পার্থিব কাজ-কর্মের হিসাব প্রদান

        হে বেচারা। তারপর চিন্তা কর, এসব ভয়াবহ ঘটনার পর তোমার নিকট প্রশ্ন করা হবে। এতে কোন মাধ্যম থাকবে না। সরাসরি তোমার ব্যাপার তোমাকেই জিজ্ঞেস করা হবে, অল্প-অধিক, ছোট-বড় সব কিছুই জিজ্ঞেস করা হবে এবং তোমাকেই তার জবাব দিতে হবে। যখন তুমি কিয়ামতের নানাবিধ ক্লেশ এবং ঘর্মের মধ্যে নিমজ্জিতপ্রায় হয়ে অবস্থান করবে, তখন আকাশের একদিক থেকে ভীষণ মূর্তি ফিরেশতাগণ নেমে আসবে। তাদের একেকজনের শরীর ভীষণ স্কুল এবং অসম্ভব বৃহৎ আকৃতিবিশিষ্ট। দোযখীদেরকে তাদের কেশের গুচ্ছ ধরে আল্লাহর সম্মুখে হাজির করার জন্য এই সব ফিরেশতার প্রতি আদেশ হবে।

        হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন যে, আল্লাহর কোন কোন এমন ফিরেশতা আছে যে, তাদের দুই চক্ষুর মধ্যকার দূরত্ব একশ' বছরের পথের দূরত্বের সমান। এখন তুমি নিজের সম্বন্ধে কি মনে কর, যদি তুমি সেদিন এই সব ফিরেশতাকে তোমার নিকট পাঠান হয়েছে বলে মনে কব, তবে তোমার অবস্থা তখন কেমন হবে? একথা এখনই চিন্তা করে ঐসব ফিরেশতা যাতে তোমাকে আল্লাহর নিকট ঐভাবে ধরে নিয়ে যাবার জন্য না আসে, তজ্জন্য তোমার প্রস্তুত হওয়া প্রয়োজন নয় কি?

        ঐসব ফিরেশতা দর্শন করে লোকগণ ভয়ের আধিক্যে তাদের নিকট প্রশ্ন করবে, ওহে। তোমাদের মধ্যে কি আমাদের প্রভুও আছেন? তাদের এ প্রশ্ন শুনে ফিরেশতাগণও ভয়ে ভীত হবে, কেননা তাদের প্রভুর গৌরব অসীম, অনন্ত। তিনি তাদের মধ্যে থাকার কথা নয়, তখন তারা অত্যন্ত উচ্চৈঃস্বরে বলবে, আমাদের প্রভু পবিত্র। তিনি আমাদের মধ্যে থাকতে পারেন না। তবে তিনি পরে আগমন করবেন। এসময় ফিরেশতাগণ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে এবং সব মানুষকে বেষ্টন করে রাখবে। মানুষ তখন অতিশয় অপমান, অপদস্থতা ও দীন-হীন অবস্থার মধ্যে থাকবে। আল্লাহ বলেন, আমি আমার প্রেরিত ফিরেশতাদেরকে মানুষের অবস্থার বিষয় জিজ্ঞেস করব এবং নবী-রাসূলদেরও কোন কোন বিষয় জিজ্ঞেস করব। আল্লাহ বলেন যে, আমিও যথাস্থানে উপস্থিত হয়ে যাব। আমার শপথ আমি প্রত্যেককে জিজ্ঞেস করব যে, তোমরা কে কি করেছিলে? সর্বপ্রথম আল্লাহ নবীদেরকে জিজ্ঞেস করবেন, তিনি বললেন, বল, আমার এ প্রশ্নের উত্তর কি? তাঁরা বলবেন, হে প্রভু! আমাদের এ ব্যাপারে কোন জ্ঞান নেই। বরং তুমিই ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান সব কিছু জান। আক্ষেপের বিষয় যে, অবস্থা এবং পরিস্থিতির প্রভাবে নবীদের জ্ঞান-বুদ্ধিও বহাল থাকবে না। যখন তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে যে, তোমাদেরকে মানুষের নিকট পাঠানো হয়েছিল, তোমরা দুনিয়ায় গিয়ে কে কি কাজ করে এসেছ? একথার জবাব যদিও তাঁদের জানা থাকবে, তবু অত্যধিক ভয়ের কারণে তাঁরা জানা বিষয়ও আল্লাহর নিকট বলতে পারবেন না, তাই তাঁরা বলে ফেলবেন, হে মাবুদ! আমাদের কোন জ্ঞান নেই; বরং সব কিছুই তুমি সর্বাধিক জ্ঞাত। তাঁরা তখন একথা সত্যই বলবেন। কেননা সত্যিই তাঁদের তখন বুদ্ধি-জ্ঞান স্বাভাবিক অবস্থায় থাকবে না; বরং তা লোপ পেয়ে যাবে।

