রসনা ব্যতীত অন্যান্য ভাবে পরনিন্দা

        পাঠক পাঠিকা। জেনে রাখ যে, শুধু রসনার দ্বারাই যে পরনিন্দা করা হয়, তা' নয়; বরং লোক অন্যান্য যে ভাবেই অপরের দোষ জানতে পারে, তাও পরনিন্দার অন্তর্ভুক্ত। ইশারা, ইঙ্গিত, অঙ্গভঙ্গী, লিখনী ইত্যাদি যে সব উপায় দ্বারা অন্যের প্রতি কু-ইঙ্গিত বুঝা যায় তাও পরনিন্দার সাদিল। সর্বপ্রকার সর্বনিন্দ্যই হারাম বা সিষিদ্ধ। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, একদা আমার নিকট একটি স্ত্রীলোক এসেছিল। সে চলে গেলে আমি আমার হস্ত দ্বারা হযরত রাসূলে পাক (দঃ)এর প্রতি ইশারা করলাম যে, স্ত্রীলোকটি বেঁটে। তখন হুযুরে পাক (সঃ) বললেন, তুমি তার নিন্দা করেছ। পরনিন্দার এরূপ আরও বহু দৃষ্টান্ত আছে। যেমন কোন খোঁড়াকে দেখিয়ে নিজে খোঁড়া হয়ে চললে তা' পরনিন্দ্য হবে বরং তা' কঠিন পরনিন্দা হবে। কেননা এটা অভিনয়ের বড় জপ এবং এর দ্বারা লোকদেরকে উত্তমরূপে বুঝান হয়। হুযুরে পাক (দঃ) এর নিকট একজন এরূপ স্ত্রীলোককে দেখান হলে তিনি বললেন, আমি এসব কাজ মোটেই পছন্দ করি না।

        লিখনী দ্বারাও এইভাবে পরনিন্দ্য করা যায়। কারণ কল্পনাও একটি রসনা স্বরূপ। কোন লিখক কোন নির্দিষ্ট লোকের দোষ সমালোচনা করলে এবং নিজের কিতাবে তার সেই দোষ নকল করে লিখলে তা' পরনিন্দা হবে। অবশ্য যদি তা' লিখার পিছনে কোন যুক্তিযুক্ত ওজর বা কারণ দর্শানো হয় তাহলে পরনিন্দা হবে না। কেউ যদি এরূপ বলে যে, একদল লোক এরূপ করেছে বা এঞ্জল বলেছে তাতে পরনিন্দা হয় না। জীবিত হোক বা মৃত হোক নির্দিষ্ট লোক সম্বন্ধে মন্দ বললে বা লিখলে পরনিন্দা হবে। তবে যদি তুমি বল যে, আমি অদ্য যার সাথে সাক্ষাত করেছিলাম বা আজ আমি যাকে দেখেছিলাম সে এরূপ, তাতে লোকগণ যদি বুঝতে পারে যে, অযুক ব্যক্তির কথা বলা হচ্ছে এবং সে লোকটির যদি মন্দ বলা হয় তাহলে পরনিন্দা হবে। মোট কথা, নিজে কোন নির্দিষ্ট লোকের কথা বললে বা যাদের নিকট বলা হয় তারা যদি নির্দিষ্ট লোকটিকে চিনে ফেলতে পারে তবে সে ক্ষেত্রে পরনিন্দা হবে। আর যদি যার কথা বলা হয় তাকে নির্দিষ্ট করা না হয় আর লোকগণও কার কথা বলা হচ্ছে তা' বুঝতে না পারে তবে সেক্ষেত্রে পরনিন্দা হবে না। হযুরে পাক (দঃ) এর কোন লোকের কোন কার্য অপছন্দ হলে তিনি বলতেন, ঐ সব লোকের কি অবস্থা হবে যারা এরূপ কাজ করে? তিনি লোককে নির্দিষ্ট করে বলতেন না। যদি তুমি এরূপ বল যে, যে ব্যক্তি সফর থেকে এসেছে সে এরূপ। তবে যদি তাকে লোকগণ চিনে ফেলতে পারে তবে তা' পরনিন্দা বা গীবত হবে।

