আবদুল মুত্তালিব ও ওয়াহাব যুহরীর মধ্যে পূর্ব হতেই পরিচয় ছিল। এ পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে তাঁদের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্কের সূত্রপাত হয়। যদিও তাঁদের একজন মক্কা ও অন্যজন মদিনার অধিবাসী তবু তারা উভয়ে একই বংশীয় এবং পরস্পর বাল্যবন্ধু ছিলেন।
একবার ওয়াহাব মুহরী হজ্জ উপলক্ষে মক্কায় গিয়ে আবদুল মুত্তালিবের সঙ্গে সাক্ষাত করলেন এবং বহুদিন পরে দুই বন্ধুর সাক্ষাত হওয়ায় অনেক বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করলেন। ওয়াহাব যুহরীর মনে এক বিশেষ উদ্দেশ্যও ছিল। ডিনি তাঁর কন্যার বিবাহ কাজ এখনও পর্যন্ত সমাধান করতে পারেন নি। আবদুল মুত্তালিবের পুত্র কোরবানীর মানত এবং কোরবানী সম্পর্কিত সর্বশেষ ঘটনা সবই তিনি মদিনায় বসেই শুনেছিলেন। তাই তাঁর অন্তর মধ্যে একটি প্রচ্ছন্ন আকাংখাও বিদ্যমান ছিল। তবে তা সরাসরিভাবে প্রকাশ করতে কেন যেন তাঁর সঙ্কোচ হচ্ছিল। তাই তিনি সেরূপ কিছু না বলে প্রকারান্তরে নিজ কন্যা আমেনার কথা উপস্থাপন করলেন। তিনি বললেন, আমার একটি কন্যা বিবাহযোগ্য হয়েছে। তাঁকে এখন পাত্রস্থ করা দরকার। অথচ যোগ্য পাত্র পাওয়া যাচ্ছে না, এ যাবত যেসব প্রস্তাব এসেছে, এর কোনটিই তাঁর মনোমত হয় নেই। শুনে আবদুল মুত্তালিব বললেন, তবে তো ভালই তোমার কন্যাকে ন্য হয় আমার পুত্র আবদুল্লাহর কাছেই বিবাহ দাও ভাই। আমার কনিষ্ঠ পুত্র আবদুল্লাহর কথা হয়ত শুনে থাকবে। স্বভাব ও বুদ্ধিমত্তায় সে সবার প্রশংসনীয়। নিজের পুত্রের গুণ প্রকাশ করা ঠিক নয় বটে, তবু সত্য বলতে আপত্তি কিসের?
আমার পুত্র তোমার কন্যার জন্য উত্তম পাত্র হবে। ইচ্ছা হলে তুমি আমার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পার। আবদুল মুত্তালিবের এ বিবাহ প্রস্তাবটি ওয়াহাব যুহরীর কাছে কত যে খুশীর বিষয় ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা অসাধ্য ব্যাপার। তাঁর মনে হতে লাগল যে. নিশ্চয়ই এ স্থানে কন্যা আমেনার বিবাহ হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। বিশেষত আবদুল মুত্তালিবের মুখে যখন তিনি শুনলেন যে, তাঁর পুত্রটির নাম আবদুল্লাহ্, তখন তিনি সেই কথা স্মরণ করে আরও বেশি আশান্বিত হলেন যে, একদা কন্যা আমেনা বলেছিল, আব্বা। আমি যখন কোন নির্জন স্থানে যাই তখন অদৃশ্য হতে কে যেন আমাকে সম্বোধন করে বলে, 'হে আবদুল্লাহর সহধর্মিণী, হে রাসূল জননী। তুমি ছালাম গ্রহণ কর। আবদুল মুত্তালিবের এ ছেলেটির নামও আবদুল্লাহ্। মোটকথা ওয়াহাব যুহরীর নিকট প্রস্তাবটি সব দিক দিয়েই খুশী ও আনন্দের কারণ হয়েছিল। একে তো আবদুল মুত্তালিবই মক্কার কুরায়েশদের সরদার, আল্লাহর গৃহ খানায়ে কা'বার তত্ত্বাবধায়ক ও বিদেশাগত হজ্জ যাত্রীদের যত্ন ও নিরাপত্তা রক্ষাকারী। তদুপরি তিনি মক্কার সকল কুরায়েশদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অভিজাত এবং মর্যাদাশালী শাখা হাশেমী গোত্রের লোক। এদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারা মক্কা ও মদিনার যে কোন কুরায়েশ গোত্রের জন্য গৌরবের কথা। ওয়াহাব যুহরী আর কোনরূপ ইতস্তত বা দ্বিধা না করে আনন্দে আবদুল মুত্তালিবের প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। বিবাহের তারিখও তখন নির্ধারিত হল।
