হাদীস: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম, এরশাদ করেছেন, রমযানের রোযার পরেই মুহররমের (দশ তারিখের) রোযা অন্যান্য সকল রোযার চেয়ে উত্তম (অর্থাৎ রমযানের রোযা ছাড়া আর সকল রোযার তুলনায় আশুরার রোযার অধিক সওয়াব)। (মুসলিম শরীফ)
হাদীস: হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আশুরার রোযা রাখে, সে ব্যক্তি ষাট বছর দিনে রোযা রাখার এবং রাতে এবাদত করার সওয়াব পায়। (তাবরানী)
হাদীস : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় গমন করে দেখতে পেলেন, সেখানকার ইহুদীগণ আশুরার রোযা পালন করে থাকে। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কেন এই দিনে রোযা রাখ? তারা উত্তর দিল ইহা একটি মহান দিন। এই দিনে আল্লাহ তায়ালা হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে এবং তার অনুসারিদেরকে ফেরাউন-গোষ্টির হাত হতে নাজাত দেন এবং ফেরাউন ও তার দলবলকে নীল নদীতে ডুবিয়ে ধ্বংস করেন। অতঃপর হযরত মূসা আল্লাইহিস সালাম আল্লাহর দরবারে শোকর আদায় করার উদ্দেশ্যে এই দিনে রোযা রাখেন। এ জন্যই আমরা এই দিনে রোযা পালন করে থাকি। তাদের উত্তর শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমরা তোমাদের তুলনায় হযরত মুসা আলাইহিস সালামের অধিকতর ঘনিষ্ট এবং তাঁর নীতি অনুসরণ করার দাবীও তোমাদের চেয়ে আমাদের বেশী। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে এই দিনে রোযা রাখলেন এবং অন্যান্যদেরকেও এই দিনে রোযা রাখার নির্দেশ দিলেন। (বুখারী ও মুসলিম)
হাদীস: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশুরার তারিখে নিজে রোযা রাখলেন এবং মুসলমানদেরকে রোযা রাখার নির্দেশ দিলেন। তখন সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! ইহা তো সেই দিন, যে দিনকে ইয়াহুদী ও নাছারাগণ মহান ও সম্মানিত মনে করে থাকে। (আমরাও কি তাদের অনুসরণ করব?) তদুত্তরে হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করলেন, যদি বেঁচে থাকি, তাহলে আমি আগামী বছর আশুরার পূর্বের (অর্থাৎ ৯ই মুহররম) তারিখে রোযা রাখব। তারা এই উপলক্ষে একদিন রোযা রাখে, আমরা দুইদিন রাখব। তা হলে আর তাদের অনুসরণ করা হবে না। (মুসলিম)
হাদীস : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা আশুরার রোযা রাখবে কিন্তু তাতে ইহুদীদের বিরোধিতা করবে। তা এ ভাবে যে, তোমরা একটি রোযা না রেখে তার আগে অথবা পরে আর একটি রোযা মিলিয়ে রাখবে। (আহমদ বাযযায)
হাদীস: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমি আল্লাহর দরবারে এ আশা পোষণ করি যে, আশুরার রোযা তার পূর্ববর্তী বছরের সকল (ছগীরা) গোনাহের কাফফারা স্বরূপ হবে, (অর্থাৎ এর বরকতে পূর্ববর্তী বছরের সমস্ত ছগীরা গোনাহ্ মাফ হয়ে যাবে)। (মুসলিম)
একমাত্র নাসাঈ শরীফ ব্যতীত হাদীসের প্রসিদ্ধ ছয় কিতাবের আর সব কয়টিতেই বর্ণিত আছে যে, রমযানের রোযা ফরজ হওয়ার পূর্বে আশুরার তারিখে রোযা রাখা ফরজ ছিল। পরে রমযানের রোযা ফরজ হয়। তারপর কেউ কেউ (নফল রোযা হিসেবে) আশুরার রোযা রাখল, আবার কেউ বা রোযা রাখল না।
হাদীসঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আশুরার তারিখে নিজের পরিবারবর্গের খাওয়া দাওয়ার খাতে অন্য সময়ের তুলনায় অধিক পয়সা ব্যয় করবে, আল্লাহ তায়ালা সারা বছর তাকে অধিক রিযিক দান করবেন। (মেরকাত, শরহে মেশকাত, রযীন, বায়হাকী)