        হযরত নূহ (আঃ)কে জিজ্ঞেস করা হবে, তুমি কি মানুষের কাছে আমার বাণী পৌছিয়েছিলে? তিনি বলবেন, হাঁ পৌছিয়েছি। তখন তাঁর উম্মতগণকে জিজ্ঞেস করা হবে, কি তোমরা কি বল? সে কি তোমাদের নিকট আমার বাণী পৌছিয়েছে? তারা বলবে যে, না, আমাদের নিকট কোন সতর্ককারী যায় নি। হযরত ঈসা (আঃ)কে উপস্থিত করে তাঁর নিকট জিজ্ঞেস করা হবে, তুমি কি লোকদেরকে বলেছ, তোমরা আল্লাহকে ব্যতীত আমাকে ও আমার মাতাকে ইলাহীরূপে গ্রহণ কর? হযরত ঈসা (আঃ) এই প্রশ্নের দরুন কয়েক বছর পর্যন্ত হতভম্ব হয়ে থাকবেন। চিন্তা কর দিনটি কি ভয়ঙ্কর। এই ধরনের প্রশ্নের দ্বারা নবীদেরকে পর্যন্ত বিব্রত ও ব্যতিব্যস্ত করে। ফেলা হবে।

        এ সময় ফিরেশতাগণ এসে একেক ব্যক্তিকে নাম ধরে ডাকবে, হে অমুকের পুত্র অমুক। হিসাবের মাঠে এস, তখন তাদের হৃদয় থর থর করে কেঁপে উঠবে। এমনকি সর্ব শরীরে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহও প্রকম্পিত হতে থাকবে। বুদ্ধি-জ্ঞান লোপ পেয়ে যাবে। তখন পর্যন্তও তাদের অসৎকার্যগুলো মহা পরাক্রমশালী আল্লাহর সম্মুখে উপস্থিত করা হবে না, তাদের গোপনীয় ব্যাপারসমূহ সবার সামনে পেশ করা হবে না। লোকদের নিকট তাদের কার্যাবলী সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হওয়ার পূর্বেই সর্বস্থান পরাক্রমশীল আল্লাহর নূরে উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। তখন প্রত্যেক বান্দা নিশ্চিতরূপে বুঝতে পারবে যে, স্বয়ং প্রভু তাদের নিকট জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য এসে পড়তেছেন।