সে যুগে বিবাহের রীতি ছিল, পাত্র ও পাত্রীর জন্য দেশের শাসক কিংবা কওমের প্রধান সরদারের নিকট হতে বিবাহের অনুমতি গ্রহণ করতে হত। কিন্তু এক্ষেত্রে আবদুল্লাহ ও আমেনার সে রীতি মেনে চলার কোন প্রয়োজন হল না। কারণ আবদুল্লাহ ছিলেন আবদুল মুত্তালিবের পুত্র এবং তিনিই ছিলেন মক্কার শাসনকর্তা। আবদুল্লাহর বিবাহের প্রস্তাব তিনি দিয়েছিলেন এবং ওয়াহাব যুহরী সাথে সাথে তা গ্রহণও করেছিলেন। সুতরাং রাজা বা শাসকের অনুমতি তো এ দু' পক্ষের প্রস্তাব ও স্বীকৃতির মধ্য দিয়েই হয়ে গিয়েছিল। তার জন্য অন্য কোনরূপ কিছু করার দরকার ছিল না। অতঃপর নির্দিষ্ট তারিখে উভয় পক্ষের অভিভাবক ও আত্মীয়-স্বজন মহা ধুমধাম ও আনন্দের সাথে পাত্র-পাত্রী নিয়ে আল্লাহ্র গৃহ খানায়ে কা'বায় উপস্থিত হলেন এবং তৎকালের রীতি অনুসারে দেবতাদের সমক্ষে বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করলেন। এভাবে দেবতাদের সম্মুখে এসে বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করাকে তখন বরকতের নিদর্শন এবং দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবনে পাত্র-পাত্রীর সুখী হবার প্রধান উছিলা হিসেবে মনে করা হত। তবে, এ প্রথা কেবল ধনীদের দ্বারাই প্রতিপালিত হত, কারণ এতে ভোজানুষ্ঠান প্রভৃতি বাৰত বহু খরচের প্রয়োজন হত। এটা গুরিবদের পক্ষে সম্ভব হত না। সুতরাং তাদের মধ্যকার বিবাহ অনুষ্ঠানগুলো রাজার নিকট হতে অনুমতি সংগ্রহের পর পাত্র বা পাত্রীও গৃহে বসেই অনুষ্ঠিত হত। বিবাহে তখন মোহরানার বালাই ছিল না, কারণ তখনও পর্যন্ত আরব সমাজে নারীর অধিকার ও মর্যাদা স্বীকৃত হয় নি, তারা তখন পুরুষদের সেবিকা মাত্র ছিল। তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব অবশ্য পুরুষ, অথবা নারীদের প্রতি অসহায় ও অবলা হিসেবে তাদের প্রতি কৃপাসুলভ কিছুটা দরদ প্রদর্শনের মত। আসলে যে নারীদের মোহরানার অধিকার, মাতৃ-পিতৃ সম্পত্তির অধিকার বা স্বামীর নিকট খোরাক-পোশাকের তেমন বাধ্যতামূলক অধিকার এ সবের কোন কিছুই তখন ছিল না। স্বামী গৃহে আসার পরে নারী স্বামীর নিকট হতে নিয়মিত ভরণ-পোষণ পেত সত্য, কিন্তু তা স্বীয় অধিকারে নয়, শুধু সেবিকার কাজ সাধন করে তার বিনিময়ে তা লাভ করত। বিবাহ অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দকে আবদুল মুত্তালির মিছি খেজুর এবং সেরা পানীয়ের দ্বারা আপ্যায়িত করেছিলেন। বিশেষত ধনী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে এ নিয়মটি প্রায় বাধ্যতামূলক ছিল। তা ছাড়া গরিব ও সাধারণ পরিবারেও তা সাধ্যানুসারে প্রতিপালন করা হত।