হাদীস: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, আশুরার দিনে হযরত আদম আলাইহিস সালামের উপর এবং অন্যান্য নবীগণের উম্মতের উপর রোযা ফরজ ছিল। এই দিনে দুই হাজার পয়গাম্বর ভুমিষ্ট হয়েছিলেন এবং দুই হাজার পয়গাম্বরের দোআ আল্লাহর দরবারে কবুল হয়েছিল। (রযীন)
হাদীস শরীফে এরশাদ হচ্ছে-
উচ্চারণ: ক্বালা রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা লাও আনফাকা মু'মিনুন বিমালায়িল আরদ্বি যাহাবান মা আদরাকা ফাদ্বীলাতা ইয়াওমি আশূরাআ ফামান ছামা ফীহি ফুতিহাত লাহু ছামানিয়াতু আবওয়াবিল জান্নাতি ইয়াদখুলু মিন আইয়ি্যহা শাআ।
অর্থঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, কোন মুমিন ব্যক্তি যদি সারা জগত পরিমাণ স্বর্ণও আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে, তথাপি সে আশুরার দিনে ইবাদত করার সমান সওয়াব পাবে না। যে ব্যক্তি এই দিনে রোযা রাখে, তার জন্য বেহেশতের আটটি দরজা খুলে দেয়া হবে। যেকোন দরজা দিয়ে সে বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে (অর্থাৎ সে বেহেশত তো পাবেই তদুপরি তার মর্যাদা আরো উন্নত হবে)।
হাদীস: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় মদীনায় একবার বেলা এক প্রহর অতীত হওয়ার পর সে দিনটি মহররমের দশ তারিখ ছিল বলে সাক্ষ্য পাওয়া গেল অর্থাৎ তার নয়দিন পূর্বে মহররমের চাঁদ উদিত হয়েছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে প্রমাণ পাওয়া গেল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনার মুসলমানদের মধ্যে একথা ঘোষণা করিয়ে দিলেন যে, আজই আশুরার দিন। সুতরাং এই দিনটির সম্মানার্থে এখন হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাদের পানাহার হতে বিরত থাকতে হবে। (বায়হাকী)
একবার হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সংবাদ জানতে পেরে হযরত কাসির ইবনে সলীম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু মহররমের ১০ই তারিখে তাঁকে দেখতে গেলেন এবং সেখানে পৌছে দেখতে পেলেন যে, তিনি রোগশয্যায় থেকে কাঁদছেন। তিনি হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে তাঁর কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, ভাই আমি অসুস্থতার দরুন রোযা রাখতে পারলাম না, অথচ এই দিনটির ফযীলত সম্পর্কে হাদীস শরীফে এরশাদ হচ্ছে-
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ صَامَ يَوْمَعَاشُورًا ، لَمْ تَمَسَّهُ النَّارُ أَبَداً *
উচ্চারণ: জ্বালা রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা সান জামা ইয়াওমা আশুরাআ লামতামাসাহুন্নারু আবাদান।
অর্থঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আশুরার দিনে রোযা রাখে সে কখনও দোযখের আগুনে জ্বলবে না। আমি আমার এই দুর্ভাগ্যের জন্যই কাঁদছি। (মাজালেসুল আবরার)
