পরনিন্দার প্রায়শ্চিত্ত কী

        পাঠক-পাঠিকা। জেনে রাখ, পরনিন্দারূপ পাপ থেকে মুক্তি লাভের দুটো উপায় আছে। একটি এই যে, নিন্দুক ব্যক্তি অনুতপ্ত হৃদয়ে তাওবাহ করবে এবং এ মন্দ কাজের জন্য দুঃখ প্রকাশ করবে। দ্বিতীয়টি এই যে, নিন্দুক ব্যক্তি নিন্দিত ব্যক্তির নিকট নিজের দীনতা ও হীনতা প্রকাশ করে তার নিকট থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করবে এবং সে তার এ কাজের জন্য অনুতাপ এবং দুঃখ প্রকাশ করে তার নিকট নিজের ওজরখাহী পেশ করবে। হযরত হাসান বছরী (রহঃ) বলেছেন, নিন্দিত ব্যক্তির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেই যথেষ্ট হবে। তার নিকট থেকে ক্ষমা গ্রহণ করার প্রয়োজন নেই। নিম্নোক্ত হাদীস দ্বারা তার প্রমাণ পাওয়া যায়। "হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, যাকে নিন্দা করা হয়েছে নিন্দুক ব্যক্তি তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেই নিন্দা করার কাফফারা হয়ে যায়।" হযরত মুজাহিদ (রাঃ) বলেছেন, তোমার ভ্রাতার পচামাংস ভক্ষণ করার কাফফারা তার প্রশংসা করা এবং তার মঙ্গলের জন্য দোয়া করা। হযরত আতা (রহঃ) কে পরনিন্দার তাওবাহ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, নিন্দিত ব্যক্তির নিকট গিয়ে তাকে বলবে, আমি যা' বলেছি তা' মিথ্যা বলেছি। আমি তোমার উপর অন্যায় করেছি এবং আমি অত্যন্ত মন্দ কার্য করেছি। এখন যদি তুমি ইচ্ছে কর তোমার হক গ্রহণ করতে পার। আর যদি ইচ্ছে কর আমাকে ক্ষমা কর। এটাই বিশুদ্ধ মত। জনৈক বুযর্গ বলেছেন, সম্মান নষ্টের কোন বিনিময় নেই। নিন্দিত ব্যক্তির নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা ওয়াজিব নয় যেরূপ ধন নষ্টের জন্য বিনিময়ে প্রার্থনা করা ওয়াজিব।

         হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, "যে ব্যক্তি তার মুসলমান ভ্রাতার সম্মান বা ধনের ক্ষতি করে, মহা বিচারের দিন হাজির হওয়ার পূর্বেই সে যেন তার নিকট থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করে নেয়। সেদিন তার থেকে তার পুণ্যসমূহ নিয়ে যাওয়া হবে। আর যদি কোন পুণ্য না থাকে তাহলে তার। প্রতিপক্ষের পাপ এনে তার নিজের পাপের সাথে সংযুক্ত করা হবে। হযরত আয়েশা (রাঃ) একদা জনৈকা রমণী সম্বন্ধে অন্যের নিকট বলেছিলেন, অমুক রমণীর আঁচল দীর্ঘ। তার একথা নিন্দারূপে গণ্য হয়েছিল এবং তিনি তজ্জন্য ঐ রমণীর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন। যদি সক্ষম হয় বা অবস্থা অনুকূল হয় তবে ক্ষমা প্রার্থনা ব্যতীত নিন্দাকারীর অব্যাহতি নেই। আর যদি নিন্দিত ব্যক্তি অনুপস্থিত থাকে বা তার মৃত্যু হয় তখন তার জন্য অধিক পরিমাণে ক্ষমা প্রার্থনা এবং দোয়া করা উচিত হবে।

        যদি কেউ প্রশ্ন করে যে, এরূপ ক্ষেত্রে নিন্দিত ব্যক্তির ক্ষমা করা কি ওয়াজিব? আমার মতে তা' ওয়াজিব নয়; বরং তা এহসান বা উপকারের নামান্তর। এহসান বা উপকার করা উত্তম বা মুস্তাহাব কিন্তু ওয়াজিব নয়। নিন্দিত ব্যক্তি থেকে ক্ষমা লাভের উপায় হল, নিন্দিত ব্যক্তিকে অধিক প্রশংসা করবে। তার প্রতি ভালবাসা, স্নেহভক্তি দেখাবে এবং তাকে খুশী করার চেস্টায় লেগে থাকবে যে পর্যন্ত তার মন সন্তুষ্ট না হয়। যদি তার মন কোন ক্রমেই সন্তুষ্ট না হয়, তবে তোমার ওজর আপত্তি, কাকুতি-মিনতি এবং তোমার ভালবাসা প্রদর্শনে ছওয়াব হবে এবং তা' তোমার পরনিন্দার পাপের সাথে রোজ কিয়ামতে মোকাবেলা করবে। পূর্ববর্তী কোন কোন বুষর্ণ ব্যক্তি পরনিন্দা ক্ষমা করতেন। সে আমাকে অত্যাচার করে আমি তাকে না। হযরত সাইদ ইবনে মুসাইয়্যিব। (রহঃ) বলেছেন, ক্ষমা করব না। হযরত ইবনে সীরীন (রহঃ) বলেছেন, আমি গীবত ক্ষমা করাকে হারাম মনে করি না, হালালও মনে করি না।। পরনিন্দাকে হারাম করেছেন। আল্লাহ যা' হারাম করেছেন, আমি তা' ক্ষমা করে কেন হালাল করব। 