         জঘন্য পরনিন্দাঃ যত প্রকার নিন্দা আছে তন্মধ্যে জঘন্যতম পরনিন্দা করে থাকে ঐ সব জালিয় যারা লোকের সামনে নিজেদের বিদ্য। জাহির করে এবং অন্যের নিন্দা করে। তারা যা' বলে লোকগণ যেন তা' নিন্দা রূপে বুঝতে না পারে তাদের ইচ্ছে এরূপ থাকে। এই শ্রেণীর প্রতার কারণে। আলিমগণ নিজেদের অম্লত্য ঋতে পারে না যে, এর দ্বারা তারা দু' রকমের দোষ করছে। একটি হল পরনিখ। এবং অন্যটি রিয়া। কোন লোকের কথা তাদের নিকট বলা হলে তারা বলে, সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর জন্য যিনি আমাদেরকে শাসনকর্তাদের নিকট যাওয় ওয়ার চাল চালনা করেন পরীক্ষায় লিপ্ত করেন নি এবং পুরস্কার অন্বেষণের অপমানের দিকে আমাদেরবে নি অথবা এঐ শ্রেণীর কোন আলিম বলে, আল্লাহর নিকট লজ্জা পাওয়া থেকে আশ্রয় চাই। উদ্দেশ্য অনে অন্যের দোষ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি। এসব কথা বলার উদ্দে পরনিন্দা ক করতে চায় প্রদর্শন করা এবং প্রার্থনার রূপে সেই দোষ প্রকাশ করা। তদ্রূপ যে ব্যক্তি পর সে তার প্রশংসার আকারে তা' করে এবং বলে আহা! অমুক ব্যক্তির অবস্থা কি সুন্দর। ইবাদাতে কোন খুঁত নেই। কিন্তু তিনি একটি বিপদের মধ্যে আছেন। যে বিপদে আমরা সবাই কিছু না কিছু জড়িত। তার ধৈর্যগুণ খুবই অল্প। এভাবে প্রথমে সে নিজের প্রতি দোষারোপ করে কিন্তু তদ্বারা তার উদ্দেশ্য অন্যকে দোষারোপ করা এবং ধার্মিক লোকদের সাথে নিজেকে তুলনা করে আত্মপ্রশংসা করা। এক্ষেত্রে একত্রে তিনটি দোষের সমন্বয় ঘটে যা' পরনিন্দ্য, রিয়া এবং নিজেকে পবিত্র মনে করা। সে মনে করে যে, সে ধার্মিক। কারো নিন্দার সাথে তার কোনও সম্পর্ক নেই। তজ্জন্য শয়তান মূর্খদের সাথে খেলা করে। কেননা বিদ্যা ব্যতীত তারা ইবাদাতে নিমগ্ন হয়। শয়তান তাদেরকে হাস্যম্পদ করে তোলে কিন্তু অজ্ঞতার কারণে তারা এ সংবাদ রাখে না।

        আর এক প্রকার পরনিন্দা এরূপ যে, কোন ব্যক্তি তার সম্মুখে কারও নিন্দা করতে প্রবৃত্ত হলে সে বলে সুবহানাল্লাহ! এটা কি আশ্চর্যের বিষয়। এর উদ্দেশ্য এবং ফল এই যে, লোকগণ তা' বিশেষ মনোযোগের সাথে শ্রবণ করে। কেউ কেউ এরূপ বলে যে, আমার বন্ধুর ক্ষেত্রে যখন এরূপ ঘটনা ঘটেছে তখন আমার দুঃখিত হওয়া একান্তই স্বাভাবিক। আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি তিনি যেন তার আত্মাকে শান্তি দান করেন। এরূপ সহানুভূতি প্রদর্শনে এবং দোয়া প্রকাশ করায় সে মিথ্যা কথা বলে থাকে। প্রকৃতপক্ষেই যদি সে তার জন্য দোয়াপ্রার্থী হয় তাহলে তার উচিত নামাযের পর নীরবে এবং নির্জনে তার জন্য দোয়া করা। যদি সে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে তবে সে যেন গোপনে তদ্রূপ দুঃখ প্রকাশ করে। সে বলে ঐ বেচারা ভয়ঙ্কর বিপদে পড়ে গেছে। আল্লাহ আমাদের ও তার তাওবাহ কবুল করুন। এসব কথার দ্বারা সে দোয়া প্রকাশ করে কিন্তু তার মনের অসৎ ভাব এবং গুপ্ত উদ্দেশ্য একমাত্র আল্লাহতায়ালাই জানেন।