হযরত শিবলী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের কলিজার টুকরা হযরত হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু মহররমের ১০ তারিখে কারবালায় শহীদ হন। এই মর্মান্তিক ঘটনা স্মরণ করে আহলে বাইতের অর্থাৎ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিবারবর্গের প্রতি ভালবাসার নিদর্শন স্বরূপ তাঁদের রূহের মাগফেরাত কামনা করে আমি আশুরার তারিখে আল্লাহর ওয়াস্তে দুই সালামে চার রাকআত নফল নামায আদায় করলাম। প্রতি রাকআতে সূরা ফাতিহার পর পনের বার সূরা এখলাস পড়লাম এবং নামাযের পর শহীদানে কারবালার নামে তার সওয়াব বখশো দিলাম। সেই রাতেই আমি হযরত হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে স্বপ্নে দেখলাম। তিনি আমাকে বললেন, হে শিবলী। যে সওয়াব তুমি আমাদের নামে বখশে দিয়েছ, আমরা তা পেয়েছি এবং নবী পরিবারের প্রতি তোমার ভালবাসার জন্য আমরা তোমাকে মোবারকবাদ দিতেছি এবং এ খোশখবর জানাচ্ছি যে, কেয়ামতের দিন তোমার মর্যাদা অধিকতর উন্নত হওয়ার জন্য আমরা আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করব। এতদসঙ্গে আরও একটি কথা তোমাকে বলে দিতেছি যে, যে কোন মুমিন ব্যক্তি আমাদের নামে কোনও ইবাদতের সওয়াব বখশায়ে দিবে, তার জন্যও আমরা আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করব। (দলীলুল আরেফীন)
আনীসুল ওয়ায়েযীন নামক কিতাবের প্রনেতা হযরত মাওলানা আবুবকর ইবনে মোহাম্মাদ আক্বারশী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও একীনের সাথে আশুরার দিন নিম্নলিখিত দোআ পাঠ করে, আল্লাহ তাআলা তার প্রতি রহমতের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন এবং তার নামে আযাব মুক্তির ফরমান জারী করেন। দো'আটি এইঃ
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহুল আলিয়্যুল আ'লা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু রাব্বুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ্বি ওয়ামা বাইনাহুমা ওয়ামা তাহ্তাছছারা। আল্লাহুম্মাজ আল্লা মিম্মান দাআকা ফাআজাবতাহু ওয়া আমানা বিকা ফাহাদাইতাহু ওয়া রাগিবা ইলাইকা ফাআতাইতাহু ওয়া তাওয়াক্কাল আলাইকা ফাআকফাইতাহু ওয়াকতারাবা মিনকা ফা আদনাইতাহু। আল্লাহুম্মাম্দুদ বি আইশী মাদ্দাও ওয়াজআললী ফী কুলুবিল মুমিনীনা বুদ্দা। আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআলুকাল ঈমানা বিকা ওয়ালফাযলা মিনাররিযকি ওয়া নাসআলুকাল আফিয়াতা ফিদ্দীনি ওয়াদ্দুনইয়া ওয়াল আখিরাহ ইয়া জালজালালি ওয়াল ইকরাম।
অর্থ: সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বমহান আল্লাহ তাআলা ছাড়া আর কেউ উপাস্য নেই। সারা জাহানের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ ব্যতীত আর কোন মাবুদ নেই। হে আল্লাহ! যে সব প্রার্থনাকারীর দোআ তুমি কবুল করেছ, যে সব প্রর্থনাকারীকে তুমি তোমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার ফলে সত্যের সন্ধান দিয়েছ, তোমার দিকে আকৃষ্ট হওয়ার ফলে যাদেরকে তুমি স্বীয় নেয়ামত দান করেছ এবং তোমার উপর ভরসা করার ফলে যাদেরকে তুমি প্রাচুর্য্য দান করেছ এবং তোমার নৈকট্য লাভ করতে চাওয়ায় যাদেরকে তুমি স্বীয় নৈকট্য দান করেছ, আমাকেও তাদের দলভুক্ত করে নাও। হে আল্লাহ! জীবিকা নির্বাহের ব্যাপারে তুমি আমাকে ব্যাপকভাবে সাহায্য কর এবং তোমার মুমিন বান্দাদের অন্তরে আমার প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি করে দাও। হে আল্লাহ! আমি তোমার দরবারে ঈমান, রিযিক এবং দ্বীন দুনিয়ার সর্বাঙ্গীন মঙ্গল প্রার্থনা করছি। হে মহামহিম পরওয়ারদিগার! আমার প্রার্থনা কবুল কর।
0 Comments