        ১নং প্রশ্নঃ হুযুরে পাক (দঃ)এর এ বাণীর অর্থ কি যে নিন্দুকের ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত? অথচ আল্লাহ যা' হারাম করেছেন তা' ক্ষমা করা অসম্ভব। এ প্রশ্নের উত্তরে আমাদের কথা এই যে, তার উদ্দেশ্য ক্ষতি ক্ষমা করা। হারামকে হালাল করা নয়। হযরত ইবনে সীরীন (রহঃ) পরনিন্দা ক্ষমাকে উত্তম বলেছেন।

         ২নং প্রশ্নঃ হুযুরে পাক (দঃ) এর এ বাণীটির অর্থ কি যে তোমাদের মধ্যে কেউ আবু জমজমের ন্যায় হতে পার। যখন সে তার গৃহ থেকে বের হত সে বলত, হে আল্লাহ। আমি লোকগণকে আমার সম্মান দান করলাম। সে কিরূপে তার সম্মান দান করত? যে তা' দান করে তা' গ্রহণ করা হালাল। যদি তার দান গ্রহণ করা না যায় তাহলে তা' দান করতে কেন উৎসাহ দেয়া হয়েছে? 

        তার উত্তরে আমরা বলব যে, এর অর্থ আমি রোজ কিয়ামতে তার নিকট থেকে ক্ষতিপূরণ চাইব না। তার সাথে আমি বিবাদও করব না। এটা বললেও পরনিন্দা তার জন্য হালাল হয় না এবং তার নিকট থেকে ক্ষতিপূরণের দায়িত্ব যায় না। কেননা প্রথমেই ক্ষমা করার অর্থ তা' নয়; বরং এটা প্রতিজ্ঞা করার একটি রূপ। অর্থাৎ যদি কেউ আমার নিন্দা করে আমি রোজ কিয়ামতে তার সাথে বিবাদ করব না। যদি সে এই ওয়াদা থেকে ফিরে যায় এবং নিজের স্বত্ব দাবী করে তাহলে কিয়াস অনুযায়ী তা' অন্যান্য হকের ন্যায় হবে। অর্থাৎ সে তা' পাবে। ফকীহগণ পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, যে ব্যক্তি অপরাধকে লোকের জন্য হালাল করে দিয়েছে, তাদের নিকট থেকে তার স্বত্ব দূর হয় না। পরকালের ক্ষতিপূরণ দুনিয়ার ক্ষতিপূরণের ন্যায়। মোট কথা, ক্ষমা করাই উত্তম। হযরত হাসান বছরী (রহঃ) বলেছেন, যখন আল্লাহর দরবারে সমস্ত উম্মত রোজ কিয়ামতে উপস্থিত হবে তাদেরকে ঘোষণা করে বলা হবে, আল্লাহর নিকট যার পুরস্কার পাওনা আছে সে যেন দাঁড়িয়ে যায়। যারা দুনিয়ায় লোকদেরকে ক্ষমা করেছিল তারা ব্যতীত আর কেউই উঠবে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, "খুযিল আফওয়া ওয়া'মুর বিল মা'কফি ওয়া আ'রিদ্ব আনিল জাহিলীন" অর্থাৎ ক্ষমা গ্রহণ কর, সৎ কার্যে আদেশ দাও এবং মূর্খদের থেকে বিমুখ হও।

         হুযুরে পাক (দঃ) জিজ্ঞেস করলেন, হে জিব্রাইল। এ ক্ষমার অর্থ কি? তিনি বললেন, আল্লাহতায়ালা আদেশ দিচ্ছেন, যে তোমার সাথে অন্যায় করে তাকে ক্ষমা করে দাও, যে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করে তা' সংযোগ কর, যে তোমাকে বঞ্চিত করে তুমি তাকে দান কর। হযরত হাসান বছরী (রহঃ) বলেছেন, এক ব্যক্তি তাকে বলেছিল, অমুক ব্যক্তি আপনার নিন্দা করেছে। তখন তিনি তার নিকট এক খাঞ্চা খুরমা পাঠিয়ে দিয়ে বলে পাঠালেন, আমি শুনতে পেলাম, তুমি তোমার পুণ্য আমার জন্য উপঢৌকন পাঠিয়েছ। আমি তার বিনিময়ে তোমার জন্য এই যৎসামান্য খুরমা লোম। কিন্তু আমি তোমার উপঢৌকনের যথাযোগ্য বিনিময় পাঠাতে পারলাম না বলে তোমার নিকট আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।

  

Post a Comment

0 Comments