আমেনা ও আবদুল্লাহ দম্পতি যুগলের মধ্যে উভয়ে ছিলেন গুণবান, গুণবতী, রূপবান-রূপবতী, বুদ্ধিমান-বুদ্ধিমতী। মোটকথা, দু'জনেই ছিলেন সর্বদিক দিয়ে উত্তম চরিত্র ও গুণের অধিকারী। সুতরাং একে অপরের গুণে মুগ্ধ এবং আকৃষ্ট ছিলেন পুরাপুরিভাবে। একজন আরেক জনকে বন্ধন করেছিলেন প্রীতি ও ভালবাসার রজ্জু দ্বারা। মোটকথা, তাদের উভয়ে মধুময় দাম্পত্য জীবন-যাপন করছিলেন। পরস্পর গভীর প্রেম-ভালবাসার মধ্য দিয়েই তারা সাধন করে যাচ্ছিলেন পারিবারিক কর্তব্যসমূহ। যুগের প্রভাব এবং প্রচলিত রীতি অনুসারে তখন আরবে গৃহবধূরা নানা সময়েই স্বামীর হাতে নিগৃহীত হত এবং পদে পদে তাকে শ্বশুর-শাশুড়ী ও দেবর-ভাসুর দ্বারা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হতে হত। কিন্তু কুরায়েশ গোত্রের বনু হাশেমী শাখায়ই এর বিপরীত অবস্থা ছিল। এদের কোন পরিবারে স্বামী তার স্ত্রীকে ঘৃণা বা অত্যাচার করত না এবং আত্মীয়গণও গৃহবধূর সাথে কোনরূপ দুর্ব্যবহারের প্রয়াস পেত না। গোত্রীয় সভ্যতার এই ধারা অনুসারেও সাইয়্যেদ আবদুল্লাহ্ স্ত্রী আমেনার সাথে অতি মধুর আচরণ। প্রদর্শন করতেন, বিনিময়ে তিনিও তাঁর পক্ষ হতে আন্তরিক প্রেম ও উত্তম আচরণ লাভ করতেন। এ দম্পতিযুগল দীর্ঘ পারিবারিক কিংবা দাম্পত্য জীবন যাপনে সক্ষম হন নি। তবে যতদিন তাঁরা একসাথে জীবন যাপন করেছিলেন, কোন দিনই তাদের মধ্যে সামান্য ঝগড়া বা কলহ দেখা যায় নি। সত্যি বলতে কি সে যুগের উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনে সুখী ও এরূপ শান্ত পারিবারিক জীবন যাপন অনভ্যস্ত ও অসুখী লোকেরাও আবদুল্লাহ ও আমেনার পারিবারিক সুখ অবলোকন করে হিংসায় জ্বলে উঠত আর বলত যে, সত্যই ওদের পরিবারটি সুখী পরিবারই বটে। বিবি আমেনা তাঁর অনুপম ব্যবহার দ্বারা শুধু স্বামীকেই যে খুশী করতেন তা নয়, বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ীকে তিনি স্বীয় পিতা-মাতার অনুরূপ ভক্তি-শ্রদ্ধা করতেন। তাঁরাও এ পুত্র বধূটিকে নিজেদের কন্যার মত স্নেহ ও আদর করতেন। শুনা যায়, আবদুল মুত্তালিব তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র আবদুল্লাহর স্ত্রী এ আমেনা বিবিকে এত ভাল জানতেন ও স্নেহ করতেন যে, তার নজীর এ বর্তমান যুগেও পাওয়া দুষ্কর। আরবে সে যুগে বিধবা বিবাহ প্রচলিত ছিল। বিবাহিতা যুবতী নারীর স্বামী অকালে মরে গেলে কিছুদিনের মধ্যেই সে নারী অন্য স্বামী গ্রহণ করত। কিন্তু বিবি আমেনার ক্ষেত্রে তার বিপরীত দেখা যায়।
তিনি স্বামী আবদুল্লাহকে এমনই অধিক ভালবাসতেন ও তাঁর প্রতি এত অধিক অনুরাক্ত ছিলেন যে, স্বামী আবদুল্লাহর পরলোক গমনকালে তিনি পরিপূর্ণ যুবতী ও অনুপম রূপলাবণ্য এবং দেহ সৌষ্ঠবের অধিকারিণী হওয়া সত্ত্বেও স্বামীর অবর্তমানে তিনি অন্য স্বামী গ্রহণ করার কল্পনা পর্যন্ত করেন নি। বিবি আমেনার আত্মীয়-স্বজন ও হিতাকাংখীগণ অনেকেই তাঁকে দ্বিতীয় বিবাহ করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে এ সব পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করে বৈধব্যকেই নিজের জন্য উত্তম বলে মেনে নিয়েছিলেন। অবশ্য সকলেরই জানা কথা যে, বিবি আমেনার এ বৈধব্য জীবন কম দীর্ঘ ছিল না, কিছু নারীর সমস্ত রূপ-রস রুচি ও বৃত্তিসমূহ নিজের মধ্যে রেখেই তিনি যেখানে যে কয়টি বছর সম্পূর্ণ নিষ্কলঙ্ক এবং পবিত্র জীবন যাপন করেছিলেন বিশেষত আরবের সে দুর্ধর্ষ পাশবিক আমলে তা জগতের ইতিহাসে চিরকালের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
0 Comments