         ইতোমধ্যে আল্লাহতায়ালা উপস্থিত হয়ে ফিরেশতা জিব্রাইলকে বলবেন, দোযখকে আমার নিকটে নিয়ে এস। জিব্রাইল দোযখের নিকট উপস্থিত হয়ে বলবে, হে দোযখ! তোমার সৃষ্টিকর্তা ও মালিকের হুকুম পালন কর। দোযখ এসময় ভয়ঙ্কর ক্রুদ্ধ এবং অগ্নিমূর্তি থাকা সত্ত্বেও জিব্রাইল তার নিকট যেতে ইতস্ততঃ করবে না, কেননা আল্লাহর নির্দেশ তাকে পালন করতে হবে। জিব্রাইল জাহান্নামকে বলবে, তুমি সম্পূর্ণরূপে স্বমূর্তি ধারণ করে তোমার প্রভুর নিকট চল। এসময় দোযখ যে তর্জন-গর্জন এবং ডাক-চীৎকার শুরু করবে, লোকগণ তা' শুনতে পাবে। আল্লাহর নির্দেশ পালন করার জন্য, পাপীদেরকে শাস্তি দেয়ার লক্ষ্যে তখন দোযখ প্রস্তুত হয়ে স্বক্রোধে অগ্রসর হবে। এ সময় বান্দাদের মনের অবস্থা কিরূপ হবে, তা' চিন্তা কর। তারা তখন ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে পড়বে এবং প্রত্যেক্যেই নত জানু হয়ে পড়ে পিছনে হটে যাবে। কুরআনে পাকে উক্ত হয়েছেঃ "ইয়াওমা তারা কুল্লা উম্মাতিন জাসিয়াহ"। অর্থাৎ সে দিন প্রত্যেক ব্যক্তিকে তুমি নতজানু হয়ে পড়ে যেতে দেখবে। কেউ কেউ তাদের নিজ নিজ মুখের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়বে। এ সময় পাপীগণ আক্ষেপ, অনুতাপ এবং হা' হুতাশ শুরু করে দেবে এবং ছিদ্দীকগণ ইয়া নাফসী ইয়া নাফসী আমাকে বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও বলতে থাকবে।

        যখন বান্দাগণ এরূপ অবস্থার মধ্যে পতিত হবে, ওদিকে তখন দোযখের অগ্নিরাশি ভীষণরূপে তার শিখা বিস্তার করে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে। তখন সব বান্দার দেহের শক্তি খর্ব হয়ে যাবে, তাদের মনে হবে যে, এই বুঝি এখনি তাদেরকে ধরে নিয়ে দোযখে নিক্ষেপ করা হয়। এরপর আবার যখন দোযখের আগুন ভীষণ মূর্তিতে ভয়ঙ্কর গর্জনে জ্বলে উঠবে, তখন সমস্ত প্রাণী সেই দৃশ্য দর্শন করে প্রবল কম্পনে নিজ নিজ মুখের উপর পড়ে যাবে। এদিকে-সেদিকে তাকিয়ে দেখার দৃষ্টি শক্তিও তারা তখন হারিয়ে ফেলবে। কেবল এক দিকেই তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকবে। যারা পার্থিব জীবনে শুধু অন্যের উপর অত্যাচার করেছে, তাদের হৃদয় তখন ঘর ঘর করে কাঁপতে থাকবে, প্রাণ কণ্ঠাগত হবে। দুর্ভাগ্যবান ও সৌভাগ্যবান প্রত্যেকেরই এসময় বুদ্ধি বিলোপ হবে।

        এসময় আল্লাহতায়ালা নবীদেরকে লক্ষ্য করে বলবেন, তোমরা আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও। লোকগণ দেখবে যে, নবীদের থেকেও অত্যন্ত কড়াকড়িভাবে হিসাব নেয়া হচ্ছে। তা' দেখে পাপীদের আত্মা ভয়ের আধিক্যে উড়ে যেতে চাইবে। এসময় প্রত্যেকেই যার যার চিন্তায় এতই সন্ত্রস্ত হবে যে, পিতা পুত্রের থেকে দূরে চলে যাবে, ভ্রাতা ভ্রাতা থেকে, স্বামী স্ত্রী থেকে, স্ত্রী স্বামী থেকে পৃথক হয়ে যাবে এবং কার উপর কি আদেশ হয় তার অপেক্ষায় ও চিন্তায় থাকবে। তখন একজন একজন করে আল্লাহর সম্মুখে উপস্থিত করা শুরু হবে। আল্লাহতায়ালা প্রত্যেকের অল্প বা অধিক এবং প্রকাশ্য বা গুপ্ত আমল সম্পর্কে অঙ্গ প্রত্যঙ্গসমূহের নিকট জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ করবেন।

        হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, ছাহাবায় কিরাম হুযুরে পাক (দঃ) এর নিকট আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (দঃ)! আমরা কি প্রভু আল্লাহতায়ালাকে রোজ কিয়ামতে দেখতে পাব? হুযুরে পাক (দঃ) বললেন, মেঘমুক্ত আকাশে দ্বিপ্রহরে কি তোমরা সূর্যের দিকে তাকাতে পার। তাঁরা বললেন, না। তিনি আবার বললেন, মেঘমুক্ত আকাশে রাত্রে পূর্ণচন্দ্রের দিকে কি তোমরা তাকাতে পার? তাঁরা বললেন, হাঁ, তা' পারি। তিনি বললেন, যাঁর হাতে আমার জীবন, তাঁর শপথ, তোমাদের প্রভুকে দেখতে তোমাদের কোনরূপ কষ্ট হবে না। আল্লাহ বান্দার সাথে সাক্ষাত করে বলবেন, আমি কি তোমাকে সম্মান দেইনি, শক্তি-সামর্থ্য দেইনি, তোমাকে স্ত্রী-পুত্র দেইনি, অশ্ব, উট ইত্যাদি তোমার অধীন করে দেইনি, তোমাকে কি প্রভুত্ব প্রদান করিনি? তখন বান্দা বলবে যে, হাঁ দিয়েছেন। তখন আল্লাহ বলবেন, তুমি কি মনে করেছিলে যে, আমার সাথে কখনও তোমার সাক্ষাত করতে হবে না? বান্দা বলবে, হে প্রভু! তাই মনে করেছিলাম। তখন আল্লাহ বলবেন, তুমি যেরূপ আমাকে ভুলে রয়েছিলে, এখন আমিও তদ্রূপ তোমাকে ভুলে থাকব।

        হে দুর্ভাগা। এখন তুমি তোমার বিষয় চিন্তা কর, ফিরেশতাগণ তোমার দুটি বাহু ধরবে, তখন তুমি আল্লাহর সামনে দন্ডায়মান থাকবে। তখন তিনি তোমাকে জিজ্ঞেস করবেন, আমি কি তোমাকে যৌবন রূপ সম্পদ দান করিনি? তুমি তার কিরূপ সদ্ব্যবহার করেছ? আমি কি তোমাকে ধন-সম্পদ দেইনি? তুমি তা' কিভাবে নিঃশেষ করেছ? আমি কি তোমাকে দীর্ঘ জীবন দেইনি? তুমি তা' কিভাবে অতিবাহিত করেছ? তোমাকে যে সম্পদ দিয়েছি, তা' কোথায় কিভাবে ব্যয় করেছ। আমি কি তোমাকে জ্ঞান দান করে সম্মানিত করিনি? তুমি যা' জানতে, তা' জেনে তুমি কিভাবে কি আমল করেছ? হে দুর্ভাগা! তুমি সেদিনের এ অবস্থার কথা চিন্তা কর, ঐ দিন তোমার লজ্জা-শরম কোথায় রাখবে, অথচ আল্লাহতায়ালা একটি একটি করে তোমাকে প্রদত্ত তার নিয়ামতসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। তোমার সমস্ত পাপ ও অসৎ কার্যের কথা মনে জাগিয়ে দেবেন এবং সামনে উপস্থিত করবেন। যদি তুমি. তার একটিও অস্বীকার কর, সাথে সাথে তোমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দান করবে।

