِنْ فَوْقِ رَأْسِهَا عَلَى وَجْهِهَا .
নারীরা ইহরাম অবস্থায় যেন নিজেদের চাদর মস্তক হতে মুখের উপর ঝুলিয়ে দেয়।
0 Comments