         পরনিন্দা শ্রবণ করে আশ্চর্যান্বিত হওয়া আর এক প্রকার পরনিন্দা। কেননা আশ্চর্যান্বিত হলে নিন্দুকের আনন্দ বৃদ্ধি পায় এবং সে আরও অধিক নিন্দা করবার জন্য প্রস্তুত হয়। এক্ষেত্রে মনে করা যায় যে, ঐ ব্যক্তি আশ্চর্যান্বিত হয়ে প্রকারান্তরে নিন্দুকের নিকট থেকে আরও বেশী নিন্দামূলক কথা বের করে নিতে চায়। এক্ষেত্রে সে এরূপও বলে যে, এ পর্যন্ত আমি তাকে ত ভাল বলেই জানতাম। আসলেই আমি এ পর্যন্ত তার প্রতি অন্যরূপ ধারণা পোষণ করতাম। তার এ বিপদ থেকে আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন। এ জাতীয় দার অন্তর্ভুক্ত নিন্দুকের সমর্থন করাও পরনিন্দার বরং এসব কথাবার্তা কথাবা বাবার্তা শ্রবণ শুনে যে নীরব থাকে দেও নিন্দুকের সাথে শরীক হয়। হুযুরে পাক (দঃ) এরশাদ করেছেন, পরনিন্দা শ্রবণকারীও পর নিন্দুকের অন্তর্গত। হযরত আবুবকর ও হযরত ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, তাদের মধ্যে একজন অন্য জনের নিকট বলতেছিলেন, অমুক ব্যক্তি খুব বেশী নিদ্রা যায়। একথা বলার পর তারা উভয়েই হুযুরে পাক (দঃ) এর নিকট রুটি ভক্ষণের জন্য কিছু ব্যঞ্জন চাইলে তিনি বললেন, তোমরা উভয়েইত ব্যঞ্জন খেয়েছ। একথা শুনে তারা উভয়েই বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ। আমরা কখন ব্যঞ্জন খেলাম? তিনি বললেন, হাঁ তোমরা তোমাদের ভ্রাতার মাংস খেয়েছ। পাঠক-পাঠিকা! লক্ষ্য কর, হুযুরে পাক (দঃ) এরূপ দু'জন প্রধান ছাহাবীকে কিভাবে নিন্দার মধ্যে শরীক করলেন এবং যদিও বাঁ একজন বলেছিলেন আর অন্য জন তা' শুনেছিলেন। কিন্তু যিনি শুনেছিলেন তিনিও রক্ষা পেলেন না। আর একদিনের ঘটনা একজন লোক আর একজনকে বলেছিলেন, অমুক লোকটিকে ব্যভিচারের অপরাধে কুকুরের ন্যায় প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা হয়েছে। একথার জন্য তিনি তাদের দু' জনকেই বলেছিলেন, তোমরা এই মৃত দেহের পচা মাংস ভক্ষণ কর। বর্ণনাকারী ও শ্রোতা দু'জনকেই তিনি এখানেও সমান দোষী রূপে সাব্যস্ত করেছিলেন। সুতরাং পরিষ্কাররূপে বুঝা যাচ্ছে যে শ্রবণকারীও পরনিন্দার পাপ থেকে মুক্ত নয়। তবে যদি শ্রবণকারী তার রসনার দ্বারা নিন্দাকারীর কথার প্রতিবাদ করে তাহলে শ্রবণকারী দোষী হবে না। যদি সে মুখে প্রতিবাদ করতে না পারে তবে সে অন্তর দ্বারা এর প্রতিবাদ করবে এবং নিন্দুকের প্রতি নাখোশ থাকবে। যদি তা' না করে তবে সে দোষী হবে। যদি কেউ নিন্দাকারীর কথা শুনে মুখে নিন্দাকারীকে বলে যে, চুপ থাক কিন্তু তার অন্তর ঐ নিন্দা শুনবার জন্য প্রত্যাশী থাকে তবে তার জন্য এটা মুনাফিকী হবে অর্থাৎ যে পর্যন্ত তার অন্তরের এ অবস্থা দূরীভূত না করে সে পর্যন্ত সে গুনাহগার হতে থাকবে। হস্ত, চক্ষু বা কপাল দ্বারা নিন্দুককে নীরব থাকবার জন্য ইঙ্গিত করলেই তা' যথেষ্ট হবে না; বরং কাজটি গুরুতর বলে তাকে প্রকাশ্যভাবে সতর্ক করে দিতে হবে।

         হুযুরে পাক (দঃ) বলেছেন, কোন মু'মিন যদি কারও সামনে অপমানিত হয় এবং তাকে সাহায্য করার শক্তি থাকা সত্ত্বেও সে তাকে সাহায্য না করে, মহা বিচারের দিন আল্লাহতায়ালা তাকে সমস্ত সৃষ্টজীবের সামনে অপমান করবেন। তিনি আরও বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের সম্মান তার অসাক্ষাতে রক্ষা করে, রোজ কিয়ামতে তার সম্মান রক্ষা করা আল্লাহর উপর কর্তব্য হয়ে পড়ে। তিনি আরও বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন মুসলমান ভ্রাতার অসাক্ষাতে তার সম্মান রক্ষা করে, তাকে দোযখের অগ্নি থেকে রক্ষা করা আল্লাহর কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। কোন মুসলমানকে পরনিন্দা থেকে রক্ষা করার জন্য সাহায্য করার কল্যাণ অনেক।

Post a Comment

0 Comments