         বর্ণিত আছে, আমরা একদা হুযুরে পাক (দঃ)এর নিকট উপস্থিত হযরত আনাস (রাঃ) থেকে থাকাকালে তিনি মৃদু হাস্য করে বললেন, তোমরা কি জান আমি কি জন্য হাস্য করলাম? আমরা বললাম, আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল-ই তা' বলতে পারেন। তিনি বললেন, বান্দা তার প্রভুর নিকট যে উত্তর দেবে সেই কথা স্মরণ করে হাস্য করলাম। বান্দা বলবে, হে প্রভু! তুমি কি আমাকে আত্যাচার থেকে রক্ষা করনি? আল্লাহ বলবেন, হাঁ করেছি। তখন বান্দা বলবে, আমার সাক্ষ্য ব্যতীত যেন আমার উপর কোন দোষারোপ করা না হয়। তখন আল্লাহ বলবেন, অদ্য তোমার আত্মা এবং কিরামুন-কাতেবীন ফিরেশতাই তোমার কিরুদ্ধে সাক্ষ্যের জন্য যথেষ্ট। ঐ সময়ে বান্দার মুখকে বন্ধ করে দেয়া হবে এবং তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে বলা হবে, তোমরা কথা বল। তখন বান্দার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোই তার আমলসমূহের কথা প্রকাশ করবে। তারা যখন বান্দার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে শুরু করবে, তখন বান্দা নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে বলবে, তোমরা দূর হও। তোমাদের জন্যই তো আমি কত কষ্ট স্বীকার করেছি। আর এখন তোমরা আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছ।

         আমরা আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করি আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেন ঐরূপ আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য না দেয় এবং আমরা যেন ঐরূপ অপমানিত ও অপদস্থ না হই। আল্লাহতায়ালা অবশ্যই তাঁর মুমিন বান্দার সাথে ওয়াদা করেছেন যে, তিনি তার দোষ গোপন রাখবেন এবং অন্যের নিকট প্রকাশ করবেন না। 

        এক ব্যক্তি হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীযকে বললেন, গোপন কার্য বা গোপন কথাবার্তা সম্বন্ধে কি শুনেছেন? তিনি বললেন, হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন যে, তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি তার প্রভুর নিকটবর্তী হবে। এমন কি আল্লাহতায়ালা তাকে তাঁর অতি নিকটে বসিয়ে তার নিকট জিজ্ঞেস করবেন, তুমি কি এই ত্রুটি করেছ? সে বলবে, হাঁ, প্রভু! আমি এই ত্রুটি করেছি। তখন আল্লাহতায়ালা বলবেন, দুনিয়ায় আমি তোমার এই ত্রুটি গোপন রেখেছি, আজ আমি তোমার সে ত্রুটি ক্ষমা করে দিলাম। হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন মুমিনের দোষ-ত্রুটি গোপন করে রাখে, রোজ কিয়ামতে আল্লাহতায়ালা তার দোষ-ত্রুটি গোপন করে রাখবেন। অতএব মানুষের দোষ-ত্রুটি গোপন করে রাখা মুমিনদের কর্তব্য। এ হাদীস ঐ সব লোক পছন্দ করবে, যারা অন্যের দোষ-ত্রুটি সম্বন্ধে নিজেদের রসনা নাড়াচাড়া করে না এবং যারা অন্যের গীবত প্রচার করে না। এই প্রকার লোকগণ রোজ কিয়ামতে এই উপকার পাবে যে, রোজ কিয়ামতে তাদের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখা হবে। 

        রোজ কিয়ামতে বান্দার নিকট জিজ্ঞেস করা হবে, কিয়ামতের এই সিঙ্গার আওয়াজের কথা দুনিয়ায় তুমি কি একবারও মনে করনি? তোমার কেশগুচ্ছ ধরে টানা-হেঁচরা করে তোমাকে যে নিয়ে যাওয়া হবে, একথা কি তোমার মনে জেগে উঠেনি? তোমার জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পেয়ে যাবে, হৃদয় মধ্যে ভয়ঙ্কর কম্পন সৃষ্টি হবে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো থর থর করে কাঁপতে থাকবে, তোমার শরীরের বর্ণ পরিবর্তিত হবে, হাশরের ময়দান দান সম্পূর্ণতঃ র্ণরূপে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাবে, এসব কথা কি তোমার মোটেই স্মরণ হয়নি? এখন তুমি তোমার পার্থিব কাজগুলোর কথা স্মরণ কর। এখন তোমাকে মুখমণ্ডল অথবা গ্রীবাদেশের উপর হাঁটতে হবে। অশ্বপালের মধ্য থেকে একটি অশ্বকে যেভাবে পৃথক করে নেয়া হয়, তোমাকে তদ্রূপ জবরদস্তি করে ছিনিয়ে নেয়া হবে আর সবার দৃষ্টি তোমার উপর পতিত হবে। তোমাকে সেই সব ফিরেশতার হাতে সোপর্দ করা হবে, যাদেরকে তোমার জন্য ন্যস্ত করা হয়েছে। তারা তোমাকে প্রভু আল্লাহতায়ালার আসনের নিকটবর্তী করে দোযখের দিকে নিক্ষেপ করবে। তখন আল্লাহতায়ালা বলবেন, হে আদম সন্তান। আমার নিকট এস। তখন অত্যন্ত ভগ্ন মনে ও সন্ত্রস্ত অবস্থায় তুমি আল্লাহর নিকটবর্তী হবে। তখন তোমার হস্তে এমন আমলনামা দেয়া হবে, যার মধ্যে ক্ষুদ্র-বৃহৎ, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কোন, কাজই বাদ থাকবে না; সবই লিপিবদ্ধ থাকবে। কত অশ্লীল। কার্য তুমি ভুলে গেছ ঐ আমলনামা তা' তোমাকে স্মরণ করিয়ে দেবে। কত ইবাদাতে তুমি। গাফলতী করেছ, তার মন্দ তোমার নিকট প্রকাশ পেয়ে যাবে। এ সময় তোমার নিকট কত রকমের অন্যায় ও অপরাধমূলক কার্যের কথাও স্মরণে এসে যাবে। তুমি তখন আল্লাহর দরবারে কিভাবে যে দাঁড়াবে তা-ই ভেবে পাওয়া যায় না। তারপর যখন তোমার পাপরাশি তোমার সম্মুখে তুলে ধরা হবে, তখন সে লজ্জা তুমি কোথায় রাখবে। আল্লাহতায়ালা তখন বলবেন, হে বান্দা! তুমি কি আমার সামনে লজ্জিত হও না? তোমার সম্পূর্ণ অপরাধ ও দোষের কাজগুলো আমার নিকট পেশ করা হয়েছে। তুমি কি আমার সৃষ্টজীবকেও লজ্জা কর না? আমি তোমার পার্থিব জীবনে সদা-সর্বদা তোমার প্রতি দৃষ্টি রেখেছি, কিন্তু তুমিত মোটেই আমার প্রতি দৃষ্টিপাত করনি, বরং তোমার লক্ষ্য ছিল অন্যদিকে। আমি কি তোমাকে নানাবিধ নিয়ামত দান করিনি? তা' সত্ত্বেও কে তোমাকে আমার সম্বন্ধে প্রবঞ্চিত করেছে? তুমি কি এরূপ ভেবেছিলে যে, আমি তোমাকে দেখছি না এবং কখনও আমার সাথে তোমার সাক্ষাত হবে না?

         হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, এমন কোন বান্দা নেই যাকে আল্লাহ জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় তার নিকট কোন পর্দা অথবা দোভাষী মাধ্যম থাকবে। তিনি আরও বলেছেন, তোমাদের প্রত্যেক ব্যক্তিই আল্লাহর সম্মুখে দাঁড়াবে। তার এবং তার প্রভুর মধ্যে পর্দা থাকবে না। আল্লাহ তাঁর বান্দাকে লক্ষ্য করে বলবেন, আমি কি তোমাকে নিয়ামত দেইনি, আমি কি তোমাকে ধন- দৌলত দেইনি? বান্দা বলবে, হাঁ দিয়েছেন। আল্লাহ বলবেন, আমি কি তোমার নিকট রাসূল পাঠাইনি? বান্দা বলবে, হাঁ পাঠিয়েছেন। তখন বান্দা তার ডান পার্শ্বে ও বাম পার্শ্বে উভয় দিকেই দোযখ দেখতে পাবে। সেই দোযখ থেকে রক্ষা পাওয়া তার পক্ষে তখন দুষ্কর হয়ে পড়বে। সুতরাং সেদিনকার সেই ঘটনার কথা মনে করে তোমরা এখন অন্তত একটি খেজুর হলেও তা' দান করে, আর তা' না পারলেও অন্তত একটি মিষ্ট কথা বলে উক্ত দোযখ থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করতে থাক।

        হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেছেন, সেদিন সেই বিচারের ময়দানে প্রত্যেক বান্দাই আল্লাহর দৃষ্টি থেকে গোপন থাকার চেষ্টা করবে, কিন্তু তাদের সে চেষ্টা পূর্ণিমার রাত্রে চন্দ্র থেকে গোপন থাকার চেষ্টার নামান্তর। আল্লাহতায়ালা তাঁর এক এক বান্দাকে লক্ষ্য করে দলবেন, যে আমার যাদা। বল, তোমাকে কে আমার সম্বন্ধে প্রবঞ্চিত করেছে? যে বান্দা। তোমাকে যে সব কথা জানিয়ে দেয়া হয়েছে, সে সম্বন্ধে তুমি কি করে এসেছ? আমি কি তোমার বিকাজে সতর্ক দৃষ্টি রাখিনি। তুমি যখন কোন হারাম দ্রব্যের দিকে লালায়িত হিসে এবং তা' এহণ করেছিলে তা' কি আমি দেখিনি? এভাবে আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দাকে তার সমস্ত পার্থিব কাজ সম্পর্কে গুঙ্খানুপুঙ্খরূপে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বান্দাকে লা-জওয়াব করে দেখেন।

        হযরত মুজাহিদ (রহঃ) বলেছেন, রোজ কিয়ামতে আল্লাহর সম্মুখে এমন কোন বান্দা দত্তয়মান হবে না যে, চারটি বিষয় আল্লাহতায়ালা তাকে জিজ্ঞেস না করবেন। বিষয়গুলো হল, সে তার জীবনকে কিভাবে অতিবাহিত করেছে? সে তার বিদ্যা ও জ্ঞান-বুদ্ধি কি কাজে খাটিয়েছে? সে তার শরীরকে কি কাজে লাগিয়েছে? আর সে তার ধন-সম্পদকে কোন পথে ব্যয় করেছে? হে দুর্ভাগা। এই প্রশ্নের সময় যদি তোমার উত্তর যথাযোগ্য না হয়, তবে তোমার লজ্জা, অপমান এবং যে শাস্তি পেতে হবে তা' অকল্পনীয়। পক্ষান্তরে, যাদের উত্তর এক্ষেত্রে যথাযোগ্য হবে, তাদের কোন দোষ-ত্রুটি থাকলেও আল্লাহ তাদেরকে বলবেন, আমি দুনিয়ায় তোমাদের দোষ- ত্রুটি ঢেকে রেখেছিলাম, আজও তা' প্রকাশ না করে তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। তুমি চিন্তা করে দেখ, যদি তুমি তোমার কার্যাবলীর দ্বারা এদের দপ্তরে নাম লিপিবদ্ধ করাতে পার, তবে সেদিন তোমার কত সুখ ও আনন্দ হবে। লোকগণ তখন তোমার অবস্থা দেখে তোমাকে ঈর্ষা করবে। পক্ষান্তরে, হতভাগ্য লোকদের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা তাঁর ফিরেশতাদেরকে বলবেন, এদেরকে ধৃত করে শৃঙ্খলাবদ্ধ কর এবং দোযখে নিক্ষেপ কর। তুমি যদি এই শ্রেণীর লোকদের দপ্তরভুক্ত হও, আর তোমার দুরবস্থা দেখে আসমান-যমিনও তোমার জন্য রোদন করতে থাকে তা' তোমার জন্য কোন উপকারে আসবে না।

Post a Comment

